প্রবন্ধ: লু স্যুন : জীবন ও সাহিত্য

প্রবন্ধ: লু স্যুন : জীবন ও সাহিত্য

লু স্যুন : জীবন ও সাহিত্য

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

লু স্যুন বলেছিলেন – “I thought : hope cannot be said to exist, nor can it be said not to exist. It is just like roads across the earth. For actually the earth has no roads to begin with, but when many men pass one way, a road is made.” সামগ্রিক বিচারে “Diary of a Madman” রচনায় বলা এই কথাগুলিতে যে জীবনদর্শন বিধৃত আছে তাঁর সাহিত্যজীবনেও বারংবার যেন তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল কেবলমাত্র নৈরাশ্যবাদীর দৃষ্টিভঙ্গীতে বিচার করলেই সমাজের বিভিন্ন অন্ধকার দিকগুলি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। যে দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি সমাজকে দেখেছিলেন তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত শব্দবন্ধ “resistance of despair” সমগ্র চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণার একেবারে কেন্দ্রে বিরাজ করছে। এই কারণেই অন্যত্রও তিনি প্রায় একই কথা বলেছিলেন – “Hope is like a road in the country; there was never a road. But when many people walk on it, the road comes into existence.” (The Wisdom of China and India : The Epigrams of Lusin)
চীনদেশের ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে লু স্যুনের আবির্ভাব। চীন দীর্ঘদিন বিদেশের প্রভাব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু সেই সময় চীন বাধ্য হয়ে পশ্চিমী অনুপ্রবেশের সামনে দরোজা খুলে দেয়। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে বিভিন্ন নতুন শক্তির প্রভাবে চীনদেশ ভরে যায়। পরবর্তীকালে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের আগে আকস্মিকভাবে তার পতনের সূত্রপাত হয়। এর ফলে সেদেশের মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশা ও বিভ্রান্তির শিকার হন। পশ্চিমী প্রভাবে সবথেকে অধিক প্রভাবিত হয়েছিল চীনের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। এই শ্রেণীর প্রতিনিধি লু স্যুন অন্যদের মতই সবরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যান এবং তার নির্যাস আত্মস্থ করেন। তাঁর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে ছিল সেই যুগের প্রধানতম সমস্যা – কীভাবে দেশ বিদেশী আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারে এবং সেই সঙ্গে আধুনিকীকরণের দিকে এগোতে পারে।
চীনদেশের আধুনিক সাহিত্যের প্রবাদপুরুষ লু স্যুন প্রসঙ্গ আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই মনে পড়ে ভারতের সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচন্দের কথা। দুজনের মধ্যে অনেক মিল। দুজনেই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। ধনপত্ রায় যেমন হিন্দী ও উর্দু সাহিত্যে প্রেমচন্দ নামে পরিচিত, সেরকমই চৌ শ্যু-ড়েন নামক ব্যক্তিটি বিশ্বসাহিত্যে লু স্যুন নামে খ্যাত। তাঁদের জন্মের সময়টাও কাছাকাছি। প্রেমচন্দের জন্ম ১৮৮০ খ্রীষ্টাব্দের ৩১ জুলাই এবং লু স্যুনের জন্ম ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর। দুজনেই শৈশবকালে দারিদ্র্য দেখেছেন। পেশার দিক থেকে বিচার করলে উভয়েই শিক্ষা বিভাগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরবতীকালে উভয়েই নিজের চেষ্টায় ছাপাখানা খুলেছিলেন। লু স্যুনের ছাপাখানাটির নাম ছিল ভোরের ফুল মুদ্রণালয়, প্রেমচন্দের ছাপাখানাটির নাম ছিল সরস্বতী প্রেস। উভয়েই দু’চোখে সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হয়েছিলেন এবং দেশ-বিদেশের সাহিত্য অনুবাদের উপর জোর দিয়েছিলেন।
লু স্যুনের জন্ম চীনের চেকিয়াং প্রদেশের শাওসিয়াং এলাকার তুঙ ফাঙ-ছাঙ গ্রামে এক প্রাচীন ভূস্বামী পরিবারে। পরিবারটি এককালে আর্থিকভাবে সম্পন্ন হলেও তাঁর জন্মের সময় অবস্থা ছিল পড়তির দিকে। ফলে তাঁর ছেলেবেলা মোটামুটিভাবে অভাবের মধ্যে কেটেছে। পাঁচ বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন। মানুষের উপকার করার ইচ্ছে বরাবরই তাঁর মনের গভীরে প্রোথিত ছিল এবং সেই মানসিকতার বশবর্তী হয়েই স্নাতক হওয়ার পর তিনি চিকিৎসাবিদ্যা অধ্যয়ন করতে চেয়েছিলেন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে (অর্থাৎ কুড়ি বছরের কাছাকাছি বয়সে) ডাক্তারী পড়ার জন্য সরকারী বৃত্তি পেয়ে তিনি জাপানে যান। সেখানে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ভতি হন বটে, কিন্তু ডাক্তারী পড়া শেষ করতে পারেন নি। জাপানে যাওয়ার পরে পরেই তিনি চীনের বিপ্লবের আবর্তে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময় জাপানে যে কয়েক হাজার চীনা ছাত্র ছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী চিন্তাধারা ও কার্যকলাপের কেন্দ্রে ছিলেন।
জাপানে থাকার সময়েই তিনি পশ্চিমী সভ্যতার স্বরূপ এবং স্বদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি উপলব্ধি করেছিলেন। টি. এইচ. হাক্সলের তত্ত্বের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি অতীত ঐতিহ্যের অন্ধ অনুসরণ থেকে বিরত হন এবং নতুনকে আবাহন করার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন চীনের আধুনিকীকরণের পথে দুটি মূল বাধা – একদিকে ভণ্ড শিক্ষিত শ্রেণী যারা নিজেদের স্বার্থে কনফুশীয়বাদকে ব্যবহার করে, অন্যদিকে অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত সাধারণ মানুষের দাসসুলভ মানসিকতা। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে চীনে ফিরে আসার পর (বিশেষত ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের বিপ্লবের পরবর্তীকালে) তিনি দেখেছিলেন ভূস্বামীদের স্বার্থান্বেষী মনোভাবের কারণে তাঁর স্বদেশ এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। এর ফলে তাঁর মন তিক্ততায় ভরে ওঠে এবং তিনি ধীরে ধীরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক টানাপোড়েনের শিকার হয়ে তিনি ক্রমে উপলব্ধি করেন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির প্রভাব এত প্রবল যে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের কথা প্রায়শই গুরুত্ব পায় না।
লু স্যুন যখন জাপানের সেন্দাই মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন তখন দেশটি ধীরে ধীরে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিকে এগোচ্ছিল। সেই সময় রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়, যার কিছুটা সংঘটিত হয়েছিল চীনের বিতর্কিত ভূখণ্ডে। তখন জাপানে কলেজের ক্লাশ শেষ হলে ছাত্রদের যুদ্ধের ছবি দেখান হত। একটি সিনেমা প্রদর্শনী লু স্যুনকে গভীরভাবে ভাবিয়েছিল। ছবিটিতে দেখান হয়েছিল একজন চীনের মানুষ রাশিয়ার হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে অভিযুক্ত হয়েছে, কয়েকজন জাপানী সৈন্য তার উপর অত্যাচার করছে। লোকটিকে মাঠে নিয়ে আসা হয়েছে শিরচ্ছেদ করার জন্য। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছিলেন এই দৃশ্যটি জাপানী দর্শকদের পাশাপাশি কয়েকজন চীনাও উপভোগ করছেন। স্বদেশীয় লোকের উপর নির্যাতনের দৃশ্য চীনের মানুষ উপভোগ করছেন এই ঘটনাটি তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। তাঁর মনের মধ্যে নিজের দেশের প্রতি ভালবাসা প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তীকালে প্রথম গল্প-সংকলন “Na Han”-এর মুখবন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন এই দৃশ্যের অভিঘাত তাঁকে কতটা গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি লু স্যুন সাহিত্যেও অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তাঁর সাহিত্য অধ্যয়ন করার বাসনা ছিল, কিন্তু পরিবারের অর্থাভাবের কারণে তিনি চীনে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তিনি যখন জাপানে ডাক্তারী পড়ছেন সেই সময় তাঁর মা কানাঘুষো শুনেছিলেন যে ছেলে একটি জাপানী মেয়েকে বিয়ে করেছে। অসুস্থতার ছুতোয় তিনি ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। চীনে আসার পর ২৬ বছর বয়সে মায়ের ঠিক করে রাখা নিরক্ষর পাত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এই পত্নীর সঙ্গে তাঁর কোনদিনই রোম্যান্টিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, যদিও সারাজীবন তার যাবতীয় প্রয়োজন তিনি মিটিয়েছেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই তিনি ভাইয়ের সঙ্গে আবার জাপানে ফিরে যান।
লু স্যুন ফরাসী ভাষায় রচিত জুলে ভার্ণের “From the Earth to the Moon” এবং “Journey to the Center of the Earth” প্রভৃতি কল্পবিজ্ঞানের বইগুলি চীনা ভাষায় অনুবাদ করেন। তাছাড়া ইতিহাস, ভূ-প্রকৃতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি প্রবন্ধও রচনা করেন। আঠাশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম বই “অন্যদেশের কাহিনী” (“Tales From Abroad”) প্রকাশিত হয়। ঊনত্রিশ বছর বয়সে তিনি জাপান থেকে দেশে ফিরে আসেন। বছর তিনেক বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ও কলেজে পড়ানোর পর তিনি শিক্ষামন্ত্রকে একটি বিভাগের সচিবের পদে নিযুক্ত হন। এই সময় থাঙ ছি ছদ্মনামে তাঁর কয়েকটি রচনা প্রকাশিত হয়। ১৯১১ সালে লেখা “হোয়াই চাউ” (“Nostalgia”) তাঁর প্রথম মৌলিক গল্প। গল্পটি লেখার পর তিনি একেবারেই সন্তুষ্ট না হয়ে সেটি ফেলে দিয়েছিলেন, তাঁর ভাই রচনাটি যত্ন করে তুলে রাখেন।
১৯১২ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত লু স্যুন বেইজিং শহরে কর্মরত ছিলেন। ১৯১৮ সালে ‘New Youth’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর বিশ্ববিখ্যাত রচনা “জনৈক উন্মাদের রোজনামচা” (“Diary of a Madman”)। এক অভিনব আঙ্গিক ব্যবহার করে তিনি শ্রেণীশাসিত ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা দুর্নীতির প্রকৃত স্বরূপ পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। পাশাপাশি চীনের প্রথাগত ধারণার সঙ্গে বিদেশী ধারণার সুষ্ঠু সংমিশ্রণে রচনাটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। প্রসঙ্গত জানাই এটিই তাঁর নিজের নামে প্রকাশিত প্রথম গল্প। আটত্রিশ বছর বয়সে লু স্যুন ছদ্মনামে এই গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি চৈনিক সাহিত্যের নব্য সংস্কৃতি আন্দোলনের অগ্রণী লেখকদের মধ্যে একজন বলে পরিগণিত হন। চিরাচরিত পথ পরিত্যাগ করে নতুন পথের সন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন – “We have hereafter only two roads to choose : one is to embrace the ancient literature and die, the other is to forsake the ancient literature and live.”
