প্রবন্ধ: গল্পে গল্পে বাংলা লেখার সাত সতেরো

প্রবন্ধ: গল্পে গল্পে বাংলা লেখার সাত সতেরো

প্রবন্ধ: গল্পে গল্পে বাংলা লেখার সাত সতেরো
রেখা রায়

◆কি এবং কী
রেখা রায়

অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম বিষয়টি নিয়ে। লিখতে লিখতে নিজেরও ধন্দ জাগে অনেক সময়ই। তাই খুঁজতে শুরু করি মূলত সেখান থেকেই। যা পেলাম , আগ্রহীদের জন‍্য শেয়ার করলাম।
১/ যদি প্রশ্ন করা হয় আর সে প্রশ্নের উত্তর হ‍্যাঁ বা না হয় অথবা সহজভাবে বলতে গেলে মাথা নাড়িয়ে উত্তর যদি দেওয়া যায় প্রশ্নের, তবে সেক্ষেত্রে প্রশ্নে “কি”-র ব‍্যবহার হবে। যেমন– তোমার লেখা কি শেষ? জেরক্স কি হল?
২/ যদি প্রশ্ন এমন হয় যার উত্তর মাথা নাড়িয়ে দেওয়া যাবে না, শব্দ ব‍্যবহার করতেই হবে, তখন “কী” হবে। যেমন–তুমি যেন কী পুরস্কার পেয়েছ? ওটা কী দিয়ে ঘর মুছেছিলে সেদিন? রাতে কী খাবে? ভাত কী রুটি?
৩/ বাক‍্যে ব‍্যবহৃত পদটি অব‍্যয় হলে “কি” হবে। যেমন–এমনকি, নাকি,কিসে,কিভাবে,বৈকি।(নতুন বানানে দেখলাম…”কীভাবে”-ও চলছে।)
৪/ বাক‍্যে যখন শব্দটি ক্রিয়া বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ এবং বিস্ময়সূচক অর্থে ব‍্যবহৃত হবে তখন “কী” হবে।
৫/ বাক‍্যের প্রথমে না বসে, শেষে বসলে “কি” হবে।
যেমন–সত‍্যি করে বলতো…তুমি কখনো আমায় ভালোবেসেছো কি ?
৬/ প্রশ্নবোধক সর্বনাম হলে “কী” হবে।
সহজ কথায় বলতে গেলে
(ক) দীর্ঘ বিবরণে উত্তর হলে ক-য় দীরর্ঘ-ই(কী)।
(খ) অতি হ্রস্বে উত্তর হলে ক-য় হ্রস্ব-ই(কি)।
কিছু উদাহরণ……
আজ কিছু লিখলে কি?
কী লিখলে?
কী আর বলব তোমায় !
কি বাংলা ,কি ইংরেজি …দুটোতেই তুমি ভালো।

◆Paddle_শত্রু_অশ্রু

তখন স্থায়ী কোনো চাকরি পাইনি। ডেপুটেশন ভ‍্যাকেন্সিতে একটি উচ্চ মাধমিক স্কুলে পড়াচ্ছি। ছোট ছোট কিছু স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা চলছে মাত্র। আমি দোকান থেকে ছিট কাপড় কিনে এনে জুড়েটুড়ে ডিজাইন করে বালিশের খোল, বিছানার চাদর, পর্দা আর মেয়ের ফ্রক বানাতাম।
ভাবলাম…সেলাই স্কুলে ভর্তি হই না কেন ! ভালো করে শিখি। সেলাই স্কুলে ভর্তি হলাম। দূর দূর থেকে মহিলারা, মেয়েরা শিখতে আসত। তিন চারজন দিদিমণি ছিলেন। বেশ কাটত সময়টা। পরীক্ষা দেওয়ার ব‍্যবস্থা ছিল। আমি অবশ‍্য তার আগেই স্থায়ী চাকরি পেয়ে সেলাই স্কুল ছেড়ে দিই।
একদিন হয়েছে কী অন‍্যরা পরীক্ষায় বসে “প‍্যাডেল” বানান নিয়ে সমস‍্যায় পড়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করে। হয় কী, যদি নিজে লিখে যাই তবে ঠিক হয়, অন‍্যে জিজ্ঞেস করলে ধন্দে পড়ি। সুতরাং দুটো “ডি” না একটা “ডি” ভাবতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় অভিনেতা ভানু বন্দ‍্যোপাধ‍্যাকে স্মরণ করি… পিলারে ক-টা এল?
ওবাবা, ও যে বড় শক্ত পোক্ত ব‍্যাপার ,নড়বড়ে হলে চলবে না। অতএব দুটো এল-ই লাগাও।
সুতরাং পায়ের জোরে মেশিনের প‍্যাডেল যখন ঠেলতেই হয় তো একটা ডি-এর ঠেলাতে তেমন জোর আসবে না । প‍্যাডেল হবে দুটো ডি যুক্ত (Paddle)।
দীর্ঘদিন স্কুলে চাকরি করা অবস্থায় স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের খাতা দেখা, মাধ‍্যমিকের খাতা দেখা এবং পর্ষদের হেড এগজামিনার হবার সুবাদে কত রকম ভুল বানান যে দেখেছি কী বলব !
আজও ছাত্রছাত্রীরা “শত্রু” বানান ভুল লেখে।
ত্রু উ-কারের আঁকশিটা নীচের দিকে টেনে দেয়। শেখালেও বেশির ভাগের মনে থাকে না। তখন বোঝাই…ওরে , “শত্রু” কখনো কি মাথা নীচু করে থাকে? মাথা উঁচু করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাহলে “শত্রু”-র আঁকশিটা ওপর দিকেই রাখিস। এবার কিন্তু তারা আর ভোলে না।
এবার আসি “অশ্রু”-র কথায়। ডেঁফো ছাত্রছাত্রীও তো থাকে কিছু।
“আচ্ছা ম‍্যাডাম, চোখের জল তো নিম্নগামী। তাহলে “শ্রু”-র আঁকশি ওপর দিকে কেন?”
তাদের জন‍্য আলাদা গল্প। সেই যে গৌরচন্দ্রের কথা…কপাল ভাসিয়া যায় নয়নের জলে।
আচ্ছা, নয়নের জল কেন কপাল ভাসাবে? সে তো গাল ভাসাবে মানে কপোল ভাসাবে। কিন্তু কথকঠাকুর হারবেন কেন ? মুখের কথা বেরিয়ে গেলে আর কি ফেরৎ আসে? সুতরাং গোঁজামিল দিতেই হয়…
আরে প্রভুর পা দুখানি বাঁধা ছিল তমালের ডালে। তাহলে বিষয়টা দাঁড়াল…
“কপাল ভাসিয়া যায় নয়নের জলে
প্রভুর পা দুখানি বাঁধা ছিল তমালের ডালে।”
**এই গল্প মনে রাখলে অশ্রুর আঁকশি ওপর দিকে থাকবেই। এবার আর ভুল হয় না।

