গল্প : সার্টিফিকেট

গল্প : সার্টিফিকেট
স্বাতী চৌধুরী
সুদর্শন চৌধুরী নিজেই স্বীকার করেন তিনি একজন ভীতু মানুষ। মারামারি, হৈ হল্লাকে সব সময় তার ভয়। সেই ভীতু মানুষ শুধুমাত্র ভয়ের কারনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। সেজন্য জীবনভর তাঁর আফসোসের অন্ত ছিল না। মাঝে মাঝে নিজেকে ধিক্কারও দিয়েছেন। কারন একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা যিনি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছেন বা অংশ গ্রহণ করে প্রাণ দিয়েছেন তাদের থেকে দেশপ্রেম তাঁর কম ছিল না। এই দেশপ্রেম তাঁর সচেতনভাবেই ছিল । আছে না , এমন অনেক যারা যুদ্ধে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু খুব একটা সচেতনভাবে যায়নি। হুজুগে গিয়েছে বা আশেপাশে যে সহিংস পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে তার জন্য তাৎক্ষণিক একটা ক্ষোভ থেকে, একটা প্রতিবাদ বা বদলা নেয়ার জন্য তারা অংশ নিয়েছিল যুদ্ধে । সেজন্যই দেখা গেছে যুদ্ধ শেষে তাদের মাঝে দেশপ্রেমের যে অন্যান্য উপকরণ যেমন সততা, আদর্শবাদিতা, দেশের মানুষকে ভালবাসা, সকল প্রকার অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তার কোনও ধার ধারেনি। বহু মুক্তিযোদ্ধা স্বার্থের জন্য অন্যায় দুর্নীতির সাথে আপোষ করেছে । রাতারাতি বড়লোক হওয়ার উন্মাদনায় সব ধরণের অপকর্মের সাথে নিজেকে জড়িয়েছে । এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের সাথেও হাত মিলিয়েছে । এভাবেই বিরাট একটা অংশের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অর্থাৎ মুল যে জিনিস দেশপ্রেম প্রকারান্তরে মানবপ্রেম সেটা ভুলুন্টিত হয়েছে। মানুষ ঐ জায়গা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। কিন্তু সুদর্শন চৌধুরীর দেশপ্রেম ছিল নির্ভেজাল, ধারাবাহিক, আজীবন লালিত।তার সাথে ছিল নৈতিক মূল্যবোধ, ছিল দায়বদ্ধতা, ছিল মানবতাবোধ, ছিল অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার শিক্ষা। তবু যুদ্ধে যেতে না পারার জন্য অপরাধবোধ তাকে বিচলিত করেছে । অবশ্য বেশী বিচলিত হলে তার আর একটি মন তাকে বোঝাত- তুমি যুদ্ধে যাওনি বলেতো আর দেশের মুক্তি আটকে থাকেনি সুদর্শন ! কেবল কি পিস্তল দিয়ে দুচারটা শত্রু নিপাত করাই যুদ্ধ ? তুমি কি যুদ্ধ করোনি ? আসলে সেই সময়টাতে যুদ্ধ কেন হয়েছিল ? মুক্তিুযদ্ধের অর্জিত মুক্তি কার জন্য হওয়ার কথা ছিল ? দেশের তো ? দেশ কাকে নিয়ে? মানুষকে নিয়েতো ? যদি দেশের মানুষ বেঁচে না থাকে তাহলে দেশের মুক্তি দিয়ে কি হবে ? তুমিত শুধু নিজেকে বাঁচাতে শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে যাওনি, গিয়েছিলে তোমার পরিবারকে বাঁচাতে। সেই সময় যুদ্ধের বিভিষীকা কেমন ছিল ? যেকোন সময় পাকহানাদাররা তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার আলবদরদের নিয়ে বাড়ীঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে , পুড়ে মরছে মানুষ । মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, পুরুষ যুবকদের গুলি করে মেরে ফেলছে, বাড়ী ঘর লুট করছে । হিন্দুরা প্রধান টার্গেট । এদের তাড়ালে সম্পত্তিটা দখলে আসবে । পালানো ছাড়া গতি ছিল কি ? এরকম পালানোর দৌড়াদৌড়িতে ঠিকমত খাওয়াদাওয়ার অব্যবস্থাপনায় কলেরা হয়ে মারা গেলেন তোমার শশুর । ঘরে তোমার যুবতী স্ত্রী, বছর চল্লিশ বয়সের শাশুড়ী, এদের সম্ভ্রম হারানোর ভয়, তিন চারটি শিশু সন্তান, এদের নিরাপত্তা দেয়ার মতো কেউ ছিলনা। না আত্মীয় স্বজন, না পাড়া পড়শী , সকলেরইতো একই অবস্থা । কে কাকে ভরসা দেবে ? আর শুধু কি পরিবার ? গ্রামের আরো শ খানেক পরিবার সকলেই পালাচ্ছিল তো ? শুধুতো পালালেই হয় না , পালানোর পথও জানতে হয়, গন্তব্য জানতে হয় । কিন্তু এই শখানেক পরিবারের মানুষের সেই পথ জানা ছিল না। এদের পথ দেখানোর গন্তব্য চেনানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেতো তুমি ! আবার গন্তব্যে গিয়ে থাকবার ডেরা, খাবার রেশন পাওয়ার বন্দোবস্ত এসবের জন্য দুচারজন সচেতন মানুষের দরকার হয়, যারা ঠিকমত জায়গা চিনে নিয়ে প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলে এসব আদায় করতে পারে । তোমার গাঁয়ের পালানো মানুষদের সে ক্ষমতা ছিল না। তুমি এতগুলো পরিবারের এতগুলো মানুষের জন্য সব কিছুর ব্যবস্থা করেছিলে । তার জন্য তুমি সময়মত খাওয়াদাওয়া ঘুমের আরাম আয়েশ,পরিবারের লোকেদের সময় দেয়া এসমস্তইতো ত্যাগ করেছিলে। একি যুদ্ধ নয় ? মুক্তিযুদ্ধ যদি হয় দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, তাহলে দেশের এই মানুষগুলোকে বাাঁচিয়ে রাখার কাজ করে তুমিও আর একধরণের যুদ্ধইতো করেছিলে। তুমি ভুলে গেছো সেই যুদ্ধের কথা? এপারে যুদ্ধ হচ্ছিল হানাদার রাজাকারদের বিরুদ্ধে আর ওপারে শরণার্থী শিবিরে যুদ্ধ হচ্ছিল – খোলা আকাশ এর নীচে দাঁড়ানো মানুষগুলোর জন্য কিভাবে একটা তাবু, নয়তো একটা ছাতার পাতার ছাউনির ব্যবস্থা করা যায়, কোথা থেকে খাবার, পানি যোগাড় করা যায় ? যখন ছাতার পাতার ছাউনির সারি সারি ঘর হলো তখন তাতে কোন কোন রাতে আগুন লেগে গেলে মানুষের সেকি হৈচৈ,নিজের পরিবারকে বাঁচানো, অন্যদের বাঁচানোর জন্য কত রকম চিন্তা পরিকল্পনা তোমার এই মাথা দিয়ে করেছিলে। পরিকল্পনা করেই শেষ নয় অনেকের কাছে ধর্ণা ধরেছিলে। সেখানে শুরু হলো বিরামহীন কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়। এক ঘরে একজন মারা গেছে তো লাশ নিয়ে গেছে পোড়াতে না হয় বালির নীচে রেখে আসতে।সেই ব্যবস্থা করে বাসায় আসতে আসতে আরেকজন আক্রান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে সেও শেষ। আবার সেই লাশের সদগতি করতে করতে আরেকজন শেষ।শরণার্থী ক্যাম্পে চাকুরী নিলে কম্পাউন্ডারের। অধীত বিদ্যাকে কাজে লাগিয়েছিলে। রাত দিন নেই হাসপাতালে ডিউটির। সেই হাসপাতালে শুধু শরণার্থীরা নয়,আহত মুক্তিযোদ্ধারাও আসে । তাদেরও সেবা দিলে। সুদর্শন এসব কি মুক্তিযুদ্ধ নয় ? কেনো আফসোস করো ? তোমার কি দেশপ্রেম কম ছিল ? নাকি এখনো কমেছে ? দেশকে ভালোবাসো বলেতো ফিরেও এলে স্বদেশে আবার ! তুমিতো অনেক বড় সুযোগ পেয়েছিলে।ওখানকার বড়ডাক্তার কর্মকর্তা তোমাকে ভাল হাসপাতালে চাকুরীর অফার দিয়েছিলেন। তোমার পুত্রহীন মামা নিজের বিশাল বাড়ীর একটা অংশ তোমাকে দিতে চেয়েছিলেন। তোমার নাগরিকত্ব পাওয়ার ব্যবস্থাও হয়েছিলো । তাও তুমি ফিরে এলে অনিশ্চিত জীবনে । রাজাকার লুটেরা গোষ্ঠী তোমার ঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল । তোমার অস্থাবর সকল সম্পত্তি লুটপাট করে নিয়ে গেছে। সব তুমি জানতে । প্রতিবেশী আপ্তর আলী শরণার্থী শিবিরে গিয়ে তোমাকে সে খবর দিয়েছিলেন। তাও তুমি ফিরে এলে। কেন ফিরে এলে ? দেশের জন্য তো ? দেশকে ভালবাসো বলে তো ? জননী জন্মভূমি স্বর্গের চেয়ে শ্রেষ্ট জেনেতো ? তাহলে ? আফসোস করোনা সুদর্শন বরং হিসেব করে দেখোতো তার জন্য কি পেয়েছো তুমি ?
না, কি পেয়েছেন তারও হিসেব করেন নি সুদর্শন । দেশ স্বাধীনের পর দেশে ফিরে নিজের পোড়া ভিটায় ঘর তোলার পাশাপাশি অন্যদের পোড়াভিটায় কি করে ঘর তোলা যায় তার জন্য দ্বারে দ্বারে ফিরেছেন । তার নিজের ঘরের টিন ফেরৎ পেয়েছিলেন। রাজাকাররা ঘরে আগুন দেবে টের পেয়ে আগে ভাগেই আপ্তর আলী ভাইরা তা খুলে নিয়ে নিজের বাড়ীতে রেখেছিলেন। বাঁশের ঝাড়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাঁশ বেত ছিল। আপ্তর আলী আর কয়েকজন মিলে সে ঘর তৈরীর কাজে কামলা দিয়ে সাহায্য করেন। কিন্তু এমন অনেক ছিল যাদের ছিল ছনের ঘর,তাদের বাঁশঝাড় নেই। লোকবলও তেমন নেই। ডিসেম্বরের শীতের রাতেও তারা খোলা আকাশের নীচে বাস করছিল । সুদর্শন চৌধুরী আপ্তর আলীর মত লোকজনদের সাথে নিয়ে যাদের বাঁশঝাড়ে বাঁশ আছে তাদের নিকট থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে দিলেন এবং যারা দেহে খাটতে পারে তাদেরকেও অনুরোধ করলেন যাতে তাড়াতাড়ি ঘরগুলো তৈরী করে শীতের হাত থেকে বাাঁচানো যায়। সপ্তাহ দশ দিনের মধ্যে গ্রামের সবগুলো পোড়াভিটায় ঘর উঠে গেল। কিন্তু শরণার্থী শিবির থেকে ফেরৎ এই লোকগুলোর দুর্দশা তাও ঘুচছিল না। তারা যখন এই বাড়ী ঘর ছেড়ে গিয়েছিল তখন প্রায় সবাই শুধু নিজের দেহখানা ছাড়া দরকারী কোনও জিনিসপত্রই নিতে পারেনি। কেউ যাওবা কিছু নিয়েছিল তাও আর শেষপর্যন্ত নিতে পারেনি। রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল। ওখানে গিয়ে যা যোগাড় করেছিল তারও সবকিছু আনতে পারেনি। তাই এখন ঘরসংসার সাজাতে গিয়ে কতযে জিনিসের দরকার। হাড়ি কুড়ি, বিছানাপত্র, খাবার দাবার সব কিছুর অভাব। এসব কিছু ভেবেই সরকার যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশের মানুষের জন্য রিলিফ চেয়ে আনে। এইসব রিলিফের মধ্যে ছিল খাদ্যবস্তু, কাপড় চোপড়, বাসন কোসন, কম্বল। এসব কিছুর বিলিবন্টন হচ্ছিল। তবে ব্যবস্থাপনা সঠিক ছিল না। যাদের বেশী দরকার তারা পাচ্ছিল না। বিশেষ করে যারা কোথায় গেলে পাওয়া যায় তা বা যারা দাবী জানাতে পারছিল না তারা একেবারে বঞ্চিত হচ্ছিল । সুদর্শন চৌধুরী নিজের জন্য ভাবেননি। এসব মানুষের হয়ে দেনদরবার করে তাদেরকে প্রাপ্য জিনিস পেতে সাহায্য করেছেন । করতে পেরে তৃপ্ত হয়েছেন । আরো অনেকের জন্য্য করতে পারেননি বলে কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু নিজের জন্য ভাবেননি। পরিবারের লোক কত অসন্তুষ্ট হয়েছে, ঈর্ষান্বিত হয়েছে যখন দেখেছে তার জন্য অন্য লোকেরা নতুন ডিজাইনের কত তৈজসপত্র পেয়েছে অথচ তাদের ঘরে একটাও আসেনি। সুদর্শন বলেছেন এসব জিনিসপত্র এসেছে যাদের কিছু নাই তাদের জন্য । আমাদের জিনিসপত্র লুটপাট হয়েছে ঠিক কিন্তু আপ্তর আলীর দয়ায় ফিরেও পাওয়া গেছে অনেক। আমাদেরতো কাজ চলে যাচ্ছে !
তারপর কত নদীর কত জল গড়িয়ে গেছে। কত নদী গেছে শুকিয়ে। কত নদী দুকূল প¬াবিয়ে তার তরঙ্গাঘাতে ভেঙ্গে নিয়ে গেছে কত গ্রাম, কত ঘর সংসার । কত লোক নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে অর্থে বিত্তে প্রতিপত্তিতে। কেউ তলিয়ে গেছে সংসার সমূদ্রের ফেনিল তরঙ্গে । কিন্তু সুদর্শন চৌধুরীর অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি । সেই একই রকম ক্ষীণকায় জীবন নদীর ধারার মতো বয়ে চলেছে অভাব অনটন টানা হ্যাচড়ার ভেতর দিয়ে । তাতেও দুঃখ বা আফসোস ছিল না । নিজেকে সান্তনা দিয়েছেন কতলোক যে দিনে একবারও খেতে পায়না । তাদের থেকেতো আমি ভাল আছি । ছেলেমেয়ে বড়মানুষ হতে পারেনি তবে মানুষ হয়েছে। তারা কেউ চোর চোট্টা গুন্ডা বদমাশ হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কোন হিসেব সুদর্শন চৌধুরীর ছিল না । হিসেব তিনি করতেন, ভাবতেন. মুক্তিযুদ্ধ করে কি হলো ? সাধারণ মানুষের জীবনে কোন ভাল পরিবর্তন এসেছে বলে চোখে তো পড়ে না। রাস্তাঘাট উন্নত হয়েছে, কিছু মানুষের ঘরবাড়ী জীবন আরো বেশী মসৃণ চকচকে হয়েছে।