সিদ্ধার্থ সিংহের কবিতা

সিদ্ধার্থ সিংহের কবিতা

হাইট

লোকটার নাম শুনেছিলাম।
সবাই বলতেন, লোকটার হাইট সাত ফুট তিন ইঞ্চি
ইয়া ছাতি
লম্বা লম্বা হাত।
আমি বিশ্বাস করতাম না।

দূর থেকে যে দিন দেখলাম
বুঝলাম, কেউ মিথ্যে বলেননি।
সাত ফুট তিন কী?
ঠিকঠাক মাপলে, দু’-চার ইঞ্চি বেশিই হবে।

এর ক’দিন পরেই
লোকটার সঙ্গে আমার আলাপ হল,
ভাল করে চিনলাম।
একদিন ফিতে দিয়ে মাপতে গিয়ে দেখি
তাঁর হাইট মাত্র পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি।
পাঁচ ফুট চার!
হিসেবে কোনও গণ্ডগোল হচ্ছে না তো!
পরের দিন মাপতে গিয়ে দেখি
তিন ফুট সাত,
তার পরের দিন
কোনও রকমে টেনে-টুনে দু’ফুট।
দু’ফুট! এর পরের দিন মাপতে গেলে
হয়তো আরও কমে যাবে…
আমি ছিটকে চলে এলাম।
মানুষকে আর কত ছোট হতে দেখব!
কত!

জানালা

ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না।

একটা জানালা দিয়ে ছেলে যাতে উড়ে যেতে পারে
রামধনুর রং মাখতে পারে সারা গায়ে
মেঘের ভেলায় চেপে ভেসে যেতে পারে যেখানে খুশি,
আর অন্য জানালা দিয়ে পা টিপে টিপে এসে
যাতে শুয়ে পড়তে পারে বিছানায়।

ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানিও।

একটা জানালা দিয়ে এসে
ছেলেকে যাতে বকাঝকা করতে পারো
কষাতে পারো দু’-একটা চড়চাপড়,
আর অন্য জানালা দিয়ে এসে
ঘুমন্ত ছেলের কপালে যাতে চুমু খেতে পারো।

ঘর বানাচ্ছ, বানাও
মনে করে দুটো জানালা বানাতে ভুলো না
আর হ্যাঁ, সেই জানালায় যেন গরাদের কোনও
ছায়া না থাকে…

চাহনি

আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে
হঠাৎই চুক চুক করে শব্দ করব
কথার ফাঁকে বলব, উমমমমম্… আঃ
সে রকম প্রশ্রয় পেলে বলতেও পারি—
একবার দেবেন?
আর… আর… আর…

মুখোমুখি কোনও রেস্তোরাঁয় বসলেই
আপনার চোখ দেখব
ঠোঁট দেখব
গলা দেখব
আর.. আর… আর…

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে
আচমকা আপনার হাত ছোঁব
মাথায় ছাতা ধরার অজুহাতে
মাঝে মাঝে ছোঁব পিঠ-কাঁধ
অটোর লাইনে দাঁড়াব
সামনে নয়, আপনার পিছনেই
আর… আর… আর…

এ সব করব, করবই
শুধু আপনার ওই চপল তির্যক চাহনি
আরও একবার
আরও একবার
আরও একবার দেখার জন্য…

আর এক হরিশ্চন্দ্র

আগেই ঘোষণা করেছিলেন
ফের জিতলেই স্থাবর-অস্থাবর যা আছে
তিনি সব বিলিয়ে দেবেন।
দিন-ক্ষণ সব ঠিক
সমস্ত মিডিয়া হাজির
আলোকচিত্রীরা তাক করে আছেন ক্যামেরা
প্রাসাদের বাইরে হাজার-হাজার লোক।

যে লোকটা একদম শূন্য থেকে
আজ এতগুলো শূন্যের আগে একটা ৯ বসিয়েছেন
তিনি তা কী ভাবে বিলিয়ে দেন, তা দেখার জন্য।
আগেই ঘোষণা করেছিলেন
এ বার জিতলেই তিনি সব বিলিয়ে দেবেন।
সব নয়, যদি তার সামান্য কয়েক শতাংশও বিলোন
তা হলেও, এ দেশের সব ক’টা গণ্ডগ্রামে
গভীর নলকূপ বসানো যাবে
অন্তত পঞ্চাশ হাজার স্কুলবাড়ি পাকা হবে
সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না
অনেক ব্যাপারেই।

ওঁর বাড়ির সামনে হাজার-হাজার উৎসুক লোক
ক্যামেরায় ক্যামেরায় ঠোকাঠুকি
এই তিনি দরজা খুললেন বলে…

সে দিন ভিড়ের চাপে অনেকেই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন
পরে জেনেছিলেন, সে দিন তিনি সব উজাড় করে দিয়েছেন
বাড়িঘরদোর থেকে ঘরের আসবাব
এমনকী নীলাখচিত আংটি, মানিব্যাগের খুচরো পয়সাও
সব, সব হরির লুঠের মতো তিনি বিলিয়েছেন
বিলিয়েছেন অন্দরমহলে
আর সেগুলো টপাটপ কুড়িয়ে নিয়েছেন তাঁর বউ
ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি।

সে দিন সমস্ত মিডিয়ার সামনে তিনি আবার কথা দিয়েছেন
এর থেকেও অনেক অনেক বেশি আবার তিনি বিলোবেন
তবে আজ নয়, ঠিক পাঁচ বছর পরে।

লোকগুলোকে দেখছি

এক দঙ্গল লোক মসজিদ গুঁড়িয়ে দিচ্ছে
এক দঙ্গল লোক দেবতার মণিমাণিক্য লুঠ করছে
এক দঙ্গল লোক ট্রামে-বাসে আগুন ধরাচ্ছে
এক দঙ্গল লোক জোর করে দোকানের শাটার নামিয়ে দিচ্ছে
এক দঙ্গল লোক ধোঁয়া, অন্ধকার আর বারুদে ঢেকে দিচ্ছে চার পাশ।
কেউ বলতেই পারে, তাতে আপনার কি?

তবু, আমি ওই লোকগুলোকে দেখছি
দেখছি, লোকগুলোর সব আছে
হাত আছে
পা আছে
বুক আছে
পেট আছে
পিঠও আছে।
আছে বউ
বাচ্চা
ঘর-সংসারও।
দেখছি, ওদের সব আছে।
সব।
শুধু মাথা নেই।

কী করে বলি

হাইকম্যান্ডকে কী করে বলি!

ও রকম দু’-চারটে খুন সবাই করতে পারে
কিন্তু এক কোপে কারও মাথা নামিয়ে
সেই মুণ্ডু নিয়ে কখনও কি ফুটবল খেলেছেন প্রকাশ্য রাস্তায়?
তবে?

ও রকম দশ-বিশটা ধর্ষণ সবাই করতে পারে
কিন্তু আপনার নাম শুনলেই
মুহূর্তে ফাঁকা হয়ে যাবে মেয়েদের স্কুল, পাপড়ি গুটিয়ে নেবে ফুল
সে রকম বিভীষিকা কি ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন চারিদিকে?
তবে?

আপনাকে আসতে দেখলে
আশপাশের বাজার, চৌরাস্তার মোড়
কিংবা অফিসপাড়া
খরগোশ হয়ে যেতেই পারে
কিন্তু ওদের ভিতরের বাঘটাও যে মাথা নুইয়ে কোণে গিয়ে লুকোবে
সে রকম কুচকুচে কালো মেঘে কি ঢেকে দিতে পেরেছেন গোটা আকাশ?
তবে?

হাইকম্যান্ডকে আমি কী করে বলি
এ বার অন্তত ভোটে দাঁড়ানোর জন্য আপনাকে একটা টিকিট দিক!

