গল্প:মিসিং ডায়েরি

গল্প:মিসিং ডায়েরি
অরূপ পালিত
ইদানিং রাতের ঘুমটা মোর্শেদ সাহেবের জন্য, ভয়ঙ্কর অভিশাপে রুপ নিয়েছে। চোখ বুজলেই কোন এক অচেনা মুখ এসে ঘুমের মধ্যে নাক মুখ চেপে ধরে, ভয়ে শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে শরীর যেন পাথরে পরিণত হয়ে যায়।
সে-ই ঘুম একবার ভেঙে গেলে , আর সারারাত হয়ে ওঠে না , একা ঘরে তখন অন্য পথ বেঁচে নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। সাহেবের রাতে আদর যত্নের অভাব নেই, বিছানার দু’পাশে টাকা দিয়ে অনাবিল সুখ কিনে রেখেছেন, অন্ধকারে কালো ছায়া গায়ে স্পর্শ না লাগে,সে জন্য ঘরের ভেতরে রঙিন আলো জ্বেলে ফুর্তিতে কাটাতে চেষ্টা করেন । সেটি ও যদি মনে না ধরে, খোলা জানালায় জোছনার আলোতে় , নিজেকে সুপুরুষ বানানোর উপায় খোঁজেন ।
একাকিত্ব দূর করতে বা ভালো সংঙ্গ দেবার জন্যে নিকটতম আত্মীয় স্বজন কেউ পাশে নেই , দায়ী অনেকটা চৌধুরী সাহেব
নিজেই ।
দিনের বেলায় চৌধুরী সাহেবের কাজের প্রেশার থাকে বেশ, দুপুরে ভাত খেয়ে একটুখানি ঝিমিয়ে নিতে পারলে শরীরটা মোটামুটি ঝরঝরে হয়ে যায়। কয়েকদিন ধরে তা আবার , কোনো রকমের হয়ে উঠেছে না। উনার কাছে প্রতিদিন একটা না একটা সামাজিক অনুষ্ঠান লেগে থাকে , না হলে মোবাইল ফোনের যন্ত্রণা । দুপুরে বাসায় খেতে আসলে ও শান্তি নেই,
আজ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন ,
মোবাইল ফোনের সুইচ অফ করে একটা ঘুম দিবেন।
কেয়ার টেকারকে বলে রেখেছেন আজ কারও সাথে দেখা করবেন না।
খাবার পরে একটু রেস্ট নিতে , সোফায় চোখ বুজে শুয়েই পড়লেন , রাজ্যের ঘুমটা আসছে সবেমাত্র ।
কলিং বেলের কড়া আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায় ,রাগে চৌধুরীর মাথায় যেন খুন চেপে বসে, গজগজ করতে লাগলেন সাহেব।
দরজা খুলার বারণ দিচ্ছে না , কলিং বেলটা যেন টিপে ধরে আছে ,শালা কেয়ার টেকার হলে কোপ মেরে গাঁড় থেকে মাথা নামিয়ে দিবেন।
গর্জে উঠে দরজা খুলতেই এক ভদ্র মহিলাকে দেখেই , চৌধুরী সাহেব চুপ হয়ে গেলেন , মনে হচ্ছে সাহেবের সুন্দরী রমণী দেখে রাগ পানিতে পরিণত হয়েছে।
ভদ্রমহিলা এমন মেকআপ নিয়েছেন মুখটা লাল, নীল, হলুদে, চিকচিক করছে।
: একটি হলুদ খাম হাতে নিয়ে বললেন ,
স্যার আপনি নিশ্চয়ই মোর্শেদ চৌধুরী।
: হুঁ , ভেতরে আসুন প্লিজ।
: না স্যার অনেক ধন্যবাদ।
একবছর আগে আপনার স্ত্রী এই খাম টি আমার কাছে ফেলে এসেছিলেন ।
: আমার স্ত্রীর এক বছর আগের ডকুমেন্ট , তো এতদিন পরে দিতে এলেন , আজ তো সে এখানে নেই , কবে আসবেন তা-ও বলতে পারছি না।
তো আমি এইটা নিয়ে কি করব , আপনি ভেতরে আসুন ।
পুরুষ বলে মহিলা ভিতরে আসতে ইতস্তত বোধ করলেন , আবার কি বুঝে ভিতরে প্রবেশ করলেন।
সোফায় বসে মহিলা একগ্লাস পানি নিজ থেকেই ঢেলে খেয়ে নিলেন।
শুধু ছটফট করতে লাগলো , যেন বাইরে কিছু ফেলে এসেছেন।
:এক কাপ চা বা কফি হবে বলতে,
না- না আমি যায় বলেই ভদ্র মহিলা উঠে দাঁড়ালো, হাতের খামটা এগিয়ে দিয়ে বললো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ,
মহিলা ছাড়া আপনার ঘরের সাজসজ্জা খুব সুন্দর।
কথাবার্তায় মহিলাকে একটুখানি ওভার এস্মার্ট মনে হল, আর মহিলা প্রতিটা কথায় হেসে উঠেন।
