প্রবন্ধঃ দস্তয়েভস্কির সাহিত্য – তত্ত্বে ও বিশ্লেষণে

প্রবন্ধঃ দস্তয়েভস্কির সাহিত্য – তত্ত্বে ও বিশ্লেষণে

দস্তয়েভস্কির সাহিত্য – তত্ত্বে ও বিশ্লেষণে
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ায় দস্তয়েভস্কি, তলস্তয়, তুর্গেনিভ ও চেকভের আবির্ভাব সমগ্র বিশ্বের কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। রাশিয়ার সাহিত্যের অঙ্গনে দস্তয়েভস্কির পদার্পণের আগেই পুশকিন ও গোগোল অবশ্য নিজস্ব ধারা গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। এই দু’জন প্রাথমিকভাবে ইংরেজি, ফরাসী ও জার্মান সাহিত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁরা স্বকীয় প্রতিভার গুণে নিজ নিজ সময় ও সমকালীন সমাজ সম্পর্কে সচেতন হয়ে কালজয়ী সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন। তাঁদের পাশাপাশি দস্তয়েভস্কি আধুনিক পাঠকের সবচেয়ে বেশি অন্তরঙ্গ হয়েছেন। এর কারণ উপন্যাসের শিল্পভাবনার সর্বাংশে আধুনিক যে ধারায় দোষ-গুণে ভরা রক্তমাংসের মানুষকে পূর্ণাঙ্গরূপে দেখতে চাওয়া হয়, তিনি সেই ধারাটির প্রবর্তক। তাঁর সাহিত্যকর্মের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল তা মানুষের জটিল মনস্তত্বের গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করে। অনেক সমালোচক মনে করেন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনস্তাত্বিক উপন্যাস রচয়িতাদের মধ্যে একজন। নরওয়ের মহাসাহিত্যিক ন্যুট হ্যামসুন তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন – “No one has analyzed the complicated human structure as Dostoyevsky. His psychologic sense is overwhelming and visionary.”
ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির জন্ম ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ১১ নভেম্বর, মস্কোয়। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি সেন্ট পিটার্সবার্গে তাঁর মৃত্যু। সমালোচকদের মতে রাশিয়ার সাহিত্যের স্বর্ণযুগের লেখকদের মধ্যে তিনিই পাঠকচিত্তে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছেন। ৫৯ বছরের জীবৎকালে তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন ‘Poor Folk’ (১৮৪৫), ‘The Double’ (১৮৪৬), ‘The Landlady’ (১৮৪৭), ‘White Nights’ (১৮৪৮), ‘The Little Hero’ (১৮৪৯), ‘Uncle’s Dream’ (১৯৫৮), ‘Friend of a Family’ (১৮৫৮), ‘The Insulted and Injured’ (১৮৬১), ‘The House of the Dead’ (১৮৬২), ‘Winter Notes on Summer Impressions’ (১৮৬৩), ‘Notes From the Underground’ (১৮৬৪), ‘Crime and Punishment’ (১৮৬৬), ‘The Gambler’ (১৮৬৬), ‘The Idiot’ (১৮৬৯), ‘The Eternal Husband’ (১৮৭০), ‘Demons’ (যা ‘The Possessed’ এবং ‘The Devil’ নামেও পরিচিত, ১৮৭১-৭২), ‘A Raw Youth’ (১৮৭৪-৭৫), ‘A Gentle Creature’ (১৮৭৬), ‘The Dream of a Ridiculous Man’ (১৮৭৭), ‘The Brothers Karamazov’ (১৮৮০) প্রভৃতি কালজয়ী রচনা।
