সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়

পৃথিবী এখন ভালো নেই। এই ভালো নেই এর মধ্যে চলে গেল বিশেষ একটি বছর ২০২০। যে বছরটি পৃথিবীর ইতিহাসের মার্জিনে লিখে নিল করোনা শিরোনামের ব্যাকুল মন্তব্য। যে বছরটি বিশ্বের চলমান অধ্যায়ে যোগ হয়ে গেল আরেকটি হাইলাইটেড অধ্যায় হিসেবে। এসবকিছুর পরও আতঙ্কের ব্যারিকেড ভেঙে জীবন চলছে। বিজ্ঞানীরা এই করোনাভাইরাস নিয়ে নতুন নতুন তথ্য দিচ্ছেন, সেই সাথে এর প্রতিষেধক আবিষ্কার করে যাচ্ছেন।গবেষণা করে যাচ্ছেন। অন্যান্য সেক্টরের মতো এই প্যান্ডামিকে সাহিত্যিকরাও বসে নেই। টেকনোলজি ব্যবহার করে সাহিত্যিকরাও সাহিত্যকর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন। রচনা করে যাচ্ছেন নিজস্ব সাহিত্য। ভার্চুয়ালি হচ্ছে বইমেলা। চলছে আলোচনা সভা, সাহিত্য আড্ডা। নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা। প্রিন্টও। ২০২০ এর করোনা মহামারির কারণে লকডাউন করা হয় পৃথিবীর বহু দেশ। লকডাউনের ব্যাকুল চেয়ারে বসে বিভিন্ন দেশে এই করোনার মহামারিকে নিয়ে লেখা হয়েছে, হচ্ছে কবিতা, গল্প, গান। কেউ কেউ লেখছেন একশ শব্দের অণুগল্প,বিশ শব্দ কিংবা এক লাইন ইত্যাদি। ইতোমধ্যে করোনা বিষয়ক কবিতা, গল্প, প্রবন্ধের সংকলন লেখা হয়েছে। জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের মতো করোনার মহামারিকালের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে লেখা হচ্ছে বই। আগামি বইমেলায় হয়ত অনেক গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদির বই আসবে বাজারে। সময়কে ধরে রাখার এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকুক। হয়তো অতীতের মতো আমাদের সাহিত্যে উঠে আসতে পারে আগাম অন্য কোনো মহামারির আভাস।

অতীতেও বিশ্বসাহিত্যে এবং বাংলা সাহিত্যে মহামারি নিয়ে বিভিন্নভাবে অনেক লেখা হয়েছে। হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড, ইতালীয় লেখক জোবান্নি বোকাচ্চোর ‘ডেকামেরন’, আমেরিকান লেখক এডগার অ্যালেন পো’র ছোটোগল্প দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ড্যাথ, মেরি শেলির উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট ম্যান’,আলবেয়ার ক্যামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য প্লেগ, কলম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক ডিয়ান মেয়ারের ‘ফিভার’, পর্তুগিজ লেখক জোসে সারামাগোর উপন্যাস ‘ব্লাইন্ডনেস’ কিংবা স্টিফেন কিংয়ের ‘দ্য স্ট্যান্ড’ সহ অনেকেই বিশ্ব সাহিত্যে অবদান রেখেছেন। তাদের লেখায় মহামারী বা দূর্যোগের প্রস্তুতি নিয়েও বিভিন্নভাবে আলোকপাত করা হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যেও বিভিন্ন সময়ে মহামারিকে বিভিন্নভাবে পাঠকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন লেখকগণ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তার শ্রীকান্ত উপন্যাসের দ্বিতীয় পর্বে কোয়ারেন্টিনের বর্ণনা পাওয়া যায়। তাঁর পণ্ডিতমশাই উপন্যাসেও মহামারীর কথা রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস চতুরঙ্গ, আনন্দমঠ’ উপন্যাসে, বঙ্কিম চন্দ্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরণ্যক, তারাশঙ্করের ধাত্রীদেবতা, গণদেবতা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ কিংবা জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে মহামারী নিয়ে লেখা হয়েছে।

সময়ের হিসেবে ২০২০ চলে গেলেও তার চলমান গতি নিয়ে আমরা এখনও হাঁটছি গন্তব্যহীন। আসলেই আমরা এখনও ভালো নেই। করোনাভাইরাসের করালগ্রাসে সবকিছু যেনো স্তবির হয়ে আছে। আর এই স্তবির হয়ে যাওয়ার পেছনে হয়তো মানুষ-ই অনেকভাবে দায়ী। পেশি আর ক্যামিক্যাল শক্তির রাজনৈতিক শোডাউনে আমরা যেনো ভুলে গেছি— শুধু মানুষ নয় ; পৃথিবীরও একটি ইমিউন সিস্টেম আছে। মানব দেহে যেভাবে রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে এই সিস্টেম কাজ করে থাকে ; তেমনি স্বার্থপর মানুষের দ্বারা সৃষ্ট দূষণ এর আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতিরও ইমিউন সিস্টেম কাজ করে থাকে। কিন্তু আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত কৃত-কর্মের মাধ্যমে প্রকৃতির সেই সিস্টেম অকার্যকর হয়ে পড়েছে। উৎপন্ন হচ্ছে সার্স, মার্স বা ইবোলার মতো রোগ। তাইতো প্রবল ক্ষোভে হয়তো প্রতিশোধ নিতে প্রকৃতি যেন এবার ছেড়ে দিয়েছে করোনার মতো ভয়ানক বিষাক্ত সৈন্য। আর অদৃশ্য ওই সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমরা ক্লান্ত। আমরা ভয়ার্ত। অনেক দেশের মতো যুক্তরাজ্য আজ এই করোনার ভয়াল আক্রমণে জর্জরিত। এখনও চলছে তৃতীয় লকডাউন। সময়ের সাথে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসুক এই প্রত্যাশা করছি।
২০২০ এর করোনা মহামারিতে আমরা হারিয়েছি ডাক্তার, নার্স,সাংবাদিক,সাহিত্যিক সহ অনেককে। সকলকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

সুপ্রিয় লেখক, পাঠক— আবারও শুধু এপার আর ওপার বাংলা নয়— পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত বাংলাভাষীর লেখা নিয়ে প্রকাশিত হল, ড্যাশ— ০৪ (বাংলা ও ইংলিশ)। বাংলাভাষী ছাড়াও অন্য ভাষার কবিরা লিখেছেন ইংলিশ সংস্করণে। ড্যাশ-০৪ এ প্রকাশিত লেখা ক্লিক করে পড়ার আমন্ত্রণ রইল। লেখক পাঠক সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা।

এ কে এম আব্দুল্লাহ
সম্পাদক, ড্যাশ—
জানুয়ারি ২০২১