স্কুল কলেজের সংখ্যা বেড়েছে। সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতের সংখ্যাও বেড়েছে। মানুষের জীবনে ভোগের নানা উপকরণ যুক্ত হয়েছে তা দেখে গরীবের শুধূ চিত্তচাঞ্চল্যই বাড়ে । তারা এনজিও থেকে লোন নিয়ে টিনের ঘর বান্ধে, সাদাকালো ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশন কিনে । আবার ঋণের দায়ে এনজিওরা সেই ঘরের টিনও খুলে নেয়। তিন হাজার টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করতে না পারার অপরাধে গরীব কৃষককে পুলিশ এসে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যায় । আর তিনহাজার কোটি ঋণের ঋণখেলাপীকে রাষ্ট্র তোষামোদ করে আরো ঋণ দেয় । তখন সুদর্শন চৌধুরীর হতাশা বাড়ে । ক্ষোভ বাড়ে । এর ফলে মাঝে মাঝে তার রক্তের চাপ কমে যায় । শরীর দূর্বল হয় । চায়ের দোকানে এসব আলোচনা হয় । আরও অনেক লোকের হতাশা, রাগ, ক্ষোভ তাতে জমা হয় । কখনো এতে ক্ষোভের মাত্রা বাড়ে কখনো বা প্রশমিত হয়। সেদিন এরকম এক চায়ের আড্ডায় এলাকার মুক্তিযোদ্ধা রফিকের সাথে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের সাথে সম্পৃক্ত কোন অফিসের এক ছোট চাকুরে এসে হাজির হয়। সে জানায় এক একটা সরকার আসে আর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তৈরীর ধুম পড়ে যায় । সেই সুযোগে নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা পয়দা হয়। রফিক আফসোস করে বলে অথচ কি দুখের কথা জানেন তো যে, আমাদের রফিকভাই আসল মুক্তিযোদ্ধা হওয়া স্বত্বেও কোন সার্টিফিকেট নাই । রফিক ভাইকে বলেছি সার্টিফিকেট যোগাড় করতে । আর নতুন তালিকায় নাম যুক্ত করে দিতে আমি সব সাহায্য করবো । আরে একটা সার্টিফিকেট থাকলে রফিকভাই এর কি আর দুর্দিন থাকে ? মাসে মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা । কত রাজাকার এখন মুক্তিযোদ্ধা । জানেন আপনারা তারা মাসে মাসে ভাতা পায় । হাসবেন না কাঁদবেন ?
ছেলেটির কথায় সুদর্শন চৌধুরীর চোখ ভরে জল আসে । তবে তিনি নিজেকে সামলে নেন । আবার হাসি পায় তার । হায়ওে বিচিত্র দেশ ! হায়রে বিচিত্র দেশের মানুষ ! যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে তারা এখন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ভাতা পায় । হাসিটাও সামলে নেন তিনি। আসলে এসব কথা যে তিনি আজই শুনলেন তাতো নয়। পত্রিকায় রোজ পড়েন । রোজই হাসি কান্নার দোলায় তিনি আন্দোলিত হন । কিন্তু সেসব মনে মনে একা একা । আজ এই ছেলেটির কথা এখানে চায়ের দোকানের সকলকেই আন্দোলিত করছে দেখে আশার ফুলকি দেখেছিলেন । তারপরেই আবার মনে হলো এই আন্দোলনের আগুন চায়ের দোকান থেকে বাড়ী যেতে যেতেই নিভে যাবে। এমনকি তার কয়লাটুকুও সংসারের যাতাকলে পড়ে পিষে যাবে।
