গল্প: বিয়ে বার্ষিকীর অর্ঘ্য

বিয়ে বার্ষিকীর অর্ঘ্য
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বিগত তিন বছর ধরে তাদের প্রেমময় সংসার। ছোট ছিমছাম। সে আর তার বউ। আর কেউ নেই সংসারে। ছোট হতেই সে অনাথ। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে খান সেনারা তার বাবা-মা দুজনকেই পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল। তাদের দোষ ছিল একটাই। তার বাবা অরবিন্দ বাবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করতেন। অরবিন্দ বাবু ছিলেন পেশায় একজন গ্রাম ডাক্তার। তার ভালোই পশার ছিল। আশেপাশের চার-পাঁচটা গ্রামে নামডাক ছিল। পাশকরা না হলেও তার এলএমএফ এর ট্রেনিং ছিল। অরবিন্দ বাবুর বউয়ের নাম অহর্নিশি। অহর্নিশি বেশি পড়াশুনা করেনি। গ্রামের স্কুলে প্রাইমারি পাশ। কিন্তু তার মেধা ভালো ছিল। অরবিন্দ ডাক্তার তাকে ইঞ্জেকশন কীভাবে মারতে হয়, রক্তচাপ কীভাবে মাপতে হয় তা শিখিয়েছিল। এই কাজগুলো বাধ্য হয়েই তাকে শিখতে হয়েছিল। গ্রামের মুসলমান মেয়েরা অরবিন্দ বাবুকে ইঞ্জেকশন দিতে দিতো না। এলাকার শামসু মাতবর বলেছিলো, মুসলমান মাইয়ারা পুরুষ ডাক্তরের হাতে সুঁই লইলে দোযখে যাইবো। সেই ফতোয়ায় গ্রামের মুসলিম মহিলারা কেউ অরবিন্দ ডাক্তারের কাছে প্রেসার ও মাপাতে পারে না, ইঞ্জেকশনও দিতে পারে না। এর ফলে গ্রামে অনেক মহিলা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মৃত্যু বরণ করেছে। অথচ সময়মত অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন ও প্রেসারের ঔষধ পড়লে তারা বেঁচে যেত। গ্রামের অবলা মহিলাদের এভাবে ভুগতে দেখেই অরবিন্দ ডাক্তারকে সবাই ধরল, যাতে অহর্নিশিকে অন্তত প্রেসার মাপতে ও ইঞ্জেকশন দিতে শেখায়। প্রথম প্রথম অহর্নিশির খুব হাত কাঁপতো। কিন্তু ধীরে ধীরে তার হাত পাকা হয়ে উঠেছে। গ্রামের রাজাকাররা অরবিন্দ ডাক্তারকে আগে থেকেই সহ্য করতে পারতো না। একজন মালাউন তাদের গাঁয়ে এত জনপ্রিয় এটা তারা সহ্য করতে পারতো না। মুসলমান বউ-ঝিদের চিকিৎসার নামে সে বে আব্রু করে তুলেছে। তাই তারা আগে থেকেই তক্কে তক্কে ছিল অরবিন্দকে দেখে নেওয়ার। যুদ্ধ যখন চরমে তখন অরবিন্দর কাছে গ্রামের মুক্তিসেনারা আসতো চিকিৎসার জন্যে। অরবিন্দ তাদের সাধ্যমতো অর্থ সাহায্যও করতো। অরবিন্দর এই কাহিনী রাজাকারদের কানে পৌঁছে গেল কী করে জানি। তারা একদিন পাকিস্তানী এক মেজরসহ এসে সকালে জ্বালিয়ে দিলো ঘর। ঘরে তখন তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই ছিল। তাদের একমাত্র সন্তান অর্ঘ্য ছিল ঘরের বাইরে। তার বয়স তখন পাঁচ। দিদিমার সাথে অর্ঘ্য গিয়েছিল পাশের গাঁয়ে দুধ আনতে। এর মধ্যেই তার জীবনের সব আলো আগুনে জ্বলে ভষ্ম হয়ে গেছে। সেই থেকে অনাথ অর্ঘ্য তার দিদুনের কাছে বড় হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পার করে আজ পঁচিশ বছর হয়ে গেল। দিন যেতে বেশি সময় লাগে না। আমরা ঊনিশশো পঁচানব্বই সালের কোন এক দিনের কথা বলছি। অনাথ অর্ঘ্য আজ ত্রিশে পা দিলো মাত্র।
