গল্প: সমান্তরাল

সমান্তরাল
জাহ্নবী জাইমা
মস্তিষ্কের শিরাগুলো জটপাকিয়ে যাচ্ছে মনে হয়, মুখে কেমন যেন তিঁতে স্বাদ, বুকের ভিতরে খালি অনুভব। মিনা বেশ কিছুক্ষণ আগে এক কাপ চা রেখে গেছে সামনে। অনিসা ছুঁয়েও দেখেনি, অনিসার অপেক্ষায় থেকে চা বরফের সঙ্গে সন্ধি করেছে। কী ম্যাডাম চ্যা-টা কি গর্ম করে দিব নাকি? ও চ্যা তো কবে পানি হয়ে গ্যেচে ?
দাও অনিসা। মিনা ওকে আড়চোখে দেখে, চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। অনিসার চোখের সামনে একটু একটু করে অতীত-বর্তমান মিলেমিশে এক ক্যানভাস তৈরি হচ্ছিল। আজ সকালে ই-মেইলের সন্ধানে কম্পিউটার খুলেই মনটা খুশি খুশি লাগছিল। তাড়াতাড়ি মিনাকে এক কাপ চা আনতে বলে, কম্পিউটারের সামনে বসে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতেই ই-মেইলটা পড়ব। রাশিক বেশ বড় ই-মেইল লিখে, এটা সেটা খবর দিয়ে। চিঠির শুরুতেই কানাডার সাম্প্রতিক আবহাওয়ার খবর, রাশিকের অফিসের সহকর্মীদের হাল হকিকত। ইংরেজি অক্ষরে লেখা বাংলা চিঠিটার মাঝ বরাবর এসে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাই। ইতিমধ্যে মিনা চা রেখে গেছে পাশে, খেয়ালই হয়নি, সে কথার পর রাশিক লিখেছে ওর পরিচিত এক ভদ্রলোক, জামান চৌধুরীর কথা, অবশ্য রাশিক আগেও বেশ কয়েক বার লিখেছিল, তাঁর একমাত্র কন্যা শ্রেয়াকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিক তার মাকে বুঝিয়ে লিখেছে যে, মা তো কিছুদিন থেকে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে কিন্তু রাশিক মনস্থির করতে পারছিল না। রাশিকের চিঠি অনুযায়ী শ্রেয়ার সঙ্গে ওর পূর্বরাগ এর বিশেষ কোনও ইতিহাস নেই। শ্রেয়ার সঙ্গে সাধারণভাবে মেলামেশা করে ওর ভালো লেগেছে মেয়েটিকে। রাশিক নিজের ইচ্ছানুযায়ী পাত্রী নির্বাচন করবে তাতে কোনও আপত্তি নেই অনিসার, কিন্তু পরের লাইনগুলি পড়েই অনিসার এমন স্তম্ভিত অবস্থা। রাশিক লিখেছে যে শ্রেয়া মেয়েটি ডিভোর্সি, তার একটি সাত বছরের ছেলে আছে। রাশিকের মনে হয়েছে যে শ্রেয়ার পাশে তার দাঁড়ানো উচিত। বিশেষ করে এই কারণেই সে এই সিদ্বান্ত নিয়েছে। “তুমিও তো মা অনেকবার আমার বিয়ের কথা বলেছ, শ্রেয়ার বাবা মা ও চাইছেন আমরা যেন দেরি না করি। তাই দুই মাসের ছুটি ম্যানেজ করেছি নভেম্বর ডিসেম্বর, সঙ্গে শ্রেয়ার বাবা মা-ও তার ছেলে লিওন থাকবে। রেজিষ্ট্রিটা আমরা ওখানেই সেরে ফেলতে চাই।” কিছুক্ষণ মাথায় কিছুই ঢুকছিল না অনিসার। রাশিক কি সব লিখেছে। কিভাবে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারল রাশিক। ওতো কখনোই এমন অঝুঝ হয়নি। রাশিককে বুঝিয়ে বললেই ও বুঝবে। অনিসার আদরের ধন, একমাত্র অবলম্বন রাশিক। মাকে ঘিরে তো রাশিক বড় হলো। মায়ের মুখের এতটুকু ম্লান ভাবও কখনও ওর চোখ এড়াত না। সে এটা কি করে করল? না এটা কিছুতেই ওকে করতে দেওয়া যায় না। ডাইনি, ডাইনি ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছিল অনিসার। উত্তেজনায় মাথার শিরাটা আবার টনটন করে উঠল। রক্তচাপের উর্দ্ধগতিটা আবার পুরোপুরি তিনি অনুভব করছেন। শিরা উপশিরা দিয়ে গরম স্রোত বইছে। ভদ্র ভালো ছেলেটাকে পেয়ে, ওর মাথাটা খেয়েছে ডাইনিটা। অস্ফুট অদেখা প্রতিপক্ষের উপর উগরে দিলেন বিষাক্ত মন্তব্যগুলি রাশিকের বিয়ে দিয়ে অনিসার কাজ শেষ হবে, দূর থেকে দেখবো রাশিক সুখে শান্তিতে সংসার করছে। তার সংসারের এ ধরণের একটা পরিসমাপ্তি দেখার জন্য অধির অপেক্ষায় ছিলাম।
