গল্পঃ ডুবে মরে যাই

গল্পঃ ডুবে মরে যাই

ডুবে মরে যাই
সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর

-স্বার্থ ছাড়া আমি একটা পা ও ফেলিনা।বুঝলে ভাতিজা,যেখানে স্বার্থ নাই সেখানে আমিও নাই।হে হে হে…

তিনি বিশ্রী দাঁত বের করে হাসতে লাগলেন।আমার বিরক্তির সীমা রইলোনা।
বিরক্তিটা তার উপরে না,আমার নিজের উপরে।কেনো আমি সেধে,সেধে তার সঙ্গে আলাপ জমাতে গেলাম!

তার সাথে আমার আগের পরিচয় নাই।আজই তার সাথে আলাপ।লঞ্চে।যাচ্ছি ফেছির বাজার।শেরপুর থেকে লঞ্চে উঠেছি।
লঞ্চে এই প্রথম উঠেছি।বর্ষা শেষের দিকে,কিন্তু কুশিয়ারা নদীতে পানির কোন কমতি নাই।পানিতে টই টুম্বুর।ভীষণ স্রোতের টান।
আমরা যাচ্ছি ভাটির দিকে।
লঞ্চ ছাড়ার পর-পত্রিকায় পড়া সব লঞ্চ ডুবির ঘটনা একে একে আমার মনে পড়তে লাগলো।
আমি কিঞ্চিত ভয় পেতে লাগলাম।লঞ্চের এ অবস্থানে নদী যদিও খুব বেশি চওড়া না,গভীরতা নিশ্চয়ই অনেক।লঞ্চ চলছে মাঝ নদী দিয়ে।যদি কোন কারনে ডুবে যায়,তাহলে উপায়?
সাঁতার জানি,তাতে কি?
লঞ্চ ডুবিতে যে এতো এতো লোক মারা যায়-তারা সবাই কি সাঁতার না জানা?তাহলে?
বসেছিলাম লঞ্চের ভেতরে।ডুবে যাওয়ার কথা ভেবে ভয়ে বাইরে চলে এলাম।
লঞ্চটা একতলা হলেও বেশ বড়ো।
আমি হেঁটে হেঁটে মাঝামাঝি গিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।সিদ্বান্ত নিলাম পুরোটা সময় এখানেই থাকবো।ডুবে যাবার কোন লক্ষণ দেখলেই-ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার ধরবো।বাকিটা,আল্লাহ ভরসা।

আমি যে গ্রামে যাচ্ছি,সেখানে এই প্রথম যাচ্ছি।কাজেই কিভাবে যেতে হয় ঠিক জানিনা।শুধু জানি লঞ্চে করে ফেছির বাজার গিয়ে নেমে আরো মাইল দেড়েক পাঁয়ে হেঁটে-যেতে হয়।
যেহেতু অঞ্চলটা অপরিচিত তাই ঐ অঞ্চলের বাসিন্দা হামিদ কে সঙ্গে নিয়েছি।
হামিদ দশ এগারো বছরের বালক।আমাদের বাড়িতে ফুট ফরমায়েশ শোনার কাজ করে।রওয়ানা দেওয়ার আগে তাকে জীজ্ঞাসা করলাম,
– রাস্তা ঘাট ছিনিসতো তুই ভালো করে?
– জ্বী মামা।
– ঠি ক মতো নিয়ে যেতে পারবি তো?
– জ্বী মামা।
তার উপর ভরসা করে ‘ধরলাম পারি’।

শুরুতেই সে আমার ভরসায় চির ধরালো।
গোয়ালা বাজার থেকে সি এন জি দিয়ে আমরা শেরপুর গিয়ে নামলাম।এখান থেকে ইন্জিনের নৌকা ভাড়া করে ফেছির বাজার যাবো।
হামিদ আমাকে নৌকা ঘাটে নিয়ে গেলো।সেখানে মাত্র দু’টি নৌকা।বললাম,
– যা,একটার সাথে কথা বলে রিজার্ভ কর।
সে গেলো।আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
নৌকার মাঝি গুলো খুবই ফাজিল ধরণের।দর কষাকষির এক পর্যায়ে তারা হামিদকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা শুরু করলো।
আমার উঠলো রাগ।আমি তাকে ডেকে বললাম,
– চল বাড়ি ফিরে যাই।দরকার নাই আর ওদিকে যাবার।
সে আমাকে বললো,
– চলেন মামা,লঞ্চে যাই।
– লঞ্চ কই?
– ঐ তো,এখনি ছাইরা দিবে।
সে আঙ্গুল তুলে দেখালো।তাকিয়ে দেখলাম,বেশ কিছু দূরে একটা লঞ্চ দেখা যাচ্ছে।লাইন ধরে লোকজন উঠছে।
আমি জীবনে কখনো লঞ্চে চড়ি নাই।তাই লঞ্চ চড়ার সাধটা চড়াৎ করে মনে দোলে উঠলো।বললাম,
– লঞ্চে নিয়ে যেতে পারবি তো?
– পারবো মামা,চলেন চলেন।সময় বেশি নাই।লঞ্চ ছেড়ে দিবে।

