গল্প:গেরবাজ

গল্প:গেরবাজ

গেরবাজ
দীলতাজ রহমান

: নয়না কেমন আছে রে জেসমিন? জানিস?
: তা নয়নাকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নাও না! আমি তো ওকে এড়িয়ে চলি জানো না?
: কিন্তু তবু তো তোরা একই এলাকার মানুষ! তাই ওর খবরটা অন্তত জানবি ভেবে তোকে ফোন দিলাম। করোনা আমাদেরকে কেমন কুঁচকে ফেলেছে। তারপরও মনটা কেমন করছিলো। তাই ভাবলাম দূর থেকে ওর খবরটা অন্তত জানি…।
: তাহলে শোনে, নয়না এখন আবার বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছে…। আর তার বাপও নিজের জন্য পাত্রী খুঁজছেন। অথচ ছ’মাসও হয়নি ওর মা মারা গেছেন!’ কথা ক’টি বলে জেসমিন নয়নাদের বাপ-বেটি দু’জনের আপাতত অবস্থার দীর্ঘ শানেনজুল বয়ান করতে লাগলো। কিন্তু সে সব কথা জুলেখার কানে ঢুকলো না। একসময় প্রসঙ্গ এড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ সাধারণ কথাবার্তা বলে ফোন রেখে দিতে দিতে স্বগোক্তি করলো সে, ২০২০এর এখন মে মাস চলছে। এই বছরটি পুরোই এমনি ভয়াবহ যাবে কি না…।
০০০
বাবা-মেয়ে একসাথে বিয়ের জন্য পাত্রী-পাত্র খুঁজছে। মেয়ে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। বাপও সত্তুর পেরিয়ে। কেমন হাস্যকর বিষয়টি। যদিও নয়নার বাবার এখনো যেন পেটানো শরীর। মনের দৃঢ়ভাবও চোখে-মুখে ঠিকরোয়। গল্প-কথায় প্রজ্ঞার ছাপ। ওটুকুর জন্যই যে কারো তার কাছে মাথা নুয়ে আসে। নয়নার বাসায় মাত্র একবার দেখে সেই থেকে জুলেখারও তার প্রতি সমীহভাবটা মনে জেগে আছে।
কিন্তু দীর্ঘদিন অসুস্থ স্ত্রী’র সেবার ধকল এবং স্ত্রী মারা যাওয়ার পর নিজেকে তিন ছেলেমেয়ের তিন বাড়িতে টানা-হেচড়াটা শরীরের থেকে আখতারুদ্দিনের মনেই আঘাত দিয়েছে বেশি।
আরো পাঁচ-দশ বছর আগে হলে জেসমিনের গল্পটুকু নিয়ে জুলেখা নিজেই হয়তো হেসে কুটিকুটি হতো। ডেকে জনেজনে ঘটনাটিতে নিজের মতো রস যুক্ত করে হয়তো বলতোও। কিন্তু এখন সে আর এটা করতে পারে না। কারণ এখন সে দেখতে দেখতে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে। নিজে সংসারের বড় সন্তান হওয়াতে বাবা-মা’র সাথে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে একটা সময় থেকে তার লাবণ্য কমতে থাকে, যে কাঁচা লাবণ্য প্রথম দর্শনেই পাত্রপক্ষকে আকৃষ্ট করে। তারপর তাকে দেখতে আসা এক পছন্দসই পাত্রপক্ষ তাকে রেখে পছন্দ করে ফেলে তার ছোটবোন রেখাকে। যে কিনা তার থেকে চার বছরের ছোট। মা-বাবা সে পাত্রপক্ষকে ধিক্কার দিয়ে তাড়িয়ে না দিয়ে, এমন কি জুলেখাকে একটিবার জিজ্ঞেসও না করে ঠিকই রেখাকে সেই পাত্রের সাথে বিয়ে দেন। অথচ জুলেখা তখনও এই চাকরিই করতো। তবে তখন সে এই ব্যাংকে ঢুকেছিলো শিক্ষানবিস হিসাবে। এখন সে সিনিয়র অফিসার। তবু অসীম অনীহা নিয়েও তাকে সেই বাড়িতে, সেই মা-বাবার কাছেই থেকে যেতে হয়েছে। কারণ জুলেখা অনেক ভেবে দেখেছে, সে বাড়ি থেকে সরে গেলে পরিবারটি আর্থিক স্বচ্ছলতা থেকে যেমন বঞ্চিত হবে, তেমনি ছোট ভাই দুটোরও মনে মা-বাবার আপসকামী মনোভাব দাগ ফেললে উচ্ছন্নে যাবে। কেউ কাউকে শাসন করার অধিকার পাবে না। নীলকন্ঠের মতো জুলেখা তাই সব বিষ হজম করে দায়িত্বগুলো পালন করে গেছে। আর পলে পলে এও বুঝেছে, দায় যে বোঝে, দায়িত্ব কেবল তাকেই ছাড়ে না।
০০০
রেখার বিয়ের পর থেকে মা-বাবা যে তার বিয়ের জন্য চেষ্টা করেননি তা নয়। তারও কতজনের সাথে কতবার কিছুটা করে সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। কিন্তু বন্ধুত্বের সীমারেখা যখনি টপকে কেউ জুলেখাকে বিয়ের কথা বলেছে, অমনি সে ডুব মেরেছে। এমন নীরব দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে, যে সেটা টপকে কেউ-ই আর ওর কাছাকাছি হতে পারেনি। কারণ তাদের অনেককেই জুলেখার বন্ধু হিসাবে ভালো লাগলেও জীবনসঙ্গী হিসাবে কাউকে ভালো লাগেনি! হয়তো ততদিনে তার চাওয়াটা গড়পরতা হিসেবের বাইরে গিয়ে অন্যধাঁচে রূপিত হয়েছে। এমনটি করে করেই বয়স সে পঞ্চাশ ছুঁয়ে ফেলেছে।
০০০
জীর্ণ গলির ভেতরে দু’কাঠা জমিতে পুরনো দিনের সেমিপাকা বাড়ি জুলেখাদের। বাড়িটি তার বাবা নিজে তৈরি করাননি। সস্তা পেয়ে তিনি পুরনোই কিনেছিলেন। এখন সেই বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার বেশ বড়সড় রুমটিতে তাদের পুরনো খাটের পাশে জুলেখা নিজের জন্য একখানা আধুনিক সিঙ্গেল খাট পেতে শোয়।
দলিল-দস্তাবেজ, মাঝারি দামের কিছু জিনিস-পত্র আর মা’র ক’খানা গহণা, ওইটাই এখন তার অর্ধেক জগৎ। তবে সে নিজেকে ওসবের পাহারাদার মনে করে না। জুলেখা তার মা-বাবার নিরাপত্তার জন্যই রাতে তাদের কাছে থাকে। আর দিনে তো তার কোথাও নিজেকে এতটুকু স্থির রাখবার ফুরসতই নেই। তার ওপর চাকরির পাশাপাশি শখ করে দু’একটি ছেলেমেয়ে পড়ায়।
তবু এই দুইকাঠা জায়গাজোড়া সেমিপাকা বাড়িটির বাকি অংশ দুই ভাই তাদের দুই বউ ও শিশু পুত্র-কন্যা নিয়ে মুখর করে রাখে। আর সেই উত্তাপে উষ্ণ থাকে মা-বাবার মরণোন্মুখ প্রাণ। এটাই এখন জুলেখার স্বস্তির বড় দিক। তবে রেখা স্বামী সন্তান নিয়ে এর ভেতর ক’দিন করে থাকতে এলে অন্য সবাই আনন্দিত হলেও তার খুব অসুবিধা হয়! যদিও জুলেখা বোঝে পৃথিবীর নব্বই ভাগ মানুষই রেখা ও সেলিমের মতো। দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেলে আর কোনো প্রশ্ন তাদের মাথাচাড়া দেয় না! আর এ জন্য সেলিমের থেকে রেখাকে দেখলেই জুলেখার মেজাজ রুক্ষ্ম হয়ে ওঠে। বড় বোনকে বাদ দিয়ে যে সেলিমরা ওকেই পছন্দ করেছিলো, সেই সূক্ষ্ম গরিমাটা জুলেখা আজো তার প্রতি রেখার ভেতর দেখতে পায়। নাকি এটা তার ভুল, সে বিষয়টি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না!
ভুল হয় হোক। তবু নিজের বোন বলেই হয়তো তাকে বুঝিয়ে দেয়া হয় না, সেলিমের থেকে অনেক ভালো ভালো পাত্রকেও সে পরবর্তী সময়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছে! আসলে বৃহত্তর শান্তি রক্ষার জন্য কোনোরকম প্রতিশোধপরায়ণাতাই তার আলাদা করে পরিবারের কোনো একজনের প্রতিও জেগে ওঠে না। কারণ সে জানে, পরিবারের একজন অসুখি হলে তার সাথে সবার শান্তি নষ্ট হয়!
এভাবে এমন এক হিসেবের জীবন যাপনের ভেতর দিয়ে সাধারণের কাছে তৈরি হওয়া বিন্দু বিন্দু গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে তাকে সবখানে হতে হয়েছে কেবলি এগিয়ে চলা এক মানুষ! এতে করে চারপাশের মানুষের অবস্থাকেও সাধারণ চোখে অন্যেরা যতই ভজখট দেখুক, জুলেখা ঘটনার অন্তরালের বিষয়টির সাথে নিজেকে এক করে ফেলে এবং মনে করে, চলতে চলতে নদীর মতো জীবনও গতি পাল্টাতে চায়! নদী সে যে পথে যায়, তার ধারেকাছে আর কোনো পথ, কোনো ছায়াবীথিও সে রাখে না। প্রান্তর, লোকালয় সামনে যা থাকে সব ভেঙেচুরে বয়ে চলে যায়। কিন্তু মানুষ নদীর মতো অন্ধ নয় বলে নিজেকে রক্তাক্ত করেও তাকে থামতে হয়। নদীর পুরোটাই একহারা শরীর বলে সে বাঁধনহারা! কিন্তু মানুষের হাত আছে বলেই তাকে অনেক ধস দু’হাতে ঠেকাতেই হয়! তাই সবাই যাকে কোনঠাসা করে রাখে জুলেখা কী করে যেন স্ব-ইচ্ছায় ধীরে ধীরে তারই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে! নয়নার সাথেও ওর ভাবটা তেমনভাবেই জমেছিলো। একটা সময় থেকে নয়নাকে যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠান-আড্ডায় দেখা শুরু করলো, তখনই মনে পড়ে গেলো, ওকে তো কোথায় একটা বুটিক হাউসে দেখেছি…! তারপর ওর প্রতি আরেকটু মনোযোগী হতেই টের পেলো ওকে নিয়ে মানুষ ফিসফিসিয়ে কী যেন বলছে। তবে চল্লিশোর্ধ নয়নার চোখেমুখে কীএক মায়া ঠিকরোয়। জুলেখা একদিন ওর এক বন্ধুর একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে গিয়েছিলো পাবলিক লাইব্রেরীতে। সেখানেও সে নয়নাকে দেখে। ওরা বসেও ছিলো সেদিন পাশাপাশি। অনুষ্ঠান শেষ হলে অনেকেই যখন ক্যাফেটেরিয়ার ঢুকে জাঁকিয়ে বসেছে, নয়না তখন ক’জনকে নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে কথার তুবড়ি ফোটাচ্ছিলো। তবে নয়না কথা বলে ধীরে ধীরে। সেদিন পাশাপাশি বসার সূত্র ধরে জুলেখা নিজের সাথে নয়নার জন্যও এককাপ কফি নিয়ে ওর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। সেই ছিলো ওদের দুজনের অন্তরঙ্গতার সূত্রপাত!
তেমনি আরেক কারুশিল্পী জেসমিনের সাথেও আলাদাভাবে আলাদা কোনো স্পটে ভাব বিনিময় শুরু হয়েছিলো জুলেখার এবং তৃতীয় কারো কাছে জেনেছিলো নয়না ও জেসমিন একই এলাকার মানুষ। তবে ভাব নেই ওদের দুজনের মধ্যে। আগে ছিলো। কিন্তু জেসমিনের হাজবেণ্ডের সাথে নয়না কি সব গোপন বিষয় নিয়ে পরামর্শ করতে যখন তখন যোগাযোগ করে। বাসায়ও যায়। জেসমিন না থাকা অবস্থায়ও গেছে এটা শুনে জেসমিন স্বামীর সাথে খুব উচ্চবাচ্য করেছে। এ নিয়ে মারও খেয়েছে। কিন্তু জুলেখা এসব জানে বা তারা দুজন একই এলাকার মানুষ এটাও জানে, সে কথা সে দু’জনের কারো কাছে কখনো কোনো প্রসঙ্গে উল্লেখ করেনি। কিন্তু বেশ ক’দিন ধরে নয়নার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে, ফেসবুকেও তার কোনো আপডেট না দেখে, এমন কি ফোনও বন্ধ পেয়ে নিজের অজান্তে জুলেখা জেসমিনকে ফোন করেছিলো।
০০০
নয়না একবার নয় তিনবার বিয়ে করেছে। দ্বিতীয় বিয়ের ফসল তার একমাত্র ছেলে সিয়াম। ভালো স্কুলে লেখাপড়া করানো থেকে গান, ছবি আঁকা, অভিনয়, মুকাভিনয় কতকিছু শিখিয়েছে নয়না তাকে। একটু অবসর পেলে তো এখনো সে ছেলেকে নিজের সাথে লেপটে রাখে। পারলে সবখানে তাকে নিয়েই যায়, এটা তো জুলেখা নিজেও দেখেছে। আরো এও দেখেছে, ছেলে যত বড় হয়েছে, ততই তার বাবার দিকে ধেয়েছে। ছেলের শিশুকালটা যদিও নিজের করাল থাবার ভেতর রেখেছিলো নয়না। কিন্তু ছেলে কৈশরে পা দিলে অনিয়মিত হলেও সে তার বাবার সাথে দেখা করতো। জুলেখার সাথে যখন থেকে নয়নার পরিচয়, তখনো পর্যন্ত নয়নার তিন বিয়ের কথা না জানা হলেও ওই এক ভুল স্বামীর দিকে আঙুল তুলে জুলেখা বলেছিলো, দেখ নয়না, কার দোষে তোদের সংসার ভেঙেছে আমি জানি না! তবে তোর জায়গায় আমি হলে কখনো ছেলেকে তার বাবার সাথে দেখা করতে দিতাম না। যে কিনা ছেলের শৈশবে খোঁজ নেয়নি। তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে! এ বিষয়ে কখনো তুই কিছু বলিসনি। কিন্তু আমি এটা বুঝি, একজন নারীর সংসারের ভেতর নাভীশ্বাস না উঠে গেলে সে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসে না!
: একদিন তো ছেলে উড়ে চলে যাবেই। আগে থেকে ঠেকিয়ে লাভ কি! বন্ধু-বান্ধবের কাছে তারও তো উত্তর দেয়ার কথা থাকতে হবে জুলেখা’পা!
: ছেলে যাবে মানে? তুই যেতে দিবি কেন? আর তার আবার কথা কি, সন্তান নিয়ে মা কি একা থাকতে পারে না!
: শোনো সিয়ামের বাবা যথেষ্ট বিত্তশালী। ওই তো তার একমাত্র উত্তরসূরী। তাই একদিন সেই বিত্তের টানেই সিয়াম যাবে। আমার কী আছে বলো? আমার এখন দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের মতো অবস্থায় ঠেকেছি। আর ছেলের চোখ-কান ফুটে গেছে। অত কৈফিয়ত চাইতেও তো ভয় করে! জানো না, সংসারের সব দোষ মেয়েলোকের! আর তাকে একটু স্বাধীনতা না দিলে আমিই বা পাই কি করে!
: সেটা ঠিক। কিন্তু তোর কি আছে মানে? তোর ঘর ভাঙার মতো তেজ আছে। শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রীটি অর্জন করা আছে! পরিচিতি আছে! নাকি তুই চাস্ তোর ছেলে ফাঁকতালে তার বাবার সম্পত্তিটা পেয়ে যাক, যা তুই উগরে এসেছিলি?