বছর তিনেক আগেই অর্ঘ্য বিয়ে করেছে। প্রেম করেছে টানা চার বছর। বউয়ের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম বাস জার্নিতে প্রথম দেখা। রাত দুটোর বাসে সে চট্টগ্রাম হতে ঢাকা যাবে। দামপাড়া বাস কাউন্টার হতে এসি বাসে উঠেছিল অর্ঘ্য। সিট পড়েছিল একেবারে শেষের দিকে। যাত্রা শুরুর ঠিক আধঘন্টার মাথায় ঝড়-বৃষ্টি শুরু। প্রবল ঝড়-বৃষ্টিতে প্রকৃতি ছিল রুদ্র ভৈরবের মতো তাণ্ডবে। এসব বাস পথের মাঝখানে এমনিতেই যাত্রী নেয় না। তবে কেউ মাঝপথে তাদের নির্ধারিত স্টেশন থেকে উঠতে পারে। ঠিক যে সময় ঝড় শুরু হবে হবে ভাব সে সময় বাসে উঠলো এক মহিলা যাত্রী। টিকিটের সিট নাম্বার মিলিয়ে সুপারভাইজার তাকে অর্ঘ্যের পাশে বসিয়ে দিলো। যাত্রীটি কিছুটা ভিজে গেছে বৃষ্টির ছটায় যদিও হাতে ছাতা ছিলো। অর্ঘ্য একমনে খুশি হয় একটা নারী সহযাত্রী পেয়ে আবার একমনে বিরক্ত হয় রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেল বলে। দুই মনের দোলাচলে তারুণ্যের জয়গান হয় অবশেষে। যেতে যেতে পথে সেই নারী যাত্রীর সাথে অর্ঘ্যের ভাব হয়ে যায়। নারী যাত্রীর নাম অর্জিতা। ঢাকার কোন এক কলেজে ডিগ্রিতে পড়ে। বিএ। যেতে যেতে একসময় ফোনের নাম্বার বিনিময় হয়ে যায়। ভোরে গাড়ি থেকে যখন দুজন নামে তখন আর তারা অচেনা থাকে না মোটেই। দুজনের আচরণে অধীরতাও ফোটে না। মনে হলো তারা অনেকদিনের চেনা একে অপরের। কে জানতো এ পরিচয়ই তাদের বেঁধে দিবে গাঁটছড়া। সেই যে শুরু, এরপর আর থামাথামি নেই। সেদিনের ঠিক সপ্তাহখানেক পরে ফোন দিয়েছিল অর্জিতা। এরপর হতে তাদের প্রেম শুরু। যে সময়ের কথা বলছি তখন আসলে কোন অ্যান্ড্রয়েড ফোন ছিল না। মোবাইল ফোনও এতো সহজলভ্য ছিলো না। তবুও কখনো দোকানের অ্যানালগ আর কখনো ল্যাণ্ডফোনে তাদের প্রেম চলতো দুর্বার। তবে কথা প্রতিদিন হতো না। কথা হতো তিন-চারদিন পর পর। মাঝখানে টানা বিশদিন কথা বন্ধ ছিল পরীক্ষার জন্যে। এর মাঝে অর্ঘ্য পড়াশুনা শেষ করে বিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢুকে যায় স্বাস্থ্য ক্যাডারে। অ্যাসিস্টেন্ট সার্জন হিসেবে প্রথম পোস্টিং তার গ্রামের ইউনিয়ন হেলথ কমপ্লেক্সে। দিদুন মারা যায় সে যখন সবেমাত্র মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে ঢুকেছে তখন। এই শোক তাকে প্রগাঢ় কষ্ট দেয়। দিদুনের মুখাগ্নির দিন সে ভেঙে পড়েছিল কান্নায়। অনেক রাত অব্দি সে ছিল শ্মশানে। ঠুস ঠুস করে দিদুনের খুলি পোড়ার শব্দে তার বুকে যেন পাথর চেপে বসেছিল। অন্যরা তাকে সরিয়ে আনতে বার বার চেষ্টা করেছে, কিন্তু পারেনি। সবাই ধরে নিয়েছে বুড়ি নির্ঘাৎ আজ তার নাতিকে নিয়ে যাবে তার কাছে। টানা প্রায় কুড়ি বছর নাতিকে লালন পালন করেছে বুড়ি। এ মায়া কি যে সে মায়া! মা না হয়েও মায়ের মমতা দিয়ে আগলে রাখা! সবাই ভয়ে ভয়ে ছিল অর্ঘ্যের গুরুদশা নিয়ে। এরপর ধীরে ধীরে পরীক্ষার চাপ, ক্লাসের চাপ ইত্যাদি কারণে শোক স্তিমিত