আমি শেষ পরিচ্ছেদে প্রায় পৌঁছেও গিয়েছিলাম, হঠাৎ এসব কি হয়ে গেল? আমার ভরা নৌকা কি তীরের কাছে এসে ডুবে যাবে ?
মিনার গরম করে আনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমি নতুন করে ভাবতে শুরু করি। আমার দিক থেকে কিভাবে এগোবো। এটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। চুমুকে চুমুকে গরম চা যেন প্রতিরোধের জোরকে বাড়িয়ে দিল। ঘাড় শক্ত করে বহুক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিতে বসে আছি। মিনা দু’বার তাড়া দিয়ে গেল কি রাধা-বাড়া হবে, বলে দাওনি ম্যাডাম ত্যাখন থেকে কম্পুটারের সামনে বসে কী করছো ম্যাডাম? অগত্যা রান্না ঘরের দিকে গেলাম। আনমনা হয়েই মিনাকে দু চার কথা বলেই আবার ডুবে গেলাম চিন্তার সমুদ্রে।
কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল জানালা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের হালকা হাওয়া আর অন্ধকার যেন মুড়িয়ে দিল আমাকে একটা বিষণ্ণতার চাদরে। এর মধ্যে বার দশেক রাশিকের চিঠিটা পড়ে ফেলেছি।
ক্রমে মনে একটা সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করেছে, রাশিককে ওর সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানো সম্ভব হবে না। প্রথমে ভেবেছিলাম ঠিকই পারবো, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর সিদ্ধান্ত বদল করাতে। ধীরে ধীরে ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের সঙ্গে আত্মবিশ্বাসও যেন কমে আসছিল।
আমার অদেখা প্রতিপক্ষের সঙ্গে ঝগড়া করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাশিক যেন আমার থেকে বিচ্ছিন্ন, বহুদূরের এক মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাশিক তুই একি করলি? দু’কামরার খালি ফ্লাটে আমি একা, হাহাকার করে মন কেঁদে উঠে ক্ষণেক্ষণে।
মধ্য পঞ্চাশের অনিসা, লম্বা, দোহারা চেহারা, আধাপাকা সাদা কালো লম্বা চুল। সাধারণত সাদা বা হালকা রঙের তাঁতের শাড়ি ছাড়া অন্য কিছুই পড়েন না অনিসা। কত বছর হয়ে গেল? সবাই তাঁকে এভাবেই দেখে অভ্যস্ত। আজ না হয় বয়স হয়েছে, কিন্তু যখন বয়স কম ছিল, তখনও তিনি নিজের দিকে কোন নজর দেননি, অনিসা তাঁর একাকী জীবনে অন্য কাউকে সঙ্গী করে নেবার কথা ভাবেননি।
রাশিক তুই কোথাকার কে এক শ্রেয়ার কথায় এত সব বুঝে ফেললি যে তাকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলি অথচ তোর একবারও মনে এল না যে, তোর মাও তো একই অবস্থায় পড়েছিল পঁচিশ বছর আগে। কই সে তো কাউকে বিয়ে করেনি অবলম্বন পাবার জন্য। অনিসা তো ছিলেন সুন্দরী একাকী এক নারী সঙ্গে ছোট্ট পাঁচ বছরের রাশিক। এক এক করে কিভাবে পঁচিশটা বছর পার করলেন, নিজের কাছেই নিজের অবাক লাগে। রাশিক ছোট বেলা থেকে