প্রবন্ধ: জাঁ পল সার্ত্র : জীবন ও সাহিত্য

জাঁ পল সার্ত্র : জীবন ও সাহিত্য
রঞ্জন চক্রবর্ত্তী
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে পৃথিবী যে গভীর অসুখে ভুগেছে তার বিরুদ্ধে একজন ফরাসী দার্শনিক ও লেখক নিজের বোধের উপর নির্ভর করে সারাজীবন লড়াই করেছেন। শুধু তাই নয় এই মানুষটি সমসাময়িক দুনিয়ার বিচ্যুতিগুলিকে যথাসাধ্য আক্রমণ করতেও ছাড়েন নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালের এই আশ্চর্য প্রতিভাধর মানুষটির নাম জাঁ পল অ্যামার্ড সার্ত্র। ১৯০৫ সালের ২১ জুন তাঁর জন্ম, ১৯৮০ সালের ১৬ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু।
একজন দর্শনতত্ত্ব বিশারদ বা একজন প্রকৃত লেখকের জীবনদর্শন জন্ম নেয় যাপনের পরিবেশ থেকে। যতক্ষণ না সেই পরিবেশ বা পরিস্থিতি থেকে জাত অভিজ্ঞতা তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত নিজস্ব জীবনদর্শন তাঁর আয়ত্ত্বাধীন হয় না। একথা সার্ত্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সার্ত্রের জীবনব্যাপী কর্মকাণ্ডের সঠিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাঁর দর্শন ও যাবতীয় রচনার মূল ভিত্তি ছিল নিজস্ব জীবন ও নিজস্ব যাপন। বস্তুত সেখান থেকেই তাঁর স্বকীয়তাপূর্ণ জীবনদর্শন ও চেতনাপদ্ধতির উদ্ভব।
সার্ত্র আজীবন এই ধারণায় অবিচল থেকেছেন যেনিজের নীতি ও বিচারপদ্ধতির প্রতি বিশ্বাসে স্থির থাকার অন্যতম শর্তটি হল প্রবহমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যুক্তিনির্ভর তর্কের সাহায্যে আক্রমণ করে যাওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সার্ত্র হলেন সেই ব্যক্তিত্ব যিনি আজীবন প্রচলিত ব্যবস্থাসমূহকে, মানুষের নীচতা ও প্রবঞ্চনার প্রবণতাকে ধাক্কা দিয়ে গিয়েছেনএবং তা করেছেন প্রকৃত বুদ্ধজীবীর কায়দায়,অপরিসীম ঔদ্ধত্যসহযোগে।তাঁর মধ্যে কোনরকম একরোখা মনোভাব বা আক্রোশ কাজ করেনি। বিশ্বের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে নিজের মতামত উপস্থাপন করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মূল্যায়ণ করেছেন এবং প্রয়োজনে সেসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
যুদ্ধোত্তর ইউরোপে দর্শন, সাহিত্য, নাটক বা রাজনীতি বিষয়ে যত আলোচনা বা সমালোচনা হয়েছে সার্ত্র তার কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন। আরও সরাসরি বলতে গেলে তিনি আগাগোড়াই বিতর্কিত থেকেছেন, ফলে খবর হয়েছেন। তিনি মার্কসবাদে অবগাহন করেছেন এবং তার ত্রুটিগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি উপন্যাস লিখতে বসে ফরাসি সাহিত্যের নায়কের চিরাচরিত ধারণাকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে বৌদ্ধিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন যাতে তাঁর দস্তুরমত বিপদের আশঙ্কা ছিল। তিনি বিবাহ নামক বিশ্বের সকল দেশে ও কালে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানটির বিরোধিতা করেছেন। এমনকী তিনি নোবেল পুরস্কারকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আলুর বস্তা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সব মিলিয়ে নিজের জীবদ্দশায় সার্ত্র বুদ্ধিজীবী বা লেখকের পরিচয় ছাপিয়ে গিয়ে মিথ হয়ে উঠেছিলেন।
কেবল চিন্তাভাবনার বিষয়েই নয়, রচনার ভাষা বা প্রকাশভঙ্গীর ক্ষেত্রেও সার্ত্র তাঁর সমসাময়িকদের থেকে একেবারে আলাদা ছিলেন। আসলে তাঁর গোত্রটাই ছিল ভিন্ন। চিন্তায়, যুক্তিতে বারচনার ভাষা ও ভঙ্গীতে তিনি কোনদিনই প্রথাগত ধরাবাঁধা পথে হাঁটেন নি। এর ফলে তাঁকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা বিস্তর। সুতরাং সার্ত্রের যুক্তি ও দর্শন বরাবরই প্রবল সমালোচনার সামনে পড়েছে। কখনও কখনও তার মাত্রা এতটাই যে সমালোচকরা যুক্তির ধার ধারেন নি।
সার্ত্র যেন বিংশ শতাব্দীর এক অবিশ্লেষিত মিথ। এর পিছনে মূল কারণ দুটি – প্রথমত তাঁর অস্তিবাদী দর্শনের প্রয়োগহীনতা এবং দ্বিতীয়ত দুরুহ ভাষা ও প্রকাশভঙ্গী। যেসব আলোচক এই স্টাইলে মুগ্ধ হয়েছেন তাঁরা সার্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব পোষণ করেছেন। আর যাঁরা তাঁকে বুঝতে ভুল করেছেন তাঁরা একের পর এক প্রশ্নবাণে তাঁকে বিদ্ধ করেছেন। যাঁরা ঐতিহ্যের ভক্ত তাঁদের বিচারে সার্ত্র কোন বিশেষ চিন্তাধারা বা দার্শনিক মতবাদের জনক বলে স্বীকৃত নন। সত্যি কথা বলতে কী তাঁর কাছের মানুষরাই তাঁকে গ্রহণ করতে পারেননি। যে শ্রমজীবীদের জন্য তিনি মরতেও রাজী ছিলেন তারাও তাঁকে বিশেষ পছন্দ করত না।
