গল্পঃ মেয়েটি

গল্পঃ মেয়েটি

মেয়েটি
হোমায়রা খাতুন হুমা

মেয়েটি মেধাবী।গর্ভে আসার পরেই মা সখ করে নাম রেখেছিলেন জয়ন্তী ; জন্মের পর সবার এক প্রশ্ন নামটি কি মুসলিম হলো ? শুনতে শুনতে অস্হির,
— না মুসলমান নাম না,তাতে আপনাদের কি!
আমার মেয়ে একদিন বিশ্বকে জয় করবে (মনে মনে বল্লো সে)।শুধু নাম রাখা নিয়েই কতশত কথা যে এজন্য শুনতে হয়েছে রানুকে ওফ্। এ নামটি রাখায় মহাভারত যেন অশুদ্ধ হয়ে গেছে।
যাক্ দিন যায় মেঘের ভেলায় কখনো উজ্জ্বল সূর্যের আলোয়।অনেক যুদ্ধ,নানান রকমের ঝড়ও সামলাতে হয়েছে রানুকে এ মেয়েটিকে নিয়ে।

রানুর একটি ছেলেও আছে।ছেলেটিও মেধাবী।মেয়ের পাঁচ বছর পর ছেলের জন্ম।নাম জয়।হায় এ নিয়েও কম যায় নি আত্মিয়স্বজনের হাউকাউ। আল্লাহর অশেষ রহমত রানুর মেয়েটি মিষ্টি,ঘন চুল,আকর্ষণীয়,বুদ্ধিমতি।
বিপদ তো সেখানে না,বিপদ হচ্ছে মেয়েটির গুণাগুণ নিয়ে।গান,আবৃত্তি,নাটক,
উপস্হিত বক্তৃতায় পুরস্কারে পুরস্কারে ভরপুর ঘর।ঈর্ষায় আত্মীয়স্বজনদের কত কি কথা গো, শুনতে শুনতে কানটি পেকে গেছে তার।

এসএসসিতে রেজাল্ট ভাল হয়েছে।নিজ পছন্দের কলেজে ভর্তি হয়েছে।এখন
মেয়েটি কলেজে পড়ে।এবার মেয়ের ইচ্ছে সে সাইকেল চালিয়ে কলেজ যাবে।
রানু এখন কি করবে?শুনেই রানুর নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগার। ভালমন্দ কার সাথে পরামর্শ করবে?এতদিন তো একরকম জোর করেই সব করেছে,সব বাধাকে পেরিয়ে এসেছে একক মনোবলে।স্বামীর সাথে করেছে নিরব যুদ্ধ। ছেলের বেলায় বাবার সবকিছুতে রাজি।মেয়ের জন্য কিছু বল্লেই এক কথা, –তুমি বুঝো ঠিক না বেঠিক।
ঘরে বাইরে নারীদের এই যে একক বুঝাপড়া যেখানে কেবল আল্লাহই সঙ্গী।এখন কি করবে রানু?মেয়েকে না করলে কিছুতেই শুনবে না।
তারা থাকে মিরপুর আর কলেজ হচ্ছে ধানমন্ডি।
মেয়েটিকে কোনোদিন কোনো কিছুতে না তো করেনি,না শুনে অভ্যস্হ না ও।এখন না করলে মন ভেঙ্গে যাবে।ভাবতে ভাবতে রানু প্রায় বদ্ধ উন্মাদ।
–আমি সাইকেল চালিয়ে কলেজ যাব,আব্বুকে বলো সাইকেল কিনে দিতে,ও আম্মু বলো না!
–জয়ন্তী তুমি কি করে ভাবলে এত ব্যস্ত রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে কলেজ যাবে। নিরাপত্তার দিকটি কি একবারও ভাবলে না?
— আম্মু আমি সাবধানে চালাবো। তুমি মোটেও চিন্তা করো না।কিছুই হবে না।
–আমি কিছুতেই তোমার আব্বুকে বলতে পারবো না।
–আম্মু জয় কিছু চাইলে তো না করো না, আজ আমাকে না করছো কেন?
মনটা ছ্যৎ করে উঠলো রানুর।মেয়ে বলে কি! ওকি জানে না, দেখে নি ওর আবদার মেটাতে আমাকে কত সুখ-আহ্লাদ বিসর্জন করতে হয়েছে! মনে গভীর অভিমান জমলো। জয়ন্তী বলেই যাচ্ছে -আম্মু ও আম্মু..
ওর কাছ থেকে সরে রান্নাঘরে গিয়ে চোখের পানি মুছলো রানু। জয়কে স্কুল থেকে আনার জন্য বেরিয়ে গেল –এই মেয়ে দরজাটা বন্ধ করো, আমি স্কুলে যাচ্ছি জয়কে আনতে।
রাতে জয়ও চিৎকার করা শুরু করলো –আব্বু আপুকে সাইকেল দিলে আমাকেও দিতে হবে।
–ঠিক আছে,দুজনকেই দিবো।
বুঝা গেল জয়ন্তী ওর আব্বুকে রাজি করিয়ে নিয়েছে।ওর আব্বু বল্লো
–কাল বংশাল নিয়ে যাবো,সবাই রেডি থেকো।
সন্তান বড় হয়ে গেলে মাকে অতটা আর প্রয়োজন হয় না।নিজের আবেদন নিজেই পাশ করিয়ে নিতে পারে।