নিরীহ, ভালো মানুষ, অহেতুক অশান্তি থেকে দূরে থাকতো। তোর বাবা যখন তোর মায়ের উপর অহেতুক অশান্তি অকথ্য গাল বর্ষণ আর মারধর করত, ছোট্ট তুই ভয়ে সিঁতিয়ে থাকতি। নিজের মনের মধ্যে জমিয়ে রেখে ভয়, মুখে কিছু বলতিনা, কিন্তু সেই ভয়টা প্রকাশ পেল তোতলামিতে। কথা বলতে বলতে আটকে যেত কথা। মুখ লাল হয়ে লজ্জায় কথা থামিয়ে দিতি তুই। চোখ ভর্তি জল নিয়ে, ঠিকভাবে কথা বলতে না পারার লজ্জায় জড়সড় হয়ে থাকতি। সে কী অশান্তি, দিনের পর দিন স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া, তোর পরিচর্যা তোর মায়ের ধৈর্য্যরে চরম পরীক্ষা ফল হিসেবে তুই আবার সহজভাবে কথা বলা শুরু করিস। ততোদিনে অবশ্য ডির্ভোস হয়ে গেছে অনিসার, তিনি তখন পাকাপাকিভাবে বাপের বাড়িতে। মা বাবা দুজনেই তখন মারা গেছেন। অনিসার বাবা বুঝেছিলেন যে হাজার চেষ্টা করলেও তার মেয়ে সম্ভবত বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। সে জন্যই তাঁর বাড়ির একাংশে দু’কামরার একটা ফ্লাট ভাগ করে দিয়েছিলেন অনিসার জন্য। বাড়ির বাকি অংশটা তোর বড় মামার। তোর মামা-মামী নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এক মাত্র তোর মামাতো বোন টুসি তোকে প্রচুর সাহায্য করেছিলো। সে সিলেটে, স্বামী ছেলে মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত সংসারী। তোর পড়াশুনার জন্য কোন টিউটর রাখতে হয়নি, সে শুধু টুসির জন্যই। সামান্য আয়ের সংসারে সব খরচই অনেক বুঝেশুনে করতেন অনিসা। বাচ্চাদের টিউশনি পড়ানোর সামান্য পয়সা, একতলার একদিকটার ভাড়ার টাকা আর নিজের হাতের কাজ বিক্রির সামান্য রোজগার-দু’টি প্রাণির কোন ক্রমে জীবন ধারণ। শখ-সৌখিনতার প্রশ্নই ছিল না। বেশিটাই ব্যয় হত তোর খাওয়া দাওয়া আর পড়াশোনার জন্য। কীভাবে যে তোকে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর খরচের মতো অসাধ্য কাজটি অনিসা সাধন করেছিলো, তা এক বিধাতাই জানেন আর আমি কিছুটা। তুই অবশ্য কোনও দিন কোনও বায়না করিসনি মায়ের কাছে। আজ হঠাৎ তোর এমন মতিভ্রম কেন হল? নিষেধ করলে, বাধা দিতে গেলে যদি দূরে চলে যাস ? তুই অনেক কষ্টের মাঝে বড় হয়ে ভালো চাকুরী করে অনিসাকে সচ্ছলতা দিয়েছিস, এখন তুই ঘরদোর সংসার পরিপাটি করে সাজিয়ে দিয়েছিস। মাকে কম্পিউটার চালানো শিখিয়েছিস। আধুনিকতার সাথে এখনো তুই অনিসার স্নেহ মমতার কাতর। তাই কী ভাবে ই- মেল করতে হয় তাও শিখিয়েছিস অনিসাকে। তোর জন্য তাঁর আশীর্বাদ সারাক্ষণ ঝরে পড়ে, তোর মায়ের একটাই প্রার্থনা, রাশিক সুখী হোক, শান্তি পাক, বিয়ে করে সংসারী হোক, নিজের পছন্দেই বিয়ে করুক, তাতে অনিসার কোন আপত্তি ছিল না, কিন্তু এ কী পছন্দ করলি তুই! এভাবে কি সুখ শান্তি পাওয়া যায় ? কি করে বোঝায় তোকে। অতীতের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করা যায় না। তোর তো বিবাহিত জীবনের কোনও অভিজ্ঞতা নেই।
মেয়েটাই বা কী? একটা বাচ্চার মা হয়ে, কী বলে তোর জীবনে জড়ালো? নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তার সুখের কথা ভাবলো, সে কী তোকে সুখী করতে পারবে?