হয়ে ওঠে। শৈশবে মা-বাবা হারানো অর্ঘ্যের আপন ছিলো দিদুন। দিদুনকে হারিয়ে তার সব বাঁধন কেটে গেছে পৃথিবীতে। এরপরেই অর্জিতার সাথে সম্পর্ক হয় অর্ঘ্যের। চাকরি পেয়ে ছয় মাসের মাথায় বিয়ে করে ফেলে অর্ঘ্য আর অর্জিতা। আজ তাদের বিয়ের তিন বছর পূর্তি। অর্ঘ্য আর অর্জিতার বিয়ে সামাজিকভাবে হয়নি। একদিন হুট করে এক কাপড়ে অর্জিতা অর্ঘ্যের চাকরিস্থলে এসে বলেছিল আমাকে বিয়ে কর। অর্ঘ্য আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি। সোজা রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়েই বিয়ে। অর্ঘ্যের পক্ষে অভিভাবক কেউ নেই। দূর সম্পর্কের আত্মীয় কিছু আছে দিদুন মারা যাওয়ার পরে তাদের সাথে আর সে যোগাযোগ রাখেনি। এরা উপকারের চেয়ে অযথা অধিকার খাটায় বেশি। হয় টেলিফোনে চিকিৎসা দাও নয়তো ডাক্তার দেখাতে এলে সিরিয়াল পাইয়ে দাও। অনেকের ক্ষেত্রে আবার সঙ্গে যাওয়ার আব্দারও থাকে। এতসব করতে করতে সে বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই এই দূরের আত্মীয়-স্বজন থেকে সে নিজেকে দূরে রেখেছে। অর্জিতার দিকেও তার মা-বাবা ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। অর্জিতা নাকি তার বাবা-মাকে বলেছিল অর্ঘ্যের সাথে তার সম্পর্কের কথা। বাবা-মা রাজি হয়নি কোন অনাথ ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে। অর্জিতার এক মাসতুতো ভাই আছে লন্ডনে থাকে। তাকে অর্জিতার মায়ের খুব পছন্দ। মাসতুতো ভাইয়ের সাথে অর্জিতার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পরের সপ্তাহে বিয়ে। তাই অর্জিতা এক কাপড়ে চলে এসেছে অর্ঘ্যের কর্মস্থলে। বাসররাতে এই ছিল অর্জিতার ভাষ্য।
অর্ঘ্য-অর্জিতার দিন চলেছে সুখে। টোনাটুনির সংসার। দুজনেই তরুণ। আজ এটা কিনে কাল সেটা কিনে। মেয়েদের ঘরের পর্দার প্রতি খুব ঝোঁক। অর্জিতা বেশ কয়য়েকটা দোকান ঘুরে পর্দা কিনল। দুহাত বোঝাই শপিং এর ফাঁকে অর্জিতা-অর্ঘ্য আইসক্রিমের দোকানে বসে নিজেদের উদরদহনও নিবৃত্তি করে। এভাবে চলতে চলতে যাচ্ছিল সোনাঝরা সংসারী দিন।
গত তিন বছরে তেমন কোন ঝুট-ঝামেলা তাদের হয়নি। শুধু একবার অর্ঘ্য বলেছিল অর্জিতাকে গাইনিকোলজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে। কিন্তু অর্ঘ্যকে অবাক করে দিয়ে অর্জিতা তার তীব্র বিরোধিতা করেছে। বলেছে, তুমি ছাড়া আমি আর কোন ডাক্তারের কাছে যাব না। যতই অর্ঘ্য বলে, আমি তো গাইনি ডাক্তার নই, ততই যেন অর্জিতা মারমুখি হয়ে ওঠে। অবস্থা বেগতিক দেখে সে আর ঘাটায় না। একটা বিষয়ে খুব অবাক হয় অর্ঘ্য। খুব দ্রুত অর্জিতা কাজ করতে পারে। বাসায় কোন হেল্পার বা কাজের বুয়া রাখেনি। একাই সব কাজ করে। সাধারণত যে সব কাজ অন্য মহিলারা করতে বেশি সময় লাগায় অর্জিতা সেগুলো খুব ঝটপট করে ফেলে।
