গল্প: গুহাচিত্র

গুহাচিত্র
অজিত কুমার রায়
নায়েমের ফার্স্ট গেটের দিকে এগুচ্ছি। বাঁ দিকে থাকছে ছোট ছোট হলরুমগুলো। ডানদিকে ফুলের বাগান, একটা স্কোয়ার। সারা বছর নানা জাতের ফুলে হেসে কুটি কুটি হয়ে থাকে। পাশ দিয়ে গেলে মনের ভেতরটা তাৎক্ষণিকভাবে উড়তে শুরু করে খোলা হাওয়ায় এককালের ঢাকাই মসলিনের মতো। আকস্মিকভাবে কানে এলো ঝরনার শব্দ। ভারি ভাল লাগার মত। কিন্তু কোথায় ঝরনা? কংক্রীট করা চত্বর। মহিমান্বিত গেট। অত্যাধুনিক অস্ত্র হাতে দুজন প্রহরী। আর পাশে একটি মেয়ে বকুলের পাপড়ির মতো যার দাঁতগুলো ঈষৎ অনাবৃত। কথা বলার নান্দনিক ভঙ্গি। যখন কথা বলছে স্বত:স্ফূর্ত ঝরনা প্রবাহিত হচ্ছে সিমলার উঁচু পাহাড় থেকে যেন। তার পাশে হয়ত তার ছোট ভাই, তার জাফরান রং এর কামিজের প্রান্ত ধরে আছে। অদ‚রে বাবা-মা ও সাথে একটা বক্স হারমোনিয়াম। মনে হল বেড়াতে এসেছি কোথাও পাহাড়ি নির্জনতায় অসংখ্য ফুল আর পাতার উৎসবে। আস্তে আস্তে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলাম গেট দিয়ে নায়েম রোড ধরে। ডানে ঢাকা কলেজ, বামে গভর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল। জনস্রোতের দিকে অসংখ্য গাড়ির হর্ণ, অসংখ্য মানুষের কলরব। দুঃসহ ধোঁয়া ও ধূলো নিমেষে ব্রাশ করে সরিয়ে দিলো মোহন দৃশ্যটুকু মনের ক্যানভাস থেকে। সারা দিনের জার্নি। মনটা বেশি ক্লান্ত ছিল শরীরের চেয়ে। অফিসিয়াল কাজে ঢাকায় আসা। প্রজাপতি ওড়া অপরাহ্নটা ক্রমে বুজে আসছিল রসহীন ফুলের পাপড়ির মত। যন্ত্র শকটের মত কখন যেন সব কিছু পার হয়ে এসে পড়েছি বি.এড. কলেজের গেটে। সামনে নাতিপ্রশস্ত অনিন্দ্য ফুল চত্বর। সেটি বায়ে রেখে অভ্যর্থনা কক্ষে আসি প্রযুক্তি উন্নয়ন কেন্দ্র হোস্টেলে। ভিআইপি সিংগেল রুমের ব্যবস্থা হল। ব্যাগটা ক্যারি করে উপরে উঠছি। পাটা পেছনের দিকে এলিয়ে পড়তে চাইছে ক্লান্তিতে। আবার সেই খল খল ঝরনার শব্দ। এমন অমলিন হাসির প্রবাহ হয়ত জীবনে এই প্রথম দেখছি। সেই অষ্টাদশীর সাথে এবার চোখাচোখি। তার চোখে ভরা আষাঢ়ের গতিষ্মান মেঘমালা। মনে হল গঙ্গোত্রীর ছন্দে নৃত্যশীল পাহাড়ি কন্যা সে। দূর যেন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তার গা ছুঁয়ে। যৌবন কুসুমিত প্রথম বর্ষার স্পর্শে। অনাঘ্রাত বনফুলটির পাশ দিয়ে আবার চলে যেতে হল পাহাড়ি পথের মত ধাপে ধাপে সিড়ি ভেঙে উঁচুতে বরাদ্দকৃত রুমের দিকে। এবার সে তাকিয়ে থাকে। অনেক ব্যঞ্জনা সেখানে সাদা মেঘের মত পুঞ্জীভূত হয়ে যায়।
কোন কথা বলা হয়নি। কিভাবে শুরু করা যেতে পারে ভাবাও হয়নি। তার চাউনির রহস্য খুঁজতে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড পর্যটনের প্রয়োজন। দোতলায় রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। বাথরুমে গিয়ে একটা নিবিড় চান সেরে নিলাম। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। কদিনের দীর্ঘ জার্নির স্ট্রেইন শরীরে। একবার মনে হল একটু ঘুরে আসা যাক ঢাকা কলেজ হয়ে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠে নি। অবসাদে শরীর এলিয়ে দিই বেডে। চোখের পাতা এক করতেই একটি বর্ষা ভেজা সুরভিত ফুল পাপড়ি মেলে কোথাও এসে যায় দাঁড়িয়ে। মুখে ভোর লেগে থাকে তার অনুক্ষণ। এমন নিবিড়তা কোন অবয়বে জীবনে কখনও দেখেছি কি? বিনিদ্র কাটে শেষ বিকেলের একান্ত শয্যা। রাতে বের হই খেতে নায়েমের ডাইনিং এ। অনেকটা নিজস্ব পরিবেশ। ভরপেট খেয়ে আবার এসেছি সিড়ির মুখে। আবার সেই শতধার নির্ঝরিণী! গাইছে সুরেলা কণ্ঠে, ‘আমি চিনি গো … বুকের ভেতর খটকা লাগে। শ্রোতা রয়েছে, শোনা যাচ্ছে তাদের স্তুতি। হলরুমের দরজা ফাঁক করলাম কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে। গাইছে গান অষ্টাদশী সেই কুমারী। এবার রূপসার জোয়ার উপচে উঠেছে যেন। তার কণ্ঠে দূরের কোন পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত সুর। গান থামায় নি সে। দৃষ্টি তার বড়ই অকৃত্রিম। হেমন্তের নতুন ধানের ঝিলিক ছিল তাতে।
চট করে দরজা বন্ধ করে এলাম রুমে। নিজেকে প্রশ্ন করি, একি নিজের ভ্রম? কেন এমন হচ্ছে? বার বার দেখা হচ্ছে। বার বার সজল চোখের রহস্যঘন চাউনি। কিছু বলবে কি? কিই বা বলার আছে? কি মূল্য আমার? কিছু বিশেষত্ব চোখে পড়ার মত? কোথাও কি ছিল পূর্ব পরিচয়? বিশেষ কোন সমাধান খুঁজে পাই না এসব প্রশ্নের। বুঝতে পেরেছি মনে একটা উথালপাথাল শুরু হয়েছে। কিন্তু কেন? সত্যিই কি তার কিছু বলার আছে? জীবনটা কলরবময়তা থেকে ক্রমে ক্রমে দুঃসহ নির্জনতার দিকে কেন যাচ্ছে? ক্রমেই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছি এত বন্ধু পরিজনের ভেতরও। এমন কুজন নির্জন সময়ে সুখদায়ীও হতে পারত! তবে কি সুযোগমত কথা বলে নেব একবার? কোত্থেকে এল ওরা আকস্মিকভাবে? কোন প্রোগ্রাম আছে কি বিশেষ?
সেই কবে চলে গেছি বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে। তারপর দেশ বিদেশ। সীমাহীন ব্যস্ততা সন্তোষজনক চাকরি ও স্টেটাসের অনুষঙ্গে। কখন যে তারুণ্যের ঢেউগুলো আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এসেছে বুঝতে পারিনি। হঠাৎ কেন এই ঢেউ? কেন আকস্মিক হাওয়ার দিক বদল? শিউলি ফোটা ভোর কবে গেছে অতীত হয়ে। বুয়েটের প্রথম বর্ষের একজনের সাথে নিবিড় দিনগুলো মনে পড়ে কখনও কখনও মেঘের ফাঁকে চিকচিকে রোদ্দুরের মত। কোথায় হারিয়ে গেল সে সব। তার মুখ বেশ মনে পড়ে- মোহনীয় সন্ধ্যামালতি, বর্ষাভেজা। সামান্য অভিমানের কারণে আর কখনও দেখা হয়নি তার সাথে। দ্বিতীয়বার কখনও দেখা করার চেষ্টাও করিনি আমি আর। অহংকারবোধ হতেও পারে সেটা আমার । ভাল রেজাল্ট, ভাল চাকরি, সামনে বসন্তের হাতছানি। কিন্তু সেও ত একবার আসতে পারত ফিরে। কোথায় সে আজ?
রুমের ভেতর গিয়ে আবার গা এলিয়ে দিই শয্যায়। এবার নেমে এল চোখে রাজ্যের ঘুম। দরজায় নক, ঠক্ ঠক্ ঠক্। এমনি কি প্রত্যাশা ছিল সে আসবে আসর শেষ করে? ধড়মড় করে উঠে খুলে দিই দোর। সেই আয়ত চোখ- আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন কোন নদী। তাকিয়ে থাকে সে। আমি এই চোখের ভেতরে দেখি অনন্ত অনুভূতি, সীমাহীন পুঞ্জিত আকুতি, কামনা ও শব্দহীন ভাষার প্রতুলতা।
পাশে এসে বসে পড়ল সে। তখন চারিদিক নিরব, নিদ্রিত। একক প্রকোষ্ঠে দুজন সংগীহীন মানুষের কাছে আসা ও হৃদয়ের তটরেখা ছুঁয়ে থাকা। দীর্ঘ সময় ছিল সে আমার কাছে। কিছুই বলা হয়নি। শুধু তাকে পেয়েছিলাম একান্ত করে নিবিড় সময়ে অতি কাছে। এতটুকু পাওয়ার পর পৃথিবীর আর কোন প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা থাকে না। কোন দূরবর্তী অথবা নিকটস্থ ঘনীভূত কামনার গন্ধ ভাবনার মধ্যে বসতি গড়তে পারে না এমনই এক নিবিড়তা। কি বলব ভাবছি। হাতটা নেব হাতে? একটু সোহাগ করে আরও নিবিড় হই? কোনও দ্বিধা হয়ত তার এখন আর নেই। যখন চলে এসেছে গুটিসুটি সন্তর্পণে হৃদয়ের ডাকে হৃদয়ের খুব কাছে। সুনসান চারদিক। কখনও ভেবে দেখে নি সেও, ভাবিনি আমিও কি পরিণাম হতে পারত কেউ জেনে গেলে আজকের এই রাতের কথা।
হঠাৎ দোয়েলের ডাক। চোখ খুলে দেখি শুয়ে আছি একা। দরজা বন্ধ ভেতর থেকে। ভোর হয়েছে। তাহলে? আসে নি কি সে?
সূর্য এখনও ওঠেনি। কুসুম ভোর। মনের মধ্যে দুর্ভেদ্য কুয়াশা জমেছে। একটা আরব্য রজনী অর্থহীন ও বিরক্তিময় ভোরে পর্যবসিত হয়েছে অবশেষে।
দরজায় নক। চমকে গেলাম মনে মনে। এবার জেগে আছি ত? হ্যা, জেগেই ত আছি। চিমটি কেটে দেখি ত্বকে। এবার কড়া নড়ে উঠল। স্বপ্ন নয় সত্য এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। সেই অষ্টাদশী। কোন প্রশ্ন মুখে আসে না আমার। আমি বিস্ময়ের আনন্দ উপভোগ করছি।
কেমন আছেন?
কথা বলতে পারলাম না।
বলছি আপনি কেমন আছেন? মেয়েটি হাসল সূর্য ওঠা সকালের মত পরিচ্ছন্ন ও কুয়াশামুক্ত এক্কেবারে।
ভা-লো বিস্ময়মিশ্রিত উত্তর ছিল আমার।
চিনতে পেরেছেন কি? আমি চিত্রা।
চিত্রা? অবুঝের মত প্রশ্ন করি।
ভুলে গেছেন এত দিনে? স্বোপার্জিত স্বাধীনতার পাশের কেন্টিনে আপনার সাথে একদিন কফি খেয়েছিলাম কবছর আগে এক সন্ধে বেলা?
মনে থাকাটা কি স্বাভাবিক? জরুরি কি? জিজ্ঞেস করি।
না, তা নয়। মানে দুজন সুন্দরী মেয়ের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্টিনে একটি নিবিড় সন্ধ্যা, মনে দাগ কাটার মত নয়? কৌতুক মেশানো হাসি হাসতে থাকে চিত্রা। নামটা মনে পড়ছে না। তাহলে সে নতুন অভিজ্ঞতা নয়। অতীতের ক্ষীণ বিদ্যুৎরেখা।
বুয়েটের বিশেষ কোন স্মৃতি আছে মনে ? আমার মুখের দিকে তাকাল সে অনুসন্ধিৎসু চোখে।
মনে হয়েছে ভীষণ ভাল মানুষ আপনি। ভাল লাগার মত একজন মানুষ। বড়ই একাকী। সংস্কৃতির প্রতি দুর্বলতা আছে আপনার।
গত সন্ধ্যায় তার গানের কথা মনে পড়ল। আবার চমকে উঠলাম।
কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। দরজার পাল্লাটা আরও একটু খুলে এবার ঢুকে পড়ল আরও একটা বিস্ময়! যেন হাজার বছর আগের খোদিত গুহাচিত্র! কোন বদল নেই। শুধু একটু সময়ের মলিনতা ছাড়া।
আমার চোখ জুড়ে এসে দাঁড়াল প্রথম বর্ষের সুদর্শনা। ইউক্যিালিপটাসের ছায়ায় আমরা কতদিন …। চমকে উঠলাম আমি। মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এল, সুদর্শনা! ওর চোখ জলে ভরে এল।