প্রবন্ধ: শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির তীর্থভূমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রবন্ধ: শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির তীর্থভূমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রবন্ধ: শিল্প-সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির তীর্থভূমি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

শাহীন চৌধুরী ডলি

ইতিহাস- ঐতিহ্যের দেশ সুজলা, সুফলা,শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশ। শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মধ্যে অন্যতম ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল। শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, সংস্কৃতিতে ঐতিহ্যের ধারক বাহক ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে যুক্তিগত কারণেই বাংলাদেশের সংস্কৃতিক রাজধানী বলে আখ্যায়িত করা হয়। আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়া তার পূর্ণরূপ লাভ করে বৃটিশ শাসন আমলে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।

বাংলাদেশের পূর্ব- মধ্য জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই অঞ্চল প্রাচীন বাংলার সমতট নামক জনপদের অংশ ছিল। মধ্যযুগে বর্তমানের ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল সরাইল পরগনার অন্তর্গত। সুলতানী আমলেই সরাইল পরগনার সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক কারণে সরাইল পরগনা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। বাংলার বার ভূইয়ার শ্রেষ্ঠ ভূইয়া ঈসা খাঁ বাংলায় প্রথম এবং অস্থায়ী রাজধানী স্থাপন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে ১০ কিমি উত্তরে সরাইলে। ভাটি রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষায় ঈসা খাঁর সঙ্গে মোঘল বাহিনীর যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ রয়েছে। ১৮৬০ সালে নাসিরনগর মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিকাংশ এর অধিনস্ত হয়। ১৮৭৫ সালে নাসিরনগর মহকুমা এর নাম পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা করা হয়। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলার সৃষ্টি হয়। ১৯৬০ সালে এক প্রশাসনিক আদেশে ত্রিপুরা জেলাকে কুমিল্লা জেলা নামে অভিহিত করা হয়। বৃটিশ আইনানুযায়ী কুমিল্লার তিনটি সাব- ডিভিশন থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা সৃষ্টি হয়। ১৮৬৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর পৌরসভায় উন্নীত হয়। ১৯৪৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

ব্রিটিশ আমলে ইংরেজ ম্যানেজার মিঃ হ্যালিডের কুঠি সরাইল থেকে শহরের মোড়াইলে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে এটি ভেঙ্গে সরকারি অফিসে রূপান্তর করা হয়েছে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ সৈন্যদের মনিপুর অধিকারের সময়ে তাদের সামরিক দপ্তর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। শহরের বাণিজ্য কেন্দ্র আনন্দবাজার ও টানবাজার। আনন্দবাজার, টানবাজার, জগৎবাজার, মহাদেব পট্টি,কালাইশ্রী পাড়া, মধ্যপাড়া, বর্ডার বাজার, কাজীপাড়া ও কান্দিপাড়া শহরের পুরাতন এলাকা। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে এবং স্বাধীনতা উত্তর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের সময় ১৯৮৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে জেলা ঘোষণা করা হয়। উনবিংশ শতাব্দীতে এই শহরের উত্থান।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। অনেকের মতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের স্থপতি বলে কথিত কাজী মাহমুদ শাহ(রাঃ) এর নাম জড়িত । তিনি ষষ্ঠ ও সপ্তদশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এখানে এসেছেন বলে কেউ কেউ অনুমান করেন। সে মতকে ধরে নিলে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া ’ নামকরণের বয়স সাতশত কিংবা আটশত বছর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের আগে এই জনপদ কি নামে পরিচিত ছিল তা রহস্যাবৃত। তবে অধ্যাপক হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ এক প্রবন্ধে ঐতিহাসিক প্রমাণ এবং বস্ত্তনিষ্ট তথ্য ছাড়া ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ শহরের পূর্ব নাম ‘রং’ শহর উল্লেখ করেছেন। এই রং শহর কিভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাম হল এ সম্পর্কে দুটি জনশ্রুতি প্রচলিত।