রাতে অর্ঘ্যের অনুভূতিতে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয় কখনো কখনো। সে ঘুমে টের পায়, কে যেন হাঁটে। অথচ চোখ মেললে কিছু দেখতে পায় না। সরকারি এই কোয়ার্টারটা খুব বেশি পুরানো নয়। তবে শুনেছে, এ জায়গায় একাত্তরের একটা বধ্যভূমি ছিলো। রাজাকাররা বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে ধরে ধরে এখানে এনে হত্যা করেছে। লোকমুখে শুনেছে কিন্তু কোন প্রমাণ পায় নি অর্ঘ্য। আশৈশব বিজ্ঞানমনষ্ক অর্ঘ্য ভৌতিক কোন বিষয়ে আগ্রহী ছিলো না কখনও। তবে ঠাকুরমার ঝুলি হতে গল্প পড়তে বেশ ভালো লাগতো। রোমাঞ্চ অনুভব করত। সে একথা অবশ্য অর্জিতাকে বলেনি কখনো। এমনিতেই বাসায় সারাদিন একা থাকে, তার ওপর নারী। এসব কথা শুনতে পেলে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। একদিন এক পুরুষ রোগী হুট করে বাসায় এসে পড়ে দেখানোর জন্যে। অর্ঘ্য বাসায় রোগী না দেখলেও সেদিন এই রোগীকে বাসায় আসতে বলেছিল। রোগীটা কীসব তন্ত্রমন্ত্র করে। অর্ঘ্য অসময়ে বলেই রোগীটাকে বাসায় আসতে বলে। শ্বাসকষ্টের রোগী। দীর্ঘদিন ধরে বিড়ি খায় তাই এ অবস্থা। ডাক্তারি ভাষায় লোকটা সিওপিডি রোগী। অর্জিতা ভেতরের রুমে ছিল। কী কারণে জানি সে সামনের রুমে এসে রোগীটাকে দেখতে পেলো। দেখতে পেয়েই যেন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। অথচ রোগীটা বেশ শান্ত এবং কাপড়ে চোপরে পরিষ্কার ছিল। তাড়াতাড়ি রোগী বিদায় করে অর্ঘ্য তার কাছে ফিরে যায়। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিল ব্যাপারটা কী। অর্জিতা বলেছিল উত্তরে, লোকটাকে দেখে তার নাকি ভূতধরা ভূতধরা মনে হয়েছে। অর্ঘ্য উত্তর শুনে হেসে দেয়। মেয়েদের চোখে কতকিছু যে দেখতে পায়!
বিয়ের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে সকালে উঠেই অর্ঘ্য অর্জিতাকে কপালে চুমু খেয়ে শুভ কামনা জানায়। আজ রাতে বাইরে কোন রেস্টুরেন্টে খাওয়ার পরিকল্পনা করে। অর্জিতাকে সে কাল রাতে একটা নতুন কাপড় এনে দেয়। কাপড়টা দেখেই তার খুব পছন্দ হয়ে যায়। মেয়েদের পছন্দের রঙ। গোলাপি। অর্জিতারও মনে ধরেছে কাপড়টা। মাঝে মাঝে অর্জিতা যখন খুব বেশি আবেগগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন তার কথায় চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহার বেড়ে যায়। মনে হয় কেন সর্দির রোগী কথা বলছে। অবশ্য স্বাভাবিক থাকলে তার এ সমস্যা হয় না। অর্ঘ্য ভেবেছে তার হয়তো ডিএনএস এর প্রব্লেম আছে। নাহলে এরকম ন্যাজাল ইনটোনেশন হওয়ার কথা নয়। সকালে নাশ্তার টেবিলেই তার ডাক আসে হাসপাতাল হতে। আজ তার ইমার্জেন্সিতে ডিউটি। বাস অ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্ট এসেছে নাকি অনেক। তীর্থযাত্রী নিয়ে বাসটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। অর্ঘ্য তাড়াতাড়ি আধেক নাশ্তা সেরেই চলে যায় ডিউটিতে। ডিউটিতে আসার আগ মুহূর্তে অর্জিতা আবেগঘন ইশারায় বলে উঠল, বাসায় আসলে তোমার বিয়ে বার্ষিকীর উপহার দেব। অর্ঘ্য শুনে মুচকি হেসে বের হয়ে যায়।
