গল্প: যমুনার জল দেখতে কালো

গল্প: যমুনার জল দেখতে কালো

গল্প: যমুনার জল দেখতে কালো
লুনা রাহনুমা

সুরমা আর তার মা জালালাবাদ স্টেশনের পাশে একটি বস্তিতে থাকে। দিনের পর দিন বস্তির এক কামরার ঘরটিতে মা ও মেয়ের দুঃখ-সুখের জীবন হাঁপিয়ে উঠেছে একেবারে। সুরমার আব্বার খবর জানে না ওরা বছর তিনেক হলো। লোকটি হয়তো কোনো একসিডেন্টে মারা গেছে, নয় তো নিজের ইচ্ছাতেই নিখোঁজ রয়েছে। পুরুষ মানুষের মন বলে কথা! মাঝেমধ্যেই ফড়িঙের মতো ফরফর করে বেড়াতে চায় এখানে সেখানে। পিছুটানের মায়া গলায় বাঁধা দড়ির মতো টেনে গৃহমুখী করতে পারেনি লোকটাকে। মেয়ে মানুষের মন সুরমার মার, সন্তান আর সংসারের স্বপ্ন কিছুতেই মুছে না মন থেকে।

সুরমার বয়স তেরো হলো এবছর। বালিকা থেকে তরুণী হবার পথে যাত্রা শুরু। শুরুটা যে খুব খারাপ তা তো বছরের প্রথমেই টের পাওয়া গেছে। ওদের এলাকায় “রহমান এন্ড ব্রাদার্স” নামের যে গার্মেন্টসটি আছে, কিছুদিন পর সেখানে মায়ের সাথে সুরমারও কাজে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৎসরের শুরুতেই হঠাৎ করে করোনা ভাইরাস এসে ওদের ভেবে রাখা সব চিন্তাগুলোকে এলোমেলো করে দিলো। সুরমার মা প্রথম দুইমাস এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ থেকে কিছু সাহায্য পেয়েছে। তৃতীয় মাস থেকে সেই সাহায্যও বন্ধ হয়ে গেলো। গ্রামের সবার ঘরে অভাবের উত্তাপ আগুন ছড়াতে আরম্ভ করেছে ধীরে ধীরে।

– কি কও সুরমার মা, তোমাগো মতো আমি যদি বইস্যা বইস্যা খাওন পাইতাম, আমার তো আর চেয়ারম্যান হওনের কোনো দরকার ছিল না।

– চেম্মেন সাব আমাগো ফকিন্নির লগে নিজের তুলনা করেন ক্যা! আসমানে আর জমিনে কি তুলনা অয় কুনো দিন? তওবা তওবা।

– তোমার মাইয়ারে সেদিন দেখলাম রাস্তা দিয়া গান গায় আর নাচতে নাচতে যায়। আদব কায়দা কিছুই শেখাও নাই। চোখ তুইল্যা হাইট্যা চইল্লা গেলো। সালাম দেওনের নাম গোন্দ নাই।

– ছুডু মানুষ। ভুল কইরা ফেলছে। আমি কইয়া দিমু। আর ভুল করবো না।

রীতিমতো চেয়ে-চিন্তে ভিক্ষা করেই কয়েক কেজি চাল আর একটু শাক সবজি নিয়ে নিজের বাড়ি ফেরে সুরমার মা। গার্মেন্টস কবে খুলবে তার কোন ঠিক নাই। আয়রোজগারের একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে দুই নাম্বার রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না সামনে। নিজে না খেয়ে থাকতে পারলেও উঠতি বয়সের মেয়েটির পেটে ক্ষুধার কষ্ট মায়ের জন্য সহ্য করা কঠিন।

– মা, ভাত রানতাছো? খুশিতে ঝলমল করে উঠে সুরমার চোখদুটি, গরম ভাতের গন্ধ এই পৃথিবীর সব গন্ধের মইধ্যে সেরা।

– চেম্মেন সাবে কইলো তুই হেরে দেইখ্যা সালাম দেস নাই।

– হ, আরো কত কি কইবো!