◆আশ্চর্য_সম্মান ইত‍্যাদি

ঐ যে বলছিলাম বানান বিভ্রাটের কথা…
দেখেছি বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে , এমনকি বড়রাও উচ্চারণে ভুল করে। আর তাই ভুল বানান লেখে। সঠিক উচ্চারণ হলে সঠিক বানান লেখার সম্ভাবনা আমার মতে ৯৫%। বাকী ৫% অভ‍্যাসে ঠিক হয়।
বানান ঠিক লেখার জন‍্য বই পড়া দরকার। পড়তে পড়তে চোখে শব্দের গড়ন স্থায়ীভাবে ধরা পড়ে। ফলে লিখতে গেলে ভুলটা নজরে আসবেই। এখনো অনেক সময় আমি ভুল বানান ঠিক লেখার জন‍্য কাগজ কলমের ওপর নির্ভর করি। বানান মুখস্থও করতে হয়।
আমি তো অনেককেই বলি…বাচ্চাকে আবৃত্তি শেখান। আবৃত্তির অনেক গুণ। প্রথমত…সঠিক উচ্চারণ শেখা, দ্বিতীয়ত…কবিতা মুখস্থ করতে গিয়ে স্মৃতিশক্তির ব‍্যায়াম হয়। যার ফলে পরীক্ষায় নম্বর তোলারও সুবিধে হয়। একটু জেনে বুঝে মুখস্থ করলে শ্রেণিতে ভালো রেজাল্ট হবেই। আর কে না জানে মুখস্থ ছাড়া ভালো রেজাল্টের অন‍্য কোনো কায়দা নেই। নিন্দুকরা যাই বলুক না কেন। এমনকি বেশি বয়সে মানুষের যে স্মৃতিবিভ্রম ঘটে তার থেকেও রেহাই পাবার উপায় স্মৃতিশক্তির ব‍্যায়াম।
তৃতীয়ত…অন‍্যের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার একমাত্র উপায় হল কথা। সঠিক উচ্চারণে, সঠিক স্বরক্ষেপনের দ্বারাই কেবল অন‍্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। সুন্দরভাবে কথা বললে চাকরীর ক্ষেত্রে ইন্টারভিউতে আমি সামনের দিকে থাকবই। আমার একটি অভিজ্ঞতা আছে। সেটা বলি… আমার পরিচিত এক যুবক SBI-র লিখিত পরীক্ষায় রাজ‍্যে প্রথম হয়েছে। কিন্তু ইন্টারভিউতে সে এতটাই ধেড়িয়েছে যে চাকরীটাই হল না।
একই কথা দুজন মানুষের মুখ থেকে দু রকম ভাবে প্রকাশিত হয়। যার কথা ভালো লাগে ,তাকে সকলেই ভালোবাসে। এ অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত‍্যেকেরই আছে কিছু না কিছু।
বানানের কথা হচ্ছিল…
দু একটি মজার ঘটনা বলি। আমাদের বাড়ি থেকে দু তিন মিনিট হেঁটে ওঠা যায় শহরতলির বুক চিরে চলে যাওয়া বড় রাস্তা…বজবজ ট্রাঙ্ক রোডে। ওখানে মিউনিসিপ‍্যালিটির সামনে তিন মাথার মোড়। ওটাই বাসস্ট‍্যান্ড। একবার আমি তারাতলা থেকে ফিরছি বজবজ। কনডাক্টর টিকিট কাটতে কাটতে এল আমার সামনে। টাকা দিলাম।
** কোথায় নামবেন?
** প‍্যায়েস্টার মোড়।
** কোথায়?
** প‍্যায়েস্টার মোড়।
** ( চোখমুখ কুঁচকে) কোথায়?
** প্লাস্টার মোড়।
** তাই বলবেন তো প‍্যালেস্টার মোড়। তখন থেকে কী সব বলে চলেছেন। নামটা ঠিকঠাক বলতে পারেন না? গাড়িতে ওঠেন না নাকি ??
** হ‍্যাঁ বাবা ঠিক বলেছো।
আসলে আমাদের এই মোড়টির নামকরণ হয়েছে
এ. ই. প‍্যায়েস্টার নামক এক সাহেবের নামে। তখন ইংরেজ আমল। উনি বজবজ মিউনিসিপ‍্যালিটির দ্বিতীয় দফার বোর্ডের একজন কাউন্সিলার ছিলেন। যে কোনো কারণেই হোক সংক্ষেপে মোড়টির নাম হল তাঁরই নামে প‍্যায়েস্টার মোড়। যাঁরা ভুল উচ্চারণ করেন তাঁরা কখনো কী সঠিক বানান লিখতে পারবেন ঐ মোড়ের ?
অনেকদিন পর্যন্ত CHEVIOT JUTE MILL-কে চিপওয়ার্ড জুট মিল বলেই জানতাম। ঐ অঞ্চলের লোকজন সেটাই বলত। এখনো বলে অনেকে।
নতুন বিয়ে হয়েছে। টিন এজ আমার। আমাদের রান্নার জন‍্য রাখা বহু পুরোনো বয়স্ক দিদিমা , আমার বড় জা আর আমি এক বিকেলে গল্প করছি। কী এক কথা প্রসঙ্গে “বেতোবাটি” -র কথা উঠল। আমি বলে উঠি…বৈদ‍্যবাটি ? তো সেই দিদিমা আমার বড় জা-কে তখুনি বলল…মেজবউমা তো গ্রামের মেয়ে, তাই কিরকম যেন উচ্চারণ করে।
বলার কথা এই…এই রকম উচ্চারণ যদি চলে আসে তবে ভুল বানান হবেই। উচ্চারণ অনুযায়ী আমাদের লেখনী চলে। বহু মানুষ কী পুরুষ, কী মহিলা বলেন…আশ্চার্য, অত‍্যান্ত, সন্মান, সন্মার্জনী , রিস্কা ইত‍্যাদি। আসল উচ্চারণ তো আশ্চর্য, অত‍্যন্ত, সম্মান, সম্মার্জনী, রিক্সা। বলতে দ্বিধা নেই অনেক মাস্টারমশায় দিদিমণিকেও “সন্মান” বলতে শুনেছি।
তাই বলি…সঠিক বানান লেখার প্রাথমিক শর্ত হল ঠিকঠাক উচ্চারণ করা।
বই পড়লে শব্দের সঙ্গে চোখের যোগসূত্র ঘটে। বই পড়াও অত‍্যাবশ‍্যক।