: রুখো, রুখো, আমার যে তেজকে তুমি তেজ হিসাবে দেখছো। পরিচিতি দেখছো, জানো না মেয়েমানুষের ওটাই আসল দোষ হিসাবে দেখা হয়। আসলে সংসার টিকিয়ে রাখতে হলে ঘেন্নাপিত্তি, স্বাধীনচেতা মনোভাব, স-ব ছেঁটে ফেলতে হয়। নাহলে প্রতিদিন সংসার ভাঙার মতো দুর্ঘটনা আরো ঘটতো।’
জুলেখাদের ভ্যাপসা অথচ দুই ভাইবউয়ের সাজানো সুদৃশ্য ড্রয়িংরুমে কার্পেটের ওপর কাঁথা বিছিয়ে, কোলবালিশে হেলান দিয়ে ওরা বসেছিলো। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গড়াগড়ি করে, বউদের বানানো নানান সুস্বাদু খাবার খেয়ে গল্প করতে করতে জুলেখাকে সেদিন আর কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করতে হয়নি। নয়না নিজেই বলতে থাকে। সিয়াম জন্মেছে বলে তুমি তার বাপের কথা জেনেছো, অথচ বিয়ে আমি আগে পরে আরো দুটো করেছিলাম। একটাও টেকেনি! শোনো তাহলে ঢাকা থেকে লেখাপড়া শেষ করে আমাদের শহরে ফিরে গিয়ে আমি একটা কলেজে পড়াতে ঢুকেছিলাম। সেখানেই আমার প্রথম স্বামীর সাথে আমার পরিচয়। কলেজটা বেসরকারি ছিলো এবং ওটা ওর বাবার প্রতিষ্ঠিত ছিলো। এখন অবশ্য সেটা সরকারি হয়ে গেছে। কিন্তু তখন বিয়ের পর চাকরি করার চেয়ে ওদের বাড়ির সবাই চাইতো আমি ওর সাথে বিদেশে গিয়ে থাকি। ও আগে থেকেই দুবাইয়ে চাকরি করতো। তখন কিছু দিনের জন্য দেশে এসেছিলো। কদিনেই ও আমার সাথে আমার ভাব জমিয়েছিলো। ওদের বাড়ির সবাইও আমাকে এককথায় যাকে বলে খুব পছন্দ করেছিলো। আমাদেরও কারো আপত্তির কিছু না থাকায় অত কিছু না ভেবে দ্রুত বিয়েটি সম্পন্ন হয়। তারপর দেখতে থাকি দেশে-বিদেশে ওর বান্ধবীর অভাব নেই। প্রথম বিয়ে ভাঙার কারণ সেটাই।
: তো বান্ধবী, বন্ধু বিয়ের পর কি সবাইকে জীবন থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে?
: জুলেখা আপা, শোনো, আমি মনে করি স্বামীর যথার্থ একজন বান্ধবী-বন্ধু, সে স্ত্রী’রও বান্ধবী-বন্ধু। সুহৃদ। কিন্তু যাদের সাথে সম্পর্কটা ফাঁকতালে দেহভোগের, লুচ্চামির, সেই তাদের জন্য আসলে বন্ধু-বান্ধবী ঠিক শব্দ নয়। এটা ভদ্রজনের আলোচনার জন্য ব্যবহার করা শব্দ আর কি…! নারীকে ঘায়েল করতে যেমন তার গোপন পুরুষটিকে লাঙ বলা হয়। ওটার স্ত্রীলিঙ্গ জেনে আমাকে জানাইও তো, তারপর থেকে সেটাই বলবো!
: শব্দ তো আছেই। তবে সেটা বললে, তথাকথিত বান্ধবীদের শিক্ষা-দীক্ষাহীন হাঁড় জিরজিরে জীর্ণ পোশাক পরা দৌলতদিয়ার ছবি ভাসে চোখে!
: কিন্তু শব্দটা কি?
: গণিকা!
: ঠিকই বলেছো। এরা তো শিক্ষিত। ভদ্র চেহারা। তাই এরা ভদ্র সমাজে মেশা উঁচুতলার গণিকা! আর শোনো একজন যথার্থ প্রেমিকাও কিন্তু চায় না প্রেমিকের সংসারে অশান্তি হোক! সম্পর্কটাকে তারা সেভাবেই রাখে।
: মেয়েরা আসলে অধিকার বোধটি একটু বেশিই ফলাতে চায়। তাই তুই যা বলছিস্, তেমনটি সচরাচর হয়ে ওঠে না! তবে আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন মানুষ একটু কম ভয়ঙ্কর।
: আপা, প্রেম এবং রাজ্য জয়ের কোনো পন্থাকেই দুর্নীতি বলা যায় না জানো তো! আত্মসম্মান না ভুললে কি আর কেউ প্রেমে পড়ে! যে প্রেমের আহ্বানে সৃষ্টির তাবৎ কূল অবনত, সেখানে দু’জন নরনারীর বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের এতটুকু আভাস দেখলে ঘর চিতা হয়ে ওঠে!
: তাই তো। যা বলছিলি, তাই বল…
: দ্বিতীয়জন, মানে সিয়ামের বাবা প্রথমজনের বন্ধু। তার আগের সংসার আমার আগেই ভেঙেছিলো। তারপর সে হাত বাড়ালে আমি জলন্ত চিতা থেকে যেন শান্তির ফোয়ারার নিচে উঠে এলাম। বছর না যেতেই সিয়ামের জন্ম। ক্রমে টের পেলাম সিয়ামের বাবা আগের স্ত্রী’র বাড়িতে আনাগোনা করে।
ততদিনে বুঝে গেছি, আরেকজনের উগরানো বমি যখন গলাধঃকরণই করেছি, মানে আরেকজনের তাড়ানো স্বামী আমি যখন আমি গ্রহণ করেছি, তখনি তা আবার না উগরে হজম করার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। সেটাই বোধহয় বড় ভুল ছিলো। প্রথম থেকে গা ঝাড়া দিয়ে বেরিয়ে যদি নতুন উদ্যমে একটা চাকরিবাকরি খুঁজে নিজের ক্যারিয়ার ডেভলপ করতাম, তাহলে জীবনটা অন্যরকম হতো ।
: তুই প্রথম স্বামীর সাথে যে দুবাই গেলি, সেখানে কিছু করিসনি কেন?
ওখানে আমার ওয়ার্ক পারমিট ছিলো না। আর আমার করার মতো কোনো কাজ পাইওনি! আমি বরাবর একটু চুজি। টাকার জন্য যা তা করতে পারি না!
জুলেখা আর প্রশ্ন করে না। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দকেও এবার ভয় পেতে থাকে সে। ভাবছে, নয়না না ভেবে বসে তার জীবনের গলদপূর্ণ কাহিনী সে গাড়লের মতো তারিয়ে গিলছে! জুলেখা শুধু একটু নড়েচড়ে বসে চোখ দু’টো এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে আবার নয়নার মুখের ওপর মেলে দিয়ে অস্ফূটস্বরে বললো, সিয়ামের বাবাকে এমনি ছেড়ে দিয়ে এলি?
: মারপিট কম হয়নি। মার শুধু খাই-ইনি, সেবার দিয়েছিও। বিভিন্নভাবে তার আগের স্ত্রী’র কাছে যাওয়ার কথা আমার কানে এলে আমি কৈফিয়ত তলব করলে, শেষে একদিন বললো, ‘তোমার কী কম পড়ছে?’ আমি বলতাম, অবস্থা যদি আমার আগের মতোই হয়, তাহলে তুমি আমার দিকে হাত বাড়িয়েছিলে কেন? না হলে তো আমি ঘর ভেঙে অন্তত তোমার কাছে আসতাম না! হয়তো থেকেই যেতাম সেখানে। এই ঢিলেঢালা ভাবে সংসার করার চেয়ে সেখানেই অধিকার প্রবল করার অধিকার আমার ছিলো…! আমার কথা শুনে ও কি বললো জানো?
: কি?
: বললো ‘তখন তোমার ঢলঢলে যৌবন ছিলো। তাই তো তোমাকে খুবলে খেতে আমাকে খুনি হতে বাঁধা ছিলো না!’
নয়নার এমন কথায় জুলেখা এবার টানটান হয়ে বসলো। চোখ দুটোতে ঘনঘন পলক ফেলে আবার আগের মতো মেলে রাখলো নয়নার নিরাশক্ত মুখের ওপর। নয়না বলতে লাগলো, আমি একেবারে চুপ হয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, তাহলে আমি বিগতা যৌবনা? অথচ ও তো আমার থেকে পাঁচ-ছয় বছরের বড়! অথচ তার ধারণা সে এখনো অটুট যৌবনের অধিকারী! আসলে পুরুষের ও গরিমা খালি টাকা ও ক্ষমতার! লজ্জা যেমন নারীর ভূষণ তেমনি অমন নির্লজ্জ দম্ভকেই অনেকে বীরত্ব মনে করে! তারই সূত্র ধরে বারোখানে হাতিয়ে বেড়ানো। সাধারণ ঘর থেকে যে সব মানুষ ভাল চাকরি পায়, সঠিক উপার্জনের বাইরে বানের জলের মতো ঘুষের টাকায় ড্রয়ার ভরে, তাদের অধিকাংশেরই এই আলগা নারীঘটিত বিষয় থাকে…।’ এই পর্যন্ত বলতে বলতে নয়না থামে। এই সুযোগে জুলেখা বলে ওঠে, তুই এসবের কতটা জানিস? ক’জনের কথা জানিস?