১৯১৯ সালের ৪ মে আন্দোলনের পরে চীনের সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতির জগতে লু স্যুনের রচনা ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। মোটামুটিভাবে ১৯১৭ থেকে ১৯২১ সালের মধ্যে ‘New Youth’ পত্রিকায় তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পগুলি প্রকাশিত হয়েছিল। এই গল্পগুলির সংকলন ১৯২৩ সালে “Na Han” (“Call to Arms”) গ্রন্থনামে প্রকাশিত হয়। এর তিন বছর পরে ১৯২৬ সালে “Panghuang” (“Wandering”) সংকলনটি প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় “The True Story of Ah Q”, যা কিনা সমালোচকদের মতে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। এই অতিবিখ্যাত রচনাটির কারণে ঐ বছর নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বিবেচিত হয়। সোভিয়েত দেশের বিশ্ববিখ্যাত সমালোচক লিও এডলিন ‘চৈনিক সাহিত্যের গর্ব’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। লু স্যুনের জন্ম শতবর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে তিনি বলেছেন “আ কিউ” বিংশ শতাব্দীতে রচিত বিশ্বসাহিত্যের সেরা দশটি গল্পের মধ্যে স্থান পাবে।
লু স্যুন সবথেকে বেশী খ্যাতি পেয়েছেন বৈপ্লবিক রচনাগুলির জন্য। তবে দেশের ও বিদেশের প্রাচীন সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ কোন অংশে কম ছিল না। চীনের সাহিত্যে গদ্য কবিতার সূত্রপাত হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত গদ্য কবিতার বই “Yecao” (ইংরেজি “Wild Grass”, বাংলায় “বুনো ঘাস”)। এই বইটি চীনের কাব্যজগতে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। সাহিত্যের পাশাপাশি শিল্পেও তিনি সমানভাবে আগ্রহী ছিলেন। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে উড্ কাট ও গ্রাফিক আর্টের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান কম নয়। পাথর, ব্রোঞ্জ ও স্মৃতিফলকগুলির গায়ে খোদাই করা লিপিগুলির পাঠোদ্ধার নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। বিভিন্ন প্রাচীন মূর্তি নিয়েও তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল এবং স্মৃতি থেকে বৌদ্ধ সূক্তগুলি নির্ভুল আবৃত্তি করতে পারতেন। তিনি ফরাসী, ইংরেজী, জার্মান ও জাপানী প্রভৃতি বেশ কয়েকটি ভাষা জানতেন। তাছাড়াও তিনি জানতেন এসপেরান্তো, যা বিশ্বভাষা বলে পরিচিত।
১৯১৮ থেকে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লু স্যুন চীনের নয়া সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন এবং পুরাতনকে বিদায় দিয়ে নতুনের প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রতিভা বা কর্মকৃতিত্বের উপর চীনের বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে না, প্রকৃতপক্ষে জনগণের পূর্ণ সমর্থনই বিপ্লবের সাফল্যের মূলে। কর্মজীবনে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ কয়েকবার তাঁর মতের অমিল হয়েছিল, ফলে একাধিকবার তিনি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি পাকাপাকিভাবে অধ্যাপনার কাজ ইতি টানেন। এরপর তিনি পুরোপুরিভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ফলতঃ তাঁকে মাঝে মাঝেই আত্মগোপন করে থাকতে হত।