‘Poor Folk’ (১৮৪৫) উপন্যাসটির মাধ্যমে রাশিয়ার সাহিত্যজগতে দস্তয়েভস্কির আবির্ভাব ঘটে। ১৮৪৯ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়, কারণ তিনি এমন একটি সাহিত্যগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যেখানে জারের রাশিয়ার সমালোচনা থাকার জন্য নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত বইপত্র আলোচনা করা হত। তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সেই দণ্ডাজ্ঞা বদলে যায়। তাঁকে চার বছর সাইবেরিয়ায় কারাগারে কাটাতে হয়, তার পর ছয় বছর বাধ্যতামূলক দেশান্তরে সামরিক বাহিনিতে কাজ করতে হয়। পরবর্তী বছরগুলোয় তিনি সাংবাদিকতার পেশা অবলম্বন করেন, কিছু পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং নিজের বিভিন্ন লেখার সংকলন গ্রন্থ ‘A Writer’s Diary’ প্রকাশ করেন। তিনি পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন এবং জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন, যার ফলে তাঁকে আর্থিক দুর্দশায় পড়তে হয়। জীবনে নানা ওঠা-পড়া সত্বেও ঘটনাচক্রে তিনি হয়ে ওঠেন স্বদেশের এবং বহির্জগতের সব থেকে বেশি পঠিত সাহিত্যিকদের মধ্যে একজন। ১৭০টির বেশি ভাষায় তাঁর বই অনূদিত হয়েছে। পরবর্তীকালের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের মধ্যে আন্তন চেকভ, আলেকাজাণ্ডার সলঝেনিৎসিন ও ফ্রানৎস কাফকা প্রমুখ তাঁর রচনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কাফকা বলেছেন দস্তয়েভস্কি তাঁর ‘blood-relative’। তিনি দস্তয়েভস্কির রচনা দ্বারা (বিশেষ করে ‘Crime and Punishment’ এবং ‘The Brothers Karamazov’) গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর ‘The Trial’ উপন্যাসে এই প্রভাব স্পষ্ট। দস্তয়েভস্কির ‘The Brothers Karamazov’ উপন্যাসটির সম্পর্কে সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেছেন – “The most magnificent novel ever written.” দার্শনিকদের মধ্যে জাঁ-পল সার্ত্র ও নীৎসে মুক্তকন্ঠে তাঁর রচনার প্রশংসা করেছেন। নীৎসে একদা দস্তয়েভস্তি সম্পর্কে বলেছিলেন তিনি হলেন একমাত্র মনস্তত্ববিদ – “ . . . from whom I had something to learn; he ranks among the most beautiful strokes of fortune in my life.”
পরাবাস্তববাদ, অস্তিবাদ প্রভৃতি আধুনিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবক্তারা দস্তয়েভস্কির প্রভাবের কথা স্বীকার করেছেন। অনেক সমালোচক তো মনে করেন দস্তয়েভস্কির হাত ধরেই অস্তিবাদের উদ্ভব হয়েছিল। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, সিগমুন্ড ফ্রয়েড, আয়ান রান্ড, হেরম্যান হেস, হুলিও কোর্তাজার সকলেই তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রসংসা করেছেন। জেমস জয়েস তাঁর রচনা সম্পর্কে বলেছেন – “. . . he is the man more than any other who has created modern prose, and intensified it to it’s present day pitch. It was his explosive power which shattered the Victorian novel with its simpering maidens and ordered commonplace; books which without imagination and violence.” আয়ান রান্ড মনে করতেন দস্তয়েভস্কি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুই ঔপন্যাসিকের একজন (অন্যজন ভিক্টর হুগো)। হেরম্যান হেস দস্তয়েভস্কির রচনার ভক্ত ছিলেন। হুলিও কোর্তাজার তাঁর ‘Hopscotch’ উপন্যাসে দস্তয়েভস্কির উল্লেখ করেছেন।

