গল্প: অপয়া বাড়ি

গল্প: অপয়া বাড়ি

গল্প: অপয়া বাড়ি
শাহ্ নাজ পারভীন

শুভ’র খুব মন খারাপ থাকে আজকাল। আসলে শুধু শুভ কেন, এই আপদ করোনা আসার পর থেকে কারই বা মন ভালো আছে!
তার মধ্যে এই নতুন পরিবেশ, শুভরা মাত্র কয়েক মাস আগে এই নতুন ভাড়া বাড়িতে উঠেছে আর এরই মধ্যে শুরু হয়েছে করোনার উপদ্রব।
বাবার চাকুরির বদলি সূত্রেই শুভদের এখানে আসা।

তবে এবার যেটা হয়েছে সেটা হলো খুব কম ভাড়ায় ওরা চমৎকার এই বাড়িটি পেয়ে গেছে, শুভর খুব পছন্দ হয়েছে ছিমছাম এই বাড়িটি, আর সব চাইতে পছন্দ
হয়েছে এই বাড়ির চিলেকোঠার ঘরটা।
করোনাকালে এই ঘরটা শুভর জন্য খুলে দেয়া হয়েছে ইচ্ছে মতো রঙ তুলির সাথে সময় কাটাতে,
শুভর আঁকার হাত খুব ভালো , এই বয়সেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার ইতোমধ্যেই তার ঝুলিতে এসেছে, এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করার খুব ইচ্ছে শুভর। সময় পেলেই রঙ তুলি নিয়ে নতুন কোন সৃষ্টিতে মেতে উঠে।

আর তারই ধারাবাহিকতায় কয়েকদিন ধরে একটা
ছবি আঁকতে গিয়ে কিছুতেই মনের মতো স্কেচ করতে পারছিলনা, ছবির থিমটা এরকম
নীল ফ্রকপরা একটা কিশোরী মেয়ে মনের আনন্দে কাশবনে নেচে বেড়াচ্ছে, আর ছবিটি নামও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল শুভ – “কিশোরী বেলা ”
কিন্তু কিছুতেই সেই মেয়েটার মুখটা মনের মতো আঁকতে পারছিল না।
আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপারও লক্ষ্য করেছে,
কয়েকদিন ধরে যখনই শুভ এই ঘরটায় আঁকা আঁকি
করতে আসে তখন কেমন একটা অন্যরকম লাগে – একটা গন্ধ পায়, তবে সেই গন্ধটা খুব মিষ্টি আর শুভর খুব পরিচিত মনে হয়, ও অনেকদিন ঘুমের মধ্যে এমন একটা মিষ্টি গন্ধ পেয়েছে। আর যেটা ওর কাছে একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হতো সেটা হলো , ওর কেবলই মনে হতো এই ঘরটায় যেন শুভ একা নয় অন্য কারো উপস্থিতি আছে, কেউ শুভকে অনুসরণ করে বিশেষ করে শুভ যখন আঁকা আঁকিতে একদম ডুবে যায় তখন
প্রায়ই মনে হয় ওর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে ওর আঁকা দেখছে, তবে এটা শুধুই শুভ অনুভব করতে পারে
চোখে কিছুই দেখেনি কখনো। শুভ ভাবে নতুন বাড়ি
আর এতো নিরিবিলি এতো বড় বাড়িতে তো শুভরা আগে আর কখনো থাকেনি তাই হয়তো ! আর হ্যালুসিনেশন সম্পর্কেও শুভ শুনেছে কয়েকটি অতিপ্রাকৃত গল্পও পড়েছেছিল ছোট মামার বদৌলতে।
কিন্তু এটা শুভ র মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না।
এই বাড়িতে ওরা ছাড়া আর তো কেউই নেই, আর প্রতিবেশী কারো সাথে এই করোনাকালে পরিচিত হবার সুযোগ ও নেই, কে আসবে এই সময় আর কীভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে কাউকে দেখা সম্ভব!
তবুও শুভর সাথে এমনটাই ঘটছে আজকাল।

আর সেদিন যা ঘটলো তা একেবারেই অবিশ্বাস্য!