সেদিন রফিক এর সাথে আবার দেখা ।সে বলল দাদা, আমার মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট মিলেছে।ভাতা পাওয়ার তালিকায়ও নাম উঠে গেছে। মনির ছেলেটা বড় করিৎকর্মা গো দাদা। সবকিছু কত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল বলো দেখি। আগামী মাস থেকে আমি ভাতা পাবো। এই দুর্দিনের বাজারে বড় উপকার হবে ।
রফিক বেশ বিগলিত। সুদর্শন চৌধুরীর ভালো লাগে। রফিক খুব টানা হ্যাচড়া করে সংসার চালায় তিনি জানেন। এবার তাহলে আর টানা হ্যাচড়া থাকবে না। বলেন, তুমি আসল মুক্তিযোদ্ধা । তোমার কাগজপত্র তো তাড়াতাড়িই ঠিক হবে। যেখানে রাজাকাররাই সব দ্রৃত ঠিক করে নিচ্ছে ।
রফিক বলে নাগো দাদা, সকলের হয় না। নকল মুক্তিযোদ্ধাদের কাগজপত্র তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায় কারণ তারা টাকা দিয়ে সবকিছু ঠিক করে নেয় । কিন্তু আমাদের মতো আসল কিন্তু গরীব মুক্তিযোদ্ধাদের তাড়াতাড়ি হয় না । কত আসল মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করে খায় । আমি ভাগ্যবান । আচ্ছা দাদা আপনাকে একটা কথা বলি, আপনিত শরণার্থী শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবার কাজ করলেন । আপনি কেন একটা সার্টিফিকেট যোগাড় করেন না ? আপনারওতো টানা হ্যাচড়ার সংসার। ভাতিজা ভাতিজীরা লেখাপড়া জানে । মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে নাকি চাকরিতে অগ্রাধিকার আছে ! আপনি কেনে এই সুযোগটা নেন না ?
রফিকের কথায় সুদর্শন একটু চমকে যান । আমি মুক্তিযোদ্ধা ! কি বলছো রফিক ? আমি একটা ভীতুর ডিম। ভয়ে যুদ্ধে গেলাম না। আবার মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুযোগ ভোগ করবো ?
কেন দাদা আপনি মুক্তিযোদ্ধা হবেন না কেন ? কতলোক মুক্তিযোদ্ধাদের হান্ডিবাসন ধুইছে কইয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে। আর আপনিত সত্যি সত্যি মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসাসেবা কাজে ছিলেন। আমি নিজে আপনার সেবা নিলাম। এখনতো কয় শুনি যে খালি যুদ্ধ করছে যারা তারাই মুক্তিযোদ্ধা না । যারা যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে, লোকজনরে সংগঠিত করছে তারাও যোদ্ধা । আপনিত দাদা আমরা যারা যুদ্ধে গেলাম তাদেরকে বুঝাতেন । আমরা মুর্খ মানুষ অত কি বুঝতাম বলেন ?