হাসপাতাল প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছায় অর্ঘ্য। এমনিতেই এসময়ে এ এলাকা রোগী,রোগীর লোক,দর্শনার্থী, ঔষধ কোম্পানির এমআর, অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার আর বিভিন্ন স্থানীয় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালে জমজমাট থাকে। আজকে তার সাথে যোগ হয়েছে সংবাদকর্মী,পুলিশ, উৎসাহী জনতা ইত্যাদি। অর্ঘ্য তাড়াতাড়ি হ্যান্ডওভার নেয়। প্রায় নারী-পুরুষ মিলে বিশজন আহত হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ব্লিডিং স্টপ করা হয়েছে।এরপর ভলিয়্যুম কারেকশনের জন্যে ফ্লুইড চ্যানেল ওপেন করে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে উন্নত চিকিৎসায়। দশজনকে হাল্কা চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বাকি পাঁচজনকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে দুজন নারী আর তিনজন পুরুষ। ওয়ার্ডবয় এসে অর্ঘ্যের কাছ থেকে স্লিপ নিয়ে যাচ্ছে। তাড়াহুড়োর মধ্যে অর্ঘ্য রোগীদের চেহারার দিকে এতোক্ষণ দেখেনি। স্লিপ দিতে গিয়ে রোগীদের চেহারার দিকে নজর গেল অর্ঘ্যের। হঠাৎ একটা নারী রোগীর মুখে তার চোখ আটকে গেল। দেখার সাথে সাথে তার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। এর মধ্যেই টিভি রিপোর্টার এসে বাইট নেওয়া শুরু করলো। লাইভ ইন্টারভিউ। মিনিট দুয়েকের মতো। রোগীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন। ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরতে না ফিরতেই দেখলো সেই মহিলা রোগীটি নেই। ওয়ার্ডবয় এরই মাঝে তাকে সার্জারি ওয়ার্ডে নিয়ে গেছে। অর্ঘ্য বাকী রোগীগুলো ম্যানেজ করতে শুরু করল। কিন্তু বারে বারে তার চোখে ভেসে আসছে ঐ নারী রোগীর মুখ। ভিড় একটু হাল্কা হলে অন্য কলিগকে বলে ছুট লাগালো সার্জারি ওয়ার্ডের দিকে। রোগীর বেডের পাশে পৌঁছেই দেখতে পেলো ঐ নারী রোগীর স্বামীর ব্যস্ততা। কী ঘটনা? ঘটনা হলো ওনার এক ব্যাগ রক্ত লাগবে। কিন্তু এই অপরিচিত জায়গায় উনি রক্ত পাবেন কোথায়? অর্ঘ্যকে দেখে তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে দিলেন। অর্ঘ্য ভদ্রলোকের গায়ে হাত দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, রক্ত জোগাড় করা ব্যাপার কোন না। বি পজেটিভ গ্রুপের রক্ত অ্যাভেলেইবল। অর্থাৎ পাওয়া যায়। অর্ঘ্য তার ফোন হতে স্থানীয় জীবন দীপ অনলাইন রক্ত দাতা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডভোকেট বিনয়দাকে ফোন দেয়। ভদ্রলোক বিগত ঊননব্বই সাল থেকে এই রক্তদাতা গোষ্ঠীটি পরিচালনা করে আসছেন। এ পর্যন্ত তারা প্রায় সাতাশ হাজার ব্যাগ রক্ত দান করেছেন। তাকে ফোন দিতেই তিনি অভয় দিলেন। বললেন, এখনই ডোনার পাঠিয়ে দিচ্ছেন হাসপাতালে। সম্ভব হলে নিজেও এক ফাঁকে আসবেন দেখতে। অর্ঘ্যের এই সহযোগিতায় নারী রোগীটির স্বামী বেশ ধাতস্থ হলেন বলা যায়। শুরু হলো আলাপ। ভদ্র লোকের নাম অনিরুদ্ধ। তিনি অচিন্ত্যপুরের লোক। পেশায় শিক্ষক। এখন অবসরে। তাদের এক মেয়ে। আর কোন সন্তান নেই। অবসরে