সার্ত্রের জীবিতাবস্থায়ই তাঁর চিন্তাধারা, দর্শন ও বিচারপদ্ধতির বিকৃত রূপের প্রচার শুরু হয়েছিল। অনেকে অপবাদ দিয়েছেন তিনি অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট এবং অনৈতিকতাকে প্রশ্রয় দেন। কট্টর মার্কসবাদীরা অসার যুক্তি প্রয়োগ করে তাঁর অস্তিবাদী বিচারপদ্ধতিকে নস্যাৎ করতে চেয়েছেন। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর চিন্তা ও যুক্তিপদ্ধতি অচল বলে অপপ্রচার চলেছে। সারা বিশ্বের খ্রীস্টধর্মের মূলকেন্দ্র ভ্যাটিকান সিটিতে তাঁর রচনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থেকেছে। এত কিছু সত্বেও সার্ত্র কিন্তু নিজের জীবনবোধ ও দর্শনের উপর একটুও আস্থা হারান নি। খ্রীস্টধর্মে যে আত্মগ্লানি, অনুতাপ ও চিত্তপীড়ার কথা বলা হয়েছে তাতে তিনি কোনকালেই ভোগেননি। সার্ত্রর এই আকাশচুম্বী আত্মবিশ্বাসের কারণ তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত অর্থে নিষ্ঠাবান দার্শনিক যিনি নিজের তত্ত্বের উপর আস্থায় অবিচল ছিলেন। তাঁর অস্তিবাদী দর্শন অনেকটাই অবিশ্লেষিত থাকলেও মানবমুক্তি ও ব্যক্তিচেতনার নিরিখে তা আজও গুরুত্বপূর্ণ।
সার্ত্রের আত্মজীবনী ‘Les Mots’ (ইংরেজিতে ‘The Words’, ১৯৬৩) থেকে তাঁর জীবন সংক্রান্ত অনেক তথ্য পাওয়া যা। তাঁর বংশগৌরব বলতে তেমন কিছুই ছিল না। যে পরিবারে তাঁর জন্ম তা মোটেই সুখী বা স্বচ্ছল নয়। শৈশবে তিনি ছিলেন রুগ্ন এবং পিতা জাঁ ব্যাপটিস্ট বা মাতা অ্যান মেরী সোয়েইজার কারুর কাছেই বিশেষ যত্ন পাননি। সার্ত্রের বয়স যখন এগারো মাস তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর পিতামহ লুই গিলমিন ছিলেন গ্রামের ডাক্তার এবং ভয়ানক বদমেজাজী মানুষ। এছাড়া পরিবারে ছিলেন এক তোতলা জ্যাঠা, জেঠিমা ও শ্বশুরালয় পরিত্যক্তা বিধবা পিসি। সেখানে অশান্তি লেগেই থাকত। এইরকম এক পরিবারে দুঃখী, নিরীহ, অনাহারক্লিষ্ট মায়ের থেকে কতটুকু যত্ন তিনি পেয়েছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। পাঁচ বছর বয়স পযন্ত তিনি কথা বলতে পারতেন না। দিনে দিনে শিশু সার্ত্র আরও রোগা হয়ে পড়েন।কৈশোরকালে কুরূপ হওয়ার জন্য তিনি হীনমন্যতাবোধে ভুগতেন, যদিও তিনি দেখতে হয়ত ততটা কুরূপ ছিলেন না।
কন্যা ও তার সন্তানের দুর্দশা দেখে সার্ত্রের মাতামহ দুজনকে নিজের কাছে এনে রাখেন। তিনিই সার্ত্রের খাওয়া-পরা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেন। একটি অত্যন্ত সাধারণ বিদ্যালয়ে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাতুললায়ের পরিবেশ বা ধমীয় গোঁড়ামি কোনটিই তাঁর পছন্দ হয় নি। বছর পাঁচেক বয়সে তাঁর গলার স্বর ফিরে এলেও কথা তিনি খুব কমই বলতেন। তখন থেকেই তিনি সবসময় নিজের মধ্যে থাকতেন অথবা বইয়ের মধ্যে নিমগ্ন থাকতেন। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী, কিন্তু অতিমাত্রায় আত্মকেন্দ্রিক ও বেজায় গম্ভীর।নিজের আত্মজীবনীতে শৈশব ও কৈশোরের কথা, বড় হয়ে ওঠার কথা তিনি বিশদে বলেছেন। সম্ভবত এইসব কারণেই তিনি সারা জীবনই তীক্ষ্ণমেজাজী ও স্বাধীনচেতা থেকেছিলেন। তিনি যে মানুষের শঠতা বা সমাজের প্রচলিত বিধিব্যবস্থাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবেন, সেগুলিকে আক্রমণ করবেন তার বীজ শৈশব থেকে এভাবে কৈশোরে উত্তরণের ওঠার মধ্যেই সুপ্ত ছিল।পরবর্তীকালেতাঁর অস্তিবাদী দর্শন বা প্রতিবাদী চিন্তাধারার বিকাশের প্রক্রিয়ার পিছনে জীবনের এই পর্যায়ে নিজের প্রতি নির্মমতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধ প্রতিবাদী হয়ে ওঠার মানসিকতা নিহিত ছিল।
