দিলারা হাফিজের কবিতা

দিলারা হাফিজের কবিতা

ভূমি ও জলতরঙ্গ নাচ

সেদিন সন্ধ্যায় পৃথিবীও জন্মেছিলো আমারই সঙ্গে—হেমন্তের শস্যোৎসবে
ক্ষীর পায়েসের মেলা বসেছিলো
দোপাট্টা উড়িয়ে কালিগঙ্গা স্রোতে
ভেসে গেছে তার অববাহিকা
নবান্নের সুবাসেও কেঁদে ফিরছিলো
ওপাড়ার নিরন্ন-অস্থির ক্ষুধা
নাগরদোলায় দুলছিলো গন্ধরাজ
রাজ অশোক,বকফুল;
বেসুমার ছাতিম ছুটে এসেছিলো বিশ্বভারতীর মাটি ছুঁয়ে
অগ্রহায়ণ মাস খুব ব্যস্ত ছিলো
খৈ-মোয়ার সদ্ভাব ও সম্প্রীতি নিয়ে—
জব্বারের লাঠিখেলা শেষে
পালা ও বিচার গানের বিচারে লালন এসে হাজির,
জারি সারি মুর্শিদী কেউ কম নয় কারু চেয়ে,
পিঠেপুলির এই উৎসবে—-
আফ্রিকার জরায়ুর জল কাটা সেই স্রোতে ভেসে
ভেসে এসেছিলো আমার মতো অনেকেই,
সৃষ্টির অস্থির ব্যাকুলতা বুকে নিয়ে
তৃষ্ণার পরিপূরক কবি,
ততোদিনে সভ্যতার কিছু কালোমেঘ
উড়তে উড়তে দুই হাতে ভাসিয়েছে
দুর্মর আকাশ নীল,
মহাযুদ্ধের দুই বিষক্রিয়ায় হারিয়েছে দশ কোটি প্রাণ
নিখিল নাস্তির সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বর্শা হাতে
পরস্পর মানুষ শূন্যতায় ছুঁড়েছে ধনুক-তীর
এইসব গাথা-স্মরনিকা পার হয়ে তবু
শীত ও উষ্ণতা মিলে জন্মবেদ এক নতুন কাহিনীস্রোত।,
আলোর-তমসা ঘিরে সভ্যতার দশক বিভাজন
ডুবে গেছে সূর্যাস্তের গোধূলিরাগে,
শিল্প ও স্বপ্নের অস্থিরতা বুকে নিয়ে আজও তবু
শব্দবন্যায় ভেসে যায় কবি ও কবিতা,
অনাদি স্রোতের প’রে এক নতুন ঠি কানা
সুর ও লাবণ্যের ঘর-দোর ছেড়ে
বাঁক বদলের নেশায় বাঁধে তার ঘর;
কার্পাস ফুলের তন্তু-জাল ভাসিয়ে যুমনার জলে
পার হয়ে গেছে চর্যার ডোম্বী,
চির বিরহের বাঁশি কাঁদে জগতের প্রাণে
রাধা তবু রয়ে যায় বৃন্দাবনে,
যদিও কংসের নিষ্ঠুরতায় ভেসেছে দুকূল
স্রোতস্বিনী নদ ও নদীর আকাঙক্ষা তবুও
ভাঙেনি অপর পারে দাঁড়ানো অশ্বত্থের মায়া
শস্যের অপত্র সম্ভাবনা নিয়ে অগ্রহায়ণ
শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে আজো
চারচালা ঘরে সকালের ঢেউতোলা
রোদের রঙের মতো অনবদ্য ছিলো সময়ের ঘড়ি
পানির উষ্ণতা ভেঙে প্রাণ প্রদীপ জরায়ু থেকে
পিছলে গড়িয়ে পড়েছিলো চটের ছালায়,
মোরগফুলেরা ডেকে উঠেছিলো আল্লাহ আক্বর;
স্বরধ্বনি ব্যঞ্জনায় সুহাসিনী এক ধূপদানী হাতে
ডেকে এনেছিলো সন্ধ্যামালতিকে;
বাঁশের নেইলে কাটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এক
আফ্রিকার মতো কেঁদেছিলো মর্মের সুতোয়

পথের মতো বুক পেতে দিয়েছে যে বার বার
তাকেই ডেকে উঠেছিলাম মা মা বলে!

পথিক

সন্ধ্যার বাতাসে খেলা করছিলো আজ
উদাসীন বেলুনেরা,পোর্টল্যাণ্ড স্ট্রিটে;
আমার অস্তিত্ব ছেড়ে সকল সম্পর্ক
তার সুতো ছিঁড়ে সম্পর্কহীনতায় দিকে
উড়েছিলো বায়ুমণ্ডলের চারপাশ জুড়ে
শেকড় উপড়ানো স্মৃতিজাল জড়িয়ে
পৃথিবীর অচেনা ভূগোলে…..
আমিও পথিক এক!!!

কেন বার বার?

