গল্পঃ শূন্য মাইল

শূন্য মাইল
ড. মুকিদ চৌধুরী
রাত্রি।
আমি এক বৃদ্ধ। অসুস্থ। বীর্যস্খলনেরও কোনো শক্তি নেই আর। এর চেয়ে আরও খারাপ অবস্থা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তখনই শুনতে পাই একটি শব্দ। শব্দটি এই প্রথম শুনছি তা নয়। ঠিকই অনুভব করছি, জয়নাবের শোবারঘর থেকে শব্দটি আসছে। হয়তো-বা সে কারও সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত। ওর শয়নকক্ষ অবশ্য আমার ঘরেরই পাশে। ভাবি, এ হয়তো আমার কল্পনা। আসলে তা কল্পনা নয়, বাস্তবই। আমরা একটি স্টোডিয়ো বাড়িতে বসবাস করি। আমার ঘরের দরজা কখনোই বন্ধ করা হয় না। রাত্রিতে যদি জয়নাবকে ডাকতে হয় তাই দরজাটি খোলাই রাখা হয়। আমি স্থির। চিন্তাশীল। বস্তাবেই অবস্থান করছি; যদিও আমার কল্পনাশক্তি বুদ্ধি আর স্মৃতিশক্তি ভীষণ প্রখর, তবুও স্বপ্নজগৎ অনেক আগেই ত্যাগ করেছি। অতীত থেকে ভেসে আসা কোনো স্মৃতিও আমাকে আর আহ্বান করে না। হঠাৎ ফিসফিস কথাবার্তা কানে ভেসে আসতে থাকে। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে। বুকটা গুরগুর করছে। চোখ অশ্রুতে প্লাবিত হয়। অশ্রুবন্যা যাকে বলে। মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে যমদূত আমার কক্ষে হানা দেবে। মৃত্যুচিন্ততেই আজকাল রাত্রির বেশিরভাগ সময়টা কাটে। অনাবরত মৃত্যুরহস্য হাতছানি দিয়ে ডাকে। ফিসফিস কথাবার্তা একবার শুরু শুরু হলে সে থামতে জানে না। কোথাও কমা, কিংবা দাড়ি দিতে জানে না। ফিসফিস কথাবার্তা আমার কানকে বধির করে দিচ্ছে, শিয়ালের চিৎকার কিংবা পুশিলগাড়ির সাইরেন বা অ্যাম্বোলেন্সের জরুরি-সংকেতের মতো।
সকাল।
জয়নাব শয্যাত্যাগ করে হস্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে ঢুকল। চোখদুটিতে যেন ক্রোধের জ্বালা। আমি শুয়ে শুয়ে আনমনে তার কথা শুনতে থাকি। “তুমি দিন দিন অবোধ শিশু হয়ে যাচ্ছ। আমি জানি তুমি রাগ করছ। কিন্তু আমাকে স্বাধীনভাবেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে।” চোখের অভিমান আরও ঘন হলো। হালকা রঙের ছাপা সালোয়ার-কামিজে জয়নাবকে কত সুশ্রী, নির্ভার ও সুন্দর দেখাচ্ছে তা যদি সে জানত। এই বিলাতের ফ্ল্যাট বাড়ির ভিড়েও একপ্রকার জীবন থাকে। লিপট সময়-অসময় ওপর-নিচ করে। শোনা যায় মানুষের চলাচল। মাঝেমধ্যে কোলাহল। কথাবার্তা। হঠাৎ হঠাৎ-ই স্টিলের দরজাটা শব্দ করে বন্ধ কিংবা খুলে যায়। মোবাইফোন বেজে ওঠে। সঙ্গে সংগীতের ঝংকার। রাগে গরগর করতে করতে উড়–নিটা উড়িয়ে, কানের রিং দুলিয়ে জয়নাব চলে গেল বাথরুমে। একটা অনেক কষ্টে তৈরি করা শান্ত সকাল খানখান হয়ে গেল। আমি জানি, সে-ই জানে কত কষ্টে, সমস্ত শক্তি কতখানি প্রয়োগ তবেই এইরকম একটা শান্ত সকালে পৌঁছনো যায়। বাথরুমে জয়নাব ঢুকে তার সেইভযন্ত্রটি নিজের শরীরের চালিয়ে দিলো। শব্দগুলো