মাতুলালয়ের পরিবেশ সার্ত্রের কাছে মোটেই সুখজনক ছিল না। ১৯০৫ থেকে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর ছেলেবেলা মোটের উপর কষ্টেরই ইতিহাস বলা চলে। ১০১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মা পুর্নবিবাহ করেন এবং সন্তানকে নিজের কাছেই রাখেন। সার্ত্রের আত্মজীবনী থেকে জানা যায় সেখানেও তিনি একাকীত্বকে সঙ্গী করে অস্বস্তিকর পরিবেশে বড় হয়ে উঠেছেন। বোধহয় এই সময় থেকেই চরম নিঃসঙ্গতার মধ্যে তাঁর দার্শনিক বোধের অঙ্কুরণ ঘটেছিল। লোকাল স্কুলে ছাত্রজীবনের প্রাথমিক পর্যায় শুরু হওয়ার পর তিনি হেনরী প্যারিস জাতীয় বিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি হায়ার নর্মাল স্কুলে ভতি হন এবং নাইশ বছর বয়সে সেখান থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর তিনি বার্লিনের ফরাসি ইন্সটিউটে সমসাময়িক জার্মান দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন, তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন এডমুন্ড হর্মাল ও মার্টিন হাইডেগার। চব্বিশ বছর বয়সের মধ্যে পড়াশোনার এই পর্বটি সমাপ্ত করে তিনি লা হার্ভেতে দর্শনের পাঠ নেন। এই সময় থেকেই তাঁর অন্তরে সুপ্ত প্রতিবাদী সত্ত্বার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে।
সার্ত্র যখন উচ্চতর বিদ্যার্জনের জন্য জার্মানি গিয়েছিলেন সেটা ছিল হিটলারের উথ্থানের সময়। তখন স্বৈরতন্ত্র ও আগ্রাসী রাজনীতির সঙ্গে তিনি সম্যকরূপে পরিচিত হয়েছিলেন। ১৯৪০ খ্রীস্টাব্দে তিনি ফরাসী সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধে গিয়ে তিনি জার্মানদের হাতে বন্দী হন। পরবর্তী ন’মাস বন্দীশিবিরে থাকার সময়তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিন্তু সেই অবস্থাতেও তিনি বন্দী সহযোদ্ধাদের জন্য নাটক লেখা ও অভিনয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে বন্দীদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি পারী শহরে এসে আবার দর্শনের অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। তবে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অক্ষুণ্ণ ছিল।
১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত তিনি একদিকে যেমন অধ্যাপনা, নাট্যচর্চা ও সাংবাদিকতা করেছেন অন্যদিকে তেমনই ফরাসী গুপ্তবাহিনীর হয়ে প্রতিরোধ আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। এই সময়কালে ‘লে লেতরস্ ফ্রাঁসিয়ে’ ও ‘কমব্যাট’ প্রভৃতি কাগজে তাঁর বেশ কিছু রচনা প্রকাশিত হয়েছিল যা ফ্রান্সের নাগরিকদের মনে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা জাগিয়ে তোলায় সহায়ক হয়েছিল।এই প্রসঙ্গে ‘Les Mouches’ (‘মাছিরা’, ১৯৪২) এবং ‘Huis Clos’ (‘প্রস্থান নেই’, ১৯৪৩) নামক তাঁর দুটি নাটিকা আলাদাভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। এই নাটিকা দুটি নাজীদের সামনে এমনভাবে উপস্থাপিত হয়েছিল যে তারা বুঝতেই পারেনি যে এগুলি আসলে তাদের বিরুদ্ধে ফরাসীদের প্ররোচিত করার উদ্দেশ্যে রচিত।
সার্ত্রর জীবনের সকল কাজের মধ্যে লেখালিখিই প্রধান ছিল। লেখায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করার জন্য ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে দেন। তাঁর সারাজীবনের সঙ্গিনী সিমঁ দ্য বোভোয়া নিজের আত্মজীবনীতে বলেছেন সার্ত্র লেখার জন্যই বেঁচে ছিলেন, অন্যকিছুর জন্য নয়। পাশাপাশি এটাও স্বীকার করতে হবে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বা আগাগোড়াই অটুট থেকেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা তাঁর প্রথম নাটক ‘Les Mouches’ (মাছিরা) থেকে শুরু করে শেষ নাটক ‘Les Sequestresd’Altona’ (আলটোনার বন্দী) পর্যন্ত প্রতিটি নাটকেরই মূল বক্তব্য হল অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এইসব নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রগুলি কোন না কোন সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। মনে রাখতে হবে তাঁর বিখ্যাত দর্শনবিষয়ক গ্রন্থ ‘Being and Nothingness’(প্রকাশকাল ১৯৪৩) রচিত হয়েছিল যখন তিনি যুদ্ধবন্দী ছিলেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ল্য তঁ মদার্ন’ পত্রিকাটি প্রকাশ করা শুরু করেন এবং আজীবন এটির সম্পাদক ছিলেন।