– হেয় কত বড়লোক মানুষ তুই জানোস! আমাগো গেরামের মাথা। হেরে দেখলে সালাম দিতে অইব। চোখ নামাইয়া কথা কইবি।

– আমাগো কোন কামে লাগছে হেয়! কোনোদিন তো গরিবের লইগ্যা কিছু করতে দেখলাম না। খালি নিজের ঘরে তার তিনডা বৌ।

– তারপরেও এই গেরামের রাজা চেম্মেন সাব। অনেক বড় মানুষ।

– হেয় যদি অনেক বড় মানুষই হয় তয় হেরে আমাগো মতো ছুডু মাইসের এতো তোয়াজ করোন লাগবো কেন? হেয় নিজে জানে না হেয় যে বড়?

– জানে। জানলেও মাইনসে সম্মান দিলে খুশি হয়।

– এরপর থেইক্যা চেম্মেনরে দেখলেই সালামের উপরে রাখমু। আইতে সালাম, যাইতে সালাম, উডতে সালাম, বইতে সালাম, বলে খিল খিল করে হাসতেই থাকে সুরমা। তারপর এক দৌড়ে ছুটলো গোসলের উদ্দেশ্যে।

সারারাত ঘুমাতে পারে না সুরমার মা। সামনের দিনগুলো তাদের মা ও মেয়ের জন্য কী নিয়ে আসছে সেই চিন্তায় মাথা খারাপের মতো লাগে। বস্তির ঘরে টিনের পাতলা দেয়ালের ওপাশে ফিসফিস কথার আওয়াজ ভেসে আসছে। দিনের আলো কমে অন্ধকার নামলে বস্তিতে নানা পোশাকের ভদ্রলোকদের আগমন বেড়ে যায়। কেউ কেউ আসে গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন, ফেন্সিডিলের খোঁজে। কেউ আসে নরম মাংসের খোঁজে। নেশাখোর লোকগুলো নিজের সংসার ফেলে সুখ খুঁজতে দুর্গন্ধের আস্তানায় এসে সমবেত হয়। বস্তির মেয়েদের সৌভাগ্য হয় না মালিকদের প্রাসাদের অন্দর মহলে পা ফেলার। বরং প্রাসাল প্রধানই নিজে থেকে চলে আসে ওদের কাছে। দিনের পুঁতি-গন্ধময় নর্দমায় যেন প্রতিরাতে নতুন নতুন পদ্ম ফোটে। খুব স্বল্পায়ু পুস্প এরা। মাত্র কয়েক ঘন্টার সজ্জ্বা জোটে এদের কপালে।

প্রথম দফায় ছয়টি মাস কোনোভাবে পার হবার পর গ্রামের সবাই মনে করলো করোনা এবার মরেছে। গার্মেন্টসও খুলে দিলো তিনদিনের নোটিশে। সুরমার মা মনের খুশিতে কাজে ফেরত যায়। পরিস্থিতি আগের মতো নেই যদিও। হাতে প্লাস্টিকের গ্লাভস আর মুখে কাপড়ের মাস্ক। সুপারভাইসর লোকটি সবাইকে কি কি সব নিয়মের কথা বলে অনেকক্ষণ ধরে। অন্য সব গার্মেন্টস কর্মীদের মতো সুরমার মাও পরিষ্কার করে সব কথা বুঝতে পারে না। তবুও মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় সব কিছুতেই। একমাস দশ দিন গার্মেন্টস চালু থেকে আবার বিনা নোটিশে বন্ধ হয়ে গেলো। সরকার নির্দেশ দিয়েছে দেশের সব গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে হবে। সুরমার মায়ের মনে গভীর দুশ্চিন্তা ঘনায়, গার্মেন্টস বন্ধ থাকলে তারা মা মেয়ে না খেয়েই মরে যাবে! গরিবের আসলে মরণের হাত থিকা বাঁচন নাই, দীর্ঘশ্বাস ফেলে জননী।

– এইযে, শুনলাম তুমি কাজ খুঁজতে আছো? চেয়ারম্যানের চ্যালা রফিক বাড়ির সামনে এসে ডাকে।

আশা জাগে সুরমার মায়ের মনে। মনে করলো চেয়ারম্যানের তিন বৌয়ের কারো হয়তো কাজের লোক দরকার। এখন বাইরে কোথাও কাজ পাওয়ার উপায় নাই। মানুষের বাড়িতেও কেউ কাজের লোক রাখে না। সবখানেই অভাব আর অভাব।

– হ, কাজ তো একটা খুব দরকার। কাজ না পাইলে আমি আর সুরমা কই যামু, কি খামু, কিছুই মাথায় আসতাছেনা।

– তোমার লইগ্যা একটা সুখবর আছে। চেয়ারম্যান সাবের মন চাইছে আইজ রাইতে তোমার বাড়িতে আইবো। আমি রাইতে তোমার দরজাত তিনবার টোকা দিলে দরজা খুইলা দিবা। জোরে কথা বলব না একদম। আশেপাশের ঘরে কেউ যেন টের না পায় কিছু। বুঝতাছো নিশ্চয় কিয়ের লাইগ্যা আইতাছে!