দস্তয়েভস্কির শিল্পীমানসকে বরাবরই প্রভাবিত করেছে সেই ধরনের মানুষজন যারা কোনভাবেই নিপাট গড়পড়তা বা পাঁচমিশেলী নয়। বরং সমাজ-সংসারে যারা ব্রাত্য, অপমানিত বা নিপীড়িত এমন শ্রেণীর মানুষ তাঁকে বেশি আকৃষ্ট করেছে। তাঁর শৈশবের অভিজ্ঞতা এর একটা কারণ হতে পারে। তিনি এক আশ্চর্য রকমের বিচ্ছিন্ন পরিবারের মধ্যে বড় হয়ে উঠেছিলেন। শৈশবে মাতৃহারা দস্তয়েভস্কি পিতার কঠিন শাসনের মধ্যে যেমন আত্মীয় বলে কাউকে পাননি, তেমনই পরিবারের বাইরে কাউকে বন্ধু বলেও মেনে নিতে পারেননি। পিতাকে তিনি কখনও শ্রদ্ধা করতে পারেননি, আবার তাঁকে অবহেলায় দূরে সরিয়ে দেওয়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাঁর প্রথম জীবন অতিবাহিত হয়েছিল এক নির্মম পরিবেশে, ব্যর্থ মানুষদের কাছাকাছি। তিনি সেই জীবনকে গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাই দেখা গেছে মানুষের অন্তঃকরণের দ্বন্দ্বমথিত রূপের চিত্র অঙ্কণে আগ্রহী এই কথাশিল্পী নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা ফুটিয়ে তুলতে প্রয়াসী হয়েছেন। তবে তা করতে গিয়ে নিজের তীব্র অন্তর্দাহকে তিনি উপেক্ষা করতে পারেননি। এই কারণেই তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা এক অসহায় যন্ত্রণার শরিক, এক তীব্র কালখণ্ডের অংশীদার। তারা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের চারদিকেই এক সংকীর্ণ পরিমণ্ডল রচনা করে।

দস্তয়েভস্কির বাল্য ও কৈশোর জীবনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি ও বাসস্থানের চিত্র তাঁর উপন্যাসে বিভিন্নভাবে ফুটে উঠেছে। ভালোবাসা পাবার ও দেবার সুগভীর আকাঙ্খা তিনি সারা জীবন অন্তরে বয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে সেই আকাঙ্খা কোনওদিন পূরণ হয়নি। পুশকিন, গ্রিবয়েদফ্, তুর্গেনিভ, সলতিকভ কিংবা তলস্তয় যে অভিজাত সমাজের প্রতিনিধি, প্রায় একই সময়ের হয়েও সেই ঐতিহ্যবাহী সমাজে তিনি প্রতিপালিত হননি। সেই বৈভবের স্পর্শ তিনি পাননি, সেই নিশ্চিন্ত কালখণ্ডের ছোঁয়াও তাঁর সত্তায় লাগেনি। তাই আমরা দেখি একদিকে তাঁর চরিত্রগুলি যেমন তথাকথিত সাধারণ চরিত্র নয়, অন্যদিকে তারা অভিজাত সমাজেরও নয়। অসম্ভব দুঃখ ও দরিদ্র্যের আগুনে পুড়ে তারা ধাতব কাঠিন্য অর্জন করেছে অথবা করতে চেয়েও পারেনি। আবার সুযোগ থাকলেও বিলাসের অদম্য জোয়ারে তারা কখনই নিজেদের ভাসিয়ে দিতে পারেনি।

দস্তয়েভস্কির সৃষ্ট চরিত্রেরা জীবনের সমগ্রতার শরিক। কোনও নৈতিকতার মাপকাঠিতে নয়, তারা নিজেদের অন্তর্দাহের তীব্রতায় এই সমগ্রতার অংশীদার। জীবনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে তারা এই সমগ্রতা অর্জন করে না। বরং তা করে জীবনের কেন্দ্রাতিগ ও বহির্মুখী শক্তি থেকে, তার যাবতীয় নেতিবাদ তথা নঙর্থকতার দিককে প্রত্যক্ষ করে। তারা বেড়ে ওঠে পৃথিবীর গভীরতম অসুস্থতায় ভুগে ও তীব্র কষ্ট ভোগ করে। তারা বেড়ে ওঠে সার্বিক অসহায়তার মধ্য দিয়ে এবং প্রচণ্ড স্ববিরোধীতায় ভুগে। দস্তয়েভস্কির কৃতিত্ব এইখানে যে তিনি মানুষের সজ্ঞানতাকে এবং তার সদাজাগ্রত চেতনাকে প্রত্যক্ষ করে সাহিত্যের পাতায় কার যথার্থ রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। সমালোচক জ্যাঙ্কো লাভরিন বলেছেন দস্তয়েভস্কি যা কিছু আবিষ্কার করতে চেয়েছেন তা মানব সত্তার কার্যক্রম ও মানুষের চেতনার মধ্য দিয়ে। সে জন্য তিনটি মুখ্য পন্থা তিনি অনুসরণ করেছিলেন যেগুলি চলেছিল চেতনার বৃহত্তম দ্বন্দ্ব-বিরোধে – অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, অপরাধ এবং ভোগান্তিতে। তিনি উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে চলতি সুখভাবকে এবং গড়পড়তা সাধারণ মানুষকে অপছন্দ করতেন।

দস্তয়েভস্কি যে গড়পড়তা সাধারণ মানুষদের সাহিত্যে স্থান দিতে চাননি তার ইঙ্গিত আমরা প্রথম উপন্যাস ‘অভাজন’ (‘Poor People’) থেকেই পাই। এখানে তিনি নায়ক দেশভুকিনকে চিহ্নিত করেছেন। তার মতোই ‘অপরাধ ও শাস্তি’ (‘Crime and Punishment’) উপন্যাসে তিনি মারমেলাদভ্ নামক এক কেরাণীকে চিহ্নিত করেছেন। যদিও এই চরিত্রদু’টি শিল্পোৎকর্ষের বিচারে তুলনীয় নয়, কারণ ‘Crime and Punishment’ উপন্যাসটিতে সংবেদনশীল স্রষ্টার শিল্পসৃষ্টি চূড়ান্ত মুহূর্তকে স্পর্শ করেছে। তর্কসাপেক্ষে এটি দস্তয়েভস্কির সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা এবং এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রাস্কলনিকভ একটি অসাধারণ সৃষ্টি। একইভাবে ‘The Idiot’ উপন্যাসের প্রোটাগোনিস্ট প্রিন্স মিশকিন পাঠকের মনে স্থান করে নেয়। তবে সাধারণভাবে বলা যায় একদিকে আত্মবিষাদ আর অন্যদিকে অনুভূতির তীব্রতা তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের চরিত্রগুলির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়।
মিখাইল বাখতিন তাঁর ‘Problems of Dostoyevsky’s Creative Art’ (১৯২৯) শীর্ষক প্রবন্ধে পাঠকদের সামনে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের সমালোচনার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। [এটি পরবর্তীকালে পরিমার্জিত আকারে ‘Problems of Dostoyevsky’s Poetics’ (১৯৬৩) নামে পুনঃপ্রকাশিত হয়]। তিনি ডায়ালগিজম, হেটেরোগ্লসিয়া, ক্রনোটোপ, পলিফনি, কার্নিভাল সংক্রান্ত তত্ত্বের মধ্য দিয়ে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করে রচনার বহুমুখী সম্ভাবনাকে খুলে দেখিয়েছেন। ডায়ালগিজম কেবলমাত্র একমুখী ক্রিয়া বা সংলাপ নয়, জগৎ সম্বন্ধে জানার ও জীবন সম্পর্কে পরিচিত হবার এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়াও বটে। জগতে চূড়ান্ত বোঝাপড়া বলে যদিও কিছু নেই, তবুও ব্যক্তির মধ্যে অনবরত বোঝাপড়া চলে। ঠিক তেমনই এক ব্যক্তি আর এক ব্যক্তির মুখোমুখি হয়, এক কালখণ্ড আর এক কালখণ্ডের মুখোমুখি হয়, এক পরিসরের সঙ্গে অনন্ত পরিসরের মোকাবিলা হয়। আপাতভাবে যা নেই, সেই দ্বিতীয় সত্তার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে জীবন, জগৎ ও সমাজে অনবরত টানাপোড়েন, ঘাত-প্রতিঘাত ও মিথস্ক্রিয়ায় চেনা-জানার বিরামহীন প্রক্রিয়া অহরহ ঘটে চলেছে।