যে কাজটির জন্য লু স্যুন বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার সেটি হল চীনদেশের সাহিত্যে চলিত কথ্যভাষার প্রচলন। বস্তুত আধুনিক চীনের সাহিত্যের ভাষার ক্ষেত্রে তিনি যে অবদান রেখে গিয়েছেন তার তুলনা নেই। তখন বিশালায়তন চীনদেশ ছিল বেশ কয়েকটি ক্যান্টনে বিভক্ত। বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেশের নানা অঞ্চলে দখলদারী কায়েম করেছিল। চীনের বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে বহু আঞ্চলিক ভাষার প্রচলন ছিল, ফলে অঞ্চল থেকে অঞ্চলে ভাষাগত ব্যবধানও কম ছিল না। লু স্যুন বুঝেছিলেন ভাষাগত ব্যবধান দূর করতে না পারলে সুবৃহৎ চীনদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব নয়। অতএব তিনি এই ভাষাগত ব্যবধান যতটা সম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। যে সুবৃহৎ কাজে তিনি হাত দিয়েছিলেন চীনে বিপ্লবের পরবর্তীকালে তা অনেকটাই সফল হয়েছিল। বিপ্লবোত্তর কালে দেখা গিয়েছিল সেদেশে কথ্যভাষা মাত্র দুটি উপভাষায় রূপান্তর লাভ করেছে। এই উপভাষাদুটির একটি হল শহরের মানুষের কথ্যভাষা পেইচিং বা পিকিং ডায়ালেক্ট এবং অন্যটি হল গ্রামের মানুষের কথ্যভাষা ক্যান্টন ডায়ালেক্ট। আরো পরে চীনে সাংস্কৃতির বিপ্লবের পরবর্তীকালে এই দুটি ডায়ালেক্ট মিশে গিয়ে একটি মাত্র ডায়ালেক্টের প্রচলন হয়েছে।
লু স্যুন ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অনুবাদক, সাহিত্য সমালোচক এবং সম্পাদক। এই সবকিছুর পাশাপাশি আরও একটি বিরাট বড় পরিচয় তিনি একজন নিরলস সাহিত্য সংগঠক। পরিণত বয়সে যখন তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক তখনও উঠতি সাহিত্যিকদের লেখা তিনি মনযোগ সহকারে পড়তেন এবং তাদের সঙ্গে লেখার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতেন। তুলনামূলক বিচারে লু স্যুনকে বলা হয় ‘চীনের গোর্কি’। এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হল দুজনের কেউই নিজ দেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না। রাশিয়ার বিপ্লবের সমকালে ম্যাক্সিম গোর্কী বিপ্লবের স্বপক্ষে লেখনী ধারণ করেছিলেন। রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিন মন্তব্য করেছিলেন গোর্কি না থাকলে রুশ বিপ্লব সম্ভব হত না। চীনদেশের ক্ষেত্রে এই জায়গায় লু স্যুনের নাম করা যায়। সেদেশের রাষ্ট্রনায়ক মাও সে-তুঙ তাঁর সম্পর্কে অতিশয় উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।
চীনদেশে বিপ্লবী সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম প্রেরণা দিয়েছিলেন বামপন্থী সাহিত্যিক চিয়ং কুয়াংৎসে। তিনি ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে নবযুবক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে ‘প্রোলেতারীয় বিপ্লব ও সংস্কৃতি’ কথাটির উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর ‘নতুন স্বপ্নসমূহ’ নামক কাব্য সংকলনে (কবিতাগুলি ১৯২০-২৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত) চীনের পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধার মনোভাব ফুটে ওঠে। চীনের মুক্তির পথ হিসেবে তিনি সর্বহারার বিপ্লবী চিন্তাধারার কথা ঘোষণা করেন। তবে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে সৃষ্টি পত্রিকায় কুও-মো-জো রচিত ‘বিপ্লব ও সাহিত্য’ প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিপ্লবী সাহিত্য কথাটির প্রচলন শুরু হয়ে এবং সাহিত্যজগতে স্থান করে নেয়। কুও-মো-জো বলেছিলেন শিল্প-সাহিত্য কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই, তার একমাত্র অবদান হল সর্বহারার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। এই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই চীনের বহু বুদ্ধিজীবী মার্কসবাদী চিন্তাধারার প্রতি আকৃষ্ট হন।
