প্রবন্ধঃ দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ

দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ
সৌম্য ঘোষ
সৌন্দর্যের ভেতর দিয়ে সত্যের ও প্রেমের সাধনাই রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যসাহিত্যের ইতিহাস। এই দর্শন বেদান্তের সেই মূল মন্ত্র : “একং সদ্বিপ্রা বহুদা বদন্তি” এই তত্ত্বের মর্মবাণী। অর্থাৎ পৃথিবীর সব বস্তুই একই বস্তুর বিকাশমাত্র। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন থেকে বেদ-উপনিষদের মূল তত্ত্বের পরিচয় লাভ করেছিলেন। কিন্তু মায়াবাদী দার্শনিক কিংবা সন্ন্যাসীর মতো সবই শেষ পরিণতিতে ঈশ্বরে বিলুপ্ত হবে বলে ঈশ্বরের বিশ্বসৃষ্টিকে ‘স্বপ্নজগৎ কিংবা মায়ার আবরণ’ বলে ভ্রম করেননি কবি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে, শত উপলব্ধির প্রত্যক্ষ অনুভূতিতে জীবনসমুদ্ররূপ রূপনারাণের কূলে জেগে উঠে তিনি অনুভব করেছেন, এ জগৎ স্বপ্ন নয়, পরম বাস্তব। এই পরম বাস্তবের আয়নায় দেখেছেন নিজ রক্তের অক্ষরে আপনার বাস্তব রূপ। এই সুখ-দুঃখময় বিচিত্র শোভাসম্পদের আধার পৃথিবী ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কবির কাছে পরম রমনীয় বলে মনে হয়েছে তাই। পৃথিবীর রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ নিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছেন কবি। তাকে ভালোবেসেছেন প্রেমমুগ্ধ অন্তরের সর্বানুভূতি দিয়ে।
বিশ্বের সেই অন্তর্নিহিত শক্তি, যাঁর থেকে এই রূপময় পৃথিবী এবং সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, সেই অন্তর্নিহিত শক্তিই হলো সমস্ত সৃষ্টির মূল সত্য। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে এই আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব।
রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক অনুসন্ধান তাঁর রচনার একটি বিশেষ অংশজুড়ে। এই দার্শনিক আলোচনা তাঁর প্রবন্ধাবলীর একটি মূল আলোচ্য বিষয়। তাঁর ধর্ম শীর্ষক প্রবন্ধসমূহ এবং শান্তিনিকেতন শীর্ষক প্রবন্ধগুলির প্রধান প্রেরণা দার্শনিক আলোচনা। এছাড়া বিক্ষিপ্ত আকারে সাহিত্য শীর্ষক প্রবন্ধে, পত্রালাপে এবং ছোট ছোট রচনায় দার্শনিক তত্ত্ব মূলস্থান দখল করে আছে। মানুষের ধর্ম শীর্ষক তাঁর ‘হিবার্ট বক্তৃতা’ একটি অমূল্য দার্শনিক রচনা। এই বক্তৃতামালায় তাঁর, সমগ্র দর্শনকে একত্রিত করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর কাব্য রচনায় অনেকাংশ দার্শনিক তত্ত্বকণিকা বুকে ধারণ করে আছে। দার্শনিক তত্ত্বই তাদের আধার।
রবীন্দ্ররচনা বিচিত্র ও বিপুল। রবীন্দ্রনাথের ভাষার মাধুর্য কল্পনার অভিনবত্ব, ভাবের গভীরতা, রসের প্রাণদর্শিতা বিস্ময়কর। ভিক্টর হুগো বলেছেন, ‘প্রতিভা ঈশ্বরের আত্মস্বরূপের বহিঃপ্রকাশ।’ বেদে ব্রহ্মকেও আত্মদা বলা হয়েছে। এ অপ্রেমেয় প্রতিভার আবির্ভাব মানুষের ইতিহাসে এক চিরস্থায়ী সম্পদ। আমাদের প্রয়োজন ক্ষুব্ধ অর্থহীন তুচ্ছতাজর্জর জীবনে পরিবর্তন ধারা অব্যাহত রাখা; কিন্তু সকল ক্ষুদ্র প্রয়োজনকে অতিক্রম করে যে মহা জীবনের দিব্য মহিমা আমাদের নিকট উদঘাটিত, তাহাকে যেন আমরা সত্যভাবে শ্রদ্ধা করতে শিখি। সংসারের প্রাত্যহিক জীবনের কৃত্রিমতার কালরেখাগুলি ধীরে ধীরে কালের ‘গহনে’ অন্তর্হিত হয়; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো তেজোদীপ্ত মনস্বী, তপস্বী রসিকের একটা পূর্ণ অবয়ব মহাকালের পটে মৃত্যুঞ্জয় হয়ে আছে।