: একদিন সুযোগ পেয়ে ওর এক কলিগকে সবকথা খুলে বললাম। তাকে বললাম, যেন সে ওকে বোঝায় ঠিকভাবে সংসার করতে। সে কি উত্তর দিলো, শুনলে তুমিও ভিরমি খাবে!
: কি বললো?
: বললো, ও শালা তো একটা বোকা! পুরনো বউয়ের কাছে কেন যায়? যায় তো যায়, তাও আবার নতুন বউ জেনে যায়। আরে যাবিই যদি পুরনোর কাছে যাবি কেন? ঘর ঠিক রেখে প্রতিদিন নতুনের কাছে যা! আমরা যে যাই, কই আমাদের বউরা তো টের পায় না! ঠিকাছে খশরুকে বোঝাবো…।’ ওই লোকের কথা শুনে তো আমার পায়ের নিচের মাটি আরো সরে গেল!
: যাবেই তো!
: কিছুদিন পরে ওনার বউয়ের সাথে এক অনুষ্ঠানে পরিচয় হলো। দুইচারদিন ফোনে কথা বলার পর টের পেলাম, সে প্রতিদিনই মার খায়। তখনই দেখেছিলাম, চোখের নিচে কালসিটে দাগ! অথচ সে মা-বাবার একমাত্র সন্তান। লেখাপড়ায় ভাল না জেনেও ওই লোক বিয়ে করেছিল সম্পত্তির লোভে। এখনো তিনটি বাচ্চা নিয়ে বেচারি খোঁয়াড়ে আটকা! এইসব কমজাত পুরুষদের ধারণা মেয়েরা প্রতিদিন পুরনো হয় আর তারা টাটকা থাকে। এ সবই ওই অবৈধ রোজগারের ভ্রান্ত তেজ জুলেখা’পা! সদ্বভাবে রোজগার করা মানুষেরা সব বিষয়েই সৎ হয়।

: ঠিক বলেছিস তো!’ যেন এতক্ষণে জুলেখা পুরুষের বিরুদ্ধে নয়নার উগরানো বিষের ভেতর একটি বীজমন্ত্র পেয়ে গেছে নারীকুলের জন্য, তেমনি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে জুলেখা নয়নার কথায়। কিন্তু জুলেখা ভিন্ন কথাও বলে- তাহলে স্বামীরা যখন অবৈধ টাকার বাণ্ডিলগুলো বউদের হাতে এনে দেয়, তখনি তাদের উচিৎ স্বামীকে সায়েস্তা করা। নাহলে একটি অন্যায়তে মদত দেবে আরেকটাতে রুখে দাঁড়াবে, তা তো হবার নয়! এই পয়েন্টে মেয়েরা একটা কঠিন ভূমিকা রাখতে পারে।
: আরে শোনোই না ! তোমাকে বলেছি বলেই না এতকথা মনে পড়ছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এসব কথা। কারণ এসব কথা মনে রেখে চলাফেরা করা খুবই দায়। তাই স্লিপিং পিল খেতে খেতে তাও এখন আমার শরীরের জন্য স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এসব মনে হলে পিল খেলেও ঘুম আসে না। আবার অনেক সময় কেন যেন এমনি শরীর অবসন্ন করে ঘুম আসে!
: শোন্, আমার ছোট্ট একটা প্রশ্নের উত্তর দে। তোর দ্বিতীয় তার আগের স্ত্রী’কে ফিরিয়ে এনেছে?
: কী জানি আনতো কি না। আমি চলে আসার পর ফাঁকা ঘরে একে-ওকে আনতে আনতে এক নারী ফাঁসিয়ে দিয়েছে নিজেকে তার স্ত্রী দাবি করে। সে আপত্তিকর অবস্থার ছবি-কাবিননামার কপি জোগাড় করে প্রমাণ করেছে সে তার স্ত্রী। আর এখনো সে, মানে সিয়ামের বাবা খশরু সিকদার দফায় দফায় প্রমাণ করে যাচ্ছে, সে ওকে বিয়ে করেনি! যা করেছে তা এমনি এমনি ইয়ে… ছিলো!
: তারপর?
: এইটুকু শোনার পর বাতাসও তার কোনো কথা ভাসিয়ে আনলে আমি বাতাসকেও অন্যদিকে ফিরিয়ে দিই। কারণ গা গুলায়। যে জন্য যে ঘর, যে সম্পর্ক ছেড়ে এসেছি, যেন তারই ভেতর আর না খাবিখাই!
: আচ্ছা কোথায় এক জায়গায় তোকে থামিয়ে দিলাম, সেখান থেকে বল তো!
: কতখানেই তো থামালে। কোনটা রেখে কোনটা বলি! সংসার ভেঙে আসার আগে ভাবছিলাম কি জানো, খেয়োখেয়ি আর নয়। ঢলঢল যৌবন দেখেই যদি কুকুর হয়ে থাকিস্, তোকে আমি গাধা বানিয়ে যাবো। ডিভোর্সের জন্য আবেদন করলে কাবিনের মাত্র তিনলাখ টাকা দিয়ে সাফ করে দিতে তার কোনো কষ্টই হবে না! তাই ভাবলাম, টাকার জন্য তাকে সে সুযোগ না দিয়ে বরং আমিই তাকে ডিভোর্স দিই। কিন্তু তার আগে আমার যৌবনের মূল্য আমাকে উসুল করতে হবে! কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে আমার জানা ছিলো, ওর আলমারিতে অনেক টাকা আছে এবং প্রতিদিন সেখানে নতুনভাবে টাকার বাণ্ডিল যুক্ত হয়। ভাবছিলাম সেখান থেকে এক থোক টাকা নিয়ে সটকে পড়তে হবে! আর তখন তো অল্প টাকাকেও অনেক মনে হতো…।
: যৌবনের মূল্যে টাকা?
: নয় কেন? জোয়ান ছেলেটা ফ্যাক্টরির মেসিনে পিষ্ট হচ্ছে, ডাক্তারের ভুল অপারেশনের পেটের শিশু মারা যাচ্ছে, স-ব টাকা দিয়ে সুরাহা হয় না? আর কাবিনের পুরো টাকা শোধ করে স্ত্রী’কে যখন তখন বের করে দেয়াই যায়, জানো না? জীবন আমাকে সেটাই শিখিয়েছে জুলেখা’পা, টাকাই প্রথম কথা!
: তাই তো! বল !
: একদিন তালা-চাবিওয়ালাকে খুঁজে ওর সেই আলমারির একটা চাবি বানিয়ে নিলাম। আর তার বাণ্ডিল বাণ্ডিল টাকা থেকে সামান্য কিছু করে ক’দিন ধরে সরালাম! একদিন তীর্যক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে খশরু বললো, আমার আলমারিতে কারো হাত পড়েছে…!’ আমি ভ্যাবলার মতো বললাম, কী আছে ও আলমারিতে? ওটার চাবি তো কোনোদিন দেখলাম না! পুরুষ মানুষ ঘরের আলমারির চাবি বয়ে বেড়ায়, বাপের জন্মেও দেখিনি! টাকা-পয়সা থাকলে ব্যাংকে রাখো না কেন? সেদিন আমার প্রতি মুড একটু ভাল ছিলো ওর। কারণ আমি ক’দিন ধরে আমার যৌবনকে বেপরোয়া করে রাখছিলাম তার জন্য। যেন এটাই জীবনের সবটুকু। এভাবেই চলবে। অথবা অনাহারী জীবনের পথে পা বাড়াতে ক্ষুধাকে বিনাশ করতে চাওয়া। মানে কুকুরের কাছে কুকুর হওয়া। অথবা কি এখন আর সেই মিশ্র অনুভূতির কথা কিছু মনে পড়ে না!
: কুকুরের কাছে কুকুর হওয়া যায় বটে। কিন্তু মনুষ্যত্ববোধ কিছু থাকলে তা মাথাচাড়া দিয়েই তো দুঃখি করে ফেলে। তখন তো আর হিসেব মেলানো যায় না।
: তা না হলে তৃতীবারও ওই বেলতলা আর যাই!
: যা বলছিলি টাকার কথা!
: ও যখন বললো, মানে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, সব টাকা ব্যাংকে রাখা যায় না। তখন ভাবলাম, তাহলে সব টাকা চুরি হয়ে গেলেও ও মামলা করতে পারবে না! প্রকাশ্যে কাউকে অভিযোগও করতে পারবে না! নিজের সাথে যুঝতে যুঝতে ভাবলাম, একটা মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য প্রতিদিন প্রতিরাত যেভাবে বিবাহিত স্বামীর সাথে পার করছি, বাঘের ঘরে হরিণের আশঙ্কা নিয়ে সময় কাটাচ্ছি, তার থেকে একলার নিরুদ্বেগ জীবনই ঢের ভালো। সিয়ামের তখন ছয় বছর। আলমারির স-ব টাকা আর আমার গহণাগুলো…। গহণা অবশ্য বেশি ছিলো না আমার।
: কী করলি? কোথায় গেলি? অতগুলো টাকা সামাল দিলি কী করে?