আমার কানে ঘাতপ্রতিঘাত করতে থাকে। শব্দটি যখন নিথর হয়ে আসে তখনই বাইর থেকে একটি পাখির কাকলি শুনতে পাই। অতি আগ্রহের সঙ্গে জানালা পথে আকাশের দিকে তাকাই। আকাশ কি এমন সাদা হয়? হয়। নীল আকাশ সাদাটে হয়ে আছে। কিংবা সাদা মেঘে ঢেকে আছে সমস্ত আকাশটা। আকাশটা যেন ধোবার বাড়ির পাটভাঙা থান কাপড়ের মতো সাদা। চারদিকে একটি এমনই সাদা আকাশ। চারদিকে যেন ভেসে বেড়াচ্ছে আরও কিছু সাদা প্রেত– উন্নয়নের প্রেত। বিলাতের এই অঞ্চলে উন্নয়নের কাজ চলছে। হয়তো-বা এই উন্নয়নের শেষ আমার দেখা হবে না। আমি অবশ্যি এই অঞ্চলের ঝরাজীর্ণ পরিবেশ দেখেই কড়িটা বছর কাটিয়ে দিয়েছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়টা আত্মগোপন করে রয়েছে এই অঞ্চলে। না হলে তো সবকিছুই তো নিকষ পানশে হয়ে যেত। উন্নয়ন আমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়, ক্লান্তিময়। আমার জীবনের দীর্ঘসময় পুরাতনকে ধরে বেঁচে আছি। উন্নয়ন শুরু হওয়ার সঙ্গেই আমার জীবনের পতন শুরু হয়। নিম্নমুখী ধাপের দিকে আস্তেধীরে এগিয়ে যাওয়াটা আনন্দের সঙ্গে মেনে নিয়েছি। সত্য সব সময়ই বিস্ময়কর।
জয়নাব তাড়াতাড়ি স্নান সেরে রান্নাঘরে পৌঁছে গ্যাস জ্বালিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে, ঠিক সাতটায় আমাকে খেতে দিতে হয়। রান্নাঘর ঝকঝকে করে মুছে যখন সে আবার আমার ঘরে ফিরে এলো, তখন সাতটা বাজার কয়েক মিনিট বাকি। চোখের পাতাগুলো কুঞ্চিত করি তার দিকে তাকাই। মুখ শুষ্ক। আমার পা-দুটি অবশ্য অবশ। জোর করে তোষকের ওপর গড়িয়ে অনেক কষ্টে শরীরটা এলিয়ে দিলাম ওর দিকে। হাত প্রসারিত করতে চায়ের ভাঁরটা টেবিল থেকে কার্পেটের ওপর গড়িয়ে পড়ল। পতনের বিকট– হাঁড়ির ওপর হাতুরে পেটানোর শব্দে আমি অস্থির। ক্রোধ সৃষ্টি হয়, নিজের ওপরই। তারপর নিদারুণ দুঃখ হয়, নিজের ওপরই। আবার ক্রোধ, নিজের ওপর, সম্পূর্ণ নজের ওপর। একটা কথাও স্বপক্ষে বলতে পারিনি। জয়নাবই কথা বলে। আমাকে অবিশ্বাসী মানুষ হিসেবেই সম্বোধন করে। “অতিরঞ্জিত কল্পনা তোমাকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলেছে। আমার খুঁত আবিস্কারে তুমি ওস্তাদ। অশান্তির গুরু।” অবশ্যি এও সত্য যে, আমি কল্পনাকে জীবিকা-উপার্জনের প্রথম হাতিয়ার করেছিলাম। কল্পনাই এই পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক বস্তু। শ্বাস ধরে রেখে করিডোরের ঝাপসা আলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। সিগারেটের গন্ধ আমার নাকে এসে ধাক্কা খায়। তীব্র তীক্ষ্ণ ইচ্ছে হয় জয়নাবকে জিজ্ঞেস করতে করিডোরে দাঁড়িয়ে কে সিগারেট টানছে। কিন্তু জয়নাবের মুখের দিকে তাকাতেই কথাগুলো প্রকাশ করতে পারিনি। চোখদুটি সুশ্রী তো বটেই, ভারি মিষ্টিও বটে। ওর চোখের চাওয়ায়, ঠোঁটের মিষ্টত্বের সঙ্গে একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে। হয়তো-বা একটু উন্নাসিক। অনন্ত কোনোদিনই সে যেচে অন্যের সঙ্গে ভাব করতে যায়নি। কিন্তু আমার সঙ্গে ভাব হওয়ায় জয়নাবের এত ভালো লেগেছিল; যেন কোনো দূর গ্রহের সঙ্গে নিজের কক্ষপথে দেখা হয়ে যাওয়া নক্ষত্র। কিন্তু আজ, কুড়ি বছরের সংসার করতে করতে গ্রহত্ব নক্ষত্রত্ব কেমন যেন আস্তে আস্তে ক্ষয়ে গেল। চিন্তা করি, গত সপ্তাহেও জয়নাব আমার কেমন যত্ন নিয়েছিল। চিরুনি দিয়ে চুল পরিপাটি করে দিয়েছিল। সরষে তেল দিয়ে আমার সমস্ত দেহ মালিশ করেছিল। আমার বুক, আমার কান ঘষেছিল। মোজা সরিয়ে পায়ের পাতা ও আঙুলগুলো সযত্নে বুলিয়েছিল।
করিডোরের মানুষটি অদৃশ্য, কিন্তু অধ্বনিত নয়, এমনকি গত রাত্রির শব্দগুলো এখনো তলিয়ে যায়নি। আমি সজাগ ছিলাম, যদিও ঘুমের বড়ি খেয়ে বিছানা নিয়েছিলাম। জয়নাব অবশ্যি নিশ্চিত করেছিল আমি ঘুমের বড়ি ঠিকমতো গিলেছি কী। সে স্বার্থপরের মতোই উদগ্রীব ছিল। অস্বস্থির সংকেত। আজকাল সে আমার প্রতি বেশিমাত্রায় নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে। তখনই করিডোরের লোকটি আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল। ওর ছোটো করে চুল ছাঁটা। ঈষৎ চৌকো মুখ। ভীষণ ফর্সা। এক সমর্থ পুরুষ। তারপর সে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। জয়নাব চৌকাঠ ধরে ম্লানহাসি ছুড়তে থাকে। বললাম, শুভ সকাল উইলিয়াম। বসো, আমার কাছে বসো। তুমি তাহলে রাতে সেন্ট্রল লন্ডন ফিরে যাওনি?
অতিশয় তরল প্রকৃতির উইলিয়াম বলল, না। এখনই চলে যাব। তোমার কাছে এসেছি বিদায় নিতে।
যাও। তারপর জয়নাবের স্বার্থের খাতিরে যোগ করি, এখানে থেকে গেলেও আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।
উইলিয়াম মাথা ঘুরিয়ে জয়নাবের দিকে তাকাল। জয়নাব উইলিয়ামের দিকে। সবকিছু জলের মতো সুস্পষ্ট।
উইলিয়াম মাথা নেড়ে বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে এখন যেতেই হবে। বিদায়।
বিদায়। আবার দেখা হবে।
উইলিয়ামের চোখে চোখ রাখি। গাঢ়, গভীর দৃষ্টি। এই দৃষ্টি সহ্য করা যায় না। চোখ ফিরিয়ে নেই। উইলিয়ামের পিছু পিছু জয়নাব কোনো কথা না বলেই দরজাটা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রাত্রি।
কুড়ি বছরের আমাদের দাম্পত্ত্য-জীবন। আমাদের বয়সের ব্যবধানও কুড়ি বছরের।
উইলিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলি, শুভরাত্রি।
উইলিয়াম বলল, শুভরাত্রি। ভালো ঘুম হোক তা-ই কাম্য।
সকালে আবার দেখা হবে।
অবশ্যি।