তাঁর কবিতা কখনও মর্তচেতনা, কখনও ব্যঙ্গ কৌতুক আবার কখনো প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে বিশ্ব চেতনায় সমকাল সংলগ্ন হয়েছে। তিনি মরমী কবিও। কারণ উপনিষদের ঋসিসুলভ প্রত্যয় তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে। সুফিবাদের ধারা, কবির ও রামপ্রসাদ সেনের আলিঙ্গণ তাঁকে ঋদ্ধ করেছে। তাঁর কবিতা গ্রাম বাংলার বাউল ফকিরদের দ্বারাও সমৃদ্ধ হয়েছে। বাউলদের মনের মানুষের মতোই তিনি জীবন দেবতা সৃষ্টি করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক চেতনার সাথে যুক্ত হয়েছিল আধুনিক ইউরোপের গতিবাদ। বিশ্বের কোনো কিছুই স্থির হয়ে নেই। সমস্তই বিপুল পরিবর্তন, পরিবর্ধনের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে অবিশ্রান্ত। এই যে অনির্বাণ ছুটে চলা, অনন্ত জীবনপ্রবাহ এটাই হলো বিশ্বসৃষ্টির মূল তত্ত্ব। বেদ উপনিষদের গতিবাদ সহস্র সহস্র বছর পূর্বে এই অমোঘ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিশ্বসত্য সম্পর্কে সাধনার লব্ধ অভিজ্ঞতায়। উপনিষদের রচয়িতারা বারংবার তাই অমৃতের সন্তানদের নির্দেশ দিয়েছিলেন সামনে এগিয়ে চলার। বলেছিলেন—- এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো এবং এগিয়ে চলো অবিরাম। যতক্ষণ না তুমি পূর্ণের সাথে মিলিত হয়ে পূর্ণ হয়ে ওঠো হে অমৃতস্য পুত্র, ততোক্ষণ এগিয়ে চলাই তোমার ধর্ম।চরৈবেতি! চরৈবেতি! বিশ্বজগৎ এই পূর্ণতালাভের জন্যই ছুটে চলেছে আদিঅন্তহীন কাল ধরে। কারণ শক্তিমাত্রই গতিময়। বিশ্বের সব বস্তুই গতিময় তাই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কবি মন যেমন ইউরোপীয় তাত্ত্বিক গতিবাদের ব্যাখ্যায় তৃপ্ত হতে পারেনি, তেমনি বেদ-উপনিষদের সৃষ্টিতত্ত্বের অবিচলিত উপসংহারে পৌঁছেও অস্থির হয়েছে বারবার। কারণ অনন্ত গতিপ্রবাহে জন্ম থেকে নানান জন্মান্তরে যাত্রা করে অসীমের পানে ছুটতে ছুটতে পূর্ণতা লাভ করার জন্য লালায়িত হননি কবি। তিনি সসীম থেকে অসীমে এবং অসীম থেকে সসীমের খণ্ডতায় প্রত্যাবর্তন করতে চেয়েছেন বারবার। সে কারণেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“আমার কাব্য সাধনার একটিমাত্র পালা। সে পালার নাম সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধনের পালা।”
রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য তাঁর ভাব-গভীরতা, গীতি ধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা আধ্যাত্মচেতনা ঐতিহ্যপ্রীতি প্রকৃতি প্রেম, মানব প্রেম, ভাব-ভাষা ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র, বাস্তবচেতনা ও প্রগতি চেতনা। রবীন্দ্রনাথের দর্শনে ঈশ্বর এক নিবিড় অনুভূতি। রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরের মূল নিহিত রয়েছে মানব সংসারের মধ্যেই। তিনি দেব বিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী-ঈশ্বরের পূজার কথা বলতেন। উপনিষদের ধর্মীয় আরাধনার পথ বেয়ে মানুষের ধর্মে উপনীত হয়েছিলেন তাঁর সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে।