: এলাকায় আব্বার একটা সুনাম আছে। বামপন্থী রাজনীতি করা একজন আপোষহীন নেতা। পূর্বপুরুষের অঢেল সম্পত্তি ছিলো। দাদার আমল থেকেই দিনাজপুর শহরে বাড়ি ছিলো। সেই সব সম্পত্তির ওপর নির্ভর করেই আব্বা জীবন কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু তখন আব্বার ওপরও আমার রাগ ছিলো। শহরের বাড়িটা তিনি তার দুই ছেলেকে রেজিষ্ট্রিী করে দিয়ে দিয়েছেন। তবে বলেছিলেন গ্রামের কিছু জমি বিক্রি করে আমাকে শহরে দুই/তিন কাঠা জমি কিনে দেবেন!
আমি ওনার একটামাত্র মেয়ে। আমার যদি ওনার সম্পত্তির দরকার হয়, তাহলে শহরের বাড়িটারই হবে। আমি ওনার গ্রামের বাড়ি-জমি দিয়ে কী করবো, আর কবে শহরে জমি কিনে দেবেন, তখন তা আমার কাজে না-ও লাগতে পারে, বলো? তাই কাউকে কিছু জানান না দিয়ে ঢাকাতে এক দুঃসম্পর্কের মামাতো বোনের বাড়িতে উঠলাম। উঠেই ডিভোর্সের নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম শারীরীক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ তুলে। আর এই দুটো অভিযোগের কিছু সাক্ষী তো ছিলোই দেয়ার মতো। শরীরে এখনো দুই একটা দাগ আছে।
: অতোগুলো টাকা…!
: দুটো বালিশ বানিয়েছিলাম মোটা ফোমের পলেস্তারা দিয়ে। তারপর ড্যামকেয়ার মুডে ছিলাম। বুঝেছিলাম এই কাজে যার কাছে সহায়তা চাইবো তার কাছেই জিম্মি হয়ে যাবো।
: মামাতো বোন টের পায়নি?
: কী?
: বালিশ…!
: বালিশ কি আর খালি বালিশ নিয়েছিলাম! দু’চারখানা কাঁথা-চাদরও তো ছিলো! আর সে মামাতো বোনের হাজবেন্ডও সরকারি চাকরি করতো। সরকারি কোয়াটারে থাকতো। তবে সে দুলাভাই মাঝারি গোছের কর্মকর্তা হওয়াতে মাঝারি মানের সরকারি কোয়াটারেই তারা থাকতো। যে সব জায়গায় কেউ কেউ চড়া দামে একটা-দুটো রুম ভাড়াও দিতো। তো সেই বোনের পাশের ফ্ল্যাটের তেমন এক রুম খালি হওয়াতে বোনের আপত্তি সত্ত্বেও সেটা ভাড়া নিয়ে অনেকদিন ঘরবন্দী জীবন-যাপন করেছি। সিয়ামকে দুই বছর স্কুলে দিইনি! ওয়ান থেকে একেবারে থ্রী ভর্তি করেছিলাম।
: তো সিয়ামের বাবা সেখানে খোঁজ নেয়নি?
: ওই মামাতো বোনদের সাথে আগে আমাদের কখনো যাতায়াত ছিলো না। ওদের নামও শোনেনি। তাই ভাবতে পারেনি। আর বোন-দুলাভাইকে মানা করা ছিলো, যেন কোনোভাবেই খশরু না জানে কোথায় আছি। আমার ভাইয়েরা, মা-বাবা অনেকদিন কেউ আমার খবর জানতো না। আমি কোনো মোবাইলও ব্যবহার করতাম না তখন।
তারপর জনসমক্ষে বের হতে আমি আমার এই নয়না বুটিক হাউজটি করলাম। চলাচল করতাম বোরখা পরে। মুখ ভালো করে ঢেকে রাখতাম। শেলাই-ফোঁড়াইয়ের নেশাটা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। তাই যে দুই বছর ঘরবন্দি ছিলাম, তখন আসলে নিজেকে এই কাজের জন্য তৈরি করছিলাম। এর ভেতর আমি গুণেও দেখেনি আমি কতটাকা নিয়ে পালিয়েছিলাম। তবে আমার এই ভরসাও ছিলো টাকা খোঁজার জন্য সে আমাকে মুখোমুখি করতে নিজের বিপদ ডেকে আনবে না। আর ততোদিনে ডিভোর্স কার্যকর হয়ে গেলে তার খোঁজার সব পথও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অবৈধ হলেও টাকার জ্বালা তো। ভয় ছিলো গুপ্ত হত্যা না করায়।
: তোর সে খশরু এত টাকা কোথায় পেতো?
: ক্যাডার সার্ভিসে চাকরি করে। ঘুষ দিয়ে ঘুষের জায়গাগুলোতে পোস্টিং নেয়…। টাকা যে কোনোভাবে যে কামাতে চায়, সে উপায় বের করে নেয় আপা!
: তারপর তৃতীয়বার যে বিয়ে করলি…।
: ও ফ্যাশান ডিজাইনার। কাজ শিখে প্রথম আমার হাউসে যুক্ত হয়েছিলো। একসময় বুঝতে পারলাম ও আমার প্রতি দুর্বল। তখন তো আমি তার মালিক। নয়না বুটিক হাউস’এর তখন রমরমা অবস্থা তখন তো এতো বুটিক সপ ছিলো না! তারপর আমার নিজস্ব ফ্ল্যাট। যে টাকা এনেছিলাম তার একটা অংশ দিয়ে সিদ্ধেশ্বরীতে আগে ওই ফ্ল্যাটটা কিনে ফেলেছিলাম। তাই ক’বছর যেতে তখন আমার একটু গা জুড়ানো অবস্থা। তাই দেরিতে হলেও আবার ঢলভাঙা স্রোতের মতো আসা প্রেমটা আর প্রত্যাখ্যান করতে জোর পেলাম না!
: জোর কি খালি ফেরাতে লাগে? গ্রহণ করতেও লাগে! না ফিরিয়ে তুই ঠিকই করছিলি! ওরও কি আগে স্ত্রী ছিলো?
: না। আমার থেকে বয়সে বেশ ছোট ছিলো। কিন্তু একসময় সে আরো বড় ফ্যাশান হাউস থেকে অফার পেয়ে সেখানে জয়েন করে। আমি তাকে বললাম, দুজনে মিলে আমাদের কর্মকাণ্ড আরো প্রসারিত করি!
শেষে বললাম, ঠিকাছে, তুমি এটাতেও যুক্ত থাকো। কিছু সময় দাও! পরে টের পেলাম সে ঘরে ফিরলেও মন সম্পূর্ণ ফেরে না। দুবার ঘরভাঙা মানুষ না আমি বলো! শেষে তারও আর না ফেরার ইচ্ছের পথ আমি রুদ্ধ করে দিলাম!
: তুই টাকাগুলো বৈধ করেছিলি কী করে?
: বাপ-ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়েছিলাম। আইনেরও মারপ্যাঁচ ব্যবহার করেছি। আরে বাদ দাও, এ আর কয় টাকা, এককোটি হবে হয়তো। যার কাছ থেকে এনেছি, সে বৈধ করতো না? করছে না মানুষ দেদারছে! আর তুমি সেইখানে বৈধ-অবৈধ’র হিসাবে আটকে আছো!
: এটাই হচ্ছে আমাদের দেশের আসল অবস্থা!
হ্যাঁ, রক্ষকরাই ভক্ষক। গ্যাঁড়াকলে না পড়লে আমিও কি এতটা জানতাম!
০০০
২০২০ সাল চলে গেছে। তবু করোনার তেজ কমেনি। কিন্তু মানুষের সাহস বেড়েছে করোনা মোকাবেলার। প্রাণ ভয়ে ভীত জুলেখা তখনো ঘর থেকে অফিস ছাড়া আর কোথাও বেরোয় না। বাড়িতে নানান রোগে জর্জরিত মা-বাবাকে নিয়ে তার বেশি ভয়। মানুষের স্বাভাবিক চলাচল শুরু হলে সে আরো ভীত হয়ে পড়ে। যেন সংক্রমিত কোনো মানুষ থেকে তার ফুসফুসে একটি অনুজীব এসে এখনি ঢুকে পড়লো বলে। আর সেটাই বুঝি সে ছড়িয়ে দিলো ঘরময়। জুলেখার এমনি একটানা ভয়ার্ত সময়ে একদিন জেসমিন ফোন করে বললো, আপা, কেমন আছো?