স্যার এই খামটা দিতে দেরি হয়েছিল, আমার কাছে আপনার নতুন ঠিকানাটা ছিল না , একদিন আপনার স্ত্রী বাসায় আসতে বলেছিলেন , কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন বলেছিলেন , কিন্তু আমি দেশের বাইরে চলে যাওয়ার উনার সাথে আর যোগাযোগ রাখতে পারি নাই ,আর উনার খামটার মধ্যে কোনো বাসার ঠিকানা ছিল না।
উনি আমাকে শেষের বার যে ফোনটা করেছিলেন সেটা বাইরের দোকান থেকে , খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সেই ফোনটা ছিল চকবাজারের এক মোবাইল এর দোকান থেকে ।
দোকানদার আপনাদের যে ঠিকানা দিয়েছেন, সেখানে গিয়ে দেখি বাসায় তালা, আপনারা আসার পর থেকে, সে বাসাটা আর ভাড়া হয় নি। বাড়ি ওয়ালা কে জিজ্ঞেস করলাম, উনি বললেন আপনারা নাকি ফ্লাটে উঠেছেন।
জুন মাসে আপনি বাসা চেঞ্জ করেছেন , এই বাসার ঠিকানা পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
কিছু মনে করবেন না স্যার , ফ্ল্যাটটি ভাড়া , না কি নিজে কিনেছেন , কথার ফাঁকে চোখদুটো ঘুরাতে লাগলেন, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিতে , কথা অন্য দিকে ঘুরানো হল ভদ্রমহিলার ।
আপনি তো একা মানুষ , ফ্লোরে এত লম্বা মহিলার চুল !
মোর্শেদ সাহেব ও হেসে কথাটি ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন ,
: আমি মহিলার চুল এক্সপোর্ট করি, আর আপনি ও দেখছি দারুন রসিক মানুষ , আপনাকে আমার খুব ভালো লাগলো, আমি কিন্তু একা মানুষ , মাঝে মধ্যে আসলে জমিয়ে আড্ডা মারা যাবে।
চৌধুরী সাহেব বুঝতে পারলেন এই স্পাই বুকের সামনের থেকে, একটি গোপন ক্যামেরা দিয়ে সব কিছু ধারণ করে নিচ্ছে। এরই মধ্যে চৌধুরী সাহেবের মোবাইলে এর মধ্যে ভদ্র মহিলার সব ডাটা চলে এসেছে।
চেনা-শোনা নেই , আবার কোথায় থেকে এলাম জানতে ও চাইলেন না ,আপনি তো দেখি অতিথি পরায়ণ লোক, আমাকে এতো আপন ভাবলেন , নিজেকে ধন্য মনে করছি । ভদ্র মহিলার মুখে আবার সে-ই হাসি , স্যার আপনি না বললে আমি আসতাম , পেটে খিদে আছে তো !
:দাঁড়ান খামটা খুলে নি , এতদিন যত্ন করে রেখেছিলেন , আবার কষ্ট করে নিয়ে ও এসেছেন ।
স্যার আমার সামনে খামটা না খোলায় ভালো , আপনাদের পারিবারিক বিষয় বলে কথা ।
ও হাঁ স্যার একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম , আপনার বর্তমান স্ত্রী কি দেশে আছেন , না কি উচ্চশিক্ষার জন্য বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছেন ?
মোর্শেদ সাহেব ভদ্রমহিলার কথায়, একটুর জন্য ও বিচলিত নয় ।
হঠাৎ করে রুমের ভেতর থেকে এক মহিলা এসে গজগজ করে বললো , আপনার এতো কিছুর প্রয়োজন নেই, কাজ শেষ হলেই এইবার আসতে
পারেন ।
ভদ্রমহিলা হতবাক হয়ে যান , এতো সুন্দর মেয়েলোক কোথাই থেকে বেরিয়ে এলেন, সামনের দিকে কাউকে আসতে দেখা যায় নি, মনে হয় পেছনের দরজা দিয়ে আসার জন্য কোন রাস্তা নিশ্চয় আছে।
বসার ঘর থেকে চৌধুরী সাহেবের বেডরুম দেখা যাচ্ছিল, এতক্ষণ ধরে খেয়াল করলো বেড রুমে ও কেউ ছিলো না।
উনি মনে হয় সুন্দরের পূজারী , না হলে এতো সুন্দরী সেক্রেটারির রাখতেন না।
কর্কশ শব্দে এইবার ভদ্রমহিলা বললেন, রুমে সিসি ক্যামেরা তো নেই, বাইরের থেকে আমাদের কথাই আড়ি পেতে আছেন কি?
