মানিকরতন শর্মার অণুগল্প

কালো বিড়াল
জান, একদিন এক রাতের ঘটনা। আমি একবার স্বপ্ন মনে করি আবার বাস্তবও মনে করি। কিন্তু কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা। বাস্তব না স্বপ্ন।
একথা বলে তিনি কি যেন ভাবতে থাকলেন। চোখ স্থির। মুখবর্ণ বিষাদের ছাপ। কি যেন খোঁজছেন মনে হলো। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে বললেন-
-এবার খাও তো দেখি
অনিমেষ একটা চাকরির পরীক্ষা দিতে এই শহরে আসা। আসার সময় তার মা হালকাভাবে বলেছিল
-আমাদের এক আত্মীয় আছে এই শহরে। কোথায় থাকেন তা জানি না। তবে সেটা অনেক দিন আগের কথা। তখনো আমার বিয়ে হয় নি। জানতাম ওনি বেশ বড় চাকরি করতেন। এখনও চাকরি করছেন কিনা জানি না। অনেক দিন হল তো বাবা, যোগাযোগ নাই।
অনিমেষ তার মার কাছ থেকে নামটা জেনে নেয়। তারপর গুগোলে সার্চ দেয়। একটা ঠিকানা অবশেষে যোগার করল সে। শহরটা খুব বেশি বড় নয়। ছিমছাম শহর। ছোট্ট শহর। এই ভেবেই আশ্বস্ত হয় অনিমেষ। একটা ব্যবস্থা করে নিবে মনেমনে ভাবে সে।
মা বলেছেন তাকে খুব বেশি আদর করতেন তিনি। সেই ছোট্ট বয়সে। সখের জিনিসপত্র কিনে দিতেন। বাবার পিসতো ভাই হতেন তিনি।
-মা আমাকে চিনবেন তো ?
-পরিচয় দিলে নিশ্চয় চিনবেন। তবে তিনি আছেন কিনা সেটাই তো বিষয়।
অনিমেষ শহরে ঢুকেই প্রাথমিকভাবে একটা সার্চ দিয়েছে। পরীক্ষা শেষে বেশ খোঁজাখুজির পর অবশেষে দেখা মিলল তার। আত্ম পরিচয়ে অনিমেষকে বুকে জড়িয়ে নিলেন তিনি।
ধীর স্থির। সৌম্য চেহারা। পরনে কৌপিন। গলায় তুলসীমালা। চশমার কালো ফ্রেমে বেশ মানিয়েছে তাকে। চাহনি গভীরতা অনেক।
দুজনের কথা বলার মুহূর্তে ঘরটার আদ্যপান্ত দেখে নিচ্ছে অনিমেষ। অত্যন্ত ছিমছাম। পুরোনো দু’টো চেয়ার। আলমিরার ওপরে একটা কাঠের রেডিও। অনেক কারুকাজময় উঁচু একটা ঘাট। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের হবে। হয়তো আরো বেশি দিনের হবে। দক্ষিণের জানালার পাশে একটা কোণাভাঙা টেবিল। কালো রঙের পর্দাগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে।
তাকে পেয়ে খুব খুশি হলেন তিনি। এটা বুঝতে পারল অনিমেষ। ঘণ্টাখানেক লাগল রান্না করতে। অনিমেষকে পরম স্নেহে চাটাই বিছিয়ে বেশ পুরোনো পাথরের থালায় খাবার বেরে দিলেন। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল-
-আপনি খাবেন না ?
-আমি ওসব তেমন একটা খাই না।
-তাহলে কী খাবেন ?
-একটু সুজি আর দুটো রুটি।
-মাত্র এই টুকু !
ক’সেকেন্ড চুপ থেকে তিনি বললেন—
-দাদুভাই এবার তুমি খাও।
খেতে খেতে অনিমেষ বলল- এইগুলো খাওয়া কি বারন ?