: সেই তো আগের মতো। তোরা?
: আমি তো দিনাজপুর এসেছি!
: সরকার আর সামাল দিতে পারছে না বলে লকডাউন তুলে দিয়েছে। কিন্তু অতদূরের পথে তোরা গেলি কোন সাহসে?
: নিজেদের গাড়িতে এসেছি আপা! চিন্তা করো না। আর গ্রামে তো করোনা নেই! এতে বোঝা যায় গ্রামের মানুষের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি!
: হবে হয়তো। কারণ তাদের শরীরে তো কিছুটা হলেও রোদ লাগে। রোদই আসলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করার শক্তি জোগায়। পরিশ্রম করা মানুষেরা তো সহজে কোনো রোগে আক্রান্ত হয় না।
: শোনো জুলেখা আপা, এদিকে আরেক খবর! আমি তো বেশ মজা পেলাম। তাই ভাবলাম তোমাকে জানাই! তা ঘরে আছো তো?
: আছি! বল, কী মজার খবর এই দুর্দিনে পেয়ে গেলি!
: তুমি তো শুধু নয়নার কথা আমার কাছে জানতে চাও, আমি বুঝি, আমি ওকে অপছন্দ করলেও তুমি ওকে খুব ভালবাসো! আগে এ নিয়ে হিংসে হতো কিন্তু এখন আর হয় না! তবে কেন তাকে অপছন্দ করি তা কিন্তু তোমাকে বলিনি। তাতে আমার ঘরের কথা বেরিয়ে যায়।
: আমি জানি!
: জানো? কিন্তু আমাকে তো কখনো জিজ্ঞেস করোনি!
: আমি ওইরকমই! আলসেমী লাগে। ভয়ও লাগে, কোনখানকার কথা কোনখানে ছড়ায়!
জেসমিন নয়না সংক্রান্ত তার সমস্যা নিয়ে একজনকে মেসেজ করেছিলো। সে হুবহু দেখিয়েছে জুলেখাকে। যাকে মেসেজ করেছিলো জেসমিন, সে জানে না জেসমিনকে জুলেখা চেনে। জেসমিনের সাথে কথোপকথনের সময় সেই মেসেজগুলোই চোখে ভাসছে জুলেখার। কিন্তু জুলেখা তখনো বিষয়টিকে মাছির মতো তাড়িয়ে সরালো! জেসমিনকে তো সেসব বলার প্রশ্নই আসে না!
: আমার হাজবেণ্ডও ওর আগের দুই হাজবেণ্ডের বন্ধু। ইউনিভার্সিটিতে তারা তিনজনই ব্যাচমেট। তাই আমার হাজবেণ্ডকে ও ওর সমস্যার কথা জানিয়ে প্রায়ই ফোন করতো। কখনো ডাকলে যেতোও। এটা নিয়ে আরমানের সাথে, মানে আমার হাজবেণ্ডের সাথে আমার হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে। বিশ্বাস করো, আমার মনে হয় আরমানেরও কুনজন ছিলো ওর প্রতি। তবে নয়নার এতে সাড়া থাকতো কি না তা আমি জানি না!
: জানি আমি তোদের এইস-ব।
: তোমাকে নয়না বলেছে?
: উহু! তোর সাথে আমার এত কথা হয় তাই তো ও জানে না!
: তাহলে কে বলেছে?
: শোন, যার জীবনে যা ঘটে, তা কোনো না কোনোভাবে সে নিজেই কোথাও না কোথাও নিজের অজান্তেই বলে ফেলে। তাই কেউ না কেউ সাক্ষী হয়ে থাকে। তবে জানলেই তা চাউর করতে হয় না। কারণ তখন এই আমি যেমন ভাবি, ওই বিষয়টা আমার হতে কতক্ষণ! কিছু না কিছু গলদ সবারই থাকে। শুধু ধরণটা যা আলাদা! কী বলতে চাইছিলি, তাই বল তো!
: তোমাকে এজন্যই খুব ভালবাসি। তাই এটুকু তোমার থেকে গ্রহণ করতে পেরেছি, দোষটুকু এড়িয়েও কাউকে কাউকে ভালবাসা যায়। কারণ ভালবাসা পাবার মতো গুণও সবার ভেতর কিছু হলেও থাকে। আমি দেখেছি তুমি সবার সেই ভাল বিষয়টিই বড় করে দেখো!
: শোন, যার যে কাজ অন্যকে বিব্রত করে সেটাই হয়তো তার তখনকার জন্য জরুরীই ছিলো। তবু ক্ষমা-ঘেন্নায় মেনে নেয়ার একটা বিষয় তো থাকেই। সেটা মেনে কাউকে অতটা জড়িয়ে না থাকতে পারলেও বিচ্ছিন্ন করে দেয়াটা অমানবিক। কারণ একসাথে চলা মানুষগুলোর দায় থাকে সবাই সবার সহায় হয়ে থাকা। এর ভেতর কখনো সে হয়তো ত্রুটিগুলো শুধরে ঠিকঠাক হয়ে যাবে। তুই কী গল্প শোনাবি সেটাই এখন বল!
: নয়নার মা মারা গেলে নয়নার বাবা ঢাকাতে পরপর তার দুই ছেলের কাছে কিছুদিন করে থেকেছেন। দুইবাড়ির কোনোটাতে তিষ্ঠোতে না পেরে নয়নাকে খবর দিয়েছিলেন। জানো?
: জানি, নয়না নিজে গিয়ে ওর বাবাকে বড় ভাইয়ের বাসা থেকে নিয়ে এসেছিলো। পরদিনই আমি তাকে দেখতে গিয়েছিলাম।
: হ্যাঁ। কিন্তু নয়নার ছেলের সাথে সব বিষয়ে এখন নয়নার বাহাস করতে করতে এমনি সে তেতে থাকে! ছেলের আঙুল এখন মায়ের দিকে। মা-ই সংসার ভেঙে তাকে বাপের থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে, এমনি সরাসরি মাকে তার অভিযোগ। তারপর করোনায় নয়নার বুটিক হাউস বন্ধ। ইনকামও বন্ধ প্রায়। তারপর নয়নার বাবা যে নয়নার দুই ভাইকে শহরের বাড়িটা লিখে দিয়েছিলেন, বাবাকে মুঠোয় পেয়ে সেও আচ্ছা মতো মোরব্বা কেঁচা দিয়েছে। যা হোক একদিন সে চাচা নয়নার বাসা থেকে পালিয়েই গ্রামে ফিরে এসেছেন।
: গ্রামে গিয়েছেন কেন? আগে তো থাকতেন শহরে!
: চাচী বেঁচে থাকতে দিনাজপুর শহরের বাড়িতেই থাকতেন। চাচী মারা যাওয়ার পর চাচা ঢাকা গেলে এই ফাঁকে দুই ছেলের শ্বশুরবাড়ির মানুষ এসে সে বাড়ি সাফ-সুতরো করে যার যার জামাইয়ের অংশ তারা ভাড়া দিয়ে দিয়ে, নগদ টাকা তুলছে। যাহোক, তারপর চাচা গ্রামে এসে কদিন তার ছোট ভাইয়ের কাছে ছিলেন। সেখানে থাকতে থাকতে যে আধবয়সী মানে আমাদের বয়সী যে মেয়ে চড়ামূল্যে প্যারালাইসি আক্রান্ত চাচীর দীর্ঘদিন সেবা করেছে, তাকে খবর দিয়ে গ্রামে এনে চাচা নিজের ভাগের ঘরদোর পরিষ্কার করিয়েছেন। নতুন করে সংসারের সব কিনে ভালই চলছিলো ক’দিন। কিন্তু এরি ভেতর একদিন সেই মেয়েকে চাচা নাকি বলেছেন, তোকে আমি বিয়ে করতে চাই, তুই রাজি হ। আমি মরলে এইসব তুই পাবি! চাচার মুখের থেকে কথাটা বেরোতে না বেরোতে সে মেয়ে সে কথা পাড়াময় রাষ্ট্র করে দিয়েছে। বলেছে ‘কবে থেকে আমি ওনাগে মেয়ের মতো কাছে থাকি। ওনারি আমি চাচা ডাকি, উনি কেমনে আমারে কলো ইয় কথা!’ এই কথার পক্ষে বিপক্ষে মেলা নাকি সোর উঠছিলো! তারপরেও চাচা ওই মেয়েকেই আবার বলছেন, বয়স আমার কম হয়নাই। কতদিনই আর বাঁচবো! কিন্তু যে ক’দিন বাঁচি মরণযন্ত্রণা ঠেকিয়ে রাখতে তো আমার সারাক্ষণ একটা মানুষ লাগে! তুই সারাদিন যেটুক পারিস সেবা-যত্ন করে পাশের ঘরে আমার ছোট ভাইয়ের কাজের মহিলার সাথে গিয়ে থাকিস। আমি রাতে যখন তোকে ডাকি, সে ডাক শুনেও তুই সাড়া দিস না আমি বুঝি। এদিকে আমার তো একটু পানি লাগে, ওষুধ খাওয়া লাগে। কথা কওয়া লাগে…। ইদানীং কত কথা যে মনে আসে! এর সব কথাই মোহরের মতো দামি মনে হয়! তাই না বলতে পেরে দম আটকে আসে!’