সুরমার মা কথা খুঁজে পান না। মাথার ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে। ঝাঁঝের সাথে রফিককে ধমকে দেবেন, নিজের গলায় তেমন জোর পান না। একটা বিষয় তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন, আজ রফিককে না করে দিলে কাল সকালে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দেবার সামর্থ তার নেই আর। গরম ভাত সুরমার খুব প্রিয়।

বেঁচে থাকায় লড়াইয়ে পরাজয় মেনে নিয়ে নিজ হাতে সাদা পতাকা উড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় তার মাথায় আসে না। ক্ষীণকণ্ঠে বলে, চেম্মেন সাবরে কইয়েন বেশি রাইত করতে না। সুরমারে কারো ঘরে পাঠাইতে হইবো। রাইত বেশি হইলে ওরে আমি কই পাডামু!

খেঁকখেঁক গলায় হেসে উঠে রফিক। সুরমারে পাঠাইবা অন্য ঘরে, তাইলে চেয়ারম্যান সাব আইতাছে কার লইগ্যা! তুমি ভাবছো তোমার লইগ্যা! হে হে হে থুক করে একদলা থুথু ফেলে রফিক সুরমাদের টিনের বেড়াতে।

– সুরমার দিকে চোখ গেছে চেম্মেন সাবের? আমার ঐটুকুন মাইয়া! আশ্চর্য হয়ে যায় সুরমার মা। তার মেয়ে যে তার পাশে পাশে থেকেই কবে এতো বড় হয়ে গিয়েছে নিজেরই চোখে পড়ে নাই।

– তোমার মাইয়া ডাঙ্গর হৈছে। চোখ না যাওনের কি আছে! আইচ্ছা যাই তাইলে। রাইতে আইতাছি আবার।

– না। পারুম না। চেম্মেন সাবরে না কইরা দিস। আমার মাইয়া শরীর বেচবো না। আমার মাইয়ার এখনো শরীর খারাপ হয় নাই।

আবার সেই গা জ্বালানো খরখরে শব্দে হাসে রফিক।
– চিন্তা কইরা কইতাছো তো! দুইদিন পেটে দানা না গেলে এই গেরামে কার কাছে গিয়া হাত পাতবা তুমি? তোমারে সাহায্য করার মতন অবস্থা অহন আর কারুরই নাই।

– খাইতে না মারলে গলায় দড়ি দিয়া মরমু। তুই যা রফিক। খেঁকিয়ে উঠে সুরমার মা।

রফিক চলে যেতে সুরমা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। রাগে নাক মুখ ফুলে উঠেছে মেয়ের। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুকটা ভারী হয়ে যায় মায়ের। কবে কবে মেয়েটা এতো সেয়ানা হয়ে গেলো তার!
বিকেলে দীঘির পাড় থেকে শাপলা আর কিছু কলমি শাক তুলে এনেছে সুরমা। সন্ধ্যার মুখে তাই সিদ্ধ করে মা আর মেয়েটি পেট ভরালো। গ্রামের সবার মুখে এখন একটিই আলোচনা – করোনা। করোনার ভয়ে গার্মেন্টস বন্ধ আছে, কবে যে খুলবে সে কথা কেউ জানে না। দরিদ্র মানুষদের পেট অবশ্য করোনাকে ভয় পায় না। তাদের পেটের ভেতর ক্ষুধার আগুন এখনো জ্বলে আগের মতোই দোর্দন্ড প্রতাপে।

কয়েকটি সপ্তাহ পার করে সুরমার মা গুটি গুটি পায় চেয়ারম্যান বাড়ি যায়। বাইরের উঠোনে বসে ভেতরে চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করার খবর পাঠায়। কিছুক্ষণ পর রফিক বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে।

– কি, মন বদলাইছো তোমার? প্রস্তাবে অহন কি রাজি তুমি আর তোমার মাইয়া?