তোর মাকেও তো কম বয়স থেকে একা থাকতে হয়েছে। মানুষ তার আশেপাশে ঘুর ঘুর করেছে। তোর মামার বন্ধু সিফাত, তোর স্কুল টিচার চয়ন তোর মাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো? কেউ বলুক তো অনিসা এক মুহূর্তের জন্যও দুর্বল হয়েছিলো? অনিসা কিছুতেই মেনে নিবে না এই বিয়ে, কক্ষণও না। অনিসা জানিয়েছে, অনিসার আপত্তিতেও যদি তুই বিয়ে করিস তবে তোর মার সঙ্গে তোর কোন সম্পর্ক থাকবে না।
অদেখা সেই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ, অনিসার হাসি-কান্না যেন ঘোরপাক খাচ্ছে অনিসার জীবনে।
আজ রাশিকরা আসবে এয়ার পোর্টে যেতে হবে সময় মতো। গত পনের দিনে রাশিকের সঙ্গে কয়েক বার ফোনে কথা বলেছে অনিসা কোন মতামত জানাতে চায়নি। অল্প কথায়, হু হা দিয়ে বুঝিয়েছে সব। তিনি ঠিক করে নিয়েছেন যে ফোনে এ সব কথা বলবেন না, কারণ এত কথা ফোনে বলে বোঝানো সম্ভব না। আসুক সামনা সামনি দেখা হলে সাফ বলে দেবে যা করতে হয় করো। আমার এই বিয়েতে কোন মত নেই। কোন বাদ প্রতিবাদের মধ্যে সে নেই। তুই তো তোর মাকে চিনিস, কোন দিনই এক কথা বারবার বলতে পছন্দ করে না। এ ক্ষেত্রে শুধু নিজের অমতটুকু যে অপরিবর্তনীয় সেটাই জানাতে চায় তোকে।
মিনা শুনেছে যে ভাইয়া আসছে। ও বড়ই ব্যস্ত করছে কাল থেকে আমাকে। রাশিক ভাইয়ার সাথে ভাবি আসছে, বাজার থেকে মাছটাচ আনত্যা হব্যে না? ভালো মন্দ একটু রাঁদতে তো হবে। ছেলেটা আসচে বলে কথা চারপাঁচবার বলার পরেও অনিসা অনড় দেখে আবাক হয়ে ও বাড়ি চলে গেছে। সকালের ফ্লাইটে আসবার কথা ওদের। আসার সময় কিন্তু কয়েক ঘণ্টা আগেই পেরিয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে অনিসার উদ্বেগ বাড়ছে কিন্তু অনিসা জোর করে নিজেকে সামলে রাখছে। ছাড়তেই যখন হবে তখন লাভ কি চিন্তা করে। এত বছর পর সন্তান আসছে অথচ অভিমান করে এয়ারপোর্টে গেল না অনিসা। রাশিক একরারও চিন্তা করে দেখলি না মায়ের কথা? কত ইচ্ছে ছিল, ধুমধাম করে তোর বিয়ে দেবো, বউমা আসবে আমার ঘরে আনন্দের হাট বসবে। সেই স্বপ্ন এভাবে তুই ভেঙে দিলি। থাক যে যার নিজের মতো নিজের জীবন নিয়ে। অনিসা ঠিক করে নিয়েছে যে রাশিক এলে ওকে ওর ঘর বাড়ি অন্যান্য কাগজপত্র সব বুঝিয়ে দেবো। আমার সামান্য সামর্থ অনুযায়ী একটা বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ পেয়েছি, আর কয়েক বছর পর সেখানে চলে যাবো, ওকে জানিয়ে দেবো ষাট হতে আর কয়েক বছর বাকি তারপর নিশ্চিন্ত। এর মধ্যে তুই ও তোর পরিবারের সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ রাখতে চাই না। ঘণ্টা চারেক পেরিয়ে গেছে রাশিকদের আগমনের সম্ভাব্য সময় থেকে। তবে কি ওরা আগে থেকেই আমার অপছন্দের খবর পেয়ে কোন হোটেলে উঠল?