কেন বার বার যাচ্ছো উড়িয়ে নিয়ে আমাকেই
বাতাসের মুখে ঘষেছি নিজের মুখ ও গ্রীবাদেশ
ভেঙে ভেঙে হায় কেন যে গুড়িয়ে দিচ্ছো অশেষ
হলুদ পাতার মতো উড়ে উড়ে যাচ্ছি ওদিক
এদিকেও তার সাড়া পড়ে গেছে চাঁদের পাহাড়ে
আসছে বছর কীভাবে হাসাবে হেমন্ত তারে?
তুমিও জানো না কেউ তা জানে না অবাক সময়;
ঢিল ছুঁড়ে দেয় পথের দুদিকে পথ বরাবর
জলের ঘূর্ণি শুষে নেয় স্মৃতি অন্ধ-আঁধার
আলো জেগে থাকে উৎযাপনের মাতৃ-আবেগে।

শব্দের বুকে

শব্দের বুক-জুড়ে
যতো গান ছিলো
আজ তার সব মুক্ত করে দিলাম,
তুমিও একদিন মুক্ত করে দিয়েছিলে
তোমার শরীর থেকে প্রণয়ের গন্ধমাখা হাত
শব্দের শাদা চোখে যতো লাবণ্যের জলছবি আঁকা;
রামকিঙ্কর বেইজের শৈল্পিক খেয়ালে শব্দের
সেই আবক্ষ চিত্র মেলেছিলো ডানা,
মুখ সেলাই করা কিছু তার নির্মোহ
অভিব্যক্তি শান্তি নিকেতন ছেড়ে
পৃথিবীর পথে পথে ছড়ায় কুসুম
এখানেও চিত্রশিল্পী ভ্যান গঘ
ছবিহীন এক শ্রবেন্দ্রিয় বিস্ময়,
আমি কবি, সেই সব গল্প
এঁকেছি তেলরঙ পরিভাষা আগুনে পুড়িয়ে;
‘সাঁওতাল পরিবার’কোনো ছেলেখেলা নয়,
আত্মপরিচয়ের এক উন্মুখ ঢেউ
শিল্পের পাঠ- উন্মোচনে
ব্রোঞ্চ, কাদা এবং
সিমেন্টে গোলা
অক্ষর সভ্যতা শেষে
তুমি আমি ছাড়া
কেউ থাকে না,
অবশিষ্ট এক
ঈশ্বর ?

আলাদা আকাশ

সবার তো আছে এক আলাদা আকাশ,
আমার যে নেই কোনো আকাশ কুসুম।

ওদের অনেক আছে, দিনের আকাশ
জ্যোৎস্না-ধোয়া চন্দ্রময় রাতের আকাশ,

রৌদ্র-ছায়া-ঘন-নীলে আপন সংসার
মেঘ-জলে পিপাসার্ত চাতকী চারণ,

স্পর্শকাতরতাময় পাগল-জীবনে
কী না আছে সেইখানে? দুঃখ বিনে?

আমার এখানে দূর অজানাকে ঘিরে
দৃশ্যের দুপারে দোলে বেভুল বিস্মৃতি,

কল্পরাজ্যে ভেসে ওঠে হারানো বয়স
মাথার উপরে শক্ত রোদের পাহাড়,

জমাট বিরহ আমি কীভাবে ডিঙাবো
নোনাজলে যদি ভেসে যায় হরিজল,

সবার তো আছে এক আলাদা আকাশ
আমার তা নেই, তবে ছিলো একদিন,

দিবানিশিজোড়া এক উড়ন্ত আকাশ,
ইচ্ছে নীল আলো,আর কিছুটা বাতাস
ভুবন জুড়ানো, গায়ে গায়ে তার ছিলো
পরম প্রযত্নে লেখা হৃদয়ের খোঁজ;

পেছনে রয়েছে তার অজন্তার গুহা
কবিতার বুক জুড়ে ইলোরা মাতম
কিছু মান-অপমান, ঘৃণা ও বিদ্বেষ
ব্যঞ্জনার কানাকড়ি ছিলো সেইসবে;

ছিলো না চিলের থাবা,আকাশ চত্তরে…..
এখন আকাশ মানে অন্যদের নীল,
চোখের সমুদ্রে আঁকা ভার্চুয়াল রীতি
ফেসবুকে কবিতার অনন্য আসর;

একদা তুমিই ছিলে আকাশ আমার,
অনন্ত-খেয়ালে বুঝি দিয়েছো উড়িয়ে
মেঘের-প্রতীক্ষাফুল,পরাণ-শিশিরে
এখন কোথায় সেই ঘোর নেশাজল?

বজ্রচেরা শব্দগুলো অহেতু আঁধারে
সলতেবিহীন মোম হয়ে জমেছিলো
মেঘ ও বৃষ্টির বুকে একতারা জল
আমি, তপ্তমুখ ঘষে তাৎক্ষণিকেই
ফিরে গেছি দ্রুত পূর্বজনমের শেষে।

তুমি ছাড়া বলো,আর কোথায় আকাশ
বিরহ-বিরাণ ভূমি চৌচির যখন।