বিশ্বজিত পাল’র অনুগল্প
পানু পিসির পানের বাটা
পিনাকী দত্ত পিনা।ছোট বেলায় সবাই পিনা নামে ডাকতো।দারুন মেধাবী ছাত্রী ছিল।বাংলায় অনার্স- মাস্টার্স।পিনাকীর বাবা চেয়েছিল ইংরেজি নিয়ে পড়ুক মেয়ে।কিন্তু পিনাকী গল্প-কবিতা লিখতে ভালোবাসতো।ছাত্রী জীবনে পত্রিকায় নিয়মিত লেখা ছাপতো।তাই বাংলা নিয়েই পড়েছিল। বিয়ে হয়। এক ছেলে হওয়ার পর পিনাকীর স্বামী গত হয়।সেই থেকে বাপের বাড়িতে থাকে।
সময় বয়ে যায়।মা কাকিমারা ভাতে ভাতে পিনাকী কে একটু একটু পান খেতে বলায় পিনাকী ও খায়।ক’দিন বাদে পিনাকীর পানের নেশা ধরে যায়।বাটার সব পান সাবাড় হয়ে যায়।মা ঠাকুম্মারা চিল্লায় “ও পিনা সব পান কেন খেয়ে ফেললি? আমরা কি খাবো? দাঁতগুলো টক হয়ে যাচ্ছে।কোন দুঃখে যে তোকে পান খানা শিখালাম।”
বেশি পান খাওয়ার দৌলতে পিনাকী হয়ে উঠে পাড়ার সবার কাছে পানু পিসি। পানু পিসির একমাত্র ছেলে এখন মস্ত ডাক্তার।মামারা পড়িয়েছে তাকে।কানাডা থাকে।
পাড়ার দুষ্টু ছেলে সলিল প্রায় পানু পিসি থেকে পান খেতে চায়।পানু পিসি যেখানে যায় পানের বাটা সাথে নিয়ে যায়।
কারন,পানুর এক দুটো পানে হয়না।পাঁচ পাঁচটা পান একসাথে মুখে দিয়ে জাবর কাটে।কে দেবে তাকে এতো পান।তাই নিজের পান নিজেই খায়।
বাপের ও বেশ পয়সাকড়ি আছে।ভাইরা বড় ব্যবসায়ী। তাই পানু পিসির পান খেতে কোন সমস্যা নেই।
সেইদিন সলিলের মাথায় কি হলো জানিনা।বলল- “পানু পিসিগো ও পানু পিসি একটা পান দাওনাগো? আরে আজ দেবোনা।পান কম বাটায়।কাল দেবো।না, না পানু পিসি একটা দাওনাগো?। আরে বলছি না, কাল খাস বাবা যা যা কোথায় যাচ্ছিস যা।”
ভাইল মেরে মেরে সলিল পানুর সামনে এসে বলল “পিসি তোমার মুখ থেকেতো দারুন সুগন্ধ বের হচ্ছে একটা পান দাওনা!”
বলতে বলতেই পানের বাটাটা নিয়ে দিল এক দৌড়।পানু পিসি সলিলকে ধরতে গিয়ে ধপাস করে পড়ে গেলো মাটিতে।
বেচারী পানুর সাথে সাথে দুটো দাঁত ভেঙে রক্ত পড়তে লাগলো।
পানু পিসির সেকি কান্না! বিলাপ করে কাঁদছিল।”আমার পানার বাটা দে… আমার পানের বাটা দে…. ”
লোকজড়ো হলো।সবাই সলিলকে ধরে নিয়ে আচ্ছামতো গাল মন্দ করলো।
পানু পিসি পানের বাটা ফিরে ফেলো।আর অমনি সাথে সাথে মোটা একটা পানের খিলি মুখে পুরে দিয়ে চিবোতে লাগলো।এইদিকে এখনো ভাঙা দাঁত দিয়ে রক্ত ঝরছিল।সবাই অবাক পানু পিসির কাণ্ড দেখে।যেই পান মুখে দিলো পানুর কান্না ও থেমে গেলো।
বৌদিরা এসে পানুকে বাড়ি নিয়ে গেলো।
আর যেতে যেতে তাকে বুঝালো “পানের জন্য কেউ বিলাপ করে ঠাকুরঝি? আমাদেরকি পানের অভাব?”