-কথা যখন তুললে দাদু ভাই তাহলে বলছি শোন, যৌবনে একটা সময় ছিল কতকিছু যে খেয়েছি, তোমাকে তা বুঝাতে পারব না। মাংসই তো কত রকম। দেশে-বিদেশে যখন যা হাতের নাগালে পেয়েছি তাই খেয়েছি। যৌবনকে ইচ্ছে মত উপভোগ করেছি। যত কৌশল আছে সবকিছু প্রয়োগ করেছি। মনকে বিবেকের নাটাইয়ের সাথে কখনোই বেধে রাখি নি। কাম লালসা চরিতার্ত করেছি বয়সের ফ্রেমে বাঁধিয়ে। কামিনী জলে ডুব দিয়েছি কত যে। দাদু ভাই এখন এই বেলায় এসে বুঝেছি কত যে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যভাবে যৌবনটাকে নষ্ট করেছিলাম। জান মুরুব্বিরা বলে, যৌবনে ধন কামাই করো। এটার দুটো অর্থ আছে, এক, বিষয়ী ধন অর্জন করা। যে ধনে মায়ার ধ্রু¤্রজাল ছড়িয়ে আছে। তোমাকে কোনো মতে নিষ্কৃতি দিবে না। বিষয় তোমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে। আরেক ধন আছে একান্তই নিজের। যার নাম হতে পারে অপার্থিব ধন। অনেকে এটাকে পরমার্থিক ধন বলে ভাবতে পারে। জান দাদু ভাই, হৃদয়ের পরম বস্তুকে যৌবনেই পাওয়া যায়। অসময়ে নয়। যে কণ্ঠস্বর যৌবনে মেলে ধরে, সেই কণ্ঠস্বর কী ব্যধিগ্রস্ত ও বার্ধক্য শরীরে পাওয়া যায় ! যায় না। মনের জোর থাকে না। কথায় আছে- ব্যধির শরীরে নাই কৃষ্ণের ভজন, যে দিকে ব্যধি সেইদিকে মন।
কথাগুলো বলার সময় একটা অনুশোচনাবোধ যেন তাকে গ্রাস করছে। মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছে অনিমেষ।
-জান দাদু ভাই, রাত খুব বেশি হয় নি। নিদ্রা লাগে লাগে ভাব। এমন সময় দেখি একটা বড় কালো বিড়াল আমার বুকে এসে বসল। বসে আমাকে বলতে লাগল- জানিস আমি কে ? আমি কথা বলতে পারি নি। তখন সে নিজেই বলতে শুরু করেন- আমি হচ্ছি তোর যৌবন কাল। কামের শরীর। অথচ আমি হতে পারতাম শাদা পায়রা। হয় তো কোন এক বাগানের ফুল। না-তুই আমাকে তা হতে দিলি না। তুই কিনা আমাকে হিংস্র পশু বানিয়ে দিলি !
আমি কম্পমান। দাদু ভাই আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না। এটা বাস্তব না স্বপ্ন ! একটা সময় দেখলাম বিড়ালটা বুকে আচড় দিয়ে মুখ ভেঙচি কেটে মিয়াও মিয়াও বলে চলে গেল।
খাবার শেষে অনিমেষ দেখছে রান্নাঘরের দরজায় একটা বিড়াল জিহ্বা নাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
পান পিচকিনি
ভাঙা বাজার। হাতে গোনা কজন মানুষ। তার মধ্যে দু-চারজন পুরুষ। বাকিসব নারী ক্রেতা। যাদের বয়স চল্লিশের ওপরে। বিক্রেতারা আগ বাজারে যথেষ্ট লাভ কুড়িয়েছে। এবার ভাঙা বাজারে কম লাভেই পন্য ছেড়ে দেন। আর এই সুযোগটাই প্রতিদিন গ্রহণ করে নারী ক্রেতারা। যাদের চুলার আগুন অভাবের আগুনে জ্বলে। টানা টানি সংসারের এই এক নিত্য-চিত্র। ফুলবানু পোকা খাওয়া বেগুন, টুকরির তলানিতে অবশিষ্ট ঢেড়শ মুলামুলি করে সদাই করে। ঘরে একমাত্র ছেলের বৌ। এক নাতি, দুই নাতনি। এই সবজি দিয়ে চলে দিনরাতের খাবার। দশমাস হলো ইটের ভাটায় কাজ নিয়েছে ফুলবানু। চরম বৈষম্য বেতনে নারী শ্রমিক সে। দৈন্য দশা সংসারের কারনে শোষণের হাতে বন্দি ওরা। কাঁচা ইট দাউ দাউ আগুনে পুড়ে। মহাজনের বাণিজ্য কৌশলেও পুড়ে ফুলবানুদের গতরঘাম।
বাদশা মিয়ার বয়স আর কত ! এই পঁচিশ-ছাব্বিশ। ঐ বয়সে এক বিকালে বিয়ে করে আনে ফুলবানুকে। বাবা রহমতউল্লা বিনা বাক্যে ছেলের বৌকে ঘরে তুলে নেন। কারণ ছেলের মা নেই। শূন্য ঘর। আর ফুলবানুও ফুলের মতই। প্রতিবেশিরা বাদশার বৌকে একনজর দেখার জন্য ভিড় করে। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে বৌয়ের রূপের কথা।
বছর যেতে না যেতে গর্ভবতী হয় ফুলবানু। ছ’মিলে কাজ করে বাদশা। পরিশ্রম একটু বেশি হলেও রুজি ভালো। সংসারটি চলছিল যেমনতেমন করে। একদিন রহমতউল্লা মারা যায়। পিতার মৃত্যুতে কেমন যেন হয়ে যায় বাদশা। বাবা ছিলেন ছাতার মতো। বাবাকে খুব ভালোবাসত সে। অল্প বয়সে মাকে হারায়। তারপর এই বাদশার মুখের দিকে চেয়ে আর বিয়ে করেনি রহমতউল্লা। বয়স বারার সাথে সাথে এই সত্যটা উপলব্ধি করে বাদশা।
ফুলবানুর ঘরে আসে হেদায়েত। বাদশা খুব খুশি। কারন তার প্রথম সন্তান পুত্র বলে। পুত্র সন্তান প্রথম হলে বাবার কাঁধের বোঝা লাগবে এগিয়ে আসবে সে। তারপর দুই দুইটি মেয়ে সন্তান। দুটি মেয়ে সন্তান জন্মে পর আর এগুয়নি বাদশা ।
ছেলে হেদায়েতকে কোনো মতে আট ক্লাস পর্যন্ত পড়িয়েছে। অংক তার মাথায় ঢুকে না। ঠেলেঠুলে এই আটক্লাস।
Ñ শোন বাদশা মিয়া, ছেলেকে ভালো দেখে একটা হাতের কাজে লাগিয়ে দাও। তার পড়াশোনা অইব না। অংকটা একদম বুঝে না সে। বললেন মনির স্যার।
প্রথমে ওয়েলডিং এ। হলো না তার। দরজি কাজেও দেওয়া হলো। মাপজোপ আর কাপড় কাটা হিসেবে গড়মিল। তাও হলো না। অবশেষে ধার দেনা করে কিছু টাকা জোগার করে বাদশা মিয়া। ছেলেকে এবার একটা পান-চকলেটের দোকান দিয়ে দেয় সে। কৈশোর পেরুনো হেদায়েত নিয়মিত দোকানে বসে। ব্যবসার কাজে ছেলের মনমতি দেখে নিশ্চিন্ত হয় বাদশা মিয়া। ধীরেধীরে দোকানে হরেক রকম খাবারের পাশে কোমল পানীয়ও ওঠে।
থানা থেকে পাঁচশ গজ দূরে দোকানটি। তাই সকাল-দুপুর মানুষের আনাগুনা। বেচাবিক্রি ভালোই। হেদায়েতের লাভের টাকা ঢুকতেই হেসে ওঠল সংসার। কিন্তু একদিন মিলে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। পঙ্গু হয়ে যায় বাদশা মিয়া। তারপর কিছু দিন বিছানায়। ডাক্তার ঔষধ টাকা যাচ্ছে। কিন্তু শেষে একদিন ভোর বেলায় মারা যায় বাদশা। পিতার মৃত্যুতে বড় রকমের একটা ঝাকুনি খায় হেদায়েত। বাপের মৃত্যু বছরে বোন দুটোকে দেনা করে বিয়ের ব্যবস্থা করে সে।
বাধ সাদলো হিরো মিয়া। থানার বড় স্যারের সোর্স। সন্ত্রাসীর মতো চেহারা। অপরাধীদের খোঁজখবর দেওয়া তার কাজ। এতে করে কামাইও কম করে না সে। ইদানিং গায়েগতরে ক্ষমতার প্রভাব দেখাতে থাকে সে। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। বড় স্যারের পোষ্য যে সে! হেদায়েতের দোকান থেকে প্রায় নিয়মিতই পান খায় হিরো। কখনো কখনো সিগারেট, কুলডিংসও। ইচ্ছা হলে টাকা দেয়, না হলে লেইখ্যা রাখিস বলে চলে যায়। হিরোর সাথে হেদায়েত বেশি কথা বলে না। কিন্তু এই বাকির দৌরাত্য চলতেই থাকে।
দুশ্চিন্তা- টেনশনে ঘুম আসো না তার। দোকানের পুঁজি কমছে। তারপর হিরোর মস্তানী। বৌয়ের সাথে কথাটা বলতে গিয়েও বলা হয় না। রাগে ক্ষোভে ভিতরে ভিতরে অস্থির সে। আজকাল টাকার দেবার কথা বললে হিরো রাগ দেখায়। হেদায়েত তবু বাকির টাকার কথা বলে। কিন্তু ইদানিং হিরো এক বন্ধু যোগার করে। সেও বাকিতে পান-সিগারেট খেতে থাকে। এসব বাকির অত্যাচারে দুচার কথায় প্রতিবাদ করে হেদায়েত। একদিন হিরোর সাথে কথা তুমুল কাটাকাটি হয়। হিরো ও তার বন্ধু মিলে ঝগড়া করে হেদায়েতের সাথে। এক পর্যায়ে দেখে নিবে বলে কড়া ভাষায় শাসিয়ে যায় হিরো।
ঠিক দু’দিন পর সন্ধ্যায় চার জন পুলিশ আসে। হেদায়েতকে ভোর বেলা তুলে নিয়ে যায়। অপরাধ অবৈধ অস্ত্র বহন করে হেদায়েত। দশমাস হলো কারা বন্দি হেদায়েত।
ফুলবানু একদিন বাজারে সস্তা সদাই করতে ব্যস্ত। হঠাৎ পিছন ফিরে দেখে হিরো মিয়া। রাগে ক্ষোভে ঘৃণায় ফুৎ করে হিরোর পায়ের কাছে পানের পিচকিরি ফেলে ফুলবানু।