তারপরই ডাবল এক্সফ্রেসোতে চুমুক বসাই। প্রতি রাত্রিতে ঘুমে যাওয়ার আগে এক পেয়ালা চিনিবিহীন এক্সফ্রেসো পান করা আমার অভ্যাস। শ্বাস রুদ্ধ করে উপভোগ করি তেতু-কফির স্বাদ। তখনই মনে হলো, আবারও তাদের হালকা ও আনন্দঘন কথাবর্তা শুরু হয়েছে; থেমে থেমে। অসাধারণ হয়তো-বা তাদের দেখাচ্ছে। নগ্ন শরীর শয্যায় সুখক্লান্ত। মনে হচ্ছে, এই প্রথম আমার বিশ্বস্ত স্ত্রী নিজেকে অন্যপুরুষে বিসর্জন দিচ্ছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস এ-ই। অবশ্য অন্যের কথায় কান দেই না। বিশ্বাসও করি না। জয়নাব আমার কাছে সবসময়ই বিশ্বস্ত মানুষ। তবে এখন সে অসাধু। সাধারণত সে সংসারজীবনে পরিপাটি, ভদ্র। বন্ধুরা এমনটাই বলে থাকে। শব্দগুলো চলতে থাকে। আমি আতঙ্কিত। উত্তেজিত। জানি, যৌনক্ষুধা নিম্নগামী; কামশক্তিতে আত্মঘাতি; ঈষাপরায়ণ। যৌনক্ষুধার কখনই মৃত্যু হয় না। আশি বছরের এক বিলাতি ব্যক্তির রতিসংগমরত কথাও আমার জানা আছে, “আমার এখনো প্রয়োজন হয় একটা শরীরের, প্রচণ্ড যৌনোত্তেজনা মেটানোর জন্য।” জয়নাব এখন কী করছে! এখন সে একটা সক্ষম শরীর পেয়েছে। এই শরীরে হয়তো-বা সে হারিয়ে যাওয়া অতীতটাকে পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছে। পাগলের মতো হয়তো-বা চুমু খাচ্ছে। কল্পনা করতে থাকি, তাদের শরীরের পাশাখেলা। দিব্যদৃষ্টিতে যেন দেখতে পাচ্ছি– আমার কল্পনা অসাধারণ, জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তো চিত্রনাট্য নির্মাণ করে কাটিয়েছি, কল্পনার শীর্যেই অবস্থান করেছি– বাস্তবতা ও কল্পনা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমি দর্শক মাত্র। কিন্তু দর্শকের দৃষ্টিতেই বাস্তবতা ধরা দেয় অসাধারণভাবে– অবিশ্বাস্য জগৎ নির্মিত হয়। আর যৌনলক্ষণ– আমি এখন অর্ধপঙ্গু– কুমড়োর মতো বেশিরভাগ সময় কাটে মাচায়। তারপরও আমার যৌনক্ষুধা এখনো ম্লান হয়নি, মাঝেমধ্যে তীব্র হয়েই প্রকাশ পায়। এখনো জয়নাবের শরীরের গন্ধ পাই। তার কামস্পর্শ অনুভব করি। আমার শেষ ও একমাত্র ভালোবাসাই তো জয়নাব। তার দেহকে এখনো কল্পনায় ভালোবাসি। আমার চোখে এখনো ভেসে বেড়ায় ওর নগ্ন দেহ। কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছে অন্যের কাছে। এগিয়ে যাচ্ছে তার হাতদুটি অন্যের বুকে। হয়তো-বা জয়নাবের চুলগুচ্ছ শাসিত হচ্ছে অন্যের মুঠোতে। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠান্ডায় শরীর কাঁপছে। ইচ্ছে হচ্ছে বাইরে দাঁড়িয়ে ভেজার; কিন্তু আমি তো অর্ধপঙ্গু। কল্পনাশক্তিতেই বৃষ্টিকে উপভোগ করতে হবে। আমার কল্পনাশক্তি মাঝেমধ্যে দেবদূতকেও পরাজিত করে। এই হচ্ছে জয়নাবের প্রধান সমস্যা। এর বেসামাল হওয়ার একমাত্র কারণই হচ্ছে আমার চিত্রনাট্যের সঙ্গে জড়িত থাকা। কিন্তু কল্পনাশক্তির কারণেই তো আমি অনেক সফল চিত্রনাট্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি। দাপটের সঙ্গেই কাঁপিয়েছি চিত্রনাট্যজগৎ। তবে সংসার… জীবনের পথকে পরিবর্তন করে দেয়; অথবা উন্মাদের মতো ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়ি, পরে ব্যর্থপ্রেমে