◆বাবলা_গাছে_বাঘ_ঝুলেছে ইত‍্যাদি

কৈশোরে আমাদের একটা খেলা ছিল…দ্রুতগতিতে একটি পংক্তি এক নাগাড়ে বলে যাওয়া। এইরকম দু/ তিনটে পংক্তি ছিল…
১/ পাখি পাকা পেঁপে খায়।
২/ বাবলাগাছে বাঘ ঝুলেছে।
৩/ জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা।

উচ্চারণের দ্রুততায় ঠিকভাবে কথাগুলো বলা যেত না বেশির ভাগ সময়। তবে একটু একটু করে এগোতাম নির্ভুল বলার দিকে। কিন্তু কেউ কখনো একবারও ঠিক বলতে পেরেছে বলে মনে করতে পারছি না। এর একটা বিরাট উপযোগিতা ছিল। জিভের আড়ষ্ঠতা কাটত। একেবারে অজ পাড়া গাঁয়ে আমার জীবনের শিখন পর্বের ভিত্তি স্থাপন হলেও কখনো “পোসেনজিৎ” , “পোশ্ন” বা “গরমেন্ট” উচ্চারণ করতে পারিনি। মনে রাখতে হবে…কথাই শ্রোতাকে বুঝিয়ে দেয় বক্তা সমাজের কোন স্তর থেকে উঠে এসেছে।
আগেই বলেছি…ভুল উচ্চারণ মানে ভুল বানানে লেখা।
ফেস বুকে একটি পোস্ট দেখলাম কে যেন লিখেছে…”কুমড়ো শুনলেই আমার কর্তার মুখ ভাড়।” … এই রকম একটি কথা। ভ-য় আ-কারের মাথায় একটি ” ঁ ” বসিয়ে দিলে হয়তো বা কর্তার মুখের আকার আকৃতি বুঝতে পারতাম। কিন্তু “ভাড়” শব্দের অর্থ বুঝলাম না একেবারেই।
“র” আর “ড়”-এর তফাৎ করতে পারে না কয়েক পুরুষের শিক্ষিত আজকের প্রজন্মও। অনায়াসে “তার”-কে বলে “তাড়”, “নারকোল” অবলীলায় হয়ে ওঠে “নাড়কোল”। আমি এই বর্ণ দুটির উচ্চারণের তফাৎ বোঝাতে ছোটবেলার উপরোক্ত দুটি পংক্তির অনুকরণে শেখাতাম এইভাবে…নারকোল গাছ থেকে নারকেল পড়েছে…বলে চল দ্রুত।
কখনো কখনো ঠিক বলত ছেলেমেয়েরা। কিন্তু লেখার সময় ঐ একই ভুল।
আবৃত্তির বিচারক হতে হয় কখনো কখনো। সেখানেও ঐ ভুল। যারা গুরুর কাছে শেখে ,তাদের অনেকের সঠিক হয়।
র-ফলার মত রেফ উচ্চারণ হয়না অনেকের। যেমন-পূর্ব-কে বলে পূব্ব, সূর্য অনায়াসে হয়ে যায় সূযয। এই ক্ষেত্রে শোনাই বুদ্ধদেবের আমলের পালি ভাষার কথা। সেখানে জিভের আড়ষ্ঠতা হেতু রেফ বাতিল হয়ে বর্ণের দ্বিত্ব এল। পুত্র হয়ে উঠলো পুত্ত। এখন সে আড়ষ্ঠতা কেটে গেছে। পালি মৃত ভাষা। তবুও অনেকদিন পর্যন্ত পূর্ব-কে পূর্ব্ব লেখা হত। এখন দ্বিত্ব উঠে গেছে।
বেশির ভাগ ছেলেমেয়েদের , সে গ্রামই হোক বা শহর, শ,ষ, স-এর উচ্চারণে পার্থক‍্য বোঝাতে কালঘাম ছুটে যায়। ইংরেজির বর্ণীকরণ বোঝাই… শ, ষ-sh, স-s হবে। বলার সময় এটা মনে রাখলেই উচ্চারণ ঠিক হবে।
কিন্তু যারা কোথায় ষ, কোথায় স হবে, কোথায় ন, কোথায় ণ হবে বুঝতে পারে না, তাদের ব‍্যাকরণের নিয়ম ধরে ধরে বোঝাতে হয়। সাধারণ ভাবে ঋ,র, ষ-র পরে স হয় না, ষ হয়। কিছু ক্ষেত্রে ব‍্যতিক্রম আছে। আর ঋ র ষ-র পরে ন হয় না ণ হয়। কিছু ব‍্যতিক্রম আছে। আমি সংক্ষেপে আপাতত এগুলো বলছি।
আমাদের সময় একটা ক্লাস থাকত হাতের লেখার বা শ্রুতিলিখনের। তা ছাড়া দীর্ঘ ছুটিতে ৩০ পাতা ইংরেজি হাতের লেখা আর ৩০ পাতা বাংলা হাতের লেখা জমা দিতে হত শ্রেণি শিক্ষিকার কাছে। গ্রামাঞ্চলের স্কুলে এটা ছিল। আমিও শহরতলির স্কুলে গরমের ছুটিতে এবং পুজোর ছুটিতে এটা ছুটির কাজ দিতাম। স্কুলের বড়দি হওয়ার পর অন‍্যদের নির্দেশ দিতাম অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ‍্যতামূলকভাবে অন‍্য কিছুর সাথে এটাও ছুটির কাজ দিতে। বিশেষ করে ভাষা বিষয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা এই দিকটি মাথায় রাখলে ভালো হয়।
সব বিষয়েই বানানে যত্নবান হওয়া উচিত। সাহিত‍্যের ক্ষেত্রে তো বটেই। পরীক্ষার খাতায় বানান ভুল দেখলে পরীক্ষকের মেজাজ বিগড়ে যায়। অবশ‍্যই নম্বর উঠবে না। ফেস বুক তো ভুল বানানের স্বর্গভূমি। এত মানুষ লেখেন, এত কিছু বিষয়ে যে ভালো লাগে পড়তে। কিন্তু পদে পদে বানানে হোঁচোট খেলে রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটে। কত রকম ভুল যে চোখে পড়ে !
অনেকে এত স্মার্ট যে এসপ্ল‍্যানেড-কে বলে স্প্ল‍্যানেড, বরানগর তাদের উচ্চারণে হয়ে যায় বরাহনগর, শিয়ালদা (Sealdah) হয়ে যায় শিয়ালদহ। আসলে বানানের হ-টি উচ্চারণে লুপ্ত হ উচ্চারিত হয়। উচ্চারণ সঠিক না হলে লেখার বানানে ভুল হতে বাধ‍্য।
একটি মজার কথা বলি…
বজবজের আগের রেল স্টেশনের নাম…নুঙ্গী। লোকজন হামেশাই বলে লুঙ্গী। “ট্রেন লুঙ্গী ছেড়ে আসছে।” বলে। এদের লেখায় জায়গাটির বানান কি কখনো সঠিক হবে? হবে না।