– তুই ক্যা? চেম্মেন সাবে কই? হের লগে কথার দরকার আছে আমার।

– বও। দেখতাছি।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর লোকটি বেরিয়ে আসে।

– সুরমার মা! কি নাকি কথার দরকার তোমার? রফিকরে তো হেইদিন বিদায় কইরা দিলা।

মাথার কাপড় টেনে লম্বা করে সুরমার মা। চেয়ারম্যানকে যা যা বলার আছে সেসব কথা সে বাড়ি থেকে বারবার করে ঝালিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন যেন ঠিক বুঝতে পারছেনা কিভাবে শুরু করবে।

লোকটি গলায় কৌতুক আর তাচ্ছিল্য মিশিয়ে প্রশ্ন করে, কি কৈবা কও। আমার একটু তাড়া আছে।

মনের সবটুকু জোর গলায় এনে সুরমার মা বলে, সুরমারে যদি আপনার মনে ধরে তয় আপনি হেরে বিয়া কইরা ঘরে তুলেন। আমার আপত্তি নাই। আমার মাইয়া আপনার ঘরে বেশি হইয়া যাইবো না।

চুপ করে থাকে চেয়ারম্যান লোকটা। সুরমাকে তার খুবই পছন্দ। গ্রামের সীমানায় টলটলে পানির গাঙের মতো লাগে মেয়েটিকে। দেখলেই মনে হয় পুরাডা গাঙ সাঁতরাইয়া আসে দিনে দুইবার। ইচ্ছা করলে নিজের ছেলের সাথেই এখন সুরমাকে বিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু তাতে নিজের মনের শখ তো মিটানো হয় না।

– দেখো সুরমার মা। তোমার প্রস্তাবডা আমার ভাইব্যা দেখতে অইবো। তুমি বাড়ি যাও। আমি চিন্তা কইরা রফিকরে দিয়া খবর পাডামু।

দিনে দশবার রফিক আসে সুরমাদের বাড়িতে। কথাবার্তার আদান প্রদান খুব বেশি প্রয়োজন হয় না। সুরমা নাবালিকা, এখনো আঠারো হয়নি, তাই ওর মতামতের চিন্তা করে না কেউ। বেঁচে থাকার শর্তে অন্ন- বস্ত্র- বাসস্থানের সাথে শরীরের বিনিময় হয়ে গেলো। গ্লানি নিয়েও বেঁচে থাকুক প্রিয়জন। তবুও প্রাণটুকু থাক। ক্লেদ, শ্রান্তি, অবসাদ ভরা থাক বুকে, তবু শরীরে বেঁচে থাক। সুরমার চোখে সুরমা মেখে, পায়ে আলতা আর সস্তার জরি শাড়ি পরে বালিকাটি বৌ সেজে চলে গেলো জীবনের খোঁজে। বাঁচবে বলে।

সুরমার মায়ের বুক হাহাকার করে। কিন্তু চোখে পানি আসে না। তক্তা বিছানো মাচার মতো খাটটির উপরে বসে থাকে নিষ্প্রাণ। নিজেকে নিয়ে বেশি চিন্তা আসে না সুরমার মায়ের। মেয়ের জন্ম হবার পরই মুছে গেছে তার নিজের নাম। সেই থেকে সে শুধুই সুরমার মা। বুকে তার যত ব্যথা হোক, একটি সান্ত্বনা আছে মেয়েটি তবু কিছু খেয়ে পরে বাঁচবে। জগতের শত মানুষ জন্মায় তারই মতন কেবল সংখ্যা হয়ে। সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এই মানুষগুলোর অন্য কোন ভূমিকা থাকে না সমাজের সামনে।

দিনে তিনবার, রাতে একবার, প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে হয় ওদের। বস্তির একমাত্র গোসলখানা আর পায়খানায় লম্বা লাইন থাকে সকালে মানুষের ঘুম ভাঙার সময় আর রাত্রে ঘুমোতে যাবার আগে। চাপকলের পানি প্লাস্টিকের বোতলে ভরে নিজের ঘরে এনে রাখে বস্তির সবাই। সুরমা থাকলে সারাদিন দুইজনের কথা বলা, সুরমার মাথার চুল বেঁধে দেয়া, মেন্দি গাছের পাতা পাটায় পিষে মেয়ের হাতে আলতার মতো লাগিয়ে দেয়া- কত কথা মনে পড়ছে আজ সুরমার মায়ের। নিজের মায়ের কথা, শৈশবে একই ঘরে ভাই-বোনদের একসাথে বেড়ে উঠা সবকিছুই কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে। ভাবতে গেলে মনে হয় ওসব তার নিজের জীবনের কথা নয়। মা খালার মুখে শোনা গল্পের কাহিনী যেন সেসব। সুরমার আব্বার কথা মনে পড়ে খুব। কখনো রাগ হয় মানুষটির উপরে আবার কখনো খুব মায়া লাগে। এই দুঃসময়ে মানুষটা পাশে থাকলে কষ্টগুলো দুইজনে ভাগ করে নিতে পারতো। এখন সব ব্যথা সুরমার মার একার।