সুদর্শন চৌধুরী হাসেন। বলেন তোমার কথা শুনে ভাল লাগছে যে , অন্তত তুমি মনে করছো আমি মুক্তিযোদ্ধা । আসলে কি জানো রফিক, আমার কি মনে হয় জানো, রাজাকার বাদ দিয়ে সেই সময়ের সব মানুষ মুক্তিযোদ্ধা। তারা কোন না কোনভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছে।মনে করে দেখো কত লোক নিজের ও পরিবারের জীবন বিপন্ন করে তোমাদের আশ্রয় দিয়েছে । কত মা বোন তোমাদেও রান্না করে খাইয়েছে । এমনকি নিজে না খেয়ে খাবার দিয়ে দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে, গোপন খবর দিয়েছে । এরকম সাহায্য না পেলে কি যুদ্ধ জয় করা সম্ভব ছিল ? এদের নামতো তালিকায় নাই রফিক ! এরা বা তোমরা বা আমার মত যারা, তারা সকলে কাজ করেছিলাম দেশকে স্বাধীন করতে, আমরা দেশের সকল মানুষ যাতে আমাদের নিজের মাটিতে মাথা উচু করে সত্যিকার মানুষের মতো মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারি। ভবিষ্যতে দেশ স্বাধীন হলে আলাদা কোন সুযোগ পাবো এ আশায় কেউ যুদ্ধ করেনি রফিক । এখন মুক্তিযোদ্ধাদের সেই সুযোগ দিয়ে সরকারগুলো বাহবা নেয়ার চেষ্টা করে । আর সেই সুযোগে প্রত্যেকটি দলের তোষামোদি করে বছর বছর কিছু ভুয়া লোক এমনকি রাজাকাররাও মুক্তিযোদ্ধা বণে গেছে । কিন্তু সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ যারা নিজে না খেয়ে খাইয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল, গোপন খবর সরবরাহ করেছিল যাদের নাম তালিকায় নেই, ইতিহাসে নেই তাদের জন্য সরকার কি করছে ? অথচ তাদের জন্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল । তাদের মৌলিক চাহিদা পুরণ করার জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল । কিন্তু আজ রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে । পচে গলে গেছে। বলেই আজ এদেশে নিজামী মুজাহিদরা মন্ত্রী হয় ! নিজামী মুজাহিদ মন্ত্রী হলে রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাওয়াটা কি অবাক হওয়ার মত ঘটনা রফিক !
তাইতো বলছি দাদা, আপনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুযোগ ভোগ করার অধিকার রাখেন । আপনি বলেন দাদা আমি মনিরকে দিয়ে আপনার ব্যবস্থা করে দেই !
না রফিক ! আমি কোন সুযোগ চাই না । তুমি মনে কিছু করো না। তুমি ভাতা পাবে বলে আমি খুশী। কিন্তু আমি চাই না । হ্যাঁ আমার প্রয়োজন আছে । আমার সংসারে প্রচন্ড অভাব। আমার ছেলে মেয়েরা বেকার । আমি জানি সার্টিফিকেট যারা দেয়, তাদের সাথে যোগাযোগ করলে, তেল দিলে, ঘুষ দিলে আমিও সব কিছু বাগিয়ে নিতে পারবো । হয়তো আমার দু একটা ছেলেমেয়ের চাকরিও জুটে যাবে । আমার তাতে আর অভাব থাকবে না । একটা তেলতেলা মসৃণ নিশ্চিন্ত নির্ভার জীবন আমি বাকী দিনগুলোর জন্য পেয়ে যাবো। কিন্তু তাও না। আমি যা কিছু করেছিলাম তা কোনও সুযোগের আশায় নয়। আমি দেশকে ভালবাসতাম । মানুষকে প্রতিবাদের ভাষা শেখাতাম। যখন যুদ্ধ লেগেছে তখন মনেপ্রাাণে সমথর্ন করেছি । ভগবানের কাছে বিজয় প্রার্থণা করেছি। আর আশা করেছি দেশের সব মানুষ ভাল থাকবে । সুখে থাকবে। সকলে সমান সুযোগ ভোগ করবে । তাতো হয়নি রফিক। যে পাকিস্থানের লুটেরাদের বিরিুদ্ধে আমাদের লড়াই ছিল সেই পাকিস্থানী হায়েনারা হয়তো নেই। কিন্তু লুটেরাতো রয়ে গেছে। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের আশা – আকাঙ্খা, স্বপ্ন , বেঁেচ থাকার অধিকার প্রতিদিন লুট হয়ে যাচ্ছে । যে দেশে আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আজও ভিক্ষা করে খায়, রিকশা চালায় সেই দেশের একজন হয়ে আমি শুধু নিজের জন্য কোন সুযোগ চাই না রফিক ! আমি চাই না। রফিককে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুদর্শন চলে যান । রফিক বসে বসে সুদর্শন দাদার ভাষণের মত বলা কথা আবার রিওয়াইনড করে শুনে । শুনতে শুনতে হঠাৎ তার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।