: ঠিকই তো! এর কোনটা বেঠিক, জেসমিন, তুই বল?
: চাচা পরে সে কাজের বেটিরে আবার বলছে, তুই রাজি না হোস্, আহলে তোর মা’রে খবর দে। তারেই বিয়ে করি! সেও তো মানুষের বাড়ি আয়ার কাজই করে। শক্তপোক্ত আছে। তোর মা’রও তো ঝাড়া হাত পা…!’
: বাহ! একেই বলে ‘প্রয়োজন আইন জানে না!’
: ঠিকই বলছো! চাচা কিন্তু দীর্ঘদিন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ওকালতিও করেছেন। আর রাজনীতি করা মানুষ বলে এলাকায় আলাদা একটা দাম আছে। অথচ সেই চাচার কেমন ন্যক্কারজনক অবস্থা ছেলেমেয়ের অবহেলায় পড়ে হয়েছে, বোঝো!
: তারপর কি হলো?
: চাচা তাকে রেখে তার মায়ের কথা বলায় পরে সে মেয়ে সে কথাও আরো জোরেসোরে সবার কাছে চাউর করে নিজে ভালো সাজতে গিয়েছিলো। আর চাচাকে একেবারে ভীমরতিতে ধরা ক্ষেপাটে বুড়োতে পর্যবসিত করে দিয়েছিলো!
: করে দিয়েছিলো মানে? চাচা এখন আর পর্যবসিত নেই?
: শোনোই না, শেষে চাচার আপন ছোট ভাই, মানে আতিক চাচা খোঁজ লাগিয়ে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপণ দিয়ে নিজে দেখেশুনে শহর থেকে এক রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষত্রীর সাথে বিয়ে দিয়েছেন চাচাকে। এখন তারা খুব ভাল আছেন।
: ভাগ্যিস এমন একটা ছোটভাই ছিলো!
: হ্যাঁ! উনি বলেছেন নয়নার বাবাকে, ডাঙায় যত জমি আছে সব তুমি বেচো আর খাও। কারো জন্য আর কুটোটাও রেখে যেও না। ছেলেমেয়েদের তো চিনলে তুমি! অতএব তোমার আর কারো জন্য ভাবনার দরকার নেই!
: কিন্তু নয়না…!
: বড়চাচা ছোটচাচাকে বলছেন, তাদের কাজ তারা করেছে। আমি তো বাবা। আমার কাজ আমি করবো। আমি লিখে দিয়ে যেতে সময় না পেলেও বাজারের দোকান তিনটি নয়নার জন্য রইলো। তবে যতদিন চাচা-চাচী বাঁচবেন ততোদিন ওর ভাড়ার টাকায় তারা চলবেন।
: সত্যিই খুব ভালো খবর এটা!
: হ্যাঁ, এই চাচী শিক্ষিত মহিলা তো সবার সাথে পুরনো আমেজে মিশে গেছে। মনেহয় আগের চাচীই ফিরে এসেছেন! কিছুই বেমানান মনে হয় না। আগের চাচী তো প্রায় পাঁচ/ছয় বছর বিছানায় পড়ে ছিলেন। জবানই বন্ধ ছিলো দু’বছর। ওই কাজের বেটি মিনারা আর কি করেছে, চাচাই করেছে বেশি। রোগী টানতে টানতে চাচা যে লবেজান হয়ে গিয়েছিল, এখন তার মেজাজে ফুরফুরে ভাব ফিরে এসেছে। পরিবেশ পেয়ে পুরনো মানুষেরা এসে পড়ো অঙ্গন এখন মুখর করে রাখছে! আমিও তো তোমাকে এখন সেই বাড়ির উঠোন থেকে কল দিয়েছি! মা রাগ করেন তবু প্রতিদিন এসে পড়ে থাকি!
: তোদের কাছাকাছি?
: একেবারে পাশাপাশি বাড়ি। নয়নার বাবার দাদা আর আমার বাবার দাদা আপন চাচাতো ভাই ছিলো!
: তোদের দুই বাপের দুই দাদার দুই বাপের এক দাদা থেকে হিসেব করলে তুই আর নয়না ষষ্ঠ না সপ্তম সিঁড়ি, সেটা তোদের দু’জনকে নিয়ে হিসেব করে বের করবোনে! তবে সত্যি খুব ভাল একটা খবর দিলি। আসলে জীবনের এইদিকটিকে বাঁকা চোখে দেখে মানুষ এমন সব ভুক্তভোগীর জীবন বিপন্ন করে তোলে। দেখ, অন্ধ-অসুস্থ না হয়ে কোনো পরিবারে বাড়তি সদস্য হয়ে থাকা যায় না। যদি না সেখানে সম্মান থাকে। ছেলেরা না বুঝুক, ওনার বউমা দু’জনও নিশ্চয় প্রয়োজনীয় সেবা- ভক্তি তাকে করেনি। করলে নিশ্চয় তাদের কাছে থেকে যেতেন। ভালোই হলো সবার থেকে তাড়া না খেলে নতুন জীবনের স্বাদ পেতেন না! আর নয়নাকে আমি দুষছি না, উনি কেন নয়নাকে রেখে শহরের বাড়িটা শুধু দুই ছেলেকে দিতে গেলেন?
: আপা, আগে থেকে কাউকেই বাড়ি লিখে দেয়া ঠিক হয়নি।
: সেটা ঠিক না হলেও অন্যায় হয়নি। কিন্তু নয়নার প্রতি অন্যায় তো করেছেন! তা সেই মিনারার কথা বল্! এখনো ওই বাড়িতে আছে?
: আছে মানে! বহাল তবিয়তে আছে। সেও তো আরেক গল্পের জন্ম দিয়েছে।
: কি? বল তো!
: এই চাচী তো খুবই পরিশ্রমী এবং সৌন্দর্য প্রিয়ও। তাই বাড়ির পিছনে সবজি বাগান। সামনে ফুলের বাগান। শিল্পিতভাবে ঘর-দোর সাজানো, সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে বেচারি। আর নিজেও এমন টিপটপ থাকে বোঝাই যায় না মহিলা তিন বছর আগে রিটায়ার করেছেন। চাচীর বাগান করার প্রধান সহযোগী তো মিনারা। মিনারাকে একদিন চাচী কাজের জন্য ধমক দেয়ার পর চাচীকে নাকি মিনারা বলে ফেলেছে, আমি আপনার মতো চালাক অলি এই সংসারের মালিক আমিই অইতাম…। আপনার আঁচলে সিন্দুকের ওই চাবি আমার আঁচলে দুলতো! তহন আর এই এঁদো গিরাম আপনার স্বর্গ বানানি লাগতো না!
: তারপর?
: চাচার কানে কথাটা যাওয়া মাত্র চাচা ওকে বিদেয় করতে চেয়েছে! কিন্তু চাচী তো কম গেরবাজ নয়। ওনার ছেলে মেজর। মেয়ে-জামাই দুজনই ডাক্তার। ওনার প্রথম স্বামী প্রথম জীবনে ওনাকে রেখে জার্মানীতে গিয়েছিলেন চাকরি করতে। সেখানে নাগরিকত্ব পেতে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। এটা শোনার পর উনি একাই এতটা সময় কাটিয়েছেন। তো চাচী নাকি চাচাকে বলেছেন, নয়নার মার সেবা-যত্নের জন্য মিনারা আগে যে বেতন পেতো, এখনো তাই পাচ্ছে বলে শহর থেকে গ্রামে এসে থাকছে। বেশি দামেও এখন গ্রামে কাজের মানুষ পাওয়া যায় না। আমি ঘরের কাজ সব করতে পারলেও বাইরে বাগানের কাজ তো একা করতে পারবো না। অতএব ওর সাথে এমন ট্রিট করতে হবে, যেন এসব কথা আর কখনো না বলে। ঘটনা ভিতরে ভিতরে যা-ই থাক, মুখ দিয়ে না উগরালে হলো!