◆যাঁর_যাঁর_তাঁর_তাঁর

যা যা বলেছি আগে মনে করে দ‍্যাখো। ঐ দেখো… “দ‍্যাখো” বলে ফেললাম। আসলে তো “দেখো”। কথাকাররা এখন বিনোদনমূলক লেখায় মানে সাহিত‍্যে দ‍্যাখো-ই ব‍্যবহার করছেন অনেকে। গুরুদেব বলেছেন…তুমি কেমন ক’রে গান করো হে গুণী।
কবিতায় এখন অনায়াসে “ক‍্যামন” চলছে। উচ্চারণ অনুসারী লেখনী। কালকে কবি সোমনাথ রায়ের সাথে কথা হচ্ছিল বানানটানান নিয়ে। পণ্ডিত মানুষ উনি। তাও আমাকে বলছেন…কী যে ঝামেলা, কী বলব ! ঐ আগে লিখতাম “ক’রে”। লেখাতেই বলে দেওয়া থাকত উচ্চারণ হবে “কোরে”। পাঠ করতে গিয়ে ধন্দে পড়া নেই। এখন ক-এর মাথায় ঐ লোপ চিহ্ন(‘)-টি তুলে দেওয়ার ফলে গল্প বা কবিতা ফাইনালি পাঠ করার আগে মহড়া দিয়ে নিতে হয়। অনেক সময় সময়াভাব ঘটে। তখন বড় ঝকমারি। উচ্চারণে কোনো বর্ণের লোপ হলে ঐ লোপ চিহ্ন (‘)-টি বসানো হত আগে। হত বললাম। এটি আগে হলে লিখতাম হ’ত। এখন কেউ কেউ লেখেন… হোতো। অনেকে “চেয়ে” না লিখে, লেখেন “চে”। এটা আমার বেশ লাগে লিখতে।
বছর দু আড়াই হবে সাহিত‍্যিক রাজা সরকার বলছিলেন…বিদেশে সাহিত‍্যে এখন যতি চিহ্নের ব‍্যবহার অনেক সময় করছেন না সাহিত‍্যিকরা। পাঠক নিজের নিজের মত পড়ছেন। আমার মনে পড়ল…তুমি সরস্বতী পূজার দিন আসিও না আসিলে রাগ করিব
আমি যদি পড়তে গিয়ে এভাবে থেমে থেমে পড়ি…তুমি সরস্বতী পূজার দিন আসিও না, আসিলে রাগ করিব। হে হে… কী গেরো কী গেরো !
তবে পরীক্ষার খাতায় কিন্তু ঐমত বানানটানান লেখার পরীক্ষানিরীক্ষা না করাই ভালো।
যাক গে যাক। আমি বলি কী ঠিকঠাক বানানে লেখায় বড় হ‍্যাপা। কঠিন কঠিন শব্দে তো আরো।তাহলে কঠিন শব্দ লিখবে কেন? বরং সহজ সরল বানানে সহজ করে লেখাই ভালো। তাতে বানান ভুলের সম্ভাবনা কমে যাবে। চলিত বাংলায় লেখাই হয় এখন সর্বত্র। আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় ছাড়া কোত্থাও সাধুগদ‍্যের ব‍্যবহার নেই। সাধুগদ‍্যেই কেবল তৎসম শব্দের ব‍্যবহার হয় বেশি। ছোটোবেলায় পাড়ার এক দাদু আমাকে দেখলেই মস্ত মস্ত শব্দের বানান ধরত। শব্দগুলো হল…কার্ত্তিকবীর্যার্যু, কুজ্ঝটিকা …এমনি ধরণের। তখন এত রাগ হত যে কী বলব। সুড়ুৎকরে দৌড় দিলেই মায়ের কাছে নালিশ যেত। প্রতিজ্ঞা করতাম…জীবনে আর ফার্স্ট হব না ক্লাসে।
বাংলায় ক্রিয়াপদের ব‍্যবহার সব সময় ভালো শোনায় না। প্রয়োজন ছাড়া সব সময় ক্রিয়াপদের ব‍্যবহার না করাই ভালো। লেখার সময় প্রতি বাক‍্যে ক্রিয়াপদের ব‍্যবহারে সাহিত‍্যের গুণগত মান সব সময় বজায় থাকে না। যেমন…আজ বাজারে যাবে কে , বাবা না দাদা, ঝামেলা বাধল।এখানে “তাই নিয়ে” ঝামেলা…কথাটি না বললেও সবাই বুঝে গেল বক্তব‍্যটি।
তাছাড়া সহজ সরল সাবলীল লেখা পড়তে সকলেই ভালোবাসে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন…
“সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায় না বলা সহজে।”
সত‍্যিই তাই।
এই প্রসঙ্গে বহুকাল আগের একটি ঘটনা মনে পড়ল…
নিউ আলিপুরের বেসরকারী নামী বাংলা মাধ‍্যম একটি স্কুলের ক্লাস এইটের এক ছাত্রী আমার কাছে পড়তে এল। তখনো প্রাইভেট টিউশান শিক্ষকদের জন‍্য নিষিদ্ধ হয়ে যায় নি। তখনো আমি মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদের বাংলা বিষয়ের প্রধান পরীক্ষক হয়ে যাই নি। কিন্তু অনেক বছর মাধ‍্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখছি। মেয়েটিকে যতই সহজ কথায় লিখতে বলি বা লেখাই, সে কিছুতেই রাজী হয় না লিখতে বা আমার লেখানোও তার পছন্দ হয় না। তার কথা হল… আমাদের স্কুলে বড় বড় লেখা এবং ভাষার কারুকার্য চায়। যত বলি …ওরে, ওসব আমাদের সময় ছিল। এখন ওসব চলে না।
পরের বছর অবশ‍্য সে আমার কাছে আর পড়ে নি। কিন্তু ঐ বছর থেকেই মাধ‍্যমিকের প্রশ্নের উত্তর লেখায় বাক‍্য সংখ‍্যা নির্ধারিত হয়ে গেল।
লেখার সময় এত ছোটোখাটো ভুল বড়দেরও হয় যে কী বলব ! ব‍্যাকরণে সর্বনামের পুরুষে “তুচ্ছার্থক” এবং “সম্ভ্রমার্থক” রূপ আছে। লেখার সময় কেউ কেউ লিখছি… যাদের আসার কথা ছিল, তারা এসেছেন। এটা ভুল। লিখতে হবে …যাঁদের আসার কথা ছিল, তাঁরা এসেছেন।
ওদের আসার কথা ছিল, আসেন নি। এখানে লিখতে হবে…ওঁদের আসার কথা ছিল, আসেন নি।
এরা ঠিকই বলেছেন …নয়, লিখতে হবে…এঁরা ঠিকই বলেছেন।
সম্ভ্রমার্থকসূচক চন্দ্রবিন্দু(ঁ )-র যথাযথ ব‍্যবহার ভুলে যাই আমরা।

◆সকালবেলা_morning_walk_এবং_love_marriage_করে_বিয়ে

আমরা যখন ছোটো ছিলাম তখন “দূর্গা” লিখতাম।তখন গ্রামে ছিলাম। অত সচেতন ছিলাম না। জানতামও না ঠিক বানান। মাস্টারমশায় দিদিমণিরাও সংশোধন করে দেননি। কেন করেন নি সেবিষয়ে কিছু বলতে পারব না। শহরে এসে জানলাম…অনেক ভুল বানানকে সঠিক ভেবে ব‍্যবহার করেছি। শুধরানো হয়নি।
সেসবের দু একটা বলি…ঠিক বানান হল… দুর্গা, প্রতিযোগিতা (কিন্তু প্রতিযোগী), সর্বজনীন, পুজো (কিন্তু পূজা),জীবিকা (কিন্তু জীবী), শারদীয় ইত‍্যাদি। এখন নতুন বানানে শারদীয়া লেখা হচ্ছে। কিন্তু বাংলা ব‍্যাকরণে “ঈয়া”-প্রত‍্যয় নেই। “ঈয়” আছে।
পুজো এলেই পাড়ার মোড়ে মোড়ে ঝুলবে ফেস্টুন…অমুক পাড়ার সার্বজনীন শারদীয়া দূর্গা পুজা। লাল, মেরুন, সাদা কাপড়ের ওপর বানানের জ্বলজ্বলে শ্রাদ্ধ ! তার ওপর নামী প্রকাশনার পুজো সংখ‍্যায়ও লেখা থাকে…শারদীয়া সংখ‍্যা।
এ যেন ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়। তাই বোধ হয় সমঝোতা করতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন…বানান মানে বানানো।
আসলে পদে পদে ভুল বানানে হোঁচট খেলে সাহিত‍্যের রসাস্বাদনে ব‍্যাঘাত ঘটে। টি ভি সিরিয়াল দেখতে বসে বার বার “কেবল-লাইন”- এর গন্ডগোল হলে কী বিরক্তিই না লাগে! শেষে ধ‍্যুত্তেরিগা বলে উঠে পড়তে হয় টি ভি বন্ধ করে।
সেদিন কোথায় যেন দেখলাম চায়ের দোকানের দেয়ালে লেখা বিজ্ঞাপন…এখানে খাঁটি গরুর দুধ পাওয়া যায়।
বাক‍্যে পদক্রম ঠিক না হলে বিজ্ঞাপন দেখে লোকে হাসবেই। কেননা, গরুতে যে ভেজাল নেই…সে তো দেখাই যাচ্ছে। খাঁটি গরুর দুধ, নাকি গরুর খাঁটি দুধ হবে?
আবার অনেকে খাঁটি বাংলার সাথে তৎসম শব্দ মিশিয়ে ফেলেন। যেমন…এখানে ইলেক্ট্রিক চুল্লিতে মড়াদাহ করা হয়। মড়াদাহ নাকি শবদাহ? মড়া পোড়ানোও হতে পারে।
বলার সময়ও ঠিক ঠিক প্রক্রম বজায় রেখে না বললে শুনতে ভালো লাগে না। “প্রক্রম”-টা আবার কী? প্রক্রম হল…বলতে গেলে বা লিখতে গেলে কিছু শব্দ পর পর চলে আসার একটা প্রবনতা বা ঝোঁক থাকে। যদি সেই ঝোঁককে গুরুত্ব না দিই তবে প্রক্রম বজায় রইল না। যেমন…এবার পুজোয় জামা চাই, জুতো চাই, বেড়ানোও দরকার। তাহলে প্রক্রম বজায় রইল না। শুনতে ভালো লাগল না। যদি বলি…এবার পুজোয় জামা চাই, জুতো চাই, বেড়ানোও চাই। তাহলে প্রক্রম বজায় রইল। শুনতেও ভালো লাগছে।
আর একটি জিনিস হল…এখানে যৌগিক বাক‍্যে এবং, আর…এই ধরণের সংযোজক অব‍্যয় ব‍্যবহার করা হয়নি। পরীক্ষার খাতায় ব‍্যাকরণে যোগ করতেই হবে। কিন্তু সাহিত‍্যে না করলে কোনো ক্ষতি হয় না। সব সময় বরং অব‍্যয়ের ব‍্যবহার করলেই শ্রুতিমাধুর্যের হানি ঘটে।
ইংরেজি থেকে যখন বর্ণীকরণ করব, তখন সব সময় হ্রস্ব-ই কার ব‍্যবহার করব।
একটা মজার কথা বলি…হরেনবাবু সকালবেলা morning work করতে এসে জানিয়ে গেলেন… হারুর যে ছেলেটি রোজ রোজ কোলকাতায় ডেলি প‍্যাসেঞ্জারি করে, সে love marriage করে বিয়ে করেছিল, বউটি গতকাল suicide করে মারা গেছে।
হে হে …এ আর কী বলব !! সাধারণ জ্ঞানে common sense-এ সবাই বুঝেছেন।

