হূবনাথ পান্ডের কবিতা

হূবনাথ পান্ডের কবিতা

হূবনাথ পান্ডের কবিতা
অনুবাদ: স্বপন নাগ

একটি প্রেমের কবিতা

বিয়ের জন্যে ধার হয়েছে ঢের,
শোধ করবে, এই স্বপ্নে যুবক
এক ফাগুনে পাড়ি দিল দূর শহরে।

ছড়িয়ে পড়লে লকডাউনের মায়া
বন্ধ হল হঠাৎই রোজগার !
খিদের থেকে বাঁচতে অবশেষে
তল্পিতল্পা সঙ্গে নিয়ে নামলো পথে —
দেড় হাজার কিলোমিটার পথ
পায়ে হেঁটেই পেরিয়ে যাবে সে।
কখনো কোন ট্রাকের পিছে পিছে,
কখনো কোন টেম্পো ধরে তাতে,
কখনো বা গাছের নিচে কোন,
কখনো কোন ঢাবার পেছনদিকে …

বুঝদার বৌমায়ের কাছ থেকে
পাচ্ছিল মা খবর প্রতি পলের।
শেষ খবরটি এসেছিল কী এক
কোনো একটা হাইওয়ের থেকে :
ধারটুকু তার হল না আর শোধ,
তারই আগে হারিয়ে গেল প্রাণ !

উড়ে আসতে চেয়েছিল সে,
ফিরে আসতে চেয়েছিল ঘরে।
কী জানি কোন্ গাড়ির চাকা এসে
অন্ধকারেই পিষে দিল তাকে।
শেষ খবরে বলেছিল, ‘বড্ড
পিপাসাতে শুকিয়ে আসছে গলা ..’

শাশুড়ি-বৌ মিলে
নামমাত্র জমি বেচে চুকিয়েছিল দেনা।
যে হাইওয়ে ছুঁয়ে আছে তাদের ছোট্ট গাঁ,
সেখানে গিয়ে বানালো এক ঝুপড়ি।
মাটির জালায় পাতকুয়ো-জল ভ’রে
এক টুকরো গুড় সঙ্গে সকাল থেকে সন্ধে
আসছে-যাচ্ছে যত লোক সে রাস্তায়
সব্বাইকে জিগেস করে, ‘তেষ্টা পেয়েছে ?’

গ্রামবাসীরা এসব দেখে বলে —
‘সারাটা দিন একফোঁটা জল নেয় না মুখে ওরা,
এইভাবে কি বাঁচতে পারে কেউ ?
দেখছি ওরা পাগল হয়ে গেছে দু’জনেই !’

কী আর জানে গ্রাম !
সেইদিন সেই হাইওয়ের ওপর
মরেছিল একটি নয়, তিন-তিনটি প্রাণ,
যাদের মধ্যে দুই দু’জনের লাশ
এখনো পাওয়া যায়নি।

ধর্ম

কোনো দুর্বল নিরপরাধের ওপর যদি
ক্রুদ্ধ হতে পারো,
অনায়াসেই হয়ে উঠতে পারো হিংস্র,
পুষে রাখতে পারো যদি ঘৃণা,
অন্যায় দেখেও যদি আলোড়িত না-হয় রক্ত,
হারামের খাওয়া যদি লজ্জার না হয়,
অন্যের মেহনতের ফসল কেড়ে নিতে
যদি হাত না কাঁপে,
অপার দুঃখ দেখেও যদি না জন্মায় করুণা,
নিজের দেহ আর দৈহিক সুখ ব্যতিরেকে
যদি কিছু ভাবতেই না পারো,
তা হলে বিশ্বাস করো —
তথাকথিত ধর্মের এতসব নাটকের পরেও
তোমরা কিন্তু ধর্ম থেকে অনেক অনেক দূরে।

দাড়ি-টিকি রোজা-উপবাস
আজান-আরতি মন্দির-মসজিদ
গীতা-কুরআন …
সব সবই অন্তঃসারশূন্য নিরর্থক শব্দ !

ধর্ম আবরণ নয়, সে আচরণ।
যা দেখা যায়, সে তো আবরণ ;
আর সুগন্ধের মত অনুভব করা যায় যা,
সে-ই তো আচরণ।

ধর্মে থাকে না দুর্গন্ধ
ধর্ম, সে তো মনুষত্বেরই সৌরভ !

বিচার

বিচার
একটা খেলা।
সব খেলারই কিছু নিয়ম থাকে,
অতএব, এ খেলারও।
যারা জানে
তারা খেলে ;
খেলে আর শেষে তালি বাজায়।
বিচার
প্রেমচন্দের জমানার
ডান্ডাগুলি খেলা নয় যে,
দুটো লোক আসবে
আর কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই
শুরু হয়ে যাবে !