বিপ্লবী শিল্পসাহিত্য মতবাদের বিরোধীদের দুটি মূল ভাগ ছিল। একদিকে ছিলেন সেইসব বুদ্ধিজীবী যাঁরা নীতিগতভাবে বিপ্লবী শিল্পসাহিত্যের বিরোধীতা করেন এর সমগ্র ধারণাকেই প্রত্যাখ্যান করেন। অন্যদিকে সেই বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা তথাকথিত বিপ্লবী লেখকদের বিচার-বিবেচনার কড়া ভাষায় সমালোচনা করেন এবং বিপ্লবী শিল্পসাহিত্যকে যথাযোগ্য আসনে বসাতে প্রয়াসী হন। তৎকালীন চীনের সাহিত্যিকদের মধ্যে লু স্যুন এবং মাও তুন ছিলেন দ্বিতীয় গোষ্ঠীটির অন্তর্ভুক্ত। তাঁরা এই সংক্রান্ত তর্ক-বিতর্কে অংশ নেওয়ায় বিপ্লবী সাহিত্যের জনপ্রিয়তা বাড়ে ও সর্বসাধারণের মধ্যে তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রাথমিকভাবে লু স্যুন ছিলেন বামপন্থী এবং উদার মতাবলম্বী। তিনি অনেক বিপ্লবী সাহিত্যিকের ভুলভ্রান্তিগুলিকে আক্রমণ করেছিলেন বটে, তবে কখনই তাঁদের মতাদর্শকে নয়। তিনি এই ধরণের শিল্পসাহিত্যের বিপ্লবী ভূমিকাকে অস্বীকার করতে চান নি। আসলে তিনি এই মতের বিরোধীতা করেছিলেন যে বিপ্লবী শিল্পসাহিত্যের উপরেই বিপ্লব নির্ভরশীল। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে হোআমপোয়া সামরিক বিদ্যালয়ে প্রদত্ত বিপ্লবী যুগের শিল্পসাহিত্য শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন – “এখানে যখন বিপ্লবী ঘটনা ঘটে চলেছে তখন লেখকরা একথা বলে আনন্দ পান যে সাহিত্য ও বিপ্লব ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সাহিত্য ও শিল্প বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে সাফল্যমণ্ডিত করতে সক্ষম।” বিষয়টার আরও সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি ঐ বক্তৃতায় বললেন – “বিপ্লবের জন্য অবশ্যই বিপ্লবীদের প্রয়োজন, কিন্তু বিপ্লবী সাহিত্যের জন্য কোন তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই। কেবলমাত্র বিপ্লবীদের লেখাই বিপ্লবী সাহিত্য বলে গণ্য।”
গোড়ার দিকে লু স্যুন বিশ্বাস করতেন কোন ব্যক্তির বীরোচিত প্রচেষ্টার দ্বারা জনগণকে উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করা যায়। কিন্তু ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তাঁর চিন্তাজগতে মূলগত পরিবর্তন দেখা দেয়। তাঁর লেখা থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায় ঐ বছর চিয়াং কাইশেকের বলপূর্বক ক্ষমতা দখল করার ঘটনায় তাঁর মানবতাবাদী চিন্তাধারা গভীরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিল। তখন থেকে শুরু করে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা ত্যাগ করেন এবং মার্কসবাদের প্রভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্তন হয়। এই সময়কালে শিল্প-সাহিত্য সম্বন্ধে মার্কসবাদী ব্যাখ্যা পাঠ করার ফলে সমাজ ও জীবন সম্বন্ধে তাঁর ধারণা পুরোপুরি বদলে যায়। মার্কসবাদী চিন্তাধারার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে সাধারণ মানুষের জন্য আত্মনিয়োগ করতে তৎপর হয়ে ওঠেন। তিনি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে লুনাচারসকী-র এবং ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে প্লেখানভের শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলি অনুবাদ করেন।
লু স্যুন জনগণের শক্তিতে গভীরভাবে আস্থাশীল ছিলেন। তিনি মনে করতেন চীনের বিপ্লবের পথে দুটি প্রধান বাধা হল পশ্চিমী দুনিয়ার দ্বারা প্রভাবিত উদারনীতিমূলক চিন্তা এবং কুওমিনটাঙ দলের অস্পষ্ট নীতি। তিনি এদের সরাসরি আক্রমণ করেন। ১৯২৮ এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লবী শিল্পসাহিত্য সম্বন্ধে বহু তর্কবিতর্কের ফলশ্রুতিতে কয়েকজন যুবক কমিউনিস্ট লেখক ও সহমতাবলম্বী বন্ধুদের সহযোগীতায় তিনি বামপন্থী লেখক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কুয়োমিনটাঙ দলের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকাশ্যভাবে বামপন্থী লেখক সঙ্ঘের অন্যতম কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং চীনের ঐতিহাসিক পরিস্থিতির মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণকে সর্বান্তকরণে গ্রহণ করেন। বামপন্থী লেখক লীগের সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে লু স্যুন বলেছিলেন – “সর্বহারার মুক্তি সংগ্রামে প্রোলেতারীয় সাহিত্য একটি অংশবিশেষ। সর্বহারার প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই সাহিত্য ব্যাপকত্ব লাভ করে।” নিজের মতামত সম্পর্কে তিনি বিন্দুমাত্র ধোঁয়াশা রাখেন নি। ঐ বছরেই তিনি অন্যত্র বলেছিলেন – “আমি একথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে ভবিষ্যৎ চীনের নায়ক সর্বহারা শ্রেণী।”
বামপন্থী লেখক সঙ্ঘের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল উদারনৈতিক চিন্তাধারা সম্পন্ন বুদ্ধজীবী সম্প্রদায়কে দলভুক্ত করা। তিনি এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং তাঁর প্রভাবে সমাজের এক বৃহত্তর অংশ এই মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কমিউনিস্ট ভাবধারার অন্যতম লেখক ফেং সুয়েফেং পরবর্তীকালে লু স্যুনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন – “লু স্যুনের নেতৃত্বেই বামপন্থী লেখক সঙ্ঘ মতাদর্শগত সংগ্রামের দ্বারা বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার প্রভাব বিস্তার করে এবং রাজনৈতিক ফল লাভ করে। . . . . আমাদের মত অসংখ্য যুবক পার্টি সদস্য লু স্যুনের সঙ্গে নিজেকে ঐক্যবদ্ধ করে তাঁর মতামতকে শ্রদ্ধা সহকারে অনুসরণ করে। তাঁর পথকে বিশ্বাস করে, জনগণের বিপ্লবী শিল্পসাহিত্যের মহান বিজয়কেতন হিসেবে তাঁকে গণ্য করে, পার্টির নেতৃত্বে আমরা সঠিক পথই গ্রহণ করেছিলাম। এ জয় লু স্যুনের জয়, এ জয় আমাদের পার্টির বিজয়।”
১৯৩০ থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কাল আধুনিক চীনের ইতিহাসের সবথেকে সংকটময় পর্যায়। কয়েক শতাব্দী যাবৎ বিভিন্ন বিদেশী শক্তিগুলি চীনের উপর জোর করে একের পর এক বৈষম্যমূলক চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। এইসব চুক্তির জালে আবদ্ধ চীন এই সময় জাপানের সশস্ত্র আক্রমণের সামনে পড়ে। সেই সময় সুনইয়াৎ সেনের জাতীয়তাবাদী বৈপ্লবিক নীতির আড়ালে কুয়োমিনটাঙ দলের প্রচ্ছন্নভাবে জাপানের সঙ্গে আঁতাতকে লু স্যুন কোন অবস্থাতেই মানতে রাজী ছিলেন না। তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধে কুয়োমিনটাঙ দলের এই নীতিকে আক্রমণ করেন এবং শাণিত যুক্তি ও বিশ্লেষণের সাহায্যে ছিন্নভিন্ন করে দেন। বিপ্লবী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে লু স্যুনের ভূমিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল তত্ত্ব ও তার প্রয়োগের সঠিক বোধ। চীনের জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রামে তিনটি বিষয়ের উপর তিনি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন – প্রগতি, জনগণ ও বাস্তব। একদিকে প্রগতির পথে চলার আকাঙ্খা ও অন্যদিকে জনগণের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা থেকে তিনি স্বদেশের সমস্যাগুলির মৌলিক সমাধান খোঁজার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তৎকালীন সংকটময় পরিস্থিতিতে মাও সে তুং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লু ল্যুন ঠিক সেই ভূমিকাই পালন করেন। এই সময়কালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মাও সে তুং বলেছিলেন – “এ সময় একাধারে ছিল প্রতিবিপ্লবী প্রচার বেষ্টন ও পরিপূর্ণ ধ্বংসসাধনের যুগ। . . . . এই বেষ্টন ও পরিপূর্ণ ধ্বংসসাধনের যুগে কমিউনিস্ট লু স্যুন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অসাধারণ শক্তিমান নায়ক হিসেবে দেখা দেন।”