◆টিয়া_টিয়া_টিয়া_অজ_পাড়াগাঁয়_থাকে

গুরুপ্রণাম দিয়ে শুরু করি। শেষ বয়সে রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখতে পারতেন না। তাঁর সেক্রেটারি অনিল চন্দের স্ত্রী রানি চন্দকে কবি বড় স্নেহ করতেন। রানি ছিলেন কবির লেখক। তিনি বলে যেতেন আর রানি লিখতেন শুনে শুনে। তবে রানি খুব ভয়ে ভয়ে থাকতেন বানানের বিষয়ে। রানি তাঁর “আলাপচারি . রবীন্দ্রনাথ” বইতে বলছেন…পদ্মাপারের মেয়ে বলেই বিশেষ সাবধান হতে গিয়ে অনবরত “র” , “ড়” নিয়ে বেঘোরে পড়ি আর অনবরতই গুরুদেব হেসে তা সংশোধন করেন। সে না হয় হল। কয়দিন থেকে “শূন‍্য” লিখতে গিয়ে “ন”-র জায়গায় “ণ” লিখে বসি। গুরুদেব দেখে আজকে বোধ হয় আর পারলেন না। ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে”ণ”-র মাথাটা চেপে ধরে হাসি মাখা চোখে কৌতুক ভরে বলে উঠলেন :
“একে তো শূন‍্য, তার আবার অত মাথা উঁচু করা কেন !”
সাবধান হতে গিয়ে রানি ভুল করেন। গুরুদেব অভয় দেন, “বানানে আবার ভুল কী ! বানান মানে হচ্ছে বানানো। লিখে যা সাহস করে। বানান ভুলের জন‍্য ভয় পাস নে। “স” কি “শ” – এ কেবল ঠিক থাকে একটা বিশেষ গালাগালির সময়ই।”
গুরুদেব কথায় কথায় কিছু বানান শেখালেন। বাকি যা কিছু বলে অভয় দিলেন, তার পিছনে অন‍্য কারণ…আমার মনে হয়। তিনি জানেন…তাঁর লেখা বা তাঁদের লেখা প্রকাশ পাবে। বাঘা বাঘা প্রুফ-রিডাররা আছেন।
গুরুদেবের প্রশ্রয়ের একটা ব‍্যাপার ছিল।
সৈয়দ মুজতবা আলি বলছেন… গুরুদেব যখন বেঁচে ছিলেন তখন শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে সুর ভেসে বেড়াত। গুরুদেব বলতেন…গান হল মনের অনুভূতির প্রকাশ। মন যেমন যেমন চাইবে, তেমনি গেয়ে চল। আমার দেওয়া সুর ভুল হলেও ক্ষতি নেই। অনেক বছর পরে মুজতবা আলি শান্তিনিকেতনে গিয়ে গানের সে পরিবেশ দেখতে পান নি। কেননা, সেই সময়কার শিক্ষকেরা ছড়ি হাতে ঘুরছেন। গানের ব‍্যাকরণে ভুল হলে রেহাই নেই। ফলে ভুল করে ফেলার ভয়ে কেউ আর গায় না।
আসলে তখনকার মানুষ পরিবেশ ছিল অন‍্যরকম। তখন এমন কথা বলার হয়তো প্রয়োজন ছিল। এখন আমরা অনেক এগিয়েছি। এখন ইচ্ছাকৃত ভাবেই ঠিকটা শিখতে চাই না। সব কিছুতে আজকাল নিষ্ঠার অভাব চোখে পড়ে। কি বড় ,কি ছোট। কী যে চায় মানুষ বুঝি না। সামান‍্য কাজেও অবহেলা।
একটা মজার ঘটনা বলি…
যখন শিক্ষিকা ছিলাম, সেই সময়কার। একদিন ছেলেমেয়েদের কিছু বলছি আমি, ওরা লিখে নিচ্ছে। কারুর কারুর লেখায় দেখছি অপ্রয়োজনে শব্দের মাথায় চন্দ্রবিন্দু। আবার কেউ কেউ চন্দ্রবিন্দু যেখানে দরকার সেখানে দিচ্ছে না। বলে বলে শেখানো গেল না। আমি গল্পের ছলে বলি…জানিস, তোরা কে কে ঘটি আর কে কে বাঙাল আমি বলে দিতে পারি‌। ওরা আগ্রহী হল। ওদের খাতা আমি হাতে নিলাম। তারপর যাদের লেখায় চন্দ্রবিন্দু দেবার প্রবনতা ,তাদের ফেললাম ঘটির দলে। আর যারা কোনোকিছুতে চন্দ্রবিন্দু দিতে চাইছে না, তাদের ফেললাম বাঙালের দলে।
ওরা তো অবাক। কেননা আমি সঠিক বলেছি…বুঝেছে ওরা। এখন কথা হল…বললাম কী করে? এবার বুঝিয়ে দিই গান গেয়ে। ঐ যে অনেক বছর আগেকার “হংসরাজ” ছবিতে একটা গান আছে…টিয়া টিয়া টিয়া , অজ পাড়াগাঁয় থাকে…এদেশীয় অনেক বাচ্চা যেভাবে গায় আমি গাইলাম সেই ভাবে…টিঁয়া টিঁয়া টিঁয়া , অজ পাড়াগাঁয় থাকে…
ওরা তো হেসেই অস্থির। বলি…ঘটিরা ঘোড়াকে বলে ঘোঁড়া।
এবার ওপার বাংলার উচ্চারণ…চাদ(চাঁদ), মাছের আশ(আঁশ)। মজা হল…এদেশীয়দের চন্দ্রবিন্দুর প্রবণতা আর ওদেশীয়দের চন্দ্রবিন্দু তুলে দেবার প্রবণতা। এবার ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল অনেক।
তবে কিছু শব্দের উচ্চারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে চন্দ্রবিন্দু চলে আসার প্রবণতা থাকে। যেমন…ইঁট(আসলে ইট), পুঁথি(আসলে পুথি)। তেমনি হাসপাতাল, হাসি ইত‍্যাদি।

