অণুগল্পঃঃ অচেনা অতিথি

অণুগল্পঃঃ অচেনা অতিথি

অচেনা অতিথি

সৌমেন চক্রবর্তী

সালটি ছিল ২০০১ । হাবলকাকার ইচ্ছে হয়েছে এবারে ছোট্ট করে দুর্গাপূজা করবেন। পাড়ার ছেলেরা সকলে মিলে হাবলকাকাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। সবার সাহায্যে ও আনুকূল্যে পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় টাকা পয়সা জোগাড় হলো। মুর্তি তৈরি হলো। মোড়োল পাড়ার ঠাকুর দালান পরিস্কার করে পুজোর জন্য প্রস্তুত করা হলো। ষষ্ঠীর দিনে ঠাকুর সেই ঘরে ঢুকবে, হঠাৎ কোথা থেকে এক পাগল এসে উপস্থিত হলো। সে এক আশ্চর্য পাগল। কেউ কিছু বলতে গেলেই সে হারে রে রে করে তেড়ে আসছে। কারো কথা শুনছেই না। তার দাবি, সে নাকি মায়ের পুজো করবে। নিদেনপক্ষে তাকে পুজোর সময় মা দুর্গার মুর্তির কাছে বসতে দিতে হবে। বেগতিক দেখে তাতেই সকলে রাজি হয়ে গেল।
হাবলকাকা বললেন, ‘যাকগে , ও ওখানে চুপ করে বসে থাকুক। কোনো সমস্যা না সৃষ্টি করলেই হলো। ‘
এইভাবেই ধীরে ধীরে সপ্তমী গেল, অষ্টমী এলো। এলো দুর্গাপুজোর প্রধান আকর্ষণ সন্ধিপূজার ক্ষণ। পাড়ার সকলে ভিড় জমিয়েছে ঠাকুর দালানে। সন্ধিপূজার সময়টা সত্যি মনোরম। মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে আরতির দ্বারা এক স্বর্গীয় আবেশের সৃষ্টি হয়। ঠিক বিকাল তিনটা বেজে কুড়ি মিনিটে ছিল সন্ধিপূজার শুরু। সকলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষারত।
এদিকে তিনদিন ধরে সেই তথাকথিত পাগল ব্যক্তিটি ঠাকুর দালানের এক কোণে ঠায় বসে থাকতো। সকাল বিকাল মায়ের প্রসাদ খেয়ে ভালোই ছিল। হঠাৎ সন্ধিপূজার সময় সবাই দেখলো অচেনা লোকটি উঠে প্রতিমার নিকটে এগিয়ে গেল। নিমেষে দেবীর আরতির ডালা হাতে তুলে ধরলো। সকলে চমকে গেল। অবাক হয়ে সকলে দেখলে অদ্ভুত এক দৃশ্য। যাকে তিনদিন ধরে সকলে পাগল বলে ভেবেছিল, সে অপরূপ চন্ডীমন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে মায়ের আরতি শুরু করলো। কি অপরূপ মন্ত্রোচ্চারণ। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পুরোহিত পাশে দাঁড়িয়ে হা করে দেখতে লাগলেন। হাবলকাকার পুজো এক অনন্য মাত্রা পেল। সন্ধিপূজার মহেন্দ্র ক্ষণে অচেনা, অজানা লোকটির নিখুঁত মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে মনে হচ্ছিল যেন, সত্যি সত্যি মা মৃন্ময়ী রূপে চিন্ময়ী হয়ে উঠেছেন। এত নিষ্ঠার সঙ্গে সুনিপুণ ভঙ্গিতে নির্ভুল মন্ত্রোচ্চারণ আমরা আজ পর্যন্ত শুনিনি ও দেখিনি।
সকলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। সময়মতো পুজো সমাপ্ত হলো। পুনরায় সেই অজানা তথাকথিত পাগল লোকটি তার আগের স্থানে গিয়ে বসে পড়লো। আর ভাবটা এমন যে সে কিছুই করেনি। সেই মুহূর্তে সকলে মিলে লোকটিকে ঘিরে ধরে প্রশ্ন করতে শুরু করে। কিন্তু লোকটি এখন নিরুত্তর। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হাবলকাকা সবাইকে বিরত করলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিকে ছড়িয়ে পরলো এই ব্যাপারটা। সবাই মিলে ঠিক করলেন যে, পরেরদিন সকালে লোকটিকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে, আসল রহস্য কি?
হাবলকাকা পরদিন ভোরে ঠাকুর দালানে পুজোর প্রস্তুতি করতে গিয়ে অবাক হয়ে যান। দেখেন যে, মায়ের মুর্তির পাশে বসে থাকা অপরূপ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে সকলকে মুগ্ধ করা, সেই তথাকথিত পাগল লোকটি আর নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। অজানা অচেনা লোকটি সকলের কাছে অচেনাই রয়ে গেলেন। প্রতি বছর পুজোর সময় হাবলকাকার তার কথা মনে পড়ে।।