গল্প: ধর্না

গল্প: ধর্না

ধর্না
শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

এটি একটি চারমাথার মোড়। যেখানে রিক্সাস্ট্যান্ডের মাথায় “একসাথে কুড়িটা রিক্সা দাঁড়াইবে” লেখা আছে, ঠিক তারই নীচ কমলা মেমোরিয়াল ফর গার্লসএর কেরানি শ্রীমতী সঞ্জিবনী কসলকর স্বহস্তে একটি লাল সাদা ফেস্টুন টানাতে চাইছেন।

সামান্য এগিয়ে গিয়ে কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা সাহস ভরে করেই ফেললাম- ম্যাডাম একাই যে!
এসব কি একার কাজ? আর সব কই?

পৃথিবীতে টাইমটেবল নিয়ে বহু প্রবাদ-প্রবচনএর মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছে বাঙালির টাইম টেবিলের হাস্যরসাত্মক নানা গল্প। সেসব না হয় অন্য কোথাও অন্য প্রসঙ্গে বলা যাবে একদিন। সেসবই ভাবতে ভাবতে হাত লাগালাম মিসেস কসলকরএর কাজে। বললাম- ডানদিকের কোনাটা আরএকটু নীচু করুন। নাহলে বামদিক উঁচু হবে না। উনি বললেন- আমার হাত আর উঁচুতে উঠছে না….
ব্যালান্সও হয়েছে, আবার দুইদিক সমান হবে, এটা আমার জানা আছে। তা-ই সমন্বিত শিক্ষাকর্মী আন্দোলনের ফেস্টুনকে টাঙাতে গেলে কি করে নীচের দিকে ঢিল বেঁধে দিতে হয়, তা আমার জানা আছে।
অতীতকে স্মরণ করলাম মনে মনে। আবার এও ভাবছি, এই যে এইসময়এর এই ফেস্টুন, তা কি কেবলই একটা নির্দিষ্ট সময়কেই নিরূপিত করে?

পিঠের মেরুদন্ডের হাড়টা চিনচিন করে উঠলো। আসলে অনেকটা উঁচুতে লাইটপোস্টের সাথে দঁড়ির ফাঁস লাগাতে গিয়েই এই পুরোনো ব্যাথাটা চাগার দিলো।
ইতিমধ্যেই সকালের অফিসযাত্রীদের ওইপথে যাতায়াত শুরু হয়ে গেছে। তারা বেশিরভাগই ট্রেনযাত্রী। ভেন্ডারদের মালপরিবহনের ট্রলি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া আর ওই ব্যস্ত সময়ে-“সরিয়ে বাবুজি– “শব্দের সাথে যারা পরিচিত, তারা জানেন, আসলে প্ল্যাটফর্মটা ওইসময় ওইসব লাল পোষাকদের দখলেই চলে যায়। এসবই আমি ফেস্টুনটা লাইটপোস্টে টানাতে টানাতে লক্ষ্য করছি।

ততক্ষনে শ্রীমতী সঞ্জিবনী কসলকর স্বহস্তে ধর্না মঞ্চের সামনে রাখা একটি টেবিল আর গোটাকয়েক ভাড়ার চেয়ারকে টেনেটুনে একটু ভদ্রস্থ করার চেষ্টা করছেন।

পোস্ট থেকে নামতে নামতে শুনতে পাচ্ছি – আরে সনাতনদা যে! এ-ই বয়সে একটা ফেস্টুন আর লাইটপোস্টএর প্রেমকে এমন করে যুগলবন্দী ফ্রেমে ধরে রাখতে আপনি বিজ্ঞানকে অবলীলায় ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন! বয়সের কথাটা মাথায় রাখবেন তো!

আমি ভূমি স্পর্শ করে ফেলেছি ততক্ষণে। বললাম – আরে কার্তিক দা যে!
কার্তিকদা চলতে চলতে — এসব তো এখন ভাড়াটে আন্দোলনকারীরাই করে দেয়….

সঞ্জীবনী কসলকর, কি ভাবছেন আপনি? ঘড়ির কাঁটার দিকে চেয়ে নিচ্ছি আমি — হয়তো মনে মনে আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি এ-ই কথাটাই বললেন।

শিক্ষায়তনে করণিকদের স্থায়ীকরণের দাবির বিষয়ে ব্যস্ত স্টেশন রোডের ওপরে অনুষ্ঠিতব্য এই গণধর্না মঞ্চে ইতিমধ্যে দু’জন পুরুষ সিংহ ও একজন নারীর আবির্ভাব হয়েছে। হারমনিয়ামে শুরু হোলো পুনর্জাগরণের কোরাস গান।
কসলকরের হাতে দাবিদাবা সম্বলিত লিখিত বয়ান চলমান মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
দর্শকেরা, বলতে- এই আমি, ততক্ষণে বুঝতে পারছি যে, ঘড়ির কাঁটার উল্টোদিকেই প্রদক্ষিন করছি আমি। আর, মাইকে ছড়িয়ে পড়া ” আমরা এই /দুনিয়ায় / জীবনেরও গান শোনাই/ মুক্তিরও গান শোনাই “.. এই গানটি হঠাৎই যন্ত্র ঘটিত কারণে ফ্যাস ফ্যাস শব্দ করে থেমে গেলো।