যথারীতি দুটো সাইকেল এসে গেছে।ভাই-বোন খুব খুশী।সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো,
–এ্যই যে দুজনকে সাইকেল কিনে দিলে আমাকে একটিবার জিগ্যেস করার প্রয়োজন মনে করো নি?
–কেন তুমি না মেয়েকে স্বাবলম্বী করবে,সারা জীবন তো তাই বকবক করলে!
চুপ হয়ে গেল সে। বুঝা গেল সন্তানদের অন্যায় দাবী পূরণ করে রানু ওপর এতদিনের চাপা ক্ষোভ মেটানোর সুযোগটি হাত ছাড়া করেনি ও।
এখন আতংক পেয়ে বসেছে রানুর। হাসিমুখে বিদায় দেয় মেয়েটিকে।বলে,
–সাবধানে সাইকেল চালিও, সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে এসো,রওয়ানা হওয়ার আগে ফোনে জানিও, কেমন!
—আচ্ছা আম্মু।
–শোনো কেউ যদি থামতে বলে মোটেও থামবে না,বুঝলে?
–আম্মু ট্রাফিক থামালে?বলেই হাসিতে কুটিকুটি,
–শোনো, দুষ্টামী না।ওড়না সাবধানে রেখো, আর সারা পথ দোআ পড়তে থাকবে,কেমন!
—আচ্ছা, ঠিক আছে।চিন্তা কোরো না।
ও বল্লেই কি হবে? সে মূহুর্ত থেকেই তো শুরু হয় রানুর চিন্তারাজ্যে সাতার। একএকটি ক্ষণ দিন সপ্তাহ কাটে দোআ পড়তে পড়তে।
পাগল পাগল দিন কাটে,যতক্ষণ বাসায় না আসে।একটা কিছু হলে সব দুমড়েমুছড়ে পড়বে যে ওর ঘাড়ে।

জয়ন্তীও কম যায় না! সাবধানী মেয়েটি দিনে দিনে সচেতন ও দক্ষ হয়ে উঠেছে।
কোথায় সাইকেল রেস,
প্রতিযোগীতা সবকিছুতে সমান তালে এগিয়েছে, পড়াশুনাতেও।জয়ও এখন সাইকেল চালিয়ে স্কুল যায়। এখন রানুর বাইরে দৌড়ানোর কষ্টটা কমেছে। জয়ের বাবাও রানুকে জব্দ করতে না পেরে মিঁউ মিঁউ করে ওর আশেপাশে।একদিন হঠাৎ বলে ওঠে,
–শোনো,আমি ঠিক করেছি আমার সব সম্পত্তি দুই ভাইবোনের অংশ দুজনের মধ্যে সমান ভাগ করে দিবো। কি বলো?
রানু হাসে।
— না হেসো না।আসলে মেয়েদেরকে বিশ্বাস করলে ওরা আত্মবিশ্বাসী হয়।
তুমি আমার চিন্তাটাই বদলে দিলে।
হঠাৎ রানুর দুটিহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে উষ্ণতায় ন্যুয়ে পড়ে ও।
রানুও বুকে জড়িয়ে নেয় স্বামীকে। যেন বহুদিন পর ডুব সাতারে নামে তারা ভালবাসার শীতল জলে।