প্রবন্ধঃ জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম

জীবনানন্দের কবিতায় প্রেম
অলোক আচার্য
সাহিত্য রচনার একটি প্রধান উপজীব্য হলো প্রেম। তা সে মানুষের জন্য হোক আর প্রকৃতির জন্যই হোক। রোমান্টিক ধারার সাহিত্য হয় নারী-পুরুষের প্রেম নিয়ে। কবি কোনো মুখ কল্পনা করে কবিতা লিখে যান, গল্পকার গল্প লিখেন। মানব জীবনের নিত্য অনুভূতির নাম প্রেম। এই প্রেমানুভূতি নিয়ে দুই ধরনের সাহিত্য তৈরি হয়। পাওয়া বা না পাওয়ার অনুভূতি। বিরহ রসে পাঠক অশ্রম্নসিক্ত হয়। তবে সাহিত্য বা চলচ্চিত্রে বিরহ পাঠককে যেভাবে টেনেছে মিলন মনে হয় ততটা পারেনি। এক্ষেত্রে শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাসের কথাই ধরা যাক। দু’জনের বিচ্ছেদেই প্রেম যেন আরও স্বার্থক হয়ে উঠেছে। তাছাড়া বড় প্রেম তো কেবল কাছেই টানে না দূরেও ঠেলে দেয়। এটা শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায়েরই কথা। তবে সবার প্রেম বা ভালোবাসাবোধ সমান নয়। কারো ভীষণ গভীর। বহু কবির বহু কবিতায়ই সৃষ্টি হয়েছে নারী চরিত্র। কবিতা প্রেমীকে তা মুগ্ধ করেছে। যারা কবিতা ভালোবাসেননা তারাও সেই কবিতার চরিত্রকে উদাহরণ টেনে স্বপ্ন বোনেন। এড়্গেত্রে উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্রের কথা মনে হলে প্রথমেই মনে আসে নাটোরের বনলতা সেনের কথা। যুগ যুগ ধরে যে বনলতা সেন বহু যুবকের উদাহরণ হয়েছে। যার স্রষ্টা কবি জীবনানন্দ দাশ। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যে যার কবিতা সব থেকে বেশি সমাদৃত, অনুসৃত তিনি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় উঠে এসেছে প্রেম, নারী, রোমান্টিকতা, ভালবাসা, দেশাত্ববোধ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার কবিতায় ঘুরে ফিরে বারবারই মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বারবার এই বাংলায় ফিরে আসার তুমূল আকুতি। কবিতায় ভালবেসেছেন স্বদেশকে। প্রিয় জন্মভূমির টান ছিল তার কলমে। ফিরে আসতে চেয়েছেন তার প্রিয় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। এই বাংলার প্রকৃতিই ছিল তার সবচেয়ে প্রিয়। মায়ায় নিজে জড়িয়েছেন, সেই সাথে তার পাঠকদেরকে টেনেছেন মন্ত্র মুগ্ধের মত। বলা হয় রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে মু্ক্ত করেছে তার কবিতা। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ঘটিয়েছেন। তার কবিতার ধারায় আজ আধুনিক কবিদের কবিতা রচিত হচ্ছে। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে ব্যর্থ। তার সৃষ্টির সমাদর তিনি জীবিত থাকা অবস’ায় দেখে যেতে পারেননি। বিষন্ন, স্বপ্নময়,আশ্চর্য শোভাময় কবিতার মধ্যে ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ সোনার টুকরোর মতন কবিতায় ফুটে উঠেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার কবিতাকে বলেছিলেন চিত্ররূপময়। বুদ্ধদেব বসু তাকে বলেছেন নির্জনতম কবি। নির্জনতম কবি হয়েও কবিমনে এমন কিছু চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন যা ছাড়িয়ে গেছে কালের গন্ডি। জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায় একটি নক্ষত্র বা নক্ষত্রের চেয়েও বিশাল। যার কবিতার ধারায় বাংলা কবিতা নতুন দিকের সন্ধান পেয়েছে। আজ বাংলা কবিতায় তার জয়জয়কার। সময় যত যাচ্ছে তার কবিতার প্রতি এবং কবির প্রতি আধুনিককালের কবিদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা অন্য কোন কবির ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়নি। কবির মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য। কবিতা তার বিষাদের আশ্রয়। না পাওয়ার হতাশার প্রকাশ। কবিতা তার প্রেমের মিলনক্ষেত্র। প্রেম? এক যুগ যুগানত্ম ধরে চলে আসা অনুভূতি। সব কবিই কি প্রেমিক হয়? হয় হয়তো? অথবা বলা যায় সব প্রেমিকরাই কবি হয়। নিজের ভালোলাগার মানুষের জন্য বলতে না পারা কথা কবিতার শব্দ হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় বনলতা সেনের মতো কোনো