পলিফনি বা ‘কন্ঠস্বরের নানাত্ব’ তত্ত্বটির উপস্থাপনায় বাখতিন বলেছিলেন যে এটি বহু কন্ঠস্বরের সম্মিলিত রূপ। আবার বহু কন্ঠস্বরের সমন্বয়ে তা গড়ে উঠলেও প্রতিটি কন্ঠস্বরই উপন্যাসের পক্ষে অপরিহার্য। কেননা প্রতিটি স্বরই মৌলিক, স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাধীন, অর্থাৎ লেখকের দ্বারা আরোপিত নয়। কেবলমাত্র প্রধান চরিত্র বা নায়ক চরিত্র নয়, যে কোনও চরিত্রের কন্ঠস্বরের মূল্যই তাই অন্যটির থেকে কম নয়। উপন্যাস তখনই মহৎ হয়ে ওঠে যখন এই চরিত্রগুলি স্রষ্টার অনুভূতির স্পর্শ পেয়েও তাঁর অধীনতায় না থেকে নিজস্বতায় বেড়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এক্ষেত্রে চরিত্রগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-নির্ভরতায় এবং নানা বৈপরীত্যমূলক স্বাধীন কন্ঠস্বরের বয়নের দ্বারা উপন্যাস পূর্ণাঙ্গ গঠনপ্রাপ্ত হয়।

সমালোচক লিন্ পিয়ার্স-এর মতে বাখতিন ক্রনোটোপ শব্দটি উদ্ভাবন করেছেন আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে। এর মাধ্যমে তিনি আক্ষরিক অর্থে বুঝিয়েছেন কাল ও স্থান। তিনি ক্রনোটোপ-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন এ হল সময়গত ও স্থানিক সম্পর্কের সহজাত সংশ্লিষ্টতা যা সাহিত্যে শৈল্পিকভাবে প্রকাশিত হয়। বাখতিনকে যে বিষয়টি আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট করে তা হল উপন্যাসের মধ্যে এই তত্ত্বের আলোকে তিনি সময় ও স্থানকে দেখতে পেয়েছেন। সাহিত্যগত শৈল্পিক ক্রনোটোপে স্থানিক ও সময়গত নির্দেশকগুলি অতি সুচিন্তিত একটি রূপের মধ্যে মূর্ত সমগ্রে মিশে যায়। এর ফলে সময় যেন ঘনীভূত রূপে প্রাণ পায়, পূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সময়ের আখ্যানও ইতিহাসের আন্দোলনের দিকে প্রতিবেদনশীল হয়ে ওঠে।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব বলে জগতে কোনও কিছুই ধ্রুব নয়, একটির সাপেক্ষে অন্যটি রূপান্তরশীল। অর্থাৎ জগত ও জীবনের কোনও কিছুই শাশ্বত নয়, একটা কিছুর পরিবর্তে অপর কিছুর রূপান্তর সর্বদা ঘটেই চলেছে। এখান থেকেই স্থান-কালের ধারণাটি গ্রহণ করে বাখতিন বললেন স্থান এবং কালও জড় বা স্থবির নয়, সেগুলিও একটি অপরটির সাপেক্ষে রূপান্তরিত হতে পারে। বরং উপন্যাসে সমগ্র বা সম্পূর্ণ চিন্তা ব্যক্ত হলে সময় ও কালের সীমাবদ্ধতা মোচন হয়ে পুনর্গঠিত হয়। এখানেই গাদামার-এর মতের সঙ্গে বাখতিনের মতের সাদৃশ্য দেখা যায়। গাদামার তাঁর হেরমেনেউটিকস-এ বলেছিলেন আমরা কোনও পাঠ্যকে বিচার করি এবং উপলব্ধির চেষ্টা করি আমরা যে সমাজ-সংস্কৃতির শরিক সেই সময়-পরিসরে তথা ক্ষেত্রভূমির প্রেক্ষিতে। কিন্তু একই সঙ্গে পাঠ্যটি এক পরিসরহীন কালের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অন্যদিকে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা কালখণ্ডটিও অতীত কালপরিসরের সঙ্গে সংযুক্ত। এভাবেই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে অনবরত এই ধরনের হেরমেনেউটিকস বোঝাপড়া ঘটে চলেছে। সমালোচক গার্ডিনার তাই যথার্থভাবেই বাখতিনের চিন্তাধারার সঙ্গে গাদামার ও হাবেরমাসের মতের মিলের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ভাষার সঙ্গে মানুষ ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। যে স্বর পরিমণ্ডলের মধ্যে মানুষ জন্মায়, সেই ভাষাতেই সে কথা বলে। আবার সেই ভাষাই মানুষকে লালন করে। কিন্তু অন্য দিক দিয়ে এই ভাষা বা স্বর মানুষের শাসন-পীড়নের অনুঘটকও বটে, কারণ স্বরের মধ্য দিয়ে সে অত্যাচারিতও হয়। আবার এই স্বরের মাধ্যমে একজন শাসিত মানুষ তার উপর দীর্ঘদিন ধরে ঘটে যাওয়া লাঞ্চনার প্রতিবাদও করে। অর্থাৎ স্বর যেমন একদিকে পীড়নের অন্যতম হাতিয়ার, অন্যদিকে তা পীড়িতের একমাত্র সম্বলও বটে। সুতরাং বহুস্বরের মধ্য দিয়ে স্বর পরিমণ্ডলের মধ্যেই নিজস্ব মর্যাদা অর্জনের লড়াই যেমন থাকে, তেমনই আধিপত্য, শাসন ও লাঞ্ছনার বিরুদ্ধেও কিছু স্বর রয়ে যায়। এই অর্থে বিচার করলে ভাষা বা স্বর-পরিমণ্ডলের মধ্যেই অনবরত এক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম ঘটে চলেছে। স্বরের এই অবস্থানকেই বাখতিন চিহ্নিত করেছেন হেটেরোগ্লাসিয়া বলে।

বাখতিনের কার্নিভাল সংক্রান্ত তত্ত্বটিও হেটেরোগ্লাসিয়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সংযুক্ত। কার্নিভাল আদতে এক উৎসব যার প্রকাশ উদ্দাম নৃত্য-গীতে, যা আদিম কৌম সমাজে তথা লোকায়ত সমাজে অনুষ্ঠিত হয়। একদিকে শাসক শক্তি অনবরত তার আধিপত্যকে কায়েম করতে চায়, আর অন্যদিকে শাসিত শক্তি সেই আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত এই তত্ত্বটিতে বাখতিন বলেছেন যে উৎসবের উদ্দামতার মধ্য দিয়ে লাঞ্চনার বিরুদ্ধে অবদমিত ও পীড়িত মানবচিত্তের যেন মোক্ষণ ঘটে। আসলে এই উদ্দামতার আড়ালে তীব্র সমাজ-সমালোচনা লুকিয়ে আছে, যাতে শাসকশক্তির উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত শাণিত ব্যঙ্গের কন্ঠস্বর শোনা যায়। সুতরাং আপাতভাবে যা লোকসংস্কৃতি, তার মধ্যে গভীরভাবে রয়েছে এমন কন্ঠস্বর যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাবান শক্তিকে লক্ষ্য করে প্রতীকী প্রতিবাদ জানানো হয়।

দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে জগত ও জীবন সংক্রান্ত ও নানা কন্ঠস্বরের মিশ্রণজাত যে বৈশিষ্ট্যগুলির উল্লেখ বাখতিন করেছেন তার আভাস ‘Poor People’, ‘Crime and Punishment’, ‘The Brothers Karamazov’ প্রভৃতি উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। তিনি চরিত্রসৃষ্টির সময় চরিত্রকে যেভাবে নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে দিয়েছেন তা কখনোই আরোপিত নয়। লেখকের লেখকত্ব থেকে তিনি চরিত্রকে দূরে রেখেছেন। আবার সচেতনভাবেই তিনি উপন্যাসে একটি বিভ্রম (বা illusion) বজায় রেখেছেন, কিন্তু তার মধ্যেই ভেসে এসেছে লেখকের কন্ঠস্বর। আসলে দস্তয়েভস্কির উপন্যাস কেবল বর্ণনা ও সংলাপের মিশ্রন নয়। তাঁর কাছে উপন্যাস হল এমন একটি শিল্প-মাধ্যম যেখানে অখণ্ড ও খণ্ডিত চৈতন্যের নানামাত্রিক দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সময় ও পরিসর চিহ্নিত হয়। তার সঙ্গে নানা স্তরগুলির সম্মিলনও ঘটে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর উপন্যাস আমাদের ‘হয়ে ওঠা’-কেই ব্যঞ্জিত করে, যদিও চূড়ান্ত ‘হয়ে ওঠা’ বলেও আবার কিছু হয় না। দস্তয়েভস্কির রচনাশৈলীর বিশিষ্টতায় এক জীর্ণ কাল-পরিসরে কুৎসিত ও কদর্য অস্তিত্বের মধ্যে যেমন বাখতিন কথিত হেটেরোগ্লাসিয়াকে শোনা যায়, তেমনই সেই সুনির্দিষ্ট পরিসর কিংবা কালও যেন্নন্ত কালপরিসরের মধ্যে মিশে যায়। ক্রনোটোপের এ হেন উপস্থিতির কারণে পাঠক তার নিজস্ব ক্ষেত্রভূমিতে দাঁড়িয়েও নতুনভাবে বিচারের গুরুত্ব উপলব্ধি করে। আধুনিককালের পাঠককেও এই বিষয়গুলিই ভাবিয়ে তোলে।

দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে স্বল্পকাল-পরিসরকে দেখানো হয়েছে, কিন্তু সময়কালের বিন্যাস শিল্পীর কুশলতায় নির্মিত। স্বল্প সময় পরিসরে যে নানা ঘটনার ঘনঘটা রয়েছে এমন নয়, তবে আমরা সেখানে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও গভীরতার পরিচয় পাই। তাঁর ‘Notes from the Underground’ উপন্যাসটিকে অস্তিবাদী (existentialist) সাহিত্যধারার একেবারে প্রথম দিকের রচনাগুলির অন্যতম বলে ধরা হয়। দস্তয়েভস্কির বিভিন্ন উপন্যাসের পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি রচনার প্রারম্ভেই পাঠককে চরিত্র সম্বন্ধে একটি ধারণা দিয়ে দেন। তার ফলে পাঠকের সঙ্গে চরিত্রের প্রাথমিক পরিচয় গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীকালে চরিত্রেরা যখন ‘হয়ে ওঠে’ তখন আগের ধারণার সঙ্গে সেই ধারণা পুরোপুরি বিপ্রতীপ হয়ে পড়ে। এই দুই প্রতিস্পর্ধী ধারণার ফলে অস্পষ্টতার সম্ভাবনা থাকলেও বরং বিপরীতটাই সত্য হয়, অর্থাৎ চরিত্রকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা স্পষ্টতর হয়। বাস্তব জীবনে আমাদের জাগতিক কাজকর্মের মধ্যেও এই ব্যাপারটিই অনবরত ঘটে চলেছে। আমরা চরিত্রগুলির বাহ্যিক সরল ব্যাপারগুলি দেখার চেষ্টা করি, তার আভ্যন্তরীণ গোপনীয়তার প্রকৃতিটি অনুধাবন করি না। কিন্তু চরিত্ররা সেই ধারণার সঙ্গে কয়েক যোজন দূরত্বে বিচরণ করে।

দস্তয়েভস্কি বিশ্বাস করতেন – “Each art corresponds to a series of poetic thoughts, so that one idea cannot be expressed in another non-corresponding form.” তিনি সচেতনভাবে রুশ সাহিত্যের প্রথাগত ধারাটিকে বর্জন করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাঁর চরিত্রগুলিকে আধুনিক সমাজ ও সময়ের শরিক করে দেখিয়েছেন যে তারা কেবল ধর্মীয় অনুশাসনের অন্ধ দাস হয়ে প্রতিটি কার্যকলাপকে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপে হয়েছে বলে মেনে নেয় না। তারা সেই সব কার্যকলাপের পর্যালোচনা করতে জানে। মানুষের মধ্যে কেবল গুণই নেই, অনেক দোষও আছে। আর সেই দোষ-গুণের জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করে লাভ নেই, কারণ মানুষই তার কর্মের জন্য দায়ী। আসলে তাঁর সজাগ দৃষ্টি পরিবর্তিত সমাজ, সময় ও মানুষকে এড়িয়ে কোনও দূর অতীতে নিবদ্ধ হয়নি। সমালোচক ম্যালকম জোনস অভিমত প্রকাশ করেছেন যে সমাজ সম্পর্কে দস্তয়েভস্কির মনোভাবে তাঁর সময়কালের এক উল্লেখযোগ্য মিল লক্ষ্য করা যায়। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর জগত এক সংকটের মধ্য দিয়ে চলেছে যেখানে পুরনো দৃষ্টান্তগুলি ঈশ্বরের ধারণার সঙ্গে যোগসূত্রে বাঁধা। ভাল কিংবা খারাপ যে জন্যই হোক, মানুষ যে দৃষ্টান্ত দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল তার পক্ষে উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারছিল না এবং যার মধ্যে পরস্পর-প্রতিযোগী বিকল্পগুলির এক বিশৃঙ্খল কলরব চলছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাহিত্য রচনা করতে গিয়ে তিনি প্রথাগত পথ ছেড়ে দিয়ে নতুন পথে হাঁটবেন বলে মনস্থ করেছিলেন। তাঁর উপন্যাস তত্ত্ব বা তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত নয়, নিবিড় পাঠে তা আমাদের হৃদয়ে এক বোধের জন্ম দেয়।

দস্তয়েভস্কির উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সমালোচক ম্যালকম জোনস বলেছেন আমরা যে যুগে বাস করি তার সঙ্গে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের জগতের অনেক কিছুই একইরকম মনে হয়। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর রচনা সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন – “There were things believable and not to be believed, but some so true that they changed you as you read them, frailty and madness, wickedness and saintliness, and the insanity of gambling were there to know.” দস্তয়েভস্কি ফরমায়েশি লেখা লিখতে চাননি, নিজের মতো করে লিখতে চেয়েছেন। পুশকিন ও গোগোল সারা জীবনে লিখেছেন কম, কিন্তু সেই লেখাই যেন সাহিত্যগুণে রত্ন হয়ে উঠেছে। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেই গোগোল সাহিত্যখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর সাফল্য একদিনে আসেনি। রাফায়েলও দ্রুত সৃষ্টি করতেন না। তিনি এক-একটি ছবি আঁকতে এক বছর বা তারও বেশি সময় নিতেন। দস্তয়েভস্কিও দীর্ঘ কৃচ্ছ্রসাধনা করে ও দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে অনেকটা সময় ধরে তাঁর তাঁর সাহিত্যের সৃষ্টিসৌধ নির্মাণ করতে চেয়েছেন। স্রষ্টা দস্তয়েভস্কি তাঁর সৃষ্টিকে গড়ে তোলার জন্য পাণ্ডুলিপির উপর অজস্র সংযোজন, পরিমার্জন করেছেন এবং প্রয়োজনে সেই পাণ্ডুলিপিকে আবার নতুন করে লিখেছেন। তাঁর সেই পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি, বিশ্বসাহিত্যকে তিনি বেশ কয়েকটি মণি-মুক্তো উপহার দিয়েছেন। ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর রচনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন – “Out of Shakespeare there is no more interesting reading.”

গ্রন্থঋণ : –
১. Dostoevsky : A Study – Janko Lavrin, The Macmillian Company, 1947।
২. Dostoyevsky : The Novel of Discord – Malcom V. Jones, Paul Elck, London, 1976।
৩. Reading Dialogics – Lynne Pearce, Oxford University Press, 1992।
৪. Dostoyevsky – John Jones, Oxford University Press, 1985।
৫. Dostoyevsky After Bankim – Malcon V. Jones, University of Nottingham, Cambridge University Press, 1990।
৬. Man and His Tragic Life Based on Dostoevsky – Laszlo Vatai, Philosophical Library, 1981।
৭. উপন্যাসের নানা স্বর – প্রসূন ঘোষ, এবং মুশায়েরা, কলকাতা, ২০০৫।
৮. লেখকের লেখক দস্তয়েভস্কি – যজ্ঞেশ্বর রায়, রামায়ণী প্রকাশ ভবন, অগ্রহায়ণ ১৩৮০।