রবীন্দ্রদর্শনে আমরা দেখি তিনি অনুভূতির পথের পক্ষপাতিত্ব করেছেন এবং তাঁর ক্ষেত্রে একে ঠিক অনুভূতির পথ বললে সঠিক হবে না। আমার মনে হয় তিনি যে পথ অবলম্বন করেছেন তাকে অনুভূতির অন্তর্গত একটি বিশেষ পথ বলে আমরা চিহ্নিত করতে পারি।
একদিকে তিনি যেমন আকুল হয়ে ওঠেন অনন্ত সুদূরের ব্যাকুল বাঁশরির আহ্বানে ——- “আমি চঞ্চল হে, আমি সুদূরের পিয়াসী” বলে, তেমনি পরক্ষণেই মৃত্তিকা পৃথিবীর আকর্ষণে তাঁর অন্তর কেঁদে আকুল হয় নিরন্তর। অসীমের আহ্বান ছেড়ে জননী জগতের সাথে নাড়ির টান অনুভব করে ছুটে যেতে চান ধরণীর সুধাস্নেহমাখা কোলে—– “আমারে ফিরায়ে লহ সেই সর্ব মাঝে/যেথা হতে অহরহ অঙ্কুরিছে, মুকুলিছে, মুঞ্জুরিছে প্রাণ শতেক সহস্র রূপে/। গুঞ্জরিছে গান শতলক্ষ সুরে/ উচ্ছ¡সি উঠিছে নৃত্য অসংখ্য সঙ্গীতে।” পৃথিবীর প্রতিটি সৃষ্টির অস্তিত্বের ভেতরে নিজেকে বিকশিত দেখতে চান তিনি। তিনি জন্মান্তরে অবিরাম যাত্রা করে ফিরেছেন। রূপ হতে রূপান্তর পরিগ্রহ করতে করতে লোক হতে লোকান্তরে বিচরণ করেছেন জীবনের নানা পর্যায়ের ভেতর দিয়ে —- “আমার পৃথিবী তুমি বহু বরষের/তোমার মৃত্তিকা সনে/আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে/অশ্রান্ত চরণে/করিয়াছ প্রদক্ষিণ সবিতৃমণ্ডল/অসংখ্য রজনী দিন যুগযুগান্তর ধরি।” বিশ্বের সবকিছুর জন্য এই যে বিপুল ভালোবাসা, বিশ্ব প্রকৃতির সাথে এই নিবিড় একাত্মতা, তার সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় কবির প্রাণে বিপুল জীবনের অনুসন্ধান জেগে ওঠা, এটা তো কেবল এক জন্মের সাধনায় সম্ভব নয়। জলস্থল, আকাশ বাতাস, লোক লোকান্তর, সর্বদেশকাল, সর্বসমাজে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করার এই প্রবল আকাঙ্খা তার কারণ অফুরান জীবনের পরশ দিয়ে বিধাতা তাঁকে গড়েছেন —— “আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব/ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব।”
রবীন্দ্রনাথের মতে, “নিছক সত্য সম্বন্ধে জ্ঞান বা নিছক শক্তির আবিষ্কার বাহিরের বস্তু, তারা সত্তার অন্তরের নাগাল পায় না।” নিছক মনন বৃত্তির সাহায্যে যে জানা তার চেয়ে ব্যক্তিগত সম্বন্ধ স্থাপনের দ্বারা হৃদয়বৃত্তির সাহায্যে যে পাওয়া ঘটে, তা আরো গভীর আরো সমৃদ্ধ অনুভূতি- এটিই রবীন্দ্র দর্শনের একটি মূল ভাবধারা। রবীন্দ্রনাথ এ কথাই দার্শনিক ও সাহিত্যিক আলোচনায় বোঝাতে চেষ্টা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ দার্শনিক। তারচেয়েও বড় কথা তিনি জীবনরসের কবি। অসীম-সসীমের মিলনকে কবি অনুভব করেছেন প্রেমে ভালোবাসায়, রূপে রসে, গন্ধস্পর্শে, বিষাদে বেদনায়, সুখ-দুঃখে। সেটা তিনি অনুভব করেছেন সর্বানুভূতির ভেতর দিয়ে। কিছুই তাঁর কাছে তুচ্ছ নয় তাই। পৃথিবীর তুচ্ছতম ধূলিকণাও কবির কাছে পরম উপভোগ্য হয়েছে। সবই অভিষিক্ত হয়েছে সৌন্দর্যের নব নব উৎসরসে। সংসারের কোনো বন্ধন কিংবা আসক্তি পরিত্যাগ করে বৈরাগ্যের সাধনায় তিনি তাই ব্রতী হতে চাননি। তাঁর অন্তরস্থিত কবিচিত্তের প্রেমমুগ্ধ হৃদয় জগতের আনন্দযজ্ঞে পূর্ণতার অভিস্নানে সিক্ত হতে উৎসুক থেকেছে অবিরাম। এ কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহু কবিতায় নানাভাবে বলতে চেয়েছেন যে পৃথিবীর সমস্ত বিষয় থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে জীবনের একাকীত্বের মধ্যে মানুষের মুক্তি নেই। বিশ্বেশ্বরকে এই বিশ্বের মধ্যেই অনুভব করতে হবে।