অপারগ

বন্যায় সব ভেসে গেছে
ক’টা জামাপ্যান্ট ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি…
ত্রাণের লাইনে দাঁড়িয়ে কথাটা বলেছিল সে।

হঠাৎ করে ঘরে আগুন লেগে গেলে
কিংবা আচমকা ভূমিকম্প হলে
মানুষ কী নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে! কী নিয়ে!

ও রকম কোনও দিন যদি আমার জীবনে আসে
তা হলে কী কী নেব? কী কী?
তার একটা তালিকা তৈরি করে রেখেছিলাম আমি।

সেই তালিকার প্রথমেই ছিল
আমার কবিতার খাতা,
দ্বিতীয় স্থানে ছিল
আমার পোষা বেড়ালছানা,
আর তৃতীয় স্থানে
ছেলেবেলায় পাওয়া আমার প্রথম প্রেমপত্র।
চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তমে আর কী কী ছিল
এখন আর মনে নেই।

যে দিন সত্যি সত্যিই ওই ভাবে আমাকে বেরিয়ে আসতে হল
সে দিন কিচ্ছু নিতে পারলাম না
না সেই প্রেমপত্র, না সেই ছোট্ট বেড়ালছানা
না সেই কবিতার খাতা
কিচ্ছু না। কিচ্ছু না। কিচ্ছু না।

এমনকী, নিজেকেও সঙ্গে করে আনতে পারলাম না।

মাঝখানে

মাঝখানে বাবি থাক, তুমি দেয়ালের দিকে
পড়লে না হয় আমিও পড়ব
খাটের পায়ে তো মাত্র ওই ক’টা ইট
সব ইটই তো মাথা তুলেছে আমাদের মাঝখানে।

কত দিন হয়ে গেল মুঠোতে বকুল এনে
বলি না আর— গন্ধ শুঁকে দ্যাখো
গলির বাঁকে মিলিয়ে যাওয়ার আগে দেখি
তুমিও দাঁড়িয়ে নেই আগের মতো…

মাঝখানে বাবি থাক, তুমি দেয়ালের দিকে

যত দিন না বাবিকে রং-তুলি দিয়ে বসিয়ে
পাশের ঘরে যাব
চুপিচুপি, তুমি আমি।

বিয়েবাড়ি

বিয়েবাড়িটা মাতিয়ে রেখেছিল সে।
ভীষণ ছটফটে, মিশুকে
কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে নিলাম তার বাড়ি, স্কুল
গানের স্কুল, এমনকী কোথায় টিউশনি নেয়, তাও।

ক্লাস নাইনে পড়ে
দল বেঁধে বেঁধে সব মেয়েরা চলে যাচ্ছে, সে কোথায়!
উলটো ফুটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম
বন্ধ হয়ে গেল স্কুলের ফটক।
আধ ঘণ্টা আগেই বাণীচক্রের সামনে আমি হাজির
রবিবার ওর গানের ক্লাস
কিন্তু তিনটে তো বেজে গেছে
তবে কি ওর কোনও অসুখ-বিসুখ হল!
যেখানে ও টিউশনি নেয়
সেই গলির মুখে ঘোরাঘুরি করলাম ক’টা দিন
এত অন্ধকার কিচ্ছু দেখা গেল না।
ওর হাতে তো একটা মোবাইল ছিল!
ওহোঃ, কেন যে নম্বরটা নিলাম না
না-হয় একটু হ্যাংলাই ভাবত!

ক’দিন পরে আবার একটা বিয়ে
এবং সেখানেও যথারীতি সে।
প্রথমেই বললাম, আগে আপনার নম্বরটা দিন তো…
উত্তাল ঢেউ শান্ত হয়ে গেল। মৃদুস্বরে বলল—
বিয়েবাড়ি ছাড়া আপনি বুঝি আমাকে চিনতে পারেন না, না?