এ এক আধুনিক খেলা।
খেলার সামগ্রী উপকরণ সব
এতই দামী যে
সাধারণ লোকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।
লাখ টাকার ব্যাট
হাজার হাজার টাকার প্যাড, স্টাম্প, বল
এরপরেও আরো অনেক কিছু …

তাও আবার, যেখানে-সেখানে নয়,
এ খেলার মাঠও হয় বিশেষ রকমের
ক্রিকেটের মত।
এই মাঠে
প্রবেশের ক্ষমতাও সবার থাকে না,
দামী টিকিট যারা কিনতে পারে
তারাই যেতে পারে মাঠে।
টিকিট ছাড়াও বিক্রি হয় আরো কিছু
মাঠের মধ্যে, মাঠের বাইরেও।

পুরো লোকের সংকুলান
সম্ভব নয় ছোট একটা মাঠে —
সরকার জানে।
জানে বলেই সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থাও
করে রেখেছে সে :
ঘরে বসে খেলা দেখো,
খেলা দেখো আর হাততালি দাও
যদি রাগ হয়, ভেঙে ফেলো সাধের টিভি
খেলা কিন্তু চলতেই থাকবে পুরোদস্তুর।
কেননা, খেলা চালিয়ে যাবার
দায় ও দায়িত্ব সরকারের।

খেলাপ্রধান আমাদের এই দেশে
সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা —
বিচার !

স্বৈরাচারী জানে

মূর্খ স্বৈরাচারীদের জমানা
কবেই শেষ হয়ে গেছে !

আজকের স্বৈরাচারীরা
ক্রুর, ঠগ আর ধূর্তই শুধু নয়,
অনেক বুদ্ধিমানও।
রসবোধে যথেষ্ট রসিক,
তারা সেয়ানা এবং চতুর ;
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়েও
চরম অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী জানে যে
কিছু লোক তাকে নিয়ে তামাশা করে,
হাসাহাসি করে,
ব‍্যঙ্গ করে,
কার্টুন বানায়,
হতাশ হয়ে কখনো বা
গালিও দেয় কেউ কেউ।

আজকের স্বৈরাচারীরা
কোনো গুরুত্বই দেয় না এসবের।
তারা শুধু নজর রাখে —
বিপদসীমা পার করছে কার হাসি,
কার ব‍্যঙ্গে প্রভাবিত হচ্ছে আম আদমি !

আঘাত আর হানি ছাড়া তার নজরে
কিছুই থাকে না আর।
তাই, একদিন হঠাৎই
হাসি আর ব‍্যঙ্গ দুইই
বদলে যায় শোক প্রস্তাবে !

আসলে, স্বৈরাচার
একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
স্বৈরাচারীর মর্জিমত
সবারই হাসবার,
ব‍্যঙ্গ করবার,
এমনকি গালি দেবারও
বিধিসম্মত অধিকার দেওয়া আছে।
আর তাতেই তার গ্রহণযোগ্যতা
বাড়তে থাকে জনমানসে।

এরপরেও
স্বৈরাচারীর দয়াকে যারা
ঈশ্বরীয় বরদান মনে ক’রে
হাসতে পারে না,
ব‍্যঙ্গ করতে পারে না,
তারা সেই হাসি আর ব‍্যঙ্গের বিরুদ্ধে
দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায় —
যে দেওয়ালেও স্বৈরাচারী সেঁটে দেয়
তার করুণার ইশতেহার ;
আর তখন
এই সব গালাগাল
হাসি আর ব‍্যঙ্গ প্রমাণ করে যে
নৃশংস হয়েও তার জনপ্রিয়তা ঊর্ধ্বমুখী !

আহা ! কতই না মজা —
স্বৈরাচারীর অসীম কৃপাতে
এখনো আমরা বেঁচেবর্তে আছি !

লেখক পরিচিতি_____________
হূবনাথ পান্ডে।
ভারতের বেনারস শহরে ১৯৬৫ সালের ১৩ ই এপ্রিল কবি হূবনাথ পান্ডের জন্ম। সমসময়, সামাজিক বৈষম্য, রাজনীতিকদের নীতিহীনতা, জাতপাতে দীর্ণ ভারতীয় সমাজ প্রভৃতি তাঁর কবিতার বিষয়। আধুনিক হিন্দি কবিতার জগতে হূবনাথ পান্ডে তাই বহুচর্চিত একটি নাম। ‘কৌয়ে’, ‘মিট্টী’, ‘লোয়ার পরেল’, ‘অকাল’ প্রমুখ তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ। বর্তমানে কবি হূবনাথ পান্ডে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দি বিভাগের অধ্যাপক।