মাস দুয়েক ঠিক চললো সবকিছু। সপ্তাহে একদিন করে রফিক এসে কিছু সদাইপাতি দিয়ে যায় সুরমার মাকে। দুই সপ্তাহ পর একদিন গিয়ে সুরমাকে দেখে আসে। বাড়ির ভেতরে যাবার অনুমতি নেই তার। বাইরের ঘরে বসে মেয়ের সাথে দেখা করে কথা বলে আসে। সুরমাকে দেখে সুখে আছে বলেই মনে হয় তার। গায়ে নতুন সুতির শাড়ি, হাতে সিটি গোল্ডের বালা, গলায় সরু চেইন।

– কেমুন আসোস সুরমা মা!
– ভালোই তো আছি। তুমি ভালা আছো মা?
– তোর সতীনেরা কেমুন?
– ভালোই। আমি তাগোর মাইয়ার লাহান। বড় বুর মাইয়া আমার থিকা বড়।
– থাহুক। তুই ঐসব নিয়ে কষ্ট পাইস না। আমাগো কপাল ভালা যে চেম্মেন বাড়ির বৌ হইতে পারছোস তুই।
– গরিবের কপাল আম্মা। টিক্কা থাকলেই অয়।

এরচেয়েও খারাপ কিছু আর কি হতে পারে তাদের জীবনে বুঝে পায় না সুরমার মা। কিন্তু আরো খারাপ ঘটার বাকি ছিল। আচমকা এক দুপুরে কোনো সংবাদ ছাড়াই সুরমা চলে আসে মায়ের কাছে, বস্তিতে। হাতের পুটুলিতে তার নিজের কয়েকটি জিনিস বাঁধা।

– সুরমা? তুই এইহানে? কি অইছে?
– আমারে করোনায় ধরছে।
– কে কইছে?
– তাগোর বাড়িতে স্বাস্থ্য কমপ্লেস থিকা ডাক্তর আইছিলো। বাড়ির সবাইরে টেস্ট করছে। কারোর অসুক নাই। খালি আমার করোনা অইছে। আমারে হেরলিগা আর ঐ বাড়িতে থাকতে দিবো না। পাঠাইয়া দিলো।

মাথায় হাত দিয়ে ঘরের দরজায় বসে পড়ে সুরমার মা। গ্রামের সবাই বলাবলি করে, করোনা খুব মারাত্মক অসুখ। সুরমার শরীরে কেমন করে করোনা আসলো সেটা তিনি বুঝে পান না। শুধু বুঝতে পারছেন, সুরমার এখন আর যাবার কোন ঘর নেই। সুরমা এখন আবার শুধুই ওর মায়ের মেয়ে। আর কোন পরিচয় নেই তার সমাজের সামনে।

– আমি ঘরে যাই?

সুরমার মা দরজা থেকে সরে বসে মেয়েকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। চোখের মনি মেয়েটা যদি মরেও যায় এইবার তাহলে মৃত্যুর আগে মায়ের হাতের সেবা পেয়েই মরবে। মমতায় সুরমার কপালে হাত ছোঁয়ায় মা। দৈবদুর্বিপাক এসে হয়তো শেষ সময়ে মা ও মেয়েকে এক হবার সুযোগ করে দিলো। অভাবের নির্মম ঢেউ একদিন পৃথক করে দিয়েছিলো ওদেরকে, আজ বিধাতার নির্দেশেই হয়তো, অদৃশ্য এক মৃত্যু ভয় ভেসে এসে আবার তাদেরকে এক করে দিলো। এখন মৃত্যু বেঁচে থাকার চাইতেও মধুরতর ঘটনা এই দুই মানবীর কাছে।