বাংলাদেশে সেন বংশের শাসনামলে এদেশে কোন ব্রাহ্মণ পরিবার না থাকার কারনে হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা পার্বন অনুষ্ঠান পরিচালনায় অসুবিধা সৃষ্টি হতো। এ অসুবিধা দূর করার লক্ষ্যে রাজা বল্লাল সেন ‘ কান্যকুব্জ্য’ থেকে বেশ কয়েকটি অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবার এনেছিলেন। ভিন্ন মতে, এদেশে বৃটিশ রাজত্ব পূর্বকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন সরাইলের প্রতাপশালী দেওয়ান পরিবার জমিদাররা অন্যস্থান থেকে কয়েকটি অভিজাত ব্রাহ্মণ পরিবার হিন্দুদের পূজা পার্বণের সুবিধার জন্য এ এলাকায় এনেছিলেন। এই ব্রাহ্মণদের একটি পরিবার ‘ রং শহরে ’ ( বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর) বসবাস করতেন। ব্রাহ্মণের আস্তানা থেকেই ‘ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ’ নামের উৎপত্তি হয়েছে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ব্যাপারে সমধিক প্রচলিত জনশ্রুতি হল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়া মহল্লায় হযরত কাজী সৈয়দ মাহমুদ শাহ(রাহঃ) এর মাজার বিদ্যমান। এই আল্লাহর ওলী মোঘল শাসনামলে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে আসেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ব্রাহ্মণেরা উক্ত দরবেশের অলৌকিক ক্ষমতায় বিষ্ময়াবিষ্ট হন এবং তাদের বিরোধিতা জনিত অপকর্মের ক্ষমা চেয়ে নবীনগর থানার বিদ্যাকুট গ্রামে চলে যান। যাবার প্রাক্কালে ব্রাহ্মণেরা কাজী সৈয়দ মাহমুদ শাহ(রাহঃ) কে এ মর্মে অনুরোধ করেন যে, দীর্ঘদিন রং শহরে তাদের প্রাধান্য ছিল। তাই তিনি যেন এ রং শহরের নামকরণে তাদের স্মৃতিকে সম্পৃক্ত রাখেন। ওলীয়ে কামেল সৈয়দ মাহমুদ শাহ (রাহঃ) তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন এবং ব্রাহ্মণ বেড়িয়ে যাওয়া থেকে ব্রাহ্মণবেড়িয়া আবার ব্রাহ্মণবেডিয়া থেকে ‘ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ’ নামকরণ হয়।

তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপমহাদেশের সুপরিচিত একটি জেলা। মেঘনা-তিতাসের পলি মাটির আবাহনে বাঁধা এই ভূখন্ড শিল্প-সাহিত্য, সংগীত, শিক্ষা, সংস্কৃতির তীর্থক্ষেত্র।জ্ঞানী-গুণীর খনিস্বরূপ সমৃদ্ধ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া অগণিত জ্ঞানী- গুণীর বিভিন্ন অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। গানের দেশ, সুরের দেশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এর সামাজিক এবং ভূ-প্রাকৃতিক বিন্যাসের দরুন,ছড়িয়ে থাকা নদ-নদীর প্রভাবে, জলবায়ুর প্রভাবে, জনবসতির ধরনে, লোক সমাজের আচার-আচরণ, বিশ্বাস-মূল্যবোধ, সংস্কৃতি- ঐতিহ্য, নিরন্তর পরিবর্তনশীল মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। লোক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এক ঐশ্বর্যশালী জেলা। তিতাসের সাথে এই জেলার নাড়ির বন্ধন। তিতাস পাড়ের আবহমান সংস্কৃতির সমৃদ্ধ জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া কালের সকল গণ্ডি অতিক্রম করে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। জেলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোক সংগীতের ব্যাপক অংশ এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। বহুসংখ্যক পালাগান, বাউলগান, মুর্শিদী গান, মারফতি গান, পুঁথি, জারি – সারি গান, ভাব সংগীত, বারোমাসি গান সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে যা খুব দুঃখজনক।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শিল্প, সাহিত্য, এবং শিক্ষা, সংস্কৃতির ঐতিহ্য অনেক প্রাচীন। সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়েব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুখ্যাতি আছে। উপমহাদেশের সংগীত ও সংস্কৃতির আদি পীঠস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে সংগীতের তীর্থভূমি বলা হয়। তিতাসের পলি, জল- কাদার অববাহিকায় জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্বখ্যাত অসংখ্য কৃতি সন্তান। এখানে আছে ধ্রুপদী সংগীতের নিজস্ব ঘরানা সংগীতের প্রবাদপুরুষ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ফকির তাপস আফতাব উদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, শচীন দেব বর্মন, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খাঁ, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খাঁ, সাধক আনন্দ স্বামী, সাধক মনোমোহন, অমর পাল, ওস্তাদ খুরশিদ খান, শেখ সাদী খান, ওস্তাদ সুবল দাস, উমেশ চন্দ্র রায় পর্যন্ত সুরের যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তা এখন সৈয়দ আবদুল হাদীর মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সুদৃঢ় ভিত্তিমূলের উপর প্রতিষ্ঠিত। বর্তমান সময়ে এই জেলার আরো অনেক শিল্পী নিজ নিজ যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে জাতীয় এবং বৈশ্বিকভাবে নিজেদের পরিচিতি তুলে ধরছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বরা হলেন,
ঈসা খাঁ – বাংলার বারো ভূইয়ার অন্যতম
অখিলচন্দ্র নন্দী – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।
অতীন্দ্রমোহন রায় – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।
অদ্বৈত মল্লবর্মণ – ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক।
অমর পাল – লোকসঙ্গীতশিল্পী।
আনিসুল হক – রাজনীতিবিদ এবং আইন মন্ত্রী।
আনোয়ার হোসেন – বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আফতাবউদ্দিন খাঁ – যন্ত্র ও লোকসঙ্গীতশিল্পী।
আবদুর রসুল – ব্রিটিশ ভারতীয় রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী।
আবদুর রহমান – বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা
আবদুল কাদির – একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি, সাহিত্য সমালোচক এবং ছান্দসিক।
আবদুল কুদ্দুস মাখন – রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আবদুল মোনেম – শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী, আবদুল মোনেম লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আবদুস সাত্তার ভূঞা – রাজনীতিবিদ এবং আইনজীবী।
আব্দুস সাত্তার খান – মহাকাশ গবেষক।
আবু সালেক – বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত কিশোর বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম – বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান।
আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া – পুরাতাত্ত্বিক ও গবেষক।
আবেদ হোসেন খান – একুশে পদকপ্রাপ্ত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার বাদক ও সুরকার।
আল মাহমুদ – একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।
আলাউদ্দিন খাঁ – সেতার, সানাই ও রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু।
আলী আকবর খান – ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের একজন সঙ্গীতজ্ঞ।
আলী ইমাম – বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু সাহিত্যিক।
আহমদ রফিক – কবি ও গবেষক।
আহমেদ আলী – রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আয়েত আলী খাঁ – মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার ও সুরবাহার বাদক।
উল্লাসকর দত্ত – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।
এ বি তাজুল ইসলাম – রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
কবীর চৌধুরী – একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক এবং সাবেক জাতীয় অধ্যাপক।
কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক – মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং গণপরিষদ সদস্য।
কিরীট খান – সেতার বাদক।
খাদেম হোসেন খান – সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞ।
খান মোহাম্মদ ফারাবী – কবি ও গদ্যকার।
খুরশিদ খান – সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞ।
গোপাল দেব – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী।
তাহেরউদ্দিন ঠাকুর – রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিক।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত – আইনজীবী, ভাষা সৈনিক ও রাজনীতিবিদ।
নবাব সৈয়দ শামসুল হুদা – ব্রিটিশ ভারতীয় মুসলিম রাজনৈতিক নেতা।
নুরুল আমিন – পাকিস্তানের অষ্টম প্রধানমন্ত্রী এবং পাকিস্তানের একমাত্র উপ-রাষ্ট্রপতি।
প্রবীর সেন – ক্রিকেটার
ফজল শাহাবুদ্দীন – একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি।
ফরিদুল হুদা – চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ।[৫২]
ফুলঝুরি খান – স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত যন্ত্র ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী।
বাহাদুর হোসেন খান – উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও সরোদ বাদক।
মনমোহন দত্ত – মরমী সাধক, মলয়া সঙ্গীