গল্প : উতল হাওয়া

উতল হাওয়া
শাশ্বতী চ্যাটার্জী
” একি! এ কী গো! ছেলেটাকে অমন মারছ কেন?” খাবার ঘরে ঢুকেই কাতর হয়ে বলে উঠলো সুচরিতা। “চুপ করো একদম। যাও এখান থেকে। সবকিছুর মধ্যে ঢুকবে না, বলেছি তোমাকে!” হুঙ্কার ছাড়ল সৌরভ। এটা নতুন না। এর চেয়ে ঢের বেশি ধমক চমক এই দশ বছরে শুনতে ও দেখতে অভ্যস্ত সুচরিতা। কিন্তু তাই বলে রামুদার মা-মরা ছেলেটাকে অমনি দুমদুম ক’রে সৌরভ মারবে, ওর যেন ভেতরটা কেমন ঘুলিয়ে উঠছিল, কাঁপছিল হাত পা।
“শা…, চুরি করতে শিখেছে! আমার চোখকে ফাঁকি দেবে ভেবেছে! শোন রে হতভাগা ড্রাইভারের বাচ্চা! এই সৌরভ সেনকে টুপি পরাবে, এমন শর্মা ভূভারতে জন্মায় নি এখনো” শাসিয়ে আর মেরে মেরে বোধহয় কিছুটা ক্লান্ত হয়েই হাতের কাঠের রুলটা ছুঁড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। এককোণে ভয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া কুকুরছানার মত কুঁই কুঁই করছিল ডালিম। রামুদা সেই কোন কাল থেকে পরিবার নিয়ে এই সেনবাড়িতেই আশ্রিত। বউ মারা যাবার পর এই ডালিমকে নিয়েই থাকে গ্যারেজের পাশের ঘরটাতে। অন্দরমহলে ডালিমের অবাধ যাতায়াত। ফাইফরমাস খাটে, সুচরিতা ওকে পড়ায় টুবানকে দেখার ফাঁকে ফাঁকে। বছর তেরোর ছেলে, কিন্তু বেশ মায়া পড়ে গেছে ওর ওপর। খেতে খুব ভালোবাসে। ভুল করে কয়েকবার না বলেক’য়ে ফ্রিজ খুলে কেক, সন্দেশ খেয়ে ফেলে। শ্বশুর শাশুড়ি ননদ স্বামী সবার কাছে এটা একটু লুকিয়েই যায় সুচরিতা। কাছে গিয়ে ডালিমকে কাছে টেনে নিল সে। জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলোতে লাগল।
সৌরভ রুথলেস। বা তার চেয়েও কিছু বেশি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে বিয়ে হবার পরদিন থেকেই বুঝতে পারছিল সুচরিতা। মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবেগহীন একটা মানুষ। কাজপাগল, ডিসিপ্লিনড কিন্তু নিষ্ঠুর…বড় নিষ্ঠুর। পথে যেতে যেতে কেউ ভিক্ষা চাইলে দেওয়া বারণ, সাহায্য, দাতব্য থেকে শুরু করে পাড়ার পুজোর চাঁদা পর্যন্ত সব নিষিদ্ধ। বাড়িতে অতিথি এলে বেশি ভালোমন্দ খাওয়াতে গেলে সেটা সুচরিতার ‘আদিখ্যেতা’, টুবানের বন্ধুবান্ধব বা তাদের মায়েদের কোনো প্রয়োজনে বা আয়োজনে এগিয়ে গেলে সেটাও “বোকামো”, “মূর্খামি”। কথায় কথায় কদর্য ভাষার প্রয়োগ, সপ্তমে উঠে থাকা মেজাজ। দেখেশুনে সত্যিই ফেড আপ সুচরিতা। দয়া, মায়া, মমতা, সহানুভূতি এসব যেন ডিকশনারিতেই নেই সৌরভের। আর এই সবেরই পেছনে যে তার বাবা মায়ের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে, সেটা বুঝতেও ভুল হয়নি সুচরিতার। কাজের মাসি, ড্রাইভারদাদা, স্যুইপার ভাই, এমনকি স্বয়ং সুচরিতাও…সবাই ওঁদের প্রয়োজনের ব্যক্তি, তার বাইরে বা বেশি কিছুই নয়। দরকারকে আবেগের স্তরে টেনে আনার অযথা অভ্যেস নেই।
মাসদুয়েক আগে হঠাৎ অফিসের গ্রুপ ট্যুরে গিয়েছিল সৌরভ। ফিরে আসার পর থেকে একটা পরিবর্তনের আভাস মৃদু টোকা দিয়ে গেল সুচরিতার মনের দরজায়। যখনতখন ফোনে মগ্ন হয়ে যাওয়া, টাইপ করার সময় কঠিন ঠোঁটের চারপাশে জেগে ওঠা একটা অদ্ভুত হাসি, এমনকি সুচরিতার সঙ্গে কথা বলার সময় এক অচেনা সফটনেস যা বিগত দশ বছরের পক্ষে এক মূর্তিমান ছন্দপতন! এই তো গেল পরশুই, ড্রাইভ করতে করতে সিগন্যালে কাচ নামিয়ে সেভেন পয়েন্ট ক্রসিং-এর বাচ্চা মেয়েটাকে দশ টাকার নোট দিলো সৌরভ। আর একজনের কাছ থেকে গোলাপও কিনল! এমন এমন বিস্ময়ে চমকে যাচ্ছে সুচরিতা।
কলাবতীর কথা সুচরিতা জানতে পারল এর কিছুদিন পরে। ফোনটা ড্রেসিং রুমে রেখে স্নান করছিল সৌরভ। “Official” নাম লেখা ফোন এলো একটা। আজকাল রিংটোনেও বাজে “য়ু পুট ইয়োর আর্মস অ্যারাউণ্ড অ্যাণ্ড আয়্যাম হোম”। সুচরিতা কলটা রিসিভ ক’রে হ্যালো বলতে যাবার আগেই ওপার থেকে সেতারের ঝঙ্কারের মত একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ” এই তুমি কাল রাতে যাবার সময় ব্লু ফাইলটা ফেলে গেছো তো! ইশ্! কী ঘোর মশাইয়ের! কাটতেই চায় না যে!”
“হ্ হ্যালো!” কোনোক্রমে বলল সুচরিতা। এক সেকেণ্ড। কেটে গেল ফোন। আসল সংবাদটা দিল সুরজিৎদা; সৌরভের বন্ধু। ওভার ফোন। ” বৌদি! বলতে খুব খারাপ লাগছে কিন্তু না বলেও পারছি না…আপনি ইয়ে মানে… এত ভালোমানুষ…সৌরভ…সৌরভ…ইদানীং…কলাবতী গুপ্তা…আমাদের অফিসের নতুন ট্রেনি…বৌদি! বৌদি শুনছেন!” সব শুনল সুচরিতা। সবটাই। সার্চ করে কলাবতী গুপ্তাকেও পাওয়া গেল। প্রোফাইল ছবি। অপূর্ব সুন্দর! মেঘের মত চুল, চন্দনের মত গায়ের রঙ, তিন ভুবনের রহস্যে ভরা চাউনি। বিকেলে ছুটির পর আকাশে যে আলোটা ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি, আশ্চর্য রূপ আর লাবণ্যের অতুলনীয় সমানুপাত। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল সুচরিতা। কেমন একটু মায়াও হ’ল সৌরভের জন্য। আহা! এমন মানুষকে দেখে তো যে কেউ…তবে হ্যাঁ, সৌরভের স্বভাব অনুযায়ী সে ঠিক ‘যে কেউ’ নয় বলেই জানত সুচরিতা। যাক্, সৌরভেরও তাহ’লে…
অজান্তেই হেসে ফেলল সুচরিতা।
সেদিন একটু বেশি রাতে বাক্সভর্তি নতুন গুড়ের সন্দেশ নিয়ে ফিরল সৌরভ। ডেকে পাঠালো ডালিমকে। মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে হাতে গুঁজে দিল বাক্সটা। আর আদর মাখিয়ে বলল, “শোন। মন দিয়ে লেখাপড়া কর। ক্লাস বাড়ছে। সামনের মাস থেকে একজন অঙ্কের টিউটর রেখে দেব তোর জন্যে, কেমন?”
সুচরিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ” রিতা! শিগগির রেডি হয়ে নাও। আজ আমরা একটু লেট নাইট লং ড্রাইভে যাব।”
স্ট্রীটল্যাম্পের বাড়াবাড়িতে ভেসে যাওয়া নির্জন রাস্তায় পক্ষীরাজের মত ছুটছে ওদের জীপ কম্পাস। হাওয়াটাও কেমন এলোমেলো। এলোচুলে ঝরাপাতার ভীড়। স্টিয়ারিঙে উৎফুল্ল সৌরভ। বছর দশেক বয়েস কমে গেছে। ওর চিরগম্ভীর মুখের নির্মল হাসির দিকে বারবার চায় সুচরিতা। কে এই কলাবতী গুপ্তা, কেন, কখন, কিভাবে, কোথা থেকে সে সৌরভের জীবনে এলো, জানে না সুচরিতা, জানতে চায়ও না। যেমন জানে না, এই উতল হাওয়া কোনো ভীষণ ঝড়ের পূর্বাভাস না কি কোনো অনাহূত বসন্তের গৌরচন্দ্রিকা…শুধু জানে, তার মাধ্যমে যা হয়নি, অন্য কেউ সেই অসম্ভবকে সম্ভব করছে। সৌরভের জানলাগুলো খুলে যাচ্ছে, ঢুকছে পৌষের রোদ, বড়দিনের ছুটির হাওয়া আর গুচ্ছ গুচ্ছ চন্দ্রমল্লিকার হিল্লোল…ঢুকছে ভালোবাসা নামের রংধনুর রেশ যা এতদিন তার কাছে অধরাই ছিল; জানলা খোলার হাতটা সুচরিতার না-ই বা হ’ল।
“তারানে নয়ে পুরাণে”র রাতের আসরে বাজছে, “দিল দেনা ভি হ্যায়, গম লেনা ভি হ্যায়…” চোখটা একটু ঘষে নিয়ে সুচরিতা মন দিয়ে শুনতে লাগল।