অনুবাদ গল্প: আত্মীয়ের দাবি

অনুবাদ গল্প: আত্মীয়ের দাবি

আত্মীয়ের দাবি

মূল লেখক: জেরাল্ডাইন
সেমোর

অনুবাদ: লুনা রাহনুমা

আমার মা। এতিমখানায় একমাত্র সন্তানের একমাত্র সন্তান। তার নীলরঙের জিন্স প্যান্টটি বহুবার ধুয়ে ধুয়ে ছাইবর্ণের হয়ে গেছে এখন। উস্কোখুস্কো চুল। বাদামি চোখের মনিতে ফ্যাকাশে পর্দা পড়েছে।

আমার মা সোজা হয়ে দাঁড়ান। রাস্তার পাশে নিজের দুই পা সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকেন। শৈশবে মা নিজের পায়ের সাথে একটি ছোট্ট চটের ব্যাগ বেঁধে রাখতো। আরেকটু বড় হবার পর, সেখানে ছিল একটি ছোট্ট শিশু।

আমাদের ছেলেবেলার সেই ভাঙা ভাঙা ভ্রমণ স্মৃতিগুলো পুরোনো গাড়ির ধোঁয়ার গন্ধের সাথে মিশে আছে। তামাক, ঘাম, রোদে পোড়া ভিনাইল এবং পেট্রোল।

চটের ব্যাগটি আর আমি একসাথে গাড়ির তালে তালে পিছন সিটের এপাশ থেকে ওপাশের দিকে গড়াগড়ি করতাম। নতুন একটা মানচিত্র উন্মুক্ত হবে। আমরা আরেকটি নতুন স্থানে যাচ্ছি। গাড়ির ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে বলত, দেখুন, আমি আপনাকে আর সামনে নিয়ে যেতে পারবো না। এবার নামুন।

আমাদের ভ্রমণগুলো চলতো দিনের পর দিন ধরে। এক গাড়ির ইঞ্জিনের গন্ধ থেকে অন্য গাড়ির ইঞ্জিনের গন্ধে চলতে থাকতো আমাদের একঘেয়ে সেই ভ্রমণ। মাঝেমধ্যে ভ্রমণ-বিরতি পেতাম, কোথাও অপেক্ষা করার সময়। কিছু রাস্তার পাশে সাদা রঙের মোটা দাগ কাটা থাকতো, অপেক্ষাকারীদের জন্য। “আমাকে ছাড়া এই দাগ কক্ষনো পেরুবে না, বুঝেছো বাচ্চা মেয়ে?”

রাস্তা জুড়ে বালি কাঁকর আর কঙ্কর বিছানো থাকতো। আমার শৈশবে টিকে থাকার সেই দিনগুলোর কোন ছবি তোলা নেই। কিন্তু নিজের মনে আমি কল্পনা করলে দেখতে পাই, পা মোটা একটি বাচ্চা মেয়ে নোংরার পাশে বসে ময়লা দিয়ে খেলছে। নখের ভেতর কালো বালি ঢুকে যাওয়া আঙ্গুলগুলো দিয়ে সে রাস্তার পাশে ইটের টুকরো জমাচ্ছে একের পর এক।

আমরা একবার ঘুরে যাওয়া স্থানে দ্বিতীবার যেতাম না কখনো।

আমার মায়ের এক থেকে দুই সপ্তাহ লাগতো নতুন আত্মীয়ের নতুন ঠিকানা খুঁজে পেতে। ঠিকানা ধরে আমরা আবার ছুটতাম সেই নতুন আত্মীয়ের খোঁজে। আরেক শহরে। নতুন আত্মীয়তার দাবি নিয়ে।

আমাদের সামনে তখন কড়া নাড়ার জন্য আরেকটি নতুন দরজা। নতুন মুখ, যদিও সেই পুরোনো অভিব্যক্তি তাদের মুখে: অবাক চোখ, বিভ্রান্তি, সন্দেহ। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমাদেরকে একগ্লাস জল দিয়েছে দয়া করে। কেউ কেউ হয়তোবা দিয়েছিলো একটা স্যান্ডউইচ খেতে। আমার মা বলতো, আমি সাথে থাকায়, আমার জন্য একটা অভিভাবক আত্মীয় খুঁজতে মায়ের খুব উপকার হয়েছে। লোকজন মাকে সহানুভূতির চোখে দেখেছে সাথে ছোট একটা বাচ্চা ছিল বলে।

মায়ের সাথে এই দীর্ঘ ভ্রমণগুলিতে আমরা যাদের সাথে দেখা করেছি, তাদের কারো নাম আমার মনে নেই। আমার মা যে আত্মীয়তার সূত্র ধরে পরিবার নামক বৃক্ষের লতা পাতার সন্ধান করে যাচ্ছিলেন, সেই বৃক্ষের মূল শাখা প্রশাখার ছবি বা সূত্র তিনি কোথাও এঁকে রাখেননি আমার জন্য।

আমি তখনই জানতাম, এখন যেমন জানি, কিছু আত্মীয়রা আসলে কিছুতেই চিহ্নিত হতে চায় না। সামনে আসতে রাজি হয় না। কখনই।

এরপর একদিন, রাস্তার পাশে সাদা রঙের মোটা দাগের ওপাশে, এলো অগাস্টের একটি বিষন্ন দিন।

আমার কানে ভাসে মায়ের কণ্ঠস্বর, বাচ্চা মেয়ে, আমাকে ছাড়া কখনও এই লাইনটি অতিক্রম করবেন না। একটি বড় পুরানো সাদা গাড়ী আমাদের সামনে এসে থামলো। গাড়িটি বাদামী ধুলায় আবৃত ছিল। মা বলেছিলো, সোনা, তুমি এখানে একটু অপেক্ষা করো। বলেই আমার মা দৌড়ে সাদা গাড়িটির কাছে গেলো, ঠিক যেভাবে সে দৌড়ে দৌড়ে যেত অন্যসব গাড়ির কাছে। ড্রাইভার গাড়ির পেছনের দরজা খুলে ধরলো এবং আমার মা গাড়ির ভেতর ঢুকে গেলো। পেছন ফিরে মা একবার আমাকে দেখেছিলো। তারপর নদীতে ঝাঁপ দেয়ার মতো করে মা গাড়ির সামনের সিটের দিকে দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি দেখতে পাই, আমার মা সাদা গাড়িটির ভেতর তার পা দুটি সোজা করে ভয়ঙ্করভাবে লাথি মারছে ক্রমাগত।

তক্ষুনি গাড়িটি চলতে শুরু করে। গাড়ির চাকাগুলি একটি বীভৎস আর্তনাদ করে চারপাশে অসংখ্য নুড়ি বালি ছিটিয়ে দিয়ে সামনে ছুটতে থাকে। গাড়ির পেছন দরজা খোলা আর আমার মায়ের পা দুটি ঝুলছে।

আমার অভিভাবকত্ব দাবি করতে এখনো কোন আত্মীয় আসেনি। আমি মোটা সাদা লাইনের পিছনে বসে অপেক্ষা করছি।