: তাই তো! সময় পাল্টেছে শুধু নয়, ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়েছে, না হলে এই কথার পরও কেউ এমন কাজের লোক বাড়িতে জায়গা দেয়? তুই একেবারে হাঁড়ির খবর তুলেছিস জেসমিন! যাক, তবু সব খবরই ভালো দিয়েছিস। ভালোয় ভালোয় ফিরে আয়। একদিন নয়নার বাসায় গিয়ে খোঁজ নেবোনে আমরা…।
: নয়না শেষের জন যাকে স্বামী বলে চালাতে চায়, নয়না ওর সাথে আসলে লিভ টুগেদার করতো! তোমাকে তার বিষয়ে কী বলেছে?
: শোন জেসমিন, লিভ টুগেদার আসলে খারাপ নয়। কিন্তু লিভ টুগেদার সভ্য সমাজের জন্য। যেখানে নারীর সম্মান আছে। তাদের কাজ করে খাওয়ার সুব্যবস্থা আছে। যেখানে নারীকে কেউ ছুঁলেই উচ্ছিষ্ট হয়ে যায় না। কদিন একত্রে বসবাস করা নারীটিকে যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো পুরুষ ছেড়ে চলে গেলেও তার কিছু এসে যায় না! আমাদের দেশের জন্য অবশ্য এটা সম্মানজন নয় এজন্য, যে এটা একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়! কিন্তু বিয়েটাই বা কতটা নির্ভরযোগ্য? নয়নাই কি তার মোক্ষম উদাহরণ নয়?
: তুমি লিভ টুগেদার সাপোর্ট করো আপা?
: আমি বলি তোকে, উন্নত দেশগুলোতে তিনমাস অথবা হতে পারে ছয়মাস একসাথে থাকার পর নারীটিকে তাড়াতে হলে তখন পর্যন্ত যা সম্পত্তি থাকে তার পুরোটা থেকে অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে। এমতাবস্থায় নারীর পেটের বাচ্চাকেও তার অস্বীকার করার উপায় নেই। অস্বীকার যদি কেউ করেই, ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পড়লে এমন শাস্তি হয়, যে সেই ভয়ে আর কেউ সেটা অস্বীকার করে না এবং সে সন্তান জন্মানোর পর পুরুষটিকে বাবার সব দায়িত্ব পালন করতে হয় বাধ্যতামূলক ভাবে। এবার বল আমাদের দেশের বিয়ের থেকে উন্নত দেশের লিভ টুগেদার ভাল কি না?
: তাহলে তো ভালই!
: আর নয়না তো আগে দুইবারই কলমা পড়ে, রেজিষ্ট্রী করেই বিয়ে করেছিলো, তাই না? সেখানে সুবিধা এই ছিলো, যে মারপিট খেয়েও সেখানে তার থাকার অধিকার ছিলো। কিন্তু সে জীবন তো আমাদের দেশী কুকুর- বেড়ালের থেকে বেশি কিছু নয়। সাঁড়াশি দিয়ে রাস্তায় প্রকাশ্যে যাদের গলা চিপে মারা যায়!
: আসলে মানুষের মতো দেখতে হলেও মানবিক গুণের মানুষ দুর্লভ! সে জন্যই আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পঁচনশীলতা। রক্তের সম্পর্কও এখন আর এক করে রাখতে পারছে না!
: তোর এই কথার পরে আর কথা চলে না। একদম ঠিক কথাটি বলেছিস্। কিন্তু কথা ওইটাই থাকলো, পরিস্থিতি আরেকটু ভাল হলে নয়নাকে ওর বাসায় গিয়ে হলেও খুঁজে বের করে জানতে হবে ও কেমন আছে।
: ফোন বন্ধ রেখে সবাইকে টেনশনে রাখার এমন অভ্যাস ওর আছে। আগেও এমন করেছে। তাই ওকে নিয়ে অতো চিন্তার তোমার কিছু নেই।
: চিন্তাটা ওইখানেই। ও বোধহয় একটু পরখ করে দেখতে চায়, আমরা ওর বন্ধুরা ওর কোনো খোঁজ-খবর নিই কি না! ওর জন্য উদ্বিগ্ন হই কি না! ও বেশ একটু অভিমানী। ওর এই দিকটিই বোধহয় আমাকে টানে! কিন্তু আমি তো নিজেও বুঝি অভিমানের দাম কে-ই বা দেয়!
০০০
করোনা কোনদিনও যাবে না। তাই তাকে অমান্য করে যখন মানুষ আগল ভেঙে চলাচল অবাধ হয়েছে, নয়নাকে করোনায় পেয়েছে তখন, একেবারে একুশ সালের দ্বিতীয় মাসে। ভাষার মাস বলে এইমাসে বাঙালির রক্ত এমনি টগবগ করে ওঠে। নয়নাও গৌরবের সেই শিখাটা জ্বালিয়ে ওর বুটিক হাউসের জন্য একটানা নতুন কিছু কাজ করছিলো কর্মচারিদের সাথে। শরীরটা তো আর একেবারে নিরোগ ছিলো না ওর। তাই প্রথম দিকেই তাকে কাবু করে ফেললো সর্বনাশা রোগটি। মায়ের একেবারে বিধস্ত অবস্থার ভেতর সিয়াম একা কুলিয়ে উঠতে না পেরে বাবাকে ডেকেছে। তিনি সহজেই আসেননি যদিও। রোগীর কাছে যাওয়ার উপায় যখন ছিলো না, রোগীর থেকে দূরে হলেও ছেলে সিয়ামের সাথে সাথে থেকেছে সিয়ামের বাবা। যেন সেতুর আরেক কূলে থাকা খশরু সিকদারকে তার সব বৈপরীত্য টপকে ভেলার মতো বেয়ে সেতু নিজেই পৌঁছে দিচ্ছে তার বিপরীত কূলে। শুরুতে খশরু চৌধুরী বুঝতে পারেনি, এই যাত্রা তাকে যেখানে নিয়ে পৌঁছে দেবে, সেখান থেকে তার আর ফেরার পথ থাকবে কি না! একদিন যার ঢলঢলে রূপ- যৌবন দেখে পতঙ্গের মতো আকৃষ্ট হয়েছিলো সে, শেষদিকে তার তেজ আর সাহস তাতে কিছুটা সমীহও যুক্ত করে দেয় বুঝি!
তাই বাধ্য হয়েই হোক আর নিজের অজান্তেই হোক, ছেলের সাথে নয়নার ফ্ল্যাটেই আসা-যাওয়া, থাকা খাওয়া শুরু করতে হয় খশরু শিকদারকে। নয়না সুস্থ হলে পুত্রকে সাথে করে তাকে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়েও সে-ই নেয়।
জুলেখা যখন নয়নাকে দেখতে গেলো। একটু দূর থেকেই দেখলো। যদিও দূর থেকে সব কথা ওর বুঝতে পারছিলো না। তবু তার ভাললেগেছিলো সিয়াম, সিয়ামের বাবাসহ ওদের তিনজনকে একত্রে, একবাড়িতে দেখে।
নয়নার হাতে চায়ের কাপটি খসরু শিকদারই ধরিয়ে দিতে দিতে বলেছিলো, নয়না বোধহয় আপনার কথাই মাঝে মাঝে বলে, আপনার নাম জুলেখা পাঠান…!’ জুলেখা শুখনো হাসিতে অধরোষ্ঠ প্রসারিত করে বলেছিলো, হ্যাঁ, আমি…!
: আমি খশরু! সিয়ামের বাবা!
: জানি, এখন আপনি যুগ্মসচিব!
: নয়না বলেছে?
: কক্ষণো না…!
এইসময়ে নয়না খুব খিনখিনেস্বরে বলেছিলো, সিয়াম তার বাবাকে এই দুঃসময়ে ডেকে না আনলে আমি আর বেঁচে ফিরতাম না আপা!’
জুলেখা বলেছিল: তুই তোর এমন অসুস্থতার কথা আমাদের কাউকে জানাসনি কেন?
: পারিনি! জীবন নিয়ে পরাজয়ের কথা আর কত নিজে মুখে জাহির করবো? আর এই রোগে বাইরের মানুষ কারো তো কিছু করারও ছিলো না। শুধু শুধু তোমাদেরকে ভারাক্রান্ত করা হতো!
জুলেখা নয়নার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে মুখের মাস্কটা ভালো করে আঁটতে আঁটতে ভাবছিলো, মানুষের জীবন কি আসলে নদীর মতো! নাকি সে কেবলি গেরবাজ পায়রা! তবে নয়না যে খশরু সিকদারের কথা কখনো বলেনি তাকে, মিথ্যে করে হলেও মৃদু একটা চপেটাঘাত বোধহয় সে তার তরফ থেকে করতে পারলো! এরচেয়ে বেশি কী-ই বা পারে জুলেখা! জুলেখা পাঠান!!