◆আমার_মা_সবচে_সুন্দর

** আমার মা সবচে সুন্দর।
কোথায় যেন পড়েছিলাম গল্পটি। একটি বাচ্চা হরিয়ে ফেলেছে তার মা-কে। খুঁজে খুঁজে সারা। লোকজন তাকে সাহায‍্য করতে উদগ্রীব। তারা জানতে চাইল…
** খোকা, তোমার মা-কে কেমন দেখতে ?
বাচ্চাটি উপরোক্ত উত্তরটি দিয়েছিল। আমার মনে হয়…আমাদের মাতৃভাষাও আমাদের কাছে তেমনি। গর্বের বিষয়…ইংলন্ডের স্কুলে আমাদের মাতৃভাষা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে পড়ার স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বে মিষ্টি ভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত।
মাতৃভাষা যে আমাদের কাছে কতখানি আদরের সেটা বোঝা যায় বিদেশে গিয়ে হঠাৎ সে ভাষা কানে এলে। এই তো সেদিন ভিয়েতনামে গিয়ে কুচি টানেলে গেছি। ওখান থেকেই আমেরিকার বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালাত ভিয়েতনাম। ওদের সেই যুদ্ধে ব‍্যবহৃত বিশাল একটি কামান টুরিস্টদের দেখার জন‍্য রাখা আছে বনের গভীরে। মন দিয়ে দেখছি। হঠাৎ কানে এল ভাঙা ভাঙা বাংলায় কেউ বলছেন…তোমরা বুঝি ভারতীয় ?
ঘুরে দাঁড়াই। ওমা, একজন বিদেশিনী। তাঁর স্বামীর সাথে ভিয়েতনামে এসেছেন। দুজনেই বেশ বয়স্ক। কী সুন্দর দেখতে। খুব স্নেহশীল ওঁরা। জানালেন…ওঁরা বেশ কয়েক বছর কোলকাতায় ছিলেন চাকরীর সুবাদে। তাই বাংলা শিখেছেন। ভীষণ ভালো লেগেছিল সেদিন।
আমার মাতৃভাষা আমার কাছে এমনি। “মা” যেমন সবচে সুন্দর একটি শব্দ, তেমনি আমার মাতৃভাষা। লেখার সময় তার কোনোরকম বিকৃতি আমি যে সইতে পারি না। সেখান থেকেই এই লেখা। বন্ধুদের ভালো লাগলে তারচে বড় কিছু হয় না।
কেউ কেউ প্রশ্ন করেন… কত রকমভাবে বাংলা ভাষা উচ্চারণ করা হয়। অথচ লেখায় তো তেমন বৈচিত্র‍্য দেখি না।
তাঁদের জন‍্য বলি…
একই ভাষা উচ্চারণকারী বিশাল জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ‍্যে নানা কারণে একই ভাষার নানান বৈচিত্র‍্য লক্ষ‍ করা যায়। যে ভাষাসম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠীর সংখ‍্যা বেশি, সেই ভাষার মধ‍্যে রূপান্তর তত বেশি। সেসব হল উপভাষা। তারও এলাকা বিশেষে ভাগ আছে। কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষেত্রে একটিই মান‍্য ভাষা বা প্রমিত ভাষা ব‍্যবহার করা হয়। আমি শুধু বাংলা ভাষার কথা বলছি। (মধ‍্যশিক্ষা পর্ষদে কিন্তু ১৭-টি প্রথম ভাষার পরীক্ষা নেওয়ার ব‍্যবস্থা আছে।)
প্রশ্ন আসে…তাহলে “মান‍্য বাংলা” বা “প্রমিত বাংলা” কোনটিকে বলব ? সাধারণ ভাবে বলি…মধ‍্য কোলকাতায় প্রচলিত বাংলাকেই “মান‍্য বাংলা” বলা হয়।
ভাষা পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন সময়ে ভাষা পাল্টায়। আবার একই সময়েও পাল্টায়। একটু গোলমেলে লাগছে, তাইতো? পরিষ্কার করে বলতে গেলে বিভিন্ন সময়ে পাল্টানোর বিষয়টি ধরা আছে প্রাচীন বাংলায়, মধ‍্যযুগীয় বাংলায় আর আধুনিক বাংলায়। প্রাচীন বাংলার নিদর্শন আছে চর্যাপদে। সে ভাষায় একটি পংক্তি বললে যাদের চর্চা নেই তাদের বুঝতে একটু অসুবিধে হবে। মধ‍্য যুগীয় বাংলার নিদর্শন আছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, মঙ্গলকাব‍্যে অনুবাদ সাহিত‍্যে, পদাবলী সাহিত‍্যে আর ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে আধুনিক যুগ। সূক্ষ্মভাবে না হলেও মোটামুটি এইভাবে সময়টা ধরা হয়েছে।
আর একই সময়ে ভাষা পাল্টায় তার আঞ্চলিকতায়। আঞ্চলিকতা বিশেষে পাল্টানোকেই বলে উপভাষা। আঞ্চলিক ভাষা শিখতে হয় না। শিশু তার পরিবেশ থেকেই শিখে যায়। মান‍্য বাংলার একটা সার্বিক গ্রহণযোগ‍্যতা থাকে। সেটি অবশ‍্যই চর্চার বিষয়।