এসে তীর্থ ভ্রমণে বের হয়েছেন দলেবলে। তীর্থে এসেই এ মরণদশা। অর্ঘ্যের সেদিকে মন নেই। তার মন পড়ে আছে ভদ্র মহিলার মুখের ওপর। একেবারে হুবহু অর্জিতার মুখটা বসানো। কোন ব্যবধান নেই। একচুলও না। এমনটাই মিল। বাস দুর্ঘটনায় ভদ্রলোক একেবারে মুষড়ে গেছেন। অর্ঘ্য তার সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করে। তিনি হু হু করে কেঁদে দিলেন। যা বললেন তা হজম করার মতো নয় অর্ঘ্যের পক্ষে। একটাই তার সন্তান। মেয়ে। মেয়েটা মাস্টার্স পরীক্ষা সবে শেষ করেছিল। আজ থেকে তিন বছর আগে। তার ছবি তিনি মানিব্যাগে নিয়ে ঘোরেন। যখনই মন চায় একমাত্র মেয়েকে এক নজর দেখে বুক জুড়ান। পরীক্ষা শেষ করে মেয়েটা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল পাহাড়ে। খুব হৈ হুল্লোড় করছিল তারা। মেয়েটা আমার খুব ন্যাওটা ছিল। তার সব কথা বলতো আমাকে। বলে যাচ্ছেন অনিরুদ্ধ বাবু। আর এক হাতে চোখ মুছছেন। বুঝলেন ডাক্তারবাবু, মেয়েটার সাথে এক হবু ডাক্তারের রিলেশন ছিল। ওর মাকে ও বলে রেখেছিল। ছেলেটার পরীক্ষা শেষে আমাদের বাড়িতে আনবে পরিচয় করাতে। এতটুকু বলার পরে খেয়াল হলো, ওনার স্ত্রী হাতের ইশারায় তাকে ডাকছেন। ভদ্রলোক কাছে গেলেন। দূর হতে বুঝলাম রোগীর টয়লেট চেপেছে। অনিরুদ্ধ বাবু বেশ যত্ন করে তাকে টয়লেটে নিয়ে গেলেন। সরকারি হাসপাতালের টয়লেটগুলো রোগী ও তাদের পরিচর্যাকারীদের ব্যবহার না জানার কারণে ময়লা হয়ে থাকে। আজকাল অবশ্য অর্ঘ্যদের হাসপাতালে পৌরসভা হতে ক্লিনার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা নিয়মিত দিনে চার-পাঁচবার সাফাই করে। ভদ্র মহিলাকে টয়লেট সারিয়ে আবার অনিরুদ্ধ বাবু এলেন অর্ঘ্যের কাছে। এই ফাঁকে রোগিনীকে রক্ত দেওয়া শুরু হয়ে গেল। মিনিটে কুড়ি ফোঁটা করে। অনিরুদ্ধ বাবু অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে উঠলেন।
অর্ঘ্য আবারও জিজ্ঞেস করে, আপনার মেয়ের এরপর কী হোল? তিনি বললেন, ফেরার পথে তাদের বাস খাদে পড়ে যায়। অনেকেই বেঁচে গেছে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকার্যের তৎপরতায়। কিন্তু আমার অর্জিতা ও তার কয়েকজন বান্ধবী বাঁচলো না। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মেয়েটা আমার মারা গেল। ভদ্রলোকের মুখে অর্জিতার নাম শুনে অর্ঘ্যের হৃদপিণ্ডে রক্ত লাফিয়ে উঠল। সে দিন-তারিখ জানতে চাইলো। এপ্রিলের তিন তারিখ শনিবার। অনিরুদ্ধ বাবু বললেন পরিষ্কার কণ্ঠে। সকাল দশটায়। অর্ঘ্যের এই তারিখ,এই দিন,এই সময় হুবহু মুখস্থ। আজ হতে তিন বছর আগে এই তারিখে এই দিনেই অর্জিতা তার কাছে চলে এসেছিল এক কাপড়ে। তার ধীরে ধীরে ঠান্ডা স্রোত বইতে শুরু করে দেহমনে। অর্ঘ্য অনিরুদ্ধের কাছে তার মেয়ের ছবিটি দেখতে চায়। অনিরুদ্ধবাবু কম্পিত হাতে ছবিটি এগিয়ে দেন তার হাতে। হাতে ছবি নিয়েই অর্ঘ্য থপ্ করে বসে পড়ে চেয়ারে। যদি অনিরুদ্ধ বাবুর মেয়ে মরেই থাকে আজ হতে তিন বছর আগে তবে তার ঘরে যে আছে সে কে?কে সে?