গল্প: নষ্ট নীড়ের কষ্ট

গল্প: নষ্ট নীড়ের কষ্ট

নষ্ট নীড়ের কষ্ট
শামীমা সুলতানা

ব্যাঙের ত্বকের মতো বিভৎস একটা শরীর নিয়ে সরে যাচ্ছে সে। সরে যাচ্ছে সন্তর্পণে। তবে শরীর কেন হিমশীতল ছিল তার? সে কি শীতনিদ্রায় সুপ্তছিল এতকাল? এখনো আঁশটে গন্ধ লেপ্টে আছে আমার সর্বাঙ্গ জুড়ে-

দুঃস্বপ্ন! প্রত্যহ ঘুম ভাঙে বিষাদময় স্বপ্নাবেশে। সে এক শিউরে ওঠা সময়! নির্মম বর্বরতা, বেদনাবিধুর গল্প!

গভীর শূন্যতার হাহাকার,ক্লেশাক্ত ক্রন্দন রোল,গুমরে গুমরে জেগে ওঠা বাষ্পরূদ্ধ গোঙ্গানির আওয়াজ। স্মৃতিকাতর সেই খালপাড়ে আজও সেই ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। সবুজ দুর্বাদলে লেপটে আছে নীলরঙা কষ্টের ছাপ। আখ ক্ষেতে সেঁটে আছে সেই রাতের বীভৎস কালিমা। ছিন্ন বস্ত্রের খণ্ডগুলো পরাজিত যোদ্ধার পতাকা হয়ে আজও বাতাসে দোল খায়। জামগাছে ঝুলে থাকা নিথর দেহটা সবার মনোজগতে সিল মোহরের স্মৃতি কথা।

রক্তাক্ত ফড়িঙ, ডানাভাঙ্গা প্রজাপতি- এই সবই আজ আমার প্রাত্যহিক রাতের সঙ্গী। আমার আকাশ এখন দুঃসহ বেদনার মেঘে ঢাকা ।

যে আমি নিজের ক্লান্তিকে ভাসাতে এসেছিলাম শৈশব-সুখের সাগরে, আরও বিষণ্নতা, আরও বেশি শ্রাবণ-মেঘ সঙ্গে নিয়েই ফিরলাম। নিজের জগতে এতোটাই নিমগ্ন ছিলাম যে, চারপাশের বদলে যাওয়া ধুসর পৃথিবীর খোঁজ খবর নেয়া হয়নি বহুদিন। দেখা হয়নি শত শত নিপীড়ন-নির্যাতনের বীভৎসতা। নিষ্ঠুর নির্মম-পৃথিবী আমার অলক্ষ্যেই ঘটিয়েছে দূর্ভেদ্য দুরাশাময় সহস্র ঘটনা।আমি শৃঙ্খলের শেকল জড়িয়ে নাক মুখ গুঁজে ছিলাম ছাপা অক্ষরের ধূসর পাতায়।

ভেবেছিলাম আমিই কেবল অভাগা। আমিই পরাধীন পরাশ্রয়ে। শাসনের শৃঙ্খলে আমিই কেবল বন্দী।পৃথিবীর সবাই সাবলীল স্বাধীন বাষ্পীয় সুখে।

শৈশব মানেই কচিকাঁচা সতেজ স্নিগ্ধ জীবন। একরাশ সোনালী স্বপন। পরাবাস্তব পৃথিবী এমনটা হতে দেয় না, কখনো দেবে কিনা জানা নেই।

দিনগুলো ঘাস ফড়িঙের রঙিন ডানায় উড়ে উড়ে বেড়ানোর।বৃষ্টি ফোঁটার মতোই ঝরে পড়া প্রজাপতি সুখের অজস্র স্বপ্নমাখা থাকবার কথা।
কিন্তু বাঁধা নিষেধের শেকলে আমার স্বপ্নগুলো বন্দীত্বে থাকে বহুদিন। কারণটা শিক্ষাজীবন।কারণটা অধ্যাবসায়,মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ সফলতার সিঁড়ি পেরিয়ে শীর্ষস্থানে গমণ।অভিভাবকদের এসব ভাবনা,বাস্তবতার শৃংখলাবদ্ধ হতে বাধ্য হই আমি।

বাবা ডেকে বলতেন — শোন বাবা,আমার বড় ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো।কিন্তু অসময়ে বাবা মারা গেলেন।আমার আর ডাক্তার হওয়া হলনা।সংসারের হাল ধরেছি সেই থেকে।পড়াশোনাটা ছিল গৌণ।কোনরকম পাশটাশ দিয়ে স্কুল শিক্ষক হয়েছি।তোমার বড় ভাই – বোন ওদের দিয়েও চেষ্টা করেছি।ওরা পারে নাই। তুমি লেখা পড়ায় বেশ ভালো। আমি চাই তুমি ডাক্তার হবে আমার স্বপ্ন পূরণ করবে। যেহেতু আমি গ্রামে থাকি।তাই হোস্টেলে রেখে শহরে পড়াতেও সাহস পাইনা। অল্প বয়সে একলা জীবন বিগড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। তাই ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করাতে চাই। সেখানে নিয়মবদ্ধ জীবন,বিপথে যাওয়ার ভয় নাই।

সেই থেকে জীবনের কাছে আমি বন্দী।ইচ্ছে ঘুড়ির সহস্র ডানা ভেঙে লাটাই সুতোয় জড়িয়ে জমাতে থাকি গোপন কক্ষে। বাঁধা নিষেধের বেড়াজালে আর নৈমিত্তিক নিয়মে স্বপ্ন সাধ আবদ্ধ হয়।

আমি তাবত পৃথিবী ভুলে ডুব দেই কাগজের মলাটে, বাঁধাধরা রুটিনে।

সেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডাক্তার হওয়া সময়কাল।ঘণ্টা,মিনিট,সেকেন্ডের চুলচেরা হিসেবে দীর্ঘ ডিজিট। এই সুদীর্ঘ কাল আমি পরাধীনতার ফ্রেমে বাঁধানো একটা চিত্র ছিলাম।

এবার ঢাকা থেকে গ্রামে আসার মূল কারণ জমতে থাকা ইচ্ছেগুলোর বন্দিত্বের অবসান ঘটানো।জমে জমে কুলফি বরফ হবার আগেই তাদের ওড়াতে হবে বিহঙ্গ ডানায়। যদিও কাগজে কলমে আগমনের হেতু বাবা – মায়ের কবর জিয়ারত,দান- খয়রাত, আর মওলানা মুন্সিদের একবেলা পেটের তৃপ্তি পূরণ।

আমাদের গ্রামের নাম রামুদিয়া।সন্ধ্যে নামতেই ঘুটঘুটে আঁধার নামে এই গ্রামে।বাইশ বছর পুর্বের আমার সেই অন্ধকার গ্রাম আজও একই অবস্থায়। একবিংশ শতকের উন্নয়ন জোয়ার এই গ্রামকে স্পর্শই করে নাই। আজও কুমারী নারীর মতোই অনূঢ়া জীবনে বহমান।সরলতা আর সততায় জড়াজড়ি এখানকার খেটে খাওয়া শ্রমিক কিষাণ।অপেক্ষায় আছে কখন কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের বরপুত্রের আগমন হয়। নদীপাড়ের ঝুপড়ি আকারে দাঁড়িয়ে থাকা ঘরগুলো ক্ষীণ স্বরে নিঃশ্বাস ফেলে আজও। কুপিবাতির তলের আলোটুকু শুষে নিয়ে কোন রকম বাঁচে।তাতেই তাদের সুখ তাতেই তৃপ্তি।চর্বিত চাহিদার বাড়াবাড়ি চেপে বসে নাই তাদের যাপিত জীবনে। সাধারন সরলতায় নিত্য জীবনের সমীকরণ।

বহুদিনের শখ ছিল সন্ধ্যার আলো আঁধারিকে আলিঙ্গন করবো একা। নিশিথ রাতের নিস্তব্দ সীমানায় লাল সবুজ আলো মুখে নিয়ে যে ভূতের ভূতুড়ে গল্প শুনেছি শৈশবে, তাকেই তাড়া করবো কোন এক নিশুতি রাতের নৈঃশব্দিক নীরবতায়।এবারের গ্রামে আসা সেই সংকল্প বাস্তবায়নের দৃঢ় বাসনা।

আমি ডক্টর হাসানুল হক পানু।
বাঁধা নিষেধের বয়স উতরানো তরুণ। গুপ্ত ধন প্রাপ্তির মতোই গুপ্ত শখ পূরণের তীব্র তৃষ্ণায় ছটফট করেছি সুদীর্ঘ বাইশটা বছর।মা- বাবা গত হয়েছেন বছর খানেক। আদর কিংবা শাসন বারণে বন্দী করবার কেউ-ই নেই এখন।বিয়ে নামক বন্ধনেও জড়াইনি। প্রফেশনাল দায়িত্বের বাইরে বাকি সময়টা স্বাধীন। ইচ্ছে হলেই বেরিয়ে পড়ি। ইচ্ছে হলেই রাতের আঁধারে ঘুরে বেড়াই বন বাদাড় পাহাড় সমুদ্র ডাঙ্গায়।বাঁধা নিষেধের শেকল নাই।

ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া হল অনেক—
গ্রামে এসেছি ভাই বোন মিলে। দায়িত্ব শেষে যে যার ঢেরায় ফিরেছে যথাসময়েই।আমি-ই কেবল থেকে যাই ইচ্ছে ডানায় উড়বার আশায়।বৈদ্যুতিক বাতিবিহীন তমসাচ্ছন্ন গাও গেরামের নিয়ম–সাঁঝবাতি জ্বালিয়ে দিয়েই রাতের ভুঁড়িভোজ সমাপ্ত করা।তারপর নিদ্রা দেবীর বুকে মুখ গুঁজে স্বপ্ন দেখা।তাদের বিনোদন বলতে ওই নিশিত নিদ্রা আর সজ্জা সংগীর সাথে শারীরিক সুখ।ঘরের খোকা-খুকীরা দাদী নানীর বুকে মুখ লুকিয়ে ভুত- প্রেত আর রাক্ষসপুরীর গল্প শোনে।শুনতে শুনতেই ভয়ে জড়সড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে লেপ কাঁথায় শরীর মুড়িয়ে।আবার দিনের আলো ফুটবার আগেই কিচিরমিচির কোরাস সুরে জেগে ওঠে তারা।পাখ-পাখালীর সুরে সুর মিলিয়ে ছড়িয়ে পড়ে দিকবিদিক।বিকেলে খেলাঘরে খেলা চলে বউচি,গোল্লাছুট,দাড়িয়াবান্ধা আরও নানা ধরনের খেলা চলে।আর বাবা-মায়ের ঘর গেরস্হালী নকল করে জামাই বউ ঘর সংসারের চরিত্র চিত্রণ সেটা তো থাকবেই।

আমাদের বাপ দাদার ভিটায় বাস করার মতো এখনো আছে ঘর উঠোন সুপেয় পানির টিউব- অয়েল,পাকা পয়নিষ্কাশন। তবুও প্রতিবেশী আত্মীয় অনাত্মীয় সবাই যে যার সাধ্য মতন আমার দেখাশোনা, নাওয়া খাওয়ার ভার নিয়েছেন স্ব-ইচ্ছায়।এটা তাদের আদর ভালোবাসা প্রকাশ হলেও আমার জন্যে বিড়ম্বনা বৈকি।একেকদিন একেক বাড়িতে খেতে বাধ্য হচ্ছি বলা চলে।

তাদের দাবী এটা।

শোন বাবা,তুমি আংগোর গাঁয়ের সোনার টুকরা ছাওয়াল।তোমার বাপ- মাও মইরা গেছে দেইহা আমরা ও কী মইরা গেছি! হোটেলে গিয়া ক্যান খাইবা? তুমি যদ্দিন ইচ্ছে থাকো।ইচ্ছে মতোইন ঘুইরা বেড়াও।কিন্তুক আংগোর হাতে খাইবা ঘুমাইবা।

আমার এই এক দোষ।কারো আদর ভালোবাসা উপেক্ষা করতে পারি না।মায়ায় জড়িয়ে যাই।

প্রতিবেশী স্বপ্নাদের বাড়িতেই রাতের ভোজের আয়োজন আজ।জামাই আদরের বাকি রাখেন নাই তারা। খেয়েদেয়ে পরিপাটি বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে গুপ্ত পথে বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা। পুব দেয়ালে স্বপ্নার কিশোরী কালের বেণী দুলানো ছবি।একসাথে বেড়ে ওঠা এক সাথে লেখাপড়া আর খেলাধুলা করেই বড় হয়েছি আমরা।কতোদিন দেখিনা ওকে। আমি তাকিয়ে দেখছি গভীর দৃষ্টিতে। ওর মায়াবী মুখ চোখ আমার সাথে নড়েচড়ে। স্বপ্না সম্পর্কে জানতে হবে আন্টির কাছে ভাবতে ভাবতেই চোখ বুজি বিশ্রামের উদ্দেশ্য।

অগ্রহায়ণ মাস। কনকনে ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া বাকি।পায়ে মোটা মোজা আর গামবুট। মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ। গায়ে জড়িয়ে নিলাম গাঢ়কালো লেদার জ্যাকেট।দরজাটা ভিজিয়ে পা বাড়ালাম সরু চিকন রাস্তায়।বাতাসে শো শো আওয়াজ।বাঁশঝাড়ের পাশের পথে থমকে গেলাম গোঙানি আওয়াজে।ভয় পেলাম না মোটেই। বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা জমানো মাথা আমার।তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেই ভয়কে।

হাঁটছি, হাঁটছি হাঁটছি—
চেনাজানা পথগুলো আমাকে জড়িয়ে নিলো ভালবাসা সিক্ত আত্মীয়ের আদরে।আমার জন্যে না জানি কতো বিরহ বসন্ত কেটেছে তাদের।শরীরের শিরায় শিরায় বাতাসের চুমুতে চঞ্চলা হই আমি।শস্যের সুললিত সুবাস ছড়িয়ে পড়ে আমার অন্তরাত্মায়।আমি বর্তমান ছেড়ে ফিরে ফিরে ফ্ল্যাশ ব্যাকে শৈশব খুঁজি।হলুদ সরিষা ক্ষেত আঁধার রাতে রঙ লুকিয়ে থাকলেও মাতানো ঘ্রাণ ঠিক চিনে নেই। দুই হাতের তালুতে ছুঁয়ে দিলাম লকলকে বাড়ন্ত ডগা। তারাও এক আঁচল সুবাস ছড়িয়ে দিলো সারা গায়ে।