ভাবলাম যা হবার হবে,যেখানে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছি-সেখানে যেতে পারলে যাবো,না পারলে বাড়ি ফিরে যাবো।জীবনে প্রথমবার লঞ্চটাতো চড়ে যাই!
বললাম,
– চল,চল।
আমরা প্রায় দৌড়ে গিয়ে,কাঠের সিঁড়ি বেয়ে লঞ্চে উঠলাম।
লঞ্চ ছাড়ার পর কেনো জানি হামিদের উপর থেকে আমার ভরসাটা হারিয়ে যেতে থাকলো।আমি তখন আমার পাশে বসা মুরুব্বি মতো লোকটার সাথে আলাপ শুরু করলাম,
– চাচা যাচ্ছেন কই।
দাঁড়ি,গোঁফের আড়াল থেকে তিনি দাঁত গুলো বের করে নিয়ে হাসলেন।প্রশ্নের উত্তর দিলেন প্রশ্ন দিয়ে।
– ভাতিজা তুমি কই যাইবা?
– যাবো ফেছির বাজার।
– কোন সমস্যা?উঠার পর থেকেই তো দেখতেছি বড়ো উসখুস করতেছো?
এ্যাই রে! লোকটা অন্তর্জামী নাকি!
বললাম,
– একটু সমস্যা আছে।
হামিদকে দেখিয়ে বললাম,
– এ আমাকে চিনিয়ে নেয়ার কথা।সে ঐ এলাকার মানুষ।কিন্তু আমি এখন আর এর উপর ভরসা রাখতে পারছিনা।
তিনি আবারো হাসলেন।বললাম,
– এই লঞ্চ ফেছির বাজার থামে তো?
– থামে।
– ফেছির বাজার আসলে আমাকে আপনি একটু অবগত করবেন প্লীজ।

ভুলটা আমার এখানেই হলো।তাকে আমি আলাপ করে আমাকে বিরক্ত করার সুযোগ করে দিলাম।
শুরুটা,প্রশ্ন দিয়ে আমিই করেছিলাম।
এরপর তিনি আমাকে প্রশ্নের বাণে জর্জরিত করতে লাগলেন।
যেমনঃ
আমার বাড়ি কোথায়?
কি করি?
ভাই বোন কয়জন?
ল্ন্ডন কিভাবে গেলাম?
লন্ডনে কোথায় থাকি?
ম্যানচেস্টার না বার্মি গ্রাম (বার্মিংহাম)?
কি কাজ করি?
এখন কেনো ফেছি যাচ্ছি?
কার বাড়ি যাচ্ছি?
যার বাড়ি যাচ্ছি তিনি সম্পর্কে কি?
ক’দিন থাকবো?
দেশে ক’দিন থাকবো?
বিয়ে করেছি কি না?

আমি তার প্রশ্নে অতিষ্ঠ হয়ে,ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে-লঞ্চ ডুবে যাওয়ার ভয়ে,ভেতর থেকে বাইরে চলে এলাম।কিছুক্ষণ পর দেখি তিনিও এসে হাজির!
মহা মুসিবত।
আমি বললাম,
– আপনিও আমার পিছে পিছে চলে এলেন?
তিনি মিটি মিটি হাসতে লাগলেন।
আমি রাগ হয়ে বললাম,
– কেনো?আমার পিছে পিছে কেনো?
তখন তিনি বললেন,
– স্বার্থ ছাড়া আমি একটা পা ও ফেলিনা।বুঝলে ভাতিজা,যেখানে স্বার্থ নাই সেখানে আমিও নাই।হে হে হে….
বললাম,
– মানে?আমার সাথে আপনার কি স্বার্থ?
– হে হে হে,ভাতিজা আমি রায়বারী কাম করি।কালই তোমার বাড়ি গিয়ে তোমার আব্বার সঙ্গে দেখা করে…আমি তো সব সময় অবিবাহিত ছেলে মেয়ের সন্ধানে থাকি।
তার কথা শোনে রাগে দুঃখে ইচ্ছে করলো লঞ্চ ডুবুক আর না ই ডুবুক,আমি লাফ দিয়ে নদীতে পড়ে ডুবে মরে যাই।