দুদিন পর পানু পিসির মারাত্মকভাবে দাঁতের যন্ত্রণা শুরু হয়।সে কি দাঁতের ব্যথা! কি কান্না পানু পিসির!।ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো।সাথে পানের বাটা ও গেলো।হরিদ্বার থেকে কেনা রুপোর পানের বাটা। তাকে ছাড়াকি পিসি যায়? তাছাড়া পান ছাড়াতো পানুর চলেইনা।
ডাক্তার বলল – পানুর আর পান খাওয়া চলবেনা টোটালি বন্ধ।পানে খেতে খেতে দাঁত ক্ষয় হয়ে গেছে।এমনকি দাঁতের,ক্যানসার ও হতে পারে।
কে শুনে কার কথা।পানু পান ছাড়েনা ডাক্তারের কথা না শুনেই সেদিনও মুখে পান পুরে দিলো।চিবুতেই.. ও মাগো বলেই চিৎকার করে সারাবাড়ি মাথায় করলো।
কিছুতেই পানু পিসি পান ছাড়ছেনা। কয়েক মাস গত হলো।পানু পিসির দাঁতের সমস্যা ভয়ানক হলো।মাড়ি ফুলে মুখ, তুক ফুলে গেছে কলাগাছের মতো।
ভাত – তাত খেতে পারেনা।দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে।
ছেলে সতীশকে খবর দেওয়া হলো।একদিন কানাডা থেকে পানু পিসির ডাক্তার ছেলে মাকে দেখতে চলে আসে।
সতীশ মাকে অনেক বুঝালো।মা পান খেয়োনা।পানেই তোমার দাঁতের এই অবস্থা।
পানু পিসি কী আর সেই কথা শুনে।পানের বাটা লুকিয়ে রাখা হলো।তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে পান খায়।
অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় পানু পিসিকে কানাডা নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।যাতে তাঁকে পান খাওয়া ছাড়ানো যায়।
পানু পিসি কানাডা যেতে রাজি হচ্ছেনা।আরো বলে মরলে এখানে মরবে কানাডা ফানাডা যাবেনা। সতীশ বেড়াতে যাওয়ার নাম করে নিয়ে গেলো।
যাওয়ার সময় পানের বাটা ছাড়া যাচ্ছেনা।কতো করে বুঝালো শুনলোনা।
অবশেষে যখন বিমান বন্দরে চেক পোষ্টে সব চেক করছে তখন পানের বাটা দেখে কর্তৃপক্ষের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।রুপোর তৈরী কি একটা ঝিলিক দিচ্ছে।পরে পানের বাটা জানতে পেরে সবাই হু হু করে হেসে উঠলো।
পানু পিসি বার বার পানের বাটাটা কেড়ে নিতে চায়।কিন্তু কি সন্দেহ হলো জানিনা বিমান কর্তৃপক্ষ পানের বাটাটা নিতে দিলোনা।সেখানে ও ছোট বাচ্চার মতো পিসি কাঁদতে লাগলো।
বিমান ছাড়ার সময় হওয়ায় সতীশ পিসিকে বিমানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে আর পিসি সুখে আচঁল চেপে পিছনে ফিরে ফিরে পানের বাটার দিকে চেয়ে আছে।
ছোটোদি
ছোটোদি ছোটো বেলায় ভীষণ দূরন্ত ছিল।কি পরিমাণ যে দূরন্ত ছিল কোজাগরী লক্ষী পুজো আসলে বুঝা যেতো। দিনের বেলায় গিয়ে কার বাড়িতে কি আছে দেখে রাখতো।আর লক্ষীপুজোর রাতে সব চুরি করে নিয়ে আসতো।কারন,কথিত আছে লক্ষীপুজোর দিন চুরি করলে নাকি পাপ হয়না। তাই সনাতন ধর্মের ছেলে মেয়েরা ঐ রাতে দুষ্টুমি করে চুরি করে এটা সেটা।