সরু সরু চিকন সুতার মতো শিশির সিক্ত পথ।পিছলে যাই আবার সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াই।পথের সাথে এটা আমার আনন্দময় খেলা। পুরনো দিনের বিনোদন ফিরে পেয়ে পুলকিত। আখ কলই গমের শীষ আরও কতো কতো রবিশস্যের ক্ষেত! শিশির সিক্ত স্পর্শে শিহরিত হচ্ছি বারেবারে।আইল পথ শেষে সেই ঐতিহাসিক খাল।যে খালের কাদা জলে হররোজ একদল কিশোর কিশোরীর ইতিহাস লেখা হত। অভিমান খুনসুটি আরও কতো কথা খলবলিয়ে ভেসে উঠে খালের স্রোতহীন স্নিগ্ধ অতীতে।খালটা ছিল নিতান্ত সরু। এখন সেই সরু খাল আরও সরু হয়েছে । খালের দুই পাড়ে বার্ধক্যের কড়া চিহ্ন জেঁকে বসেছে। বৃদ্ধার নুয়ে পড়া চোয়ালের চামড়ার মতোই। শুকনো খালের তলানিতে সামান্য পানি।থকথকে কাদার ওপর টলটলে আধ ইঞ্চি জল।সেই জলে হাত ডুবিয়ে পরিমাণটা জেনে নিলাম।কাদার মাখামাখি থেকে বুট জোড়াকে বাঁচাতে তাকে টপকে ওপারের জাম তলায় যাই।শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস।শিশির ভেজা ঘাস আমায় মাদুর মেলে দেয় সযতনে। আমি সেখানে বসে পড়লাম নিবিড় মমতায়। পেছন থেকে একটা হাত কাঁধে। মিহি কণ্ঠে ডাকলো— পানু, এই পানু
এই পানু কেবা আছস রে?
হঠাৎ মনুষ্য কণ্ঠে হতচকিত আমি। কে? কে?
আরে আমি স্বপ্না। ভয় পাইছস?
স্বপ্না তুই?এতো রাতে এখানে?
তোর পিছু পিছুই তো আইসলাম।
আমি ভালো আছি, তুই কেমন আছিস? কতদিন পর তোকে দেখলাম।এতক্ষণ চুপ ছিলি কেন?
কথা বলতে বলতে আসা যেত। আবেগের আতিশয্যে জড়িয়ে ধরে অনর্গল কথাগুলো বলে দিলাম। স্বপ্নার ক্ষীণ শরীর। কী শীতল! ব্যাঙের দেহের মতোই শীতল আর খসখসে।কিছুটা আঁশটে গন্ধ। গা থেকে ভুরভুর করে ছড়িয়ে পড়ছে আমার চারপাশে।আমার গা থেকে জ্যাকেট টা খুলে ওই শীতল শরীরটা ঢেকে দিলাম জোর করেই।

গাঢ় অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছি না ঠিক মতো। আবছা, আবছা ছায়া মুর্তি। এনালগ ক্যামেরার নেগেটিভ ফিল্মের মতোই।কিন্তু কণ্ঠ স্বর চিরচেনা। কথা বলার ধরণ শারীরিক হাবভাবে চিনে নিলাম।

শরীরে হেলান দিয়ে কতো কথাই বললাম দুই জন। এখানে এই জামতলায় কতো বনভোজন কতো আয়োজনের ঘর সংসার ছিল আমাদের। স্বামীত্বের শাসন খবরদারী।সেইসব অতীত দৃশ্যপটে হাঁটাহাঁটি টের পাচ্ছি আমি।আমাদের ঘর বেড বাচ্চা কাচ্চা আর ক্ষেত খামার। বাজার থেকে সোনালী সরু পাড়ের লাল শাড়ি,আলতা আরও কতো কিছু এনেছি ওর জন্যেই। কতো অভিমান কতো রাগ।দুই জনে হাসছি সেই কিশোর বয়সের মতোই।

বানের পানিত ভাইসা যাইতেছিলাম একবার। তুই আর আমি। ওই যে ভ্যালা বানাছিলাম। ঠিক মতন বান্দন দেওয়া অইছিল না। পানির তোড়ে খুইলা গেল ভ্যালাডো।

মনে আছে রে, সব মনে আছে। কিছুই ভুলি নাই।
আইজ কী মনে অইত্যাছে জানোস?
কী?বল
মনে অইত্যাছে ওইদিন দুই জন এক লগে ভাইসা গেলিই ভালো আছিলো।
পানি খাতি খাতি মইরা ভাইসা যাইতাম ওই মাঝ নদিত।তবু তোর সাথে থাকা যাইতো।
আমার তেমন ইচ্ছে নেই। মারা গেলে কী ডাক্তার হতে পারতাম?
তুই ডাকতর!!
কী ভাগ্য আমার। একজন ডাকতর যার হাতে ছোট বেলাত জামাই বউ খেলছি। হেই জন্যিই তো কই পানু এতো সুন্দর হইরা কতা কয় ক্যা।

হ্যা, সেই তো ক্লাশ সেভেন থেকে হোস্টেল জীবন।ক্যাডেট কলেজের কড়া শাসন অতঃপর মেডিকেল কলেজ ডিঙিয়ে আজ ডাক্তার। বড্ড হাঁপিয়ে উঠেছিলাম রে স্বপ্না।তাইতো গ্রামে আসা।হাফ ছেড়ে সতেজ সজীব বাতাস নিতে চাই ফুসফুসের কোষে কোষে।যতো দূরেই যাই তোদের স্মৃতি ভুলি নাই। তবে তোকে এভাবে পাবো চিন্তাই করি নাই।ভেবেছিলাম তুই কোথায় কার ঘরের ঘরণী হয়ে আছিস।
কিরে স্বপ্না! তোর সংসারের কথা কিছু বল এবার।সংসার জীবনটা কী পুতুল খেলা দিনগুলোর মতো? নাকি আরও রঙিন? ছেলে মেয়ে কয়টা? স্বামী কী করছেন?– একটানা নানা প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছি স্বপ্নাকে।

পুবাকাশ আলো করে রঙিন লাল সুর্যটা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।শীতে সবুজ রঙ হারিয়ে বাদামী রঙে বদলে যাওয়া মেহগুনি পাতার আড়ালে সুর্যের লুকোচুরি। একটু পরেই সাদা আলোক ধারা বইয়ে দেবে পুরো আকাশটাতে।ঝিমিয়ে পড়া লোকালয় সজাগ হচ্ছে একটু একটু। হাঁস মুরগী ডানা ঝাঁপটায় কক কক কলরব।পাখিরা এ ডাল থেকে সে ডালে উড়ে বেড়ায় কিচিরমিচির আর ঠোঁট ছোঁয়াছুয়ি করে।বকের দল সারিবদ্ধ সরণীতে প্রস্ততি নিচ্ছে আকাশে উড়ে বেড়াবার। নিজেদের ঘুম ভাঙার সংবাদ জানাতে পশু পাখির প্রচণ্ড দাপাদাপি।হাম্বা রব,ভ্যা ভ্যা আরও কতো কী!! বিচিত্র প্রকৃতির বিচিত্র প্রাণী।

শুধু আমি ডেকে যাচ্ছি স্বপ্নার নাম ধরে। বিছানার এক পাশে জ্যাকেটটা বালিশে ঠেস দিয়ে রাখা। কটু আঁশটে গন্ধ এখনো জ্যাকেটে। আমার মুখে স্বপ্নার নাম শুনে ওর মা বাবা ছুটে এসেছে এই ঘরে।তাদের হাত মুখ ভেজা। অজু সেরে নামাজের প্রস্ততি নিচ্ছিলেন।

তারা দুই জনেই কাঁদছেন। স্বপ্নার মায়ের কান্নায় হেঁচকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে তীব্র যন্ত্রণা।
আমি বেদনায় নীল। পানুর সেই শৈশব স্মৃতি সেই জাম গাছ সেই খাল পাড় দুঃসহ বেদনার।

আরক্তিম চোখ, সকালের সুর্যের মতোই আমি ফ্যাকাশে হতে থাকি আন্টির কথা শুনে।ধুলো বালির পৃথিবীর আলোয় আমি রক্ত দেখি। লাল তাজা রক্ত। দেখি ধর্ষিত স্বপ্নার ক্ষত বিক্ষত লাশ। দেখি আখ খেতে ধস্তাধস্তি করা নির্জন প্রান্তর।সেই সন্ধ্যার নিরিবিলি। জামগাছে ঝুলিয়ে দিচ্ছে পৈচাশিক পশুর দল।মগডাল, সেই মগডাল! যে ডালে বসে উড়োজাহাজ উড়োজাহাজ খেলেছি আমরা কিশোর কিশোরীর দল।

আমি সজোরে চিৎকার করে জেগে উঠি।প্রতিটা ভোর আমার কাছে জেগে ওঠে দুঃস্বপ্নের দরজায় কড়া নেড়ে।রাত আসে বীভৎস ভূতুড়ে আঁধার নিয়ে…