মারইয়াম মনিকার কবিতা

যে আকাশে চাঁদ নেই
যে আকাশে চাঁদ নেই সে আকাশ অন্ধকার
তার ভাষাহীন উদাম বুক জুড়ে নিঃশব্দতার ছন্দ
পাহাড়ের ঘন-নীল চূড়া হতে আসে দীর্ঘশ্বাস
অশান্ত বিষন্নতায় কাঁপে স্তব্ধ পৃথিবীর বন্ধ চোখ।
রাত্রির বুকে যখন নামে ধূসর নিরবতা মসৃণ সাপের মতো
সদ্য ফোটা ভাটফুল মাড়িয়ে চিৎকার করে ওঠে-
বিবেকহীন বুদ্ধিহীন মানুষের ফাঁকা-ফাঁকা মাথার খুলি
মরা মানুষের কঙ্কালের মতো পড়ে থাকে জীবন্ত মানুষ।
গভীর বনে যখন বাঘ নেই, হরিণ নেই, হলদে-টিয়া পাখি নেই
কৃষ্ণচূড়ার ডাল ফাঁকা, রাখালের বাঁশির সুর বন্ধ
কালের গলিত গর্ভ থেকে আসে মৃত্যুর মহড়া
ঐ দূর বহুদূরে ভাসে গলানো পিচের গন্ধ
তারপর…তারপর কর্কশ কাকের কা-কা চিৎকার শুনে
বৃদ্ধ শতাব্দী হেঁটে হেঁটে দেখে, সভ্যতা আর কতো দূরে!
ডায়মন্ডহারবার থেকে যখন আসে প্যাকেট করা বুদ্ধিজীবী
কালের ঘোলাটে জলে ভাসে সূর্য
চন্দ্রগ্রহে যখন কাঁপতে থাকে পৃথিবীর বুক থরো থরো
রাজনীতির উরুর নিচে লুকায় ল্যাংটো ভিখারির দল।
যে আকাশে চাঁদ নেই সে আকাশ অন্ধকার।
অপেক্ষা
উঁচু সিঁড়িগুলো ভাঙতে ভাঙতে ডুবে যাচ্ছে সাগরে
বুকের ভেতর ফেঁপে ওঠা সমস্ত ব্যথা সময়ের সূতোয় আটকে যায়;
সুখের জানালায় ঝুলে থাকে যে চুমুগুলো সময় ফুরালে তা হেসে ওঠে
স্বপ্নের শিয়রে বসে এঁকে যায় শতাব্দীর পদচিহ্ন।
অন্তহীন নীলিমা পেরিয়ে মৃত্যু-ঘ্রাণে ভরে যায় রজনীগন্ধার বাগান
গনিকালয়ের উঁচু দেয়ালের ভেতর ছটফট করতে থাকে নিষ্পাপ কিশোরীর সতী আত্মা।
পারিজাত ফুলের সুবাসে গলে যায় পাথরের দরজা
লাশকাটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আঁধারের মতো দীর্ঘশ্বাস;
বুকের গহীনের ধূ-ধূ তেপান্তরের উচ্চারিত হতে থাকে-
আর কতো ক্ষয় আর কতো ব্যথা আর কতো দুঃশাসন!
শরীরের নিবিড় ছায়ায় ভেসে ওঠে গাঢ় অন্ধকারের সমুদ্র
শুধু অপেক্ষা অপেক্ষা; যুগ-যুগান্তরের অপেক্ষা; কাল- মহাকালের অপেক্ষা
নক্ষত্র ঝরার অপেক্ষা ফুল ফোটার অপেক্ষা প্রেমের অপেক্ষা
জারুল গাছে সমস্বরে দুটি হলদে টিয়ে ডাকার অপেক্ষা!
একদিন নীল কস্তূরীর আভায় ভরে উঠবে এ পৃথিবী – সেই অপেক্ষা।
জননীর জরায়ুতে শ্বেতপদ্ম
সমুদ্র খুঁজতে গিয়ে খুঁজে পেলাম জননীর জরায়ু
শীর্ণ যোনিতলে ঝুলে আছে কাঁচা নাভী; তারওপর শ্বেতপদ্ম,
শক্ত তর্জনী যেন শত বছরের বটবৃক্ষ
গুহারূপি উদরে শিকড়ের ভিড়, চোখের ভেতর বঙ্গভূমি,
আড়াইশো মাইল পেরুলে পাওয়া যায় তার বুকের সীমানা
কঠিন পাথরের ভেতর আজন্ম ফোটা গোলাপকলি।
বিচ্ছুরিত দৃশ্যবলি জমাট বাঁধে ললাট তলে
মায়ের হাতের তালুতে তৈরি হয় পাঠদান কেন্দ্র।
জননীর মুখ সুচন্দন ফুলবাগান
সবুজ নিসর্গ সৌন্দর্যের বেলাভূমি;
স্বপ্নের অশ্রু-বিন্দুগুলি থোকা থোকা প্রেমস্বরূপ
সংগোপনে ছলোছলো করে ওঠে জননীর মাতৃরূপ।