যা দিনকাল কথায় কথায় যে অ্যাকসিডেন্ট। না, অমঙ্গলের কথা ভাববো না। নিজের অজান্তেই হাতটা উঠে গেল কপালে। সঙ্গে সঙ্গেই ডোর বেলের জোর আওয়াজে কপালে ছোঁয়ানো হাতটা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠল। রাশিক, নিশ্চয় রাশিক এসেছে। বাইরে ব্যাগ রাখার শব্দ, দরজার বাইরে রাশিকের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন অনিসা। ভাবলেশহীন গম্ভীর মুখে দরজা খুলেই সামনে রাশিকের হাসি মুখ বুকের মধ্যেটা দুলে উঠল। সরে দাঁড়ালাম রাশিককে ঘরে ঢুকবার জন্য। ওফ, এয়ারপোর্টে প্রায় ২ ঘণ্টা লম্বা লাইন আর বিমান দুই ঘণ্টা লেট। তারপর শ্রেয়ার মা বাবাকে ওদের আত্মীয়ের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসতে আরও দেরি হল। শ্রেয়া এসো।”-
রাগে বিরক্তিতে কোনও কথা মুখে এল না আমার, আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম একধারে। দরজার ওপাশ থেকে ধীরে ধীরে ঢুকে এল ছাব্বিশ, সাতাশ বছরের এক যুবতী। মনে হল বড়ই রোগা, শ্যামলা মুখটাতে কী এক মায়া জড়ানো। হঠাৎ করে চোখ পড়লে, চোখ ফেরানো যায় না। মেয়েটির হাত ধরে, মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক শিশু। স্বাস্থ্য ভালই, গায়ে একটা লাল সোয়েটার, এক মাথা ঝাঁকড়া চুল ছোট্ট মুখখানাকে আড়াল করে রেখেছে। মায়ের হাত ধরে, ঘরটাতে ঢুকেছে সে খেয়ালই তার নেই, এক মুহূর্ত স্তব্ধতার পরে হঠাৎই শিশু তার নিজের খেয়ালে মুখটা ওঠাতেই, দেখতে পেলাম শিশুটিকে চোখ মুখ আর সবকিছু দিলেও, দেননি স্বাভাবিকতা বিধাতা। শিশুটির চোখ মুখ দেখলেই বোঝা যায় যে ও জড় বুুদ্ধি অটিষ্টিক শিশু। অবোধ দুই চোখে অপার বিষ্ময় নিয়ে শিশুটি চেয়ে আছে আমার দিকে। আমার বুকে সজোরে ধাক্কা দিল বহু বছর আগের রাশিকের পাওয়া ছোট্ট মুখটা। আস্তে আস্তে শ্রেয়ার কাছে এগিয়ে গেলাম, ওর হাত ধরে বললাম, এসো মা ঘরে এসো।