মোহনীয় চরিত্রের। নেশা ধরানো কাব্যিক অবয়বের। কেবল বনলতা সেনই নয় জীবনানন্দের হাতে সৃষ্টি হয়েছে সুরঞ্জনা,সুদর্শনা,শ্যমলী,অরুণিমা বা সুচেতনার মতো আবেগিক নারী চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তিনি। উল্লেখ্য যে, এসব চারিত্রিক উপমার একজন অপর চরিত্র থেকে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের। কবির বনলতা সেন কেবল তাকেই দুদন্ড শান্তি দেয়নি বরং আজও ক্লান্ত অবসন্ন হৃদয়কে শান্ত করে। জীবনে যখন আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে তখনও থাকে শুধু বনলতা সেন। কবির ভাষায়, ’ সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী;/ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন/থাকে শুধু অন্ধকার;মুখোমুখি/বসিবার বনলতা সেন। বনলতা সেনের মুখোমুখি বসে কি শান্তি পেয়েছিলেন কবি? সে প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। পাঠকরা কল্পনা করে নিক। এই যে অমর এক চরিত্র তার কবিতায় তিনি সৃষ্টি করে গেলেন তা তো সবটুকু তার কল্পনা থেকে নয়। তিনি কি সত্যি বনলতা সেনের মুখোমুখি হয়েছিলেন? কবির আকাশলীনা কবিতার সুরঞ্জনাকে ফিরে আসার যে আকুতি আমরা পড়েছি তা যেন আজও বুক ভাঙা প্রেমিকের আকুতি প্রকাশ করে। ”সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি/বোলোনাকে কথা ঐ যুবকের সাথে/ফিরে এসো সুরঞ্জনা/নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে।” নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে কি সুরঞ্জনা ফিরে এসেছিল কবির আহবানে? আজ এত বছর পর খুব জানতে ইচ্ছে করে? নাকি সুরঞ্জনাদের বার বার এভাবেই ডেকে ব্যর্থ হতে হয়? লোকেন বোসের জার্নালে সুজাতার প্রতি ভালোবাসা ছিল। তবে কবিতায় ভালোবাসায় এক প্রশ্নোবোধক চিহ্ন রয়েছে। তিনি অবসরে সুজাতাকে ভালোবাসতেন কি না তা নিয়ে ভাবতে চেয়েছেন। সত্যি কি কোনোদিন অবসর হয়েছিল সুজাতাকে নিয়ে ভাববার? হয়তো হয়নি? সুচেতনা বা সুজাতা চরিত্রও কবিরই সৃষ্টি। তবে বনলতা সেন বা সুরঞ্জনার মতো এতটা প্রেমিক হৃদয় টানতে পেরেছে কি? এক ঝলকেই সুচেতনাকে বুঝে নেওয়া কষ্টকর। কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আধারে সে কে এক নারী এসে কবিকে ডেকেছিল। চেয়েছিল কবিকে। কে সে? সে হলো কবির শঙ্খমালা। যাকে কবি সন্ধ্যার নদীর জলে জোনাকীর আলোয় খুঁজেছিল। ” চোখে তার/যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার/সত্মন তার/করুণ শঙ্খের মতো-দুধে আর্দ্র/কবেকার শঙ্খিনীমালার/এ পৃথিবী একবার পা তারে/পায় নাকে আর। শ্যামলী কবিতায় শ্যামলী এক চিরায়ত শক্তি হিসেবে দেখেছেন। শুরুতেই শ্যামলীকে পুরোপুরি চেনা যায় না। এই শ্যামলীকে চিনতে হলে কবিতার শেষ লাইন অবধি অপেড়্গা করতে হয়। ধীরে ধীরে শ্যামলীকে চেনা যায়। কবি যার মুখের দিকে তাকালে সমুদ্রের নীল,নক্ষত্র,রাত্রির জল বা যুবাদের ক্রন্দন সব অনুভব করতে পারেন। শ্যামলীর মধ্যে এতটা শক্তি ছিল। তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো/আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল/দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা/বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল/নক্ষত্র,রাত্রির জল,যুবাদের ক্রন্দন সব/শ্যামলী করেছি অনুভব। আজীবন দুঃখ কষ্ট অভাবের সাথে সংগ্রাম করা কবি তার ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্রতার কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন। অনেক চেষ্টার পরেও যেন আর্থিক সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। অভাব ছিল তার জীবনের সাথী। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো তিনি জীবিত থাকা অবস’ায় তার সাহিত্য কর্মের স্বিকৃতি দেখে যেতে পারেননি। তার কবিতা গল্প সব মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হয়েছেন অন্যতম প্রধান কবি। তার কবিতার টানে আজও অনেকেই কবিতা লিখে চলেন। তাই এখন তিনি পাচ্ছেন শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবির মর্যাদা।