: না তা দরকার হয় না , ওই যে রুমের ভেতরে যে ভোমরা টা উড়ছে , সে আমাকে আপনার অবস্থানের খবর পৌঁছে দিয়েছে ।
ভদ্র মহিলা তরী ঘরি করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে উঠলেন , নামার সময় বললেন, স্যার আপনার তো দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি , তো আমি কবে আর সান্নিধ্য লাভের আশা করতে পারি ?
: ভুল যদি না বলি আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা মনে হয় এই প্যাকেটে দিয়েছেন , আপনার মতো পর উপকারী লোকের আমার বড্ড প্রয়োজন, বাসা যখন চিনতে ভুল হয় নি , অবশ্য এখানে আসতে বা একটি কল করতে ভুল হবে না নিশ্চয়।
এরই মধ্যে চৌধুরী সাহেব সিগারেট আনার জন্য একবার ভিতরে গিয়েছিলেন।
না স্যার আমি বলতে চাচ্ছি, অনেক
ব্যস্ততা সময় পার করতে হয় আপনাকে , তিনদিন অপেক্ষার পর ভাগ্য গুনে সিডিউল পেলাম , আদৌও তো আমি জানি না যে , অরিজিনাল না কি ডুপলিকেট চৌধুরী স্যারের সাথে কথা বলছি কি না ,আরেকবার সময় নিতে কয়দিন লাগে সৃষ্টি কর্তা জানেন ।
: আচ্ছা আপনি ডিসেম্বরের ১৭ তারিখে দেশে এসেছেন , আজ ৩১ই তারিখ , মাঝখানের গ্যাপ ছিল বেশ কয়েক দিন , এতো দিন মনে হয় শহরে ছিলেন না,
তাই না সেলিনা ম্যাডাম , আর আপনি স্পাই এজেন্সিতে কাজ করেন , অফিস হচ্ছে খুলসিতে ।
ভদ্র মহিলা হতবাক হয়ে যান, উনি তো আরো দূর্ত , না হলে উনার তো এত কথা জানার কথা নয় , বিপদে পরার আগে এখান থেকে কেটে পড়তে পারলে ভালো।
আপনি বোধহয় ভুল নামে ডাকলেন স্যার আমায়, আমার নাম তৃষ্ণা।
: ও সরি ভুল নাম উচ্চারণ করে ফেললাম,
নো প্রবলেম , সামনে থেকে তৃষ্ণা বলে সম্বোধন করবো।
মহিলা আর কথা না বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
মোর্শেদ সাহেবের এই দেশে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সব বন্ধ হয়ে গেছে কিছু দিন হয়েছে , ছেলে মেয়ে দেশে আসেন নি কোন দিন , আর আসবে কিনা সন্দেহ আছে।
উনার ২য় বিয়েটাও ছিল রহস্যজনক , কেউ বলেন এইটা চৌধুরী সাহেবের গোপন কোনো সমস্যা।
২য় স্ত্রী শিলা রহমান , চৌধুরী সাহেবের এক সময়কার অফিসের সেক্রেটারি ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর দেশে না থাকার অনুপস্থিতিতে ২য় স্ত্রী শিলা , চৌধুরী সাহেবের বাসায় আসা যাওয়া ,
অবশ্য এই নিয়ে প্রথম স্ত্রী অনন্যার সঙ্গেই হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে , দফায় দফায় বৈঠক ও হয়েছিল অফিসে, শিলা মেডামকে অনন্যা মেডাম একবার অফিস থেকে বের ও করিয়ে দিয়েছিলেন জনসম্মুখে।
এতে শিলা মেডাম আরো বিগড়ে যায়, অনন্যার উপর প্রতিশোধ নিতে চৌধুরী সাহেব কে টেপে ফেলে বিয়ে করতে বাধ্য করেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাগ করতে বলেন।
কিন্তু চৌধুরী সাহেব অনন্যা মেডাম কে প্রচন্ড ভালোবাসেন, চৌধুরী সাহেবদের মতো লোকের কাছে মেয়ে লোক হচ্ছেন
টিস্যু পেপার, একবার ব্যবহার করে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া নিত্য প্রয়োজনীয় অভ্যাস , তাই একবার ব্যবহার করার পর ফেলে দিতে ভুল করেন না।
শিলা মেডাম কে নিয়ে চৌধুরী সাহেব হানিমুন করতে গিয়েছিলেন সবাই জানতেন, এরপর কোথায় কিভাবে আছেন কেউ জানে না, এই নিয়ে শিলা মেডামের বাপের বাড়ি থেকে থানায় একটি মিসিং ডায়রি করলেও, মামলা দায়ের করা দূরে থাক বা সাক্ষীর অভাবে তা আর বেশি দূরে এগুতে পারেনি।