হঠাৎ ঘাড়ের কাছে যেন কার নিঃশ্বাস অনুভূত হলো ফিরে দেখে, ও যেই মুখটা আঁকতে চাইছে
ঠিক সেই আদলের ১৩/১৪ বয়সের একটা ফুটফুটে মেয়ে নীল ফ্রক পরে ওর পাশে দাঁড়িয়ে,
খিলখিল করে হেসে বলে উঠলো , কি গো আমার মুখটা আঁকতে পারছোনা!
এই বাড়ির মালিকের একমাত্র মেয়ে অদ্রিতা, ১০ বছর আগে গৃহপ্রবেশর দিন চিলেকোঠার এই ছাদ থেকে পড়ে মারা যায়, সেদিন ওর পরনে ছিল গাঢ় নীল রঙের একটা ফ্রক!
তবে এটা নিছক দুর্ঘটনা ছিলনা, ছিল পরিকল্পিত হত্যা।
আদ্রিতার বাবা আর তার সেক্রেটারি নিতু আন্টির অনৈতিক সম্পর্কের কথা আদ্রিতা জেনে গিয়েছিল
সেই নিয়ে মা বাবার মধ্যে তুমুল অশান্তি আর তার মূল্য চুকাতে হয়েছে কিশোরী আদ্রিতাকে, নিতু রায়
কেয়ারটেকার সোলেমানকে মোটা অংকের টাকার লোভ দেখিয়ে হাত করেছিল পথের কাঁটা আদ্রিতাকে সরিয়ে দিতে, তাহলেই নাকি রহমান গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির মালিক রহমান সাহেবের তার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে আপত্তি থাকবেনা আর নিতু রায় সেই সুযোগটা
নিতয়েই রহমান গ্রুপে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করার রঙিন স্বপ্ন দেখছিল অনেকদিন ধরে।

কিন্তু আদ্রিতাকে নিয়ে কোন আপোষ করবেনা রহমান সাহেব এটা নিতু রায় বুঝেগিয়েছিল, কারণ আদৃতা যে তার নয়নের মণি।
তবু কিছু ভুলের জন্য – পাপের জন্য, কখনও কখনও মানুষকে চরম মূল্য চুকাতে হয়, রহমান সাহেবকেও সেই মূল্য দিতে হয়েছে একমাত্র সন্তান আদরের মেয়েকে হারিয়েছেন ।

আর সেই জন্যই অনিন্দ্য সুন্দর এই শখের বিলাসবহুল বাড়িটি আজ সবার কাছে অপয়া বাড়ি!
অদ্রিতা মারা যাওয়ার দুবছরের মাথায় স্ত্রী শারমিনকে নিয়ে কানাডায় চলে যান এই দুঃসহ পরিবেশ থেকে পরিত্রাণ পেতে আর নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনা করতে সব কিছু ছেড়ে এতোটা দূরে চলে গেছেন।

ঘটনার পর পরই এই কেসের প্রধান আসামি সেক্রেটারি নিতু ও তার সহযোগী সোলেমান এরেষ্ট হয়েছে এবং নারী ও শিশু অপরাধ ট্রাইবুনালে তাদের যাবতজীবন কারাদণ্ডও হয়েছে।

এরপর অনেক দিন এই বাড়ি তালা বন্ধ অবস্থায় পড়েছিল
সারা বাড়ি আগাছা আর ধুলো ময়লায় নিজস্ব জৌলুশ হারাতে বসেছিল ,অবশেষে রহমান সাহেবের ছোটভাই রহমান সাহেবের অনুমতি নিয়েই ভাড়া দেয়ার সিধান্ত নেয়।
সচারাচর এলাকার লোকজন ভর দুপুর বা সন্ধ্যায় বাড়িটির ছায়াও মারাতে চায় না, তবে যারা জানেনা
তারা অবশ্য এমন সুন্দর একটা বাড়ির দিকে একনজর না তাকিয়ে পারেনা আর এর মালিকের প্রশংসা করতেও দ্বিধা করে না।

তবে লোকমুখে শোনা যায়, অনেকেই নাকি
১৩/১৪ বছরের একটা কিশোরী মেয়েকে কখনও কখনও ওই বাড়ির ছাদে ঘুরতে দেখেছে যার পরনে নীল রঙের ফ্রক!

শুভ এখন হসপিটালে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে, চিকিৎসা চলছে। হয়তো শুভ আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে, প্রত্যাশাও তেমনটাই। তবে
অনাকাঙ্ক্ষিত এই গল্প গুলো আমাদের কারো কারো জীবনেরই কালো অধ্যায় !