১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ফরাসী সরকার সার্ত্রকে ‘Legion of Honour’ দিয়ে সম্মানিত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এবিষয়ে তিনি পরিস্কার করে বলেছিলেন যে ব্যক্তি রাজনৈতিক, সামাজিক বা সাহিত্যিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত তাঁর একমাত্র নিজস্ব মাধ্যম হল অক্ষর বা লিখিত শব্দমালা। তার মধ্যে দিয়েই তিনি কাজ করে চলেন। অন্য কোন পুরস্কারবাপ্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি তাঁর কাম্য হতে পারে না। একই যুক্তিতে অবিচল থেকে পরবতীকালে তিনি ‘নোবেল পুরস্কার’কেও আলুর বস্তা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরের দিন তিনি সুইডেনের প্রেসের প্রতিনিধিবর্গের কাছে যে বক্তব্য রাখেন তা কেবলমাত্র পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বস্তুত যে মনোভাব তিনি সারাজীবন সযত্নে পোষণ করে এসেছেন, সেদিনের বক্তব্য ছিল তারই প্রতিফলন। নিজের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন একজন লেখক নিজেকে প্রতিষ্ঠান রূপে গড়ে তুলতে পারেন না, এমনকী কোন সম্মানজনক আবেষ্টনীর মধ্যেও নয়। তাঁর যুক্তিতে স্বাধীনতা লাভের জন্য কোন ব্যক্তিবিশেষের ভূমিকার কথা মনে রেখে তাঁকে বিশেষ পুরস্কার দিলে মনে হবে তিনি যেন স্বাধীনতার ওপরে। তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছিলেন নোবেল পুরস্কার দেওয়ার পদ্ধতি সন্তোষজনক নয়।তিনি আরও বলেছিলেন লেখক হিসেবে কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একাত্ম হওয়া তাঁর পক্ষে অনুচিত বলে বোধ করেন, তা সে যতই সম্মানজনক হোক না কেন। তাঁর পক্ষে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করলে তা বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের আনুগত্য স্বীকার করার সামিল হবে।
মানুষেরস্বাধীনতার চেতনা সার্ত্রের মনোজগতে সতত ক্রিয়াশীল থেকেছে। তাঁর রচনায় ভাগ্য, বংশগতি ও ফ্রয়েডিয় অবচেতনের তত্ত্বের কিছুটা প্রভাব আছে ঠিকই, কিন্তু তার থেকে অনেক বেশী পরিমাণে আছে ব্যক্তিমানুষের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের সার্থকতার ধারণা। তাঁর মতে মানুষ নিজেই নিজের পরিচালক, নিজের জীবনকে সে যতটুকু গড়ে তোলে তার জীবন ঠিক ততকুই। ‘Lucifer and the Lord’নাটকে গোয়েটজ-এর কথায় অস্তিবাদের সেই ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছে –“The silence is God. The absence is God – God is the loneliness of Man. There was no one but myself; I alone decided on evil; and I alone invented God . . . . If God exists, Man is nothing. If Man exists, God does not exist.” যেহেতু ঈশ্বরের অস্তিত্বের উপর মানুষের অনস্তিত্ব নির্ভর করছে এবং বিপরীতক্রমে ঈশ্বরের অনস্তিত্বের উপর মানুষের অস্তিত্ব নির্ভরশীল, তাই যা একমাত্র সত্য সেটি হল ঈশ্বরই যখন নেই তখন মানুষ অবশ্যই আছে। এইজন্যই মানুষের স্বাধীনতা তথা মানবমুক্তির কামনায় সার্ত্র মনোযোগী থেকেছেন। যা কিছু এর পক্ষে বাধাস্বরূপ সেসবের বিরুদ্ধ তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।
নাৎসীদের সন্ত্রাস বা দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদীদের সৃষ্ট ভীতির বাতাবরণ সার্ত্রের প্রতিবাদী কন্ঠ বা ক্ষুরধার কলমকে থামাতে পারেনি। ফরাসীদের মুক্তির জন্য তিনি ফ্যাসিবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। আবার ভিয়েতনাম ও আলজিরিয়ার স্বাধানতাযুদ্ধকে তিনি মুক্তকন্ঠে সমর্থন করেছেন। এমনকী তিনি ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর কাছে দমন-নিপীড়ন রোখার জন্য আবেদন জানিয়েছিলেন। এই কারণে তাঁকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে দক্ষিণপন্থীরা দু’বার তাঁর বাড়িতে বোমা ছুঁড়েছিলেন, সরকারের কয়েকজন সদস্য জেনারেল দ্য গলের কাছে রাষ্ট্রবিরোধীতার জন্য তাঁর কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করার আর্জিও জানিয়েছিলেন। এতে সার্ত্র দমে তো যানই নি, বরং তাঁর প্রতিবাদের সুর আরও চড়া হয়ে ওঠে। মানবতাবাদী ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল প্রতিষ্ঠিত International War Tribunal-এর সভাপতি হিসেবে তিনি ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘Vietnam : Imperialism and Genocide’ নামক একটি বই প্রকাশ করেছিলেন। এই বইতে ভিয়েতনামের গণহত্যার জন্য আমেরিকাকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছিল।
প্রতিবাদী চরিত্রই সার্ত্রকে একাধারে অসাধারণ প্রতিভাধর ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব রূপে পরিচিত করেছে। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী – একাধারে গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সম্পাদক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ। তাঁর মধ্যে যে পাণ্ডিত্য ও মনীষার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবতার অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছিল তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। সর্বোপরি সারা জীবন ধরেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদে আপোষহীন। তাঁর রচনায় ও কাজে প্রতিবাদ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আমরা দেখেছি অনেক বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই যখন কলম ধরেছেন তখন আপাদমস্তক রাজনীতির লোক হওয়া সত্বেও তাঁদের লেখক সত্বা একেবারে আলাদা হয়ে গেছে। জওহরলাল নেহরু, মাও-সে-তুং, হো-চি-মিন বা মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে এরকম স্ববিরোধ দেখা যায়। যদি কবি-সাহিত্যিকদের কথা ধরি তাহলে দেখব নাজিম হিকমত, হসরৎ, মখদুম, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা ফণীশ্বরনাথ রেণুর মধ্যে রাজনৈতিক সত্বা ও লেখক সত্বার মধ্যে এই স্ববিরোধ রয়েছে। অবশ্য জাঁ পল সার্ত্র এঁদের থেকে ভিন্ন গোত্রের, প্রায় কারুর সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে না। পৃথিবীতে সত্যিকারের বিদ্রোহী অনেকেই আছেন, সত্যিকারের প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যক্তির উদাহরণও কম নেই। কিন্তু যে জায়গাটায় সার্ত্র অন্যদের থেকে আলাদা সেটা হল তিনি স্বভাবগতভাবেই প্রতিবাদী এবং সেই প্রতিবাদের পদ্ধতি একেবারে সরাসরি, তাতে কোন রাখঢাখ নেই। সার্ত্রর রচনা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে তাঁরঅনুভূতি কত গভীর এবং উপলব্ধি কতখানি ব্যাপক। সম্ভবত এইজন্যই তাঁর হৃদয়ে প্রতিবাদী সত্ত্বার জন্ম হয়েছে।
সার্ত্রর গল্প-উপন্যাস-নাটক যাই আলোচনা করা হোক না কেন তিনি যে একজন অস্তিবাদী দার্শনিক সেকথা মাথায় রাখতে হবে। তিনি নিজে অস্তিবাদকে ‘Non-Philosophy’ বলে অভিহিত করেছিলেন, কিন্তু আলোচকরা একে পাশ্চাত্য দর্শনের অংশ বলেই বিচার করেন। অস্তিবাদী দর্শনের কাঠামোটি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গঠিত। এর মূলে যে ধারণাটি আছে তা হল একটি সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করে ব্যক্তি নিজেকে উপলব্ধি করে। অস্তিবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যক্তির এই আত্মোপলব্ধি তিনটি পথ ধরে ভাবে আসা সম্ভব –
ক. প্রথমত, সে সমাজের প্রচলিত কাঠামোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে,
খ. দ্বিতীয়ত, সে সামাজিক নীতিগুলিকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারে,
গ. তৃতীয়ত, সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থেকেও এমন কিছু করতে,বলতে বা লিখতে পারে যা সমাজ দ্বারা স্বীকৃত নয়।
সার্ত্রের রচনা থেকে বোঝা যায় তিনি নিজে এই তিনটি পথই নিয়েছিলেন।
সার্ত্র রচিত উপন্যাস ‘La Nausee’ (ইংরেজি অনুবাদে ‘Nausea’, বাংলায় ‘বিবমিষা’, প্রকাশকাল ১৯৪৯) একটি অসাধারণ সৃষ্টি। এই উপন্যাসে তিনি এমন একজন বিদ্যালয় শিক্ষককে আমাদের সামনে এনেছেন যে অতিমাত্রায় নিঃসঙ্গতায় ভোগে। এই নিঃসঙ্গতাজনিত কারণে সে নিজের অস্তিত্ব বিষয়ে চিন্তা করতে বাধ্য হয়। সে নিজেকে নানারকম প্রশ্ন করে ও তার উত্তর খোঁজে। এইভাবে সে নিজেকে উপলব্ধি করে এবং পরিশেষে আত্মহত্যার দ্বারা নিজের অস্তিত্বের অবসান ঘটায়। এই হল প্রকৃত অস্তিত্ববাদী নায়ক বা anti-hero, যার মাধ্যমে লেখক বলেন – “My thought is me : that’s why I can’t stop. I exist because I think . . . . and I can’t stop myself from thinking.” এই নায়ককে আমাদের সামনে উপস্থিত করে সার্ত্র দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ফরাসী সাহিত্যের নায়কের চিরাচরিত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছিলেন। এখানে যে প্রশ্নটা উঠে আসে সেটা হল ‘La Nausee’ উপন্যাসের নায়কের প্রতিবাদটা ঠিক কোন জায়গায়? আসলে এই উপন্যাসের নায়কের প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ খুব একটা স্পষ্ট নয়। তার কারণ চরিত্রটির বাহ্যিক আচরণ প্রচলিত সামাজিক বিধিগুলির বিরুদ্ধাচরণ করে না। কিন্তু অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে দেখা যায় তার চরিত্রের অন্তর্গত নিঃসঙ্গতার জন্য সে অন্য সকলের থেকে আলাদা হয়ে যায়। এটাই নায়ক চরিত্রটির প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ।