১৯৩০ এর দশকের মাঝের দিকে লু স্যুনের স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিল না। বুকে ও পাঁজরে তিনি প্রায়ই অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করতেন। বছর দুয়েক চিকিৎসা চলার পর ধরা পড়ল তাঁর রোগটা আসলে ছিল পেটে, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। এর মধ্যেই ১৯৩৪ সালে তাঁর শেষ ছোটগল্পের সংকলন “Old Tales Retold” প্রকাশিত হয়। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরাসরি বলেন – “অতীতে আমি পুরনো সমাজের অবক্ষয় অনুভব করেছি এবং নতুন সমাজ প্রতিষ্টার আশা নিয়ে বুক বেঁধেছি – যদিও সেই নতুন কিংবা নতুনের আগমনে সমাজের অবস্থা ভাল হবে কিনা তা আমি জানতাম না। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবের পর আমি অনুভব করি যে এই নতুন সমাজের সৃষ্টিকর্তা সর্বহারা শ্রেণী; – এই বিশ্বাস শুধু আমার সন্দেহই দূর করেনি, পাশাপাশি আমার সাহস বৃদ্ধি করেছে।” ১৯৩৫ সালে লং মার্চ-এ সাফল্যের জন্য তিনি কমিউনিষ্ট পার্টিকে চিঠি দিয়ে অভিনন্দন জানান। কমিউনিষ্ট পার্টি তাঁকে চীনের গ্রামাঞ্চলে বামপন্থী বিপ্লবকে বিষয়বস্তু করে একটি উপন্যাস রচনা করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেছিলেন পরিপ্রেক্ষিত সম্পর্কে অনবধানতার কারণে এবং বিষয়টি ভালো করা বোঝেন না বলে এই অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ১৯৩৬ সালে লং মার্চ সমাপ্ত হলে তিনি চীনের কমিউনিষ্ট পার্টিকে টেলিগ্রাম করে অভিনন্দন-বার্তা পাঠান।
১৯৩৬ সালের তাঁর যক্ষ্মারোগ ধরা পড়ে, মার্চ মাসে তিনি জটিল ব্রঙ্কাইটিক অ্যাজমায় আক্রান্ত হন। প্রখর ধূমপায়ী হওয়ার কারণেও তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটা সম্ভব। মে মাসে ডাক্তার তাঁকে অসুখের কথা বিশদে জানান এবং বিশ্রামের উপদেশ দেন। কিছুটা সেরে ওঠার পর তিনি দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন – “Death” এবং “This Too Is Life”। অক্টোবর মাসের আট তারিখে তিনি শারীরিক অবস্থা উপেক্ষা করে সাহিত্য সভায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৭ অক্টোবর অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তিনি লু তি এবং নেই সান নামক দুজন জাপানী সাহিত্যিক পিকিং শহরে এসেছেন খবর পেয়ে তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। পরের দিনই তিনি জ্ঞান হারান এবং প্রায় ২৪ ঘন্টা ঐভাবে থাকার পর ১৯ অক্টোবর তাঁর জীবনাবসান হয়।
লু স্যুনের সাহিত্যজীবনের সামগ্রিক বিচারে দেখা যায় তিনি লেখায় সততই সত্যভাষণ করেছেন, কখনও সাজানো গোছানো ভাষায় অবাস্তব কল্পনার জাল বোনেন নি যা পড়ে পাঠক বিভ্রান্ত হয়। তিনি মনেপ্রাণে যা সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন সেটাই বলেছেন – “The literature of former days is like watching a fire from across the water; in present day literature, the author himself is being scorched by the fire and he is bound to feel it deeply, and when he begins to feel it deeply, he is bound to take part in the social struggle.” ১৯৪৯ সালের পর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সরকার দ্বারা লু স্যুনের অবদান উচ্চ-প্রশংসিত হয়। মাও সে-তুঙ সারা জীবন তাঁর রচনার ভক্ত ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে মাও সে-তুঙ বলেছিলেন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রধান সেনাপতি লু স্যুন একজন বিরাট পণ্ডিত, মহান চিন্তাবিদ ও বিপ্লবী। লু স্যুনের মতাদর্শগত সংগ্রাম ও চীনের বিপ্লবে তাঁর ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছিলেন – “লু স্যুন হলেন ব্যাপকতম জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের জাতীয় নায়ক, ইতিহাসে যাঁর কোন জুড়ি নেই। তিনি একজন সবচেয়ে সঠিক, সবচেয়ে সাহসী, একনিষ্ঠ, দৃঢ়চেতা, অনুপ্রেরণাদীপ্ত নায়ক, যিনি শত্রুপক্ষের শিবির আক্রমণের পর আক্রমণে জর্জরিত করে ধ্বংস করেন। লু স্যুনের গতিপথই, সংক্ষেপে চীনের নতুন সংস্কৃতির পথ।”