◆বিষয়— বিভ্রাট।

এক বড়লোকের বাড়িতে টিউশন করি। ছাত্রের সুন্দরী মা চলেছেন ডাক্তারের কাছে,কোলকাতায়।তাঁদের তো আবার শহরতলির ডাক্তারে রোগ সারে না কিনা ! দুয়ারে বাহন প্রস্তুত। ছেলে আব্দার করে মায়ের গলা জড়িয়ে বলে,”তাড়াতাড়ি আসবে।আমি বেশিক্ষণ একা থাকতে পারব না কিন্তু।”
সঙ্গে সঙ্গে মা মিষ্টি করে উত্তর দেন,”যে সময় ডাক্তারের এ্যাপার্টমেন্ট আছে,তখন ছাড়া তো উনি দেখবেন না বাবা।”
তারপর,আমার দিকে ফিরে মিষ্টি হেসে ,”দিদি,ওর হিস্টেরিয়ার টিচার নেই,অনুশীলনী করিয়ে রেখেছি। খাতাটা কালেকশন করে দেবেন তো ভালো করে।”
এসব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকা ছাড়া আর উপায় কি!!
এক মাস্টারমশায় বলছিলেন…
তাঁর স্কুলে শোক সভা হচ্ছে সদ্য প্রয়াত এক দিদিমণির। চারদিক নিস্তব্ধ। ছুঁচ পড়লেও শোনা যাবে। শোকস্তব্ধ এক মাস্টারমশায় আবেগ মথিত কন্ঠে গাইছেন কান্ত কবির গান,
“কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব,
তোমার রসাল বন্ধনে।”
কবির “নন্দনে” মাস্টারমশায়ের আবেগে হয়েছে “বন্ধনে।” নাকি উনি মৃত দিদিমণির বাহু বন্ধনকে গুরুত্ব দিয়ে …….!!!
বলা তো যায় না !!
নতুন বিয়ের পরে আমার অনভিজ্ঞতা পরিবারের অন্যদের অনুসরণে উচ্চারণ করতে শিখিয়ে ছিল, বৈদ্যবাটিকে “বেতোবাটি” এবং চেভিয়ট জুটমিলকে “চিপওয়াট” মিল।
তবে স্বাধীনতা দিবসে কয়েক শো ছেলে মেয়ের সামনে মাইকে তুকাদার ঘোষণা..
“পকাতাকে স্যালুট কর”…
ছোটরা হেসে উঠতে তুকাদা সামলে নিয়ে বললেন….”পতকাকাকে স্যালুট কর”।
অনবদ্য।
কোনও দিনও ভুলিনি। প্রত্যেক বছর পতাকা উত্তোলনের সময় স্মরণ করেছি তুকাদাকে, দীর্ঘ বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ বছর।
অনেক শিক্ষিত মানুষ আজও উচ্চারণ করেন..সনমান,সম্মান নয়। “ডহরবাবু” ,”বুলেট প্রুফ ট্রেন” এবং বাঙালীর হরেক উৎসবকে যখন তখন যা ইচ্ছে গুলিয়ে ফেলায় আমাদের”গরমেন্ট”-এর তুলনা নেই !নো”পবলেম”।
একবার স্টেশনে বসে আছি। ট্রেন লেট। এক সময় মাইকে ঘোষণা শোনা গেল,”ডাউনে বজবজ লোকাল”লুঙ্গি”ছেড়ে আসছে।” আসলে হবে তো “নুঙ্গী”।
বিশেষ দ্রষ্টব‍্য :–
কয়েকজন বলছেন নদিয়া জেলার মুখের ভাষাকে মান‍্যভাষা বলে তাঁরা জানেন।
তাঁদের উদ্দেশে বলি…
ভাষাতাত্ত্বিকরা দেখেছেন কোনো একটি উপভাষা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় কারণে বেশি গুরুত্ব পেয়ে গেলে, সেই উপভাষার সর্বজনগ্রাহ‍্য একটি রূপ গড়ে ওঠে। সর্বজনগ্রাহ‍্য এই উপভাষাটি হয়ে ওঠে মান‍্যভাষা।
এখন আমরা দেখি কোলকাতাই প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক …সব দিক থেকেই এ রাজ‍্যের কেন্দ্র। তখনো তাই ছিল। কোলকাতায় যে উপভাষাটির প্রচলন ছিল তা হল”রাঢ়ী” উপভাষা। অবশ‍্য বীরভূম, বর্ধমান, পূর্ব বাঁকুড়া, নদিয়া, হাওড়া, হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা, মেদিনীপুরের কিছু অংশে, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে রাঢ়ি উপভাষার প্রচলন আছে। তাহলে সব জেলাই এই গৌরবের দাবীদার হতে পারে। তাছাড়া জেলাগুলিতে পরিবেশ ভেদে ভাষায় কিছু আঞ্চলিক ভেদও লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে অর্থাৎ কোলকাতাকেই ধরা হয়ে থাকে মান‍্যভাষার কেন্দ্রস্থল হিসেবে।