১৯৪২ থেকে ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে লেখা সার্ত্রের নাটকগুলিতে বিদ্রোহের এই রূপটিই প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর প্রতিটি নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধ দাঁড়িয়েছে। আরও একটি লক্ষ্যণীয় দিক হল তাঁর প্রতিটি নাটকেই ব্যক্তির কোন না কোন সিদ্ধান্ত প্রাধান্য লাভ করেছে এবং সেই ব্যক্তি এমন কিছু করবে বলে স্ছির করে যা তার চরম পরিণতি বা সর্বনাশও ডেকে আনে। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি সার্ত্রর সব নাটকেই দৃষ্টিগোচর হয়। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন, তৎসঞ্জাত অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি এই কালসীমার মধ্যে রচিত নাটকগুলিতে অন্যতম উপাদান হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
সার্ত্রর লেখা কয়েকটি নাটক আলোচনা করলে তাঁর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। উদাহরণস্বরূপ এখানে চারটি নাটক আলোচনা করব :
ক) সার্ত্রর প্রথম নাটক ‘Les Mouches’ (ইংরেজিতে ‘The Flies’, বাংলায়‘মাছিরা’, ১৯৪৩) ফরাসী জনগণের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার ইস্কাইলাস রচিত ওরেস্তেস নাটকটি থেকে এর কাহিনীসূত্র নেওয়া হয়েছিল। ট্রয়ের যুদ্ধের অবসানে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর গ্রীক বাহিনীর নেতা আগামেনন দেখলেন তাঁর পত্নী ক্লাইতেমেস্ত্রা অন্য প্রেমিকের প্রতি আসক্ত। সেই প্রেমিক পুরুষটিকে দিয়ে ক্লাইতেমেস্ত্রা তার স্বামী আগামেননকে হত্যা করায়। আগামেননের পুত্র ওরেস্তেস পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু তার মাতাই প্রধান শত্রু হওয়ায় সে সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়। এই পরিস্থিতিতে ভগ্নী ইলেকট্রার প্ররোচনায় পিতার মৃত্যুর বদলা নেওয়ার জন্য সে মাতৃহত্যা করে। তখন প্রতিহিংসার দেবীরা মাছির রূপ ধারণ করে ওরেস্তেসকে নানাভাবে যন্ত্রণা দিতে থাকে। ওরেস্তেসের মৃত্যু না হলেও যতদিন সে বেঁচে থাকে ততদিন মারাত্মক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। এই নাটকটির নায়কের চরিত্র দেখে ফ্রান্সের জনগণ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
খ) ‘Les Mains Sales’(ইংরেজিতে ‘Diry Hands’,বাংলায়‘নোংরা হাত’. ১৯৪৮) নাটকটিও ফরাসী জনতাকে প্ররোচিত করেছিল। মনে রাখতে হবে সার্ত্রর লেখকসত্বা ও ব্যক্তিসত্বার মধ্যে কোন আবরণ ছিল না। তিনি নিজে যেভাবে প্রতিরোধের আন্দোলনের শরিক হয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র নেক্রাসভও আন্দোলনের শরিক হয়েছিল। ব্যক্তি সার্ত্রর মধ্যে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল তা নাটকের নায়কচরিত্র নেক্রাসভের সংশয়ের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। নাটকের নায়ক এবং নাট্যকার কেউই দলের সব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু একটা বড় তফাৎ হল নেক্রাসভ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিল, আর সার্ত্র প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছিলেন।
গ) Huis Clos(ইংরেজি ‘No Exit’,বাংলায় ‘প্রস্থান নেই’, ১৯৪৪) নাটকে সার্ত্রর ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যাগুলি সবথেকে বেশী করে প্রতিফলিত হয়েছে, তাঁর অন্তর্দ্বন্দ্ব সবথেকে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তাঁর অন্যান্য নাটকগুলিতে বিভিন্ন রকম সামাজিক সমস্যার সামনে পড়ে বিভিন্ন চরিত্র বিভিন্ন ধরণের অন্তর্দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছে। ফলে এক-একটি চরিত্র এক-এক রকম অনুভবের কথা বলেছে। কিন্তু এই নাটকে নাট্যকার যেন অনেক বেশী করে সামনে এসেছেন।
ঘ) ‘Les Sequestred’Altona’ (ইংরেজিতে ‘The Condemned of Altona’, বাংলায়‘আলটোনার বন্দী’, ১৯৫৯) নাটকে আলটোনার দু’জন বন্দীর মৃত্যু হয়। সেই দু’জন আবার নিজের পরিণতি তথা অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে শুরু করে। এভাবে অস্তিত্ববাদের ধারণা তাঁর নাটকে অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত প্রবাহিত হয়েছে।
