গল্পঃ যদি কিছু আমারে শুধাও

যদি কিছু আমারে শুধাও
অদিতি ঘোষদস্তিদার
অফিস যাবার পথে অটোটাতে উঠেই ধৃতির মন ভালো হয়ে গেলো। অটোচালকটি বেশ শৌখিন। জুঁইফুলের মালা ঝুলিয়েছে সামনের আয়নায়, FM রেডিওতে গান বাজছে, লারেলাপ্পা আধুনিক গান নয় – লতার পুরোনো ক্লাসিকাল! আহা! ধৃতির কি প্রিয় এই গানগুলো! আগে কত শুনেছে, একই লাইন বারবার শুনে লিরিক লিখেছে খাতায় – কোন সে যুগের কথা! এখন গানশোনা! সময় কই? চাকরি, ছেলে, সংসারের চাপে সব গেছে হারিয়ে! আজ কতদিন পর মনটা আবার ভালো হয়ে যাচ্ছে শুনে, “ঝনঝন ঝনঝন পায়েল বাজে”, রাধার অভিসার! সব বাধা তুচ্ছ করে চলেছে প্রিয় মিলনে! ধৃতির মনে পড়ে যাচ্ছিলো ইলেভেন টুয়েলভের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বৈষ্ণব পদাবলী পড়ার কথা। বাবা কি যত্ন করেই না পড়িয়েছিলো। রাধার প্রেম,অভিসার, মাথুর বা বিরহ সব সব। মা তো রেগেই যেত মাঝে মাঝে, “কি যে সব আলোচনা করো মেয়ের সাথে, কে বলবে তুমি ওর বাবা!”
বাবা হাসতে হাসতে বলতো, “আরে জানো না, শাস্ত্রে বলেছে ষোলো বছর হয়ে গেলে ছেলে মেয়ে বন্ধু হয়ে যায়!”
স্মৃতি সততই সুখের! সকালটা সব মিলে সুন্দর। অটো থেকে নেমে যাবার পরও ধৃতির মনে বার বার সেই গানের সুরটাই ফিরে ফিরে আসছে! অফিসে ঢোকার আগে ফোনটা ভাইব্রেশন মোডে রাখতে গিয়ে একঝলক ফেসবুক দেখে নিলো ধৃতি। প্রতিদিনের অভ্যাস! ফেসবুকের টাইমলাইনে ফুটে উঠেছে, ‘What’s on your mind, Dhriti?’ মনে মনে বারে বারে ঘুরে ঘুরে আসছিল যে গানের লাইনটা, ঝট করে সেটাই টাইপ করে ফেললো, “ম্যায় দুনিয়াকি রীত নিভাউ না প্রীত নিভাউ”।
সুরটা গুণগুণ করতে করতেই অফিসে ঢুকে পড়লো ধৃতি।
ঢুকতেই মৃগাঙ্কর সাথে দেখা, “এই তো তুমি এসে গেছ, দারুন খবর – নতুন প্রজেক্টটা এসে গেছে! সুবীরদা আর্জেন্ট মিটিং ডেকেছেন।”
ব্যস! ধৃতি ঢুকে পড়লো কাজে! কাজ, কাজ আর কাজ! অন্যদিন লাঞ্চব্রেকে একটু আধটু ফেসবুক দেখে, মাঝে মাঝে মাকে ফোন করে, আজ আর কিস্যু হলো না! লাঞ্চও হলো না। পেটে পড়লো দু’কাপ কফি শুধু।
কাজ করতে করতে কখন যে সাড়ে সাতটা বেজে গেলো খেয়ালই নেই, পুরো টীমটাই বড়ো ব্যস্ত আজ। আটটা বাজতে ধৃতি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লো। মাথাটা ধরেছে। ইস বড্ডো দেরি হয়ে গেছে আজ। দিবাকর নিশ্চয়ই এসে গেছে। সাতটার বেশি দেরি হয় না ধৃতির কক্ষনো। কল্পনাদি মানে বুবুনকে যিনি দেখেন তিনিও নিশ্চয়ই বেরিয়ে গেছেন। যাক গে! কি আর করা যাবে! মাঝে মাঝে তো এরকম হয়ই, তবুও নতুন প্রজেক্টটায় কাজ করতে পারবে এটা ভেবেই মনটা আবার ফুরফুরে হয়ে গেলো। অটোর অপেক্ষা না করে একটা ট্যাক্সিই ডেকে নিলো ধৃতি, দু’বার করে অটো বাস না পাল্টে সোজা টানাই বাড়ি চলে যাবে আজ।
ট্যাক্সিতে বসে জানলাটা খুলে দিলো ধৃতি। একঝলক ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেলো। আর তখনই মনে পড়লো তার ফোনের কথা। এই রে? মিটিঙে ঢোকার আগে ফোন যে সুইচড অফ করেছিল তা তো আর খোলাই হয় নি! missed call আছে বেশ কয়েকটা। মায়ের, দিবাকরের, কল্পনাদির। চিন্তা করেছে সারাদিন ফোন পায়নি বলে।দিবাকর টেক্সটও রেখেছে বাড়ি ফিরে এসে ঠিক সময়ে কল্পনাদিকে ছেড়ে দিয়েছে বলে। যাক নিশ্চিন্ত! মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে বসে ভালো করে কথা বলবে ভেবে দিবাকরকে “বাড়ি ফিরছি” টেক্সট রেখে দিলো ধৃতি। এবার অভ্যেসের বশে ফেসবুকে ঢুকল।
87 notification!
কি ব্যাপার? খুলতেই দেখে সেই যে সকালে পোস্টটা দিয়েছিলো timeline এ, “ম্যায় দুনিয়াকি রীত নিভাউ না প্রীত নিভাউ”, তাতে গুচ্ছের কমেন্ট!
” কি ব্যাপার ইয়ার! ডুবে ডুবে জল খাচ্ছো?”
“কবে এগোলো এতো দূর?”
কাকিমা লিখেছে, “এসব কি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওইটুকু বাচ্ছা তোর!”
নমিতা বৌদি লিখেছে, “কে রে? ইনবক্স-এ বলবি?”
ধৃতির ভেতর থেকে দমকে দমকে হাসি উঠে আসছিলো! আরে কি এসব? মাথা টাথা খারাপ আছে নাকি লোকজনের? একটা সামান্য গানের লাইন …উফফ এরা পারেও বটে! বাড়িতে গিয়ে দিবাকরকে রসিয়ে রসিয়ে বলতে হবে আজকের ঘটনাটা!
দিবাকর নিশ্চয়ই আবার বলবে, “দেখলে এই জন্যেই আমি সোশ্যাল মিডিয়ার সোশ্যাল নই!”
গোটা পথটা এইসব ভেবে মনে মনে দমফাটা হাসি হাসতে হাসতে চলে এলো ধৃতি।
ট্যাক্সি ভাড়া চুকিয়ে হাউসিং কমপ্লেক্স এর গেটে ঢুকতেই দেখা মন্দিরাদির সাথে। মন্দিরা সামন্ত। ধৃতি শুনেছে উনি নাকি কি সব নারী উন্নয়ন সমিতি টমিতি করেন। পরিষ্কার করে ঠিক জানা নেই তার।
ধৃতিকে দেখেই তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে এলেন মন্দিরাদি।
“কি ব্যাপার Mrs Roy? Anything wrong? আপনার হাসব্যান্ড কি আপনাকে অসম্মান করেন? আমাকে নিঃসঙ্কোচে জানাবেন। উকিল টুকিল সব ব্যবস্থা আমি করে দেব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন, বাচ্ছা আপনার কাছেই থাকবে……” এক নিশ্বাসে ঝড়ের গতিতে বলেই চললেন মন্দিরাদি।
হতবাক ধৃতি একরকম জোর করেই তাঁকে থামিয়ে বলে ওঠে, “কি বলছেন দিদি আবোল তাবোল! কেনই বা বলছেন?”
“আরে সংকোচ কিসের? আমি তো আপনার প্রতিবেশী! না বললেও বুঝতে পারি! আপনিই তো ফেসবুকে লিখেছেন আপনি confused! কিচ্ছু ভাববেন না, we are always at your service!”
মন্দিরাদিকে প্রায় ঠেলে সরিয়েই হনহন করে নিজের ফ্ল্যাটের দিকে এগিয়ে গেলো ধৃতি। কি সব লোকজন হয়েছে! যারা সত্যিকারের নির্যাতিত তাদের খোঁজও এরা বোধহয় রাখে না!
বাড়িতে ঢুকতেই বুবুন ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বুবুনকে দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ধৃতির আবার মনে পড়লো সারাদিনের ঘটনাগুলো। আবার দমফাটা হাসি এলো ভেতর থেকে।
রাতে খেতে বসে রসিয়ে রসিয়ে সারাদিনের গল্পগুলো একে একে শুরু করল ধৃতি। নতুন প্রজেক্ট, ফেসবুক পোস্ট থেকে শুরু করে মন্দিরাদি পর্যন্ত সবটা। কোন দিকে না তাকিয়ে একটানা বলে যাচ্ছে আর হাসছে।
হঠাৎ মনে হল অপরপক্ষ যেন বড্ড বেশি চুপচাপ।
“কি গো কিছু বলছ না যে, জানি ফেসবুকের কথা বলে আবার আমাকে ..,”
কথা বলতে বলতেই দিবাকরের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো ধৃতি। কেমনভাবে যেন চেয়ে আছে । মুখে হাসির লেশমাত্র নেই। চোখে শূন্য দৃষ্টি।
চোখে চোখ পড়তেই দিবাকর আস্তে আস্তে বললো, “অফিস থেকে ফিরে এতো গল্প তো কখনো করো না! খেতে খেতেই তো তোমার হাই ওঠে রোজ! তুমি সত্যি সত্যি গানটা শুনেই পোস্টটা দিয়েছিলে তাই না ধৃ?”