গল্প: রিনি হারিয়ে গেল

গল্প: রিনি হারিয়ে গেল

রিনি হারিয়ে গেল
মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছে সোহিনী । পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন কেউ ধরে রাখতে পারছে না । সান্ত্বনা দেবার ভাষাকারোর মুখে নেই । এই ঘটনার কোন সান্ত্বনা হয় না । সারাপাড়ায় বোধহয় একটাও মানুষ নিজেদের বাড়িতে নেই । সবাইএসে সোহিনীদের বাড়িতে ভেঙে পড়েছে । তাদের চোখ জলে ভেজা। কেউ সশব্দে কাঁদছে, আবার কেউ কেউ রাগেতে ফুঁসছে । কান্না, গুণগুণ জটলা, দীর্ঘনিঃশ্বাস পুরো জায়গাটাকে ভারি করে দিয়েছে।

ছোট্ট রিনি অবাক হয়ে তার মামণিকে দেখছে । এত ভিড় হয়েছে, যে তার মতো ছোট্ট মানুষের অত ভিড় ঠেলে তার মামণির কাছেপৌঁছনো সম্ভব হচ্ছে না । রিনির খুব কষ্ট হচ্ছে মামণির কান্না দেখে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেও পারছে না । মামণি সবসময় বলে, ‘রিনিসোনা, চাঁদের কণা । তুমি আমার কাছে থাকলে আমার জগৎআলো-আলো, খুশি-খুশি ।’ সে তো মামণির কাছেই আছে ! তাহলে মামণি এত কাঁদছে কেন ! সে পুরো ভিজে গেছে । শীতকরছে খুব । মামণির কাছে গেলে তবেই মামণি ভেজা জামাছাড়িয়ে দেবে । ভেজা চুপচুপে চুল মুছিয়ে দেবে । কিন্তু যেতেইপারছে না রিনি । এবার সে চেঁচিয়ে ‘মামণি’ বলে ডাকে । কিন্তুঅত লোকের গলার স্বরে তার আওয়াজ গিয়ে পৌঁছল না মামণিরকাছে ।

মামণি, রিনি আর ওর বাবাই যখন একসঙ্গে থাকে তখন খুবআনন্দে থাকে ওরা । আচ্ছা সত্যি তো ! বাবাই কোথায় ? বাবাইকেরিনি কোথাও দেখতে পাচ্ছে না । তাহলে বাবাইকে দেখতে না পেয়েমামণি কাঁদছে ?

রিনির মনে পড়ে যায়, গতবছর পুজোর ছুটিতে তারা তিনজনেদিল্লী, আগ্রা বেড়াতে গিয়েছিল । তখন তার ক্লাস টু’র সেকেন্ডটার্ম পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে । পড়ার চাপ নেই । মামণি একদমইতাকে পড়ার জন্য চাপ দেয় না । মামণি কক্ষনো তাকে বলেনি, ‘রিনি তোমায় পরীক্ষায় এত পার্সেন্ট পেতে হবে । ফার্স্ট হতে নাপারলেও সেকেন্ড হতেই হবে ।’ শুধু মামণি কেন, বাবাইও কোনদিনবলেনি ।

অথচ স্কুলে দিওতিমা সেদিন টিফিন ব্রেকে কত কাঁদছিল । রিনিকাছে গিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে জানতে চেয়েছিল কেন সেকাঁদছে ? আরো কাঁদতে-কাঁদতে দিওতিমা বলেছিল, ‘আজকেআমি ক্লাস টেস্টে টোয়েন্টি মার্কসের মধ্যে মাত্র ফিফটিন পেয়েছি ।বাড়ি ফিরলেই মামমাম মারবে । খুব মারবে ।’

‘মারবে কেন তোর মামমাম ?’ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিল রিনি।

‘মামমাম সবসময় বলে, ‘তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে দিওতিমা ।আমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে হবে ।’

‘তোকে বাড়িতেও দিওতিমা বলে ডাকে ? তোর ডাক নাম নেই ?’ অবাক হয়ে বলে রিনি ।

‘আছে তো । তুপাই আমার বাড়ির নাম । কিন্তু মামমাম যখনগম্ভীর হয়ে কথা বলে তখন দিওতিমা আর তুমি করে বলে ।’

রিনি ভীষণ অবাক হয়েছিল দিওতিমার কথায় । সে কখনোমামণিকে গম্ভীর হয়ে কথা বলতে দেখেনি । শুধু তার সঙ্গে বলেনয়, কারোর সঙ্গেই । সবসময় হাসিখুশি থাকে । কী সুন্দর মামণিরগা থেকে গন্ধ আসে । রিনি সেই গন্ধের টানেই বারবার মামণিকেজড়িয়ে ধরে গায়ে মুখ গুঁজে দেয় ।

মামণি আদর করে বলে ওঠে, ‘রিনি সোনা, চাঁদের কণা ।’

রিনি আরও জোরে চেপে ধরে মামণিকে ।

দিল্লী, আগ্রা বেড়াতে গিয়ে ওরা খুব আনন্দ করেছিল । কত কিছুনতুন সব দেখেছিল রিনি । কুতুবমিনার দেখে হাঁ হয়ে গিয়েছিলরিনি । তবে মথুরা, বৃন্দাবন ভাল লাগেনি তার । আগ্রাতে অবশ্যরিনি একটু দুষ্টুমি করে ফেলেছিল । আগ্রার তাজমহলের সুবিশালচত্বর দেখে ছোট্ট রিনি খুব আনন্দ পেয়েছিল । সমস্ত তাজমহলহেঁটে নয়, নেচে-নেচে ঘুরেছিল । কত ছবি তুলেছিল বাবাই ।আবার সেলফিও তুলেছিল মামণি, বাবাই আর রিনি । ছবি তুলবেবলে রিনি বায়না জুড়তে বাবাই অবশ্য তুলতে দিয়েছিল । ছবিতুলে দেওয়ার পর মামণি বলেছিল বাবাইকে, ‘দ্যাখো আমাদেররিনি কত বড় হয়ে গেল । কী সুন্দর আমাদের দুজনের ছবি তুলেছে।’ বাবাই চকাস করে একটা চুমো খেয়েছিল রিনিকে ।

কিন্তু রিনি তারপরেই যা কান্ড করেছিল তাতে আর তাকে বড় বলাযাবে না । তবে বুঝেছিল কাজটা ঠিক করেনি সে । হয়েছিল কী, বাবাই তাজমহলের ছবি তুলছে, মামণি দেখছে । রিনি পাশেরফুলবাগানের বড় বড় ফুলগুলো দেখে এক দৌড়ে সেখানে চলেগেছে । ফুল দেখতে গিয়ে মামণি, বাবাইকে হারিয়ে ফেলেছে রিনি ।ব্যস্‌, ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিয়েছে সে । চারপাশে বেশ কিছুলোকজন জড়ো হয়ে গেছে । নাম জিজ্ঞাসা করছে । কার সঙ্গেএসেছে জানতে চাইছে । রিনি এত কাঁদছে, কারোর কথার কোনউত্তর দিতে পারছে না । হঠাৎ রিনি দেখে মামণি পাগলের মতোকাঁদতে কাঁদতে বাগানের দিকে আসছে । সেই প্রথম রিনি কাঁদতেদেখেছিল মামণিকে ।

রিনি মামণিকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল । মামণিরতখনো কান্না থামেনি । আশেপাশের লোকজন কেমন করে যেনবাবাই আর মামণির সঙ্গে কথা বলছিল । “নিজেরা এত মশগুলথাকলে চলবে ? মেয়ের দিকেও তো খেয়াল রাখতে হবে । নাহলে যেকোন মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে”। রিনির একদম ভাল লাগেনিএইসব কথাগুলো । মামণি আর বাবাইয়ের দোষ কোথায় ? সেনিজে না বলে বাগানে ফুল দেখতে চলে এসেছিল । সেই প্রথমরিনির সত্যিকারে ভয় হয়েছিল । মামণি আর বাবাইকে হারিয়েফেলার ভয় ।

রিনি আরও একদিন ভয় পেয়েছিল । তবে সেই ভয়টা অন্যরকম ।অত চিৎকার চেঁচামেচি সেদিনের আগে দেখেনি, শোনেনি । তাদেরবাড়িতে কখনো এই ধরণের জোরে কথা বা চিৎকার হয় না । কিন্তুসেদিন হয়েছিল ।