জাঁ পল সার্ত্র সারাজীবন নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, কখনও প্রতিবাদের পথ থেকে সরে আসেননি বা আপোষ করেননি। তাঁর জীবনযাপন, আচরণ বা কাজকর্মে সেই মানসিকতারই প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর রাজনৈতিক ও দার্শনিক রচনাগুলিতে নিজের প্রতিবাদী চরিত্রের ছাপ পড়েছে। মাও-সে-তুং, জওহরলাল নেহরু বা হো-চি-মিন প্রভৃতির ক্ষেত্রে ব্যক্তিসত্ত্বা ও লেখকসত্ত্বার মধ্যে যে তফাৎ চোখে পড়ে সাত্রের্র ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও নেই। তবে একটি জায়গায় স্ববিরোধিতা আছে। সার্ত্র একদা লেখকের সর্বময়তার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছিলেন যে একজন ঔপন্যাসিক কখনই ঈশ্বর নন। কিন্তু সেই মানুষটিই নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী বিষয় ও চরিত্র নির্বাচন করেছেন, নিজে যা ঠিক বলে বুঝেছেন সেই পথেই কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং চরিত্রগুলির পরিণতি স্থির করেছেন। এখানে সবথেকে লক্ষ্যণীয় ব্যাপারটি হল তাঁর নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধি থেকেইতিনি লিখেছেন, তাঁর সৃষ্টি কখনই পুরোপুরি কল্পনাশ্রিত বা ছদ্ম নয়। এ হল নিজের জীবনের মত কাহিনীকেও সর্বময় কর্তৃত্ব সহকারে ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ‘The Age of Reason’-এতিনি সরাসরি বলেছেন–“The individual’s duty is to do what he wants to do, to think whatever he likes, to be accountable to no one but himself, to challenge every idea and every person.” এই রচনায় ম্যাথুর চিন্তাভাবনা ও সক্রিয়তার মধ্যে আগাগোড়া চরিত্রটির স্রষ্টা সার্ত্রর অস্তিত্বই অনুভূত হয়। অতএব ডব্লিউ জে হার্ভের সঙ্গে একমত হয়ে বলতে হয় সার্ত্র লেখকের সর্বময়তার সমালোচনা করলেও নিজের সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বসৃষ্ট তত্ত্বের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন।
সাহিত্যজগতে সার্ত্র যে বক্তব্য উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তা একইসঙ্গে শূণ্যতা ও স্বচ্ছতার কথা বলে। আসলে তিনি চেয়েছিলেন মানুষ যেন স্বচ্ছ হয়, কোথাও যেন কিছু লুকিয়ে রাখা বা চাপা দেওয়া না থাকে। মার্কসবাদের দ্বারা তিনি অবশ্যই প্রভাবিত হয়েছিলেন। তবে তিনি অস্তিবাদের ভিত্তিতে গঠিত ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে মান্যতা দিয়েই সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটার কথা বলেছেন। পরবতীকালে মার্কসবাদের সমালোচনা করতে বসে তিনি বলেছিলেনবামপন্থীদের প্রচারিত জনসংযোগের তত্ত্বের দ্বারা মানুষের পারস্পরিক আত্মার অবচেতনকে স্পশ করা অসম্ভবের নামান্তর। কারণ তাঁর মতে একজন ব্যক্তির self-এর সাথে অন্য একজনের self-এর সংযোগ সাধিত হলে তবেই ব্যক্তির প্রকৃত মুক্তি সম্ভব। এই মতের সমর্থন মিলবে তাঁর দুটি রচনায় –‘La Nausee’ এবং ‘Le Mur’। বস্তুত এই রচনাদুটির মাধ্যমে তিনি সমস্যার গভীরে দৃষ্টিপাত করেছেন।
সার্ত্র ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও লেখক। তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য আসলে নিজের দার্শনিক তত্ত্বের ভাষ্য। তাঁর সাহিত্যচিন্তার কেন্দ্রে এই ধারণা বিরাজ করত যেলেখকের দায়িত্ব হল তার নিজের মনকে যে স্বাতন্ত্র্যবোধ আলোড়িত করছে পাঠকমনে তার সঞ্চারণ ঘটান। এর পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলী। লেখকে এই বাধা অতিক্রম করতে হবে। বাইরে যাকে দেখা যাচ্ছে সেই মানুষটি নয়, ভিতরে যে সত্ত্বা রয়েছে সেই প্রকৃত লেখক। এই ভিতরের সত্ত্বাকে যিনি বাঁচিয়ে রাখতে পারেন তিনিই সত্যিকারের লেখক।
অনেক সমালোচক মনে করেন সার্ত্র যে মাণদণ্ডে সাহিত্য বিচার করেন তার সার্থক প্রতিফলন তাঁর নাটকগুলিতে এবং কিছুটা উপন্যাসে। তিনি সাকুল্যে পাঁচটি ছোটগল্প লিখেছিলেন যেগুলি ‘Le Mur’ নামক বইতে প্রকাশিত হয়। গল্পগুলি তাঁর দার্শনিক সত্ত্বাপ্রসূত এবং বোধের আলোকে উজ্জ্বল, পাশাপাশি সাহিত্যমূল্যের বিচারেও রসোত্তীর্ণ। এখানে সার্ত্রের গল্পগুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা প্রয়োজন।