একবার লক্ষী পুজোর রাতে ছোটদি অনু মামীদের পেঁপে গাছ কেটে পেঁপে সব নিয়ে আসে।তারপর মোহনবাঁশিদের বাড়ি গিয়ে চালকুমড়ো গাছ কেটে সব চালকুমড়ো নিয়ে আসে।মেজো দিমনির বাড়ি থেকে কলাগাছ কেটে কলার ছরা নিয়ে আসে।
চুরি করা জিনিসে দক্ষিনের বারান্দা ভরিয়ে ফেলছে।আমি তো ভিতুর ডিম।নাক ডেকে ডেকে ঘুমাচ্ছি।সকালে উঠে দেখি দখিনের বারান্দা ভরপুর…।
এইদিকে সবাই পরদিন ঘুম থেকে উঠে গালি গালাছ শুরু করে দিয়েছে- কোন ফুতানি,কোন ভাইয়ানি,কোন লক্ষীছাড়া আমার কলা,পেঁপে,চালকুমড়ো নিয়ে গেলিরে…!পেটে তোদের ফোঁড়া হবে।কলেরা হবে মরবি.. মরবি. বলে গালমন্দ করছিল।আর ছোট দি চুরি করা পেঁপে,কলা এইসব খাচ্ছে।
সময়ের কী নির্মম পরিহাস! ছোটদির সব দূরন্তপনা আজ শেষ।সংসার জালে আটকে গিয়ে কোজাগরীতে তাঁর আর চুরি করা হয়না।
স্বামীটা তাঁর বড় খারাপ।সময়ে অসময়ে নুন থেকে চুন খসলে প্রহার করে।
ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে।সবাই শিক্ষিত।তবু অসৎ স্বামীর নির্যাতন থেকে তাঁর মুক্তি নেই।
জীবনের এক বড় অভিশাপ অসুরকে স্বামী হিসেবে বিয়ে করা।ছোটদির হাসিখুশুি, উচ্ছ্বাস দূরন্তপনা, আর দুষ্টুমির সব দিনগুলো অসভ্য স্বামী নির্যাতনের যাঁথাকলে পিষে ফেলেছে।
এখন দিদির চোখে সব স্মৃতি।সব দুস্বপ্ন।
চিন্তায় চিন্তায় নানা রোগের বসত এখন দিদির শরীরে।কিডনি দুটোও শেষের পথে।চোখের দৃষ্টি ক্রমশঃ ঝাপসা হয়ে আসছে।হাঁটতে কষ্ট হয়।তবু ও প্রতিমাসে উপোস করে নানা পুজো করে ছেলে,মেয়েদের মঙ্গল কামনায়।
তবুও বাড়ির সব কাজ করে হাসিমুখে।সংসার তাঁকে দুঃখ ছাড়া কিছু দেয়নি।দিয়েছে প্রতিনিয়ত অত্যাচার,অবহেলা আর যন্ত্রণা।
মানুষ জীবন কেন এতো কষ্টের হয়? এতো বেদনার হয়? কেন এতো জ্বালাময় মানুষ জীবন?
নানা প্রশ্নে দিদিকে জর্জরিত করে মন।মাঝরাতে প্রশ্ন গুলো চোখ পাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে।দিদি ঘুমোতে পারেনা।তখন দিদির চোখ দুটো আষাঢ়ের সন্ধ্যাবেলা হয়ে উঠে। বালিশ ভিজে জুবুতুবু হয়ে যায়।
নির্ঘুম রাত্রি কেটে যায় ভোরের কড়া নাড়ার আঘাতে।
দিদি ফের শুরু করে ঘর মোছা,ঝাড় দেওয়া,অসভ্য স্বামীর খাবার তৈরী করা।
একটা দূরন্ত জীবন থেমে যায় পাষণ্ড আর বর্বরতায়…
এখনো লক্ষীপুজো আসে।কোজাগরী রাত আসে।কিন্তু ছোটদির সময়ের কোজাগরী আর আসেনা।
এখন লক্ষীপুজো আসলে ছোটদির কথা মনে পড়ে।অজান্তে দু’চোখে বর্ষা নামে!