পার্থ কাকু মানে বাবাইর ভাই সেদিন এসেছিল ওদের বাড়িতে ।সঙ্গে কাকিমাও । কয়েকটা দিন থাকবে বলে শুনেছিল রিনি । খুবআনন্দ হয়েছিল তার । ওদের বাড়িতে মাঝেমাঝে দাদুন আরদিদুন এসে থাকে । এই প্রথম অন্য কেউ এলো । মামণি কত রকমরান্না করেছিল দুপুরে । সবাই হইচই করে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়াকরল ।

কিন্তু গন্ডগোল শুরু হলো সন্ধ্যেবেলায় । রিনিকে পড়াতেবসিয়েছিল মামণি । হঠাৎ বাবাইয়ের চিৎকারে মামণি দৌড়ে যায় ।রিনি ভয়ে জড়োসড়ো । এমনভাবে বাবাইকে আগে দেখেনি ।বাবাই এতটাই রেগে গেছে মুখচোখ সব লাল হয়ে গেছে । চিৎকারকরে বলছে, ‘এই মুহূর্তে তুই আর তোর বউ আমার বাড়ি থেকেবেরিয়ে যাবি । আর কোনদিন যেন তোদের মুখ না দেখি আমি ।’

রিনি দেখেছিল মামণি বাবাইকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টাকরছে । দুহাত জোড় করে পার্থকাকুকে বলছে, ‘প্লিজ তোমরা এখনএখান থেকে যাও । পরে কথা হবে ।’ রিনি ভয়ে আতঙ্কে ফুঁপিয়েকেঁদে উঠেছিল ।

‘ওই তো নিয়ে আসছে,’ সবার ফিসফিসে গলার আওয়াজে রিনিরভাবনা কেটে যায় । দেখে বাবাই একটা ছোট্ট মেয়েকে দুহাতে করেকোলের মধ্যে নিয়ে আসছে । এনে মামণির কাছে শুইয়ে দিল ।রিনি ভাবে, কে ওই মেয়েটা ?

ভিড় ঠেলেঠুলে কাছে আসতেই তার সব মনে পড়ে গেল । প্রচন্ডভয় পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল । যদিও তার কান্না কারোরকানে পৌঁছল না ।

আজ সকালে পার্থকাকু আবার এসেছিল । রিনি কথা বলেনি ।পার্থকাকু তাকে বলেছিল বাবাই নিজে কাকুকে আসতে বলেছে ।বাবাই এখন বাড়িতে নেই যখন রিনিকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে সেআসতে পারে । রিনিও আর আপত্তি করেনি ।

কিন্তু বেড়াতে নিয়ে যাবে বলে পার্থকাকু বাড়ির পিছনে বাগানসংলগ্ন পুকুরধারে নিয়ে যায় । এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কাকু ।কেউ কোথাও নেই । তারপরেই হঠাৎ যেন রাগে আগুন ছোটেকাকুর চোখ দিয়ে । বলে, ‘জানিস, দুলাখ টাকা ধার চেয়েছিলুমতোর বাপের কাছে । একটা ফ্ল্যাটের অ্যাডভান্স দেবো বলে । নাহয়আমি আপন ভাই নই । কিন্তু সম্পর্কে তো ভাই । কিন্তু তোর বাপএকটা টাকা তো ঠেকালোই না, উল্টে যা নয় তাই বলে অপমানকরল । কিন্তু আজ এর পরিণামে যা হবে, তার জন্যে তোর বাপইদায়ী থাকবে । আর সারাজীবন তাকে চোখের জল ফেলতে হবে ।’

রিনি ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কি হবে কাকু ?’

কাকু বলল, ‘দেখবি কী হবে ? তবে দ্যাখ ।’

কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই কাকু তাকে টেনে নিয়ে দৌড়ে পুকুরেরজলে নেমে পড়ে । আর সজোরে তার মাথাটা জলের মধ্যে . . .

‘মামণি গো, আমার খুব কষ্ট হয়েছে । দমটা যত আটকেছে, ততআমি শুধু তোমাকেই ডাকতে চেয়েছি । তোমার কাছে ছুটে আসতেচেয়েছি । কিন্তু পারিনি আমি । আজ তোমাকে ছেড়ে চলে যেতেহচ্ছে মামণি । তুমি কেঁদো না । আমি আবার ফিরে আসব তোমারকাছে । তোমার রিনি সোনা, চাঁদের কণা, আলো-আলো, খুশিখুশি হয়ে…’