১. ‘Le Mur’ গল্পগ্রন্থের প্রথমগল্পটিরও নাম ‘Le Mur’ (ইংরেজিতে ‘The Wall’, বাংলায় ‘দেওয়াল’, 1039)।এর আখ্যান হল কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বন্দী হয়েছেন এবং তাঁদের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে। দণ্ডিতদের মধ্যে একটি কিশোরও আছে যে মৃত্যুভয়ে ভীত ও অস্থির। এই গল্পে সার্ত্র বলতে চেয়েছেন মৃত্যুভয়ে জীবনের মানে, মূল্যবোধ প্রভৃতি অর্থহীন হয়ে যায়। অনেকের মতে মৃত্যুচিন্তাই এই গল্পের মূল উদ্দেশ্য। আবার অনেকে মনে করেন গল্পের নায়কের শেষ পর্যন্ত বেঁচে যাওয়া থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের দ্বারা মৃত্যুকেও দূরে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব। অর্থাৎ লেখক বোঝাতে চেয়েছেন মৃত্যু মানুষের পরিণতি এটাই বড় কথা নয়। এই গল্পটির সাথে লেখকের ‘Men without shadows’–এর মিল পাওয়া যায়।
২. সার্ত্রের ‘Erostrate’ গল্পটি কেবলমাত্র ঘৃণাকে অবলম্বন করে একজন মানুষের পক্ষে সুস্থভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব কি না তার পরীক্ষা। শেষে লেখক দেখিয়েছেন যে তা সম্ভব নয়। এই গল্পের হিলবার্ট চরিত্রটি তুলনায় মর্বিড, সে যেভাবে মৃত্যু বা যৌনতার কথা বলে তা পাঠকের মনে ঘৃণা জাগায়। কেউ কেউ গল্পটিকে মর্বিডিটি ও অশ্লীলতার জন্য সমালোচনা করলেও এটি সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। আসলে সার্ত্র জীবনের ঘৃণিত অংশগুলিকে উপেক্ষা করতে চান নি, কারণ সামগ্রিক বিচারে এগুলিও জীবনেরই অংশ।
৩. তাঁর ‘Intimite’ (ইংরেজিতে ‘Intimacy’, বাংলায় ‘অন্তরঙ্গতা’, ১৯৪৯) গল্পটিতে আছে আত্মপ্রবঞ্চনার তত্ত্ব, অর্থাৎ আমরা নিজেদের বহু অন্যায় বা ভুল স্বীকার করতে চাই না। মনস্তত্ত্ববিদেরা বলেন এ হল অবচেতনের সঙ্গে সম্পর্কিত, যদিও সার্ত্র আবার অবচেতনকে মানেন না। তাঁর মতে অন্যায় চিন্তাকে মানুষ যখন মন থেকে তাড়িয়ে দেয় তখনও সেই চিন্তাকে পুরোপুরি বর্জন করা যায় না, কারণ সেই অন্যায় সম্বন্ধে আমাদের সঠিক ধারণার অভাব।
৪. ‘La Chambre’ (ইংরেজীতে ‘The Room’, বাংলায় ‘ঘর’) গল্পে আমরা দেখি একজন স্বাভাবিক যুবতী তার পাগল স্বামীর জীবনে ঢুকতে পারছে না। এখানে সার্ত্র বলতে চান জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে মানুষ অস্বভাবিক জীবনে প্রবেশ করতে পারে, কিন্তু এরকম ঘটলে জীবন পূর্ণতা পায় না। আর একটু গভীরে গেলে দেখব আসলে তিনি বলতে চাইছেন ব্যক্তি চাইলে তার স্বাধীন সত্ত্বাকে নষ্ট করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে জীবনের স্বাধীনসত্ত্বাটি রক্ষিত হয় না।
৫. ‘LEnfanced’um chef’ (ইংরেজি ‘The Childhood of a Leader’, বাংলায় ‘জনৈক নেতার শিশুকাল’) গল্পটিতে সমাজ ও রাজনীতিকে সার্ত্র আঘাত হেনেছেন।এই গল্পে তাঁর রজনৈতিক বক্তব্য ও অস্তিবাদী দর্শনের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।
পাঁচটি ছোটগল্প, নাটকগুলি এবং ‘La Nausee’ছাড়া সার্ত্র আর একটি উপন্যাস লিখেছিলেন। এই উপন্যাসের তিনটি খণ্ড তিনি সম্পূর্ণ করেছিলেন, কিন্তু চতুর্থ খণ্ডটি লেখা হয় নি। তাঁর রচনাগুলির সামগ্রিক বিচারে আমরা দেখতে পাই মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তিকে তিনি সবথেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আঙ্গিকের দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি যে পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন তা পুরোপুরি প্রথাবিরুদ্ধ। এই টেকনিকটি হল, চরিত্রগুলির মনের গভীরে ঢুকে গিয়ে সেখানে যেসব চিন্তাগুলি বিক্ষিপ্তভাবে খেলা করছে সেগুলিকে ভাষার মাধ্যমে প্রতিফলিত করা। এই আঙ্গিক ব্যবহার করার ফলে তাঁর উপন্যাসে তিনটি বিশেষ দিক স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল –রাজনৈতিক বক্তব্য, দার্শনিক তত্ত্ব ও প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তাঁর গল্পগুলিতেও এই পদ্ধতির যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায়।
সার্ত্র কখনই লেখককে সর্বজ্ঞ বলে মনে করতেন না। তিনি এই ধারণা পোষণ করতেন যে লেখক যে চরিত্রগুলি সৃষ্টি করবেন তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেবেন। এর ফলে চরিত্রগুলি নিজের নিয়মেই এগিয়ে চলবে এবং কাহিনীও আপন গতিতে এগোবে। এটা ঠিক যে সবসময় তিনি এই ধারণার অনুসরণ করতে পারেন নি। তা সত্বেও তিনি সর্বক্ষেত্রেই ব্যক্তির স্বাধীনতাকে সবথেকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। সেইজন্যই সার্ত্র বলেছিলেন–“Life has no meaning a priori . . . . it is up to you to give it a meaning, and value is nothing but the meaning that you choose.”