জীবনটাই বদলে যায়; অথবা প্রেমে ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে জীবনপথ কাঁটাতারে ভরে উঠেছে; আজীবনের জন্য। তারপরও চলে জীবন নিয়ে পর্যালোচনা। কে ভেবেছিল এই ভাবেই আমার জীবনটা পালটে যাবে। এখন আমার অফুরান্ত সময়—জীবন নিয়ে সমালোচনা, পর্যালোচনা করার। সমস্ত রাত্রিই তো পড়ে থাকে চিন্তা করার জন্য। বিবেচনার জন্য। রাত্রিতে মনে হয়, আগামী কাল তো রয়েছে বিশ্রামের জন্য। তখনই না হয় বিশ্রাম নেব; ঘুমাব।
সকাল।
করিডোরে এই মুহূর্তে উইলিয়ামের কোটটি ঝুলানো নেই। হয়তো-বা সে নিঃশব্দে পালিয়েছে। যতটুকু মনে পড়ে, সে এই বাড়িতে কমপক্ষে দশ-বারো রাত্রি যাপন করেছে। যখন সজাগ তখনো তাকে দেখেছি এই বাড়িতে আসতে। কখনো কখনো সে সকালের নাস্তা করার সময় আমার সঙ্গে আলাপ করে। ভারতবর্ষের খবর নিতেই কথা শুরু করে। তার খাবারের ধরন, আমার কাছে. খরগোশের মতো– যা পায় তা-ই খায়। আজকাল অবশ্য জয়নাবের রান্না তার প্রিয় হয়ে উঠেছে। তাই তো মাঝেমধ্যে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে কখনো কখনো এঁটো বাসনপত্র ধুঁয়ে দিয়ে যায়। কিছুদিন যাবৎ এই বাড়িটিই তার প্রধান আশ্রয়স্থালে পরিণত হয়েছে। এখান থেকেই সে নির্দ্বিধায় অন্যের সঙ্গে কথা বলে। জুতো খুলে দরজার পাশে রাখে। আমার ঘরে এসে আরামকেদারায় পা তুলে বসে। মাধেমধ্যে রেডিয়ো ছেড়ে হালকা ধ্রুপদী সংগীত শুনে। এসবের মধ্যেই জয়নাব ও উইলিয়ামের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাত্রিতে দেহ বিনিময় হয়। মাঝেমধ্যে আমার নজর এড়িয়ে উইলিয়াম নিষ্ক্রান্ত হয়। হয়তো-বা সে আমার দৃষ্টির সম্মুখে পড়তে চায় না। কিংবা আমার প্রশ্নের মুখোমুখি এখনই হতে চাইছে না, তিরস্কারের ভয়ে হয়তো-বা। ওকে ভালোমতোই জানি। ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে যে চিন্তা করি না তা নয়, ভালোভাবেই করি। সে অবশ্যি ফিরে আসবে, দেড়ি করে নয়, বরং শীঘ্রই। অতি উদ্বেগের সঙ্গে তার প্রতিক্ষায় থাকি। ভাবি, জয়নাবের সঙ্গে ওর সম্পর্ক কেমন করে এগিয়ে যাচ্ছে। কী বিপদ্দজনক পথেই না বেছে নিয়েছে। পরকীয়া প্রেমে উইলিয়ামের মন এখন আবেগাপ্লুত। মস্তিষ্ক বিকার। সঠিক চিন্তা করতে পারছে না। একটা আশ্রয়ের আগ্রহে সে এখন চোরাবালির ওপর এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হয়তো-বা ওর ও আমার সম্পর্কটাই ঈর্ষার। সে আমাকে যে কারণে হিংসা করতে পারে আমিও সেই কারণেই তাকে হিংসা করতে পারি। তবে আমি ওর চেয়ে বাস্তববোধসম্পন্ন। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। স্বাধীন ইচ্ছার মানুষ। হয়তো তাই পঙ্গুত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, লাঠিতে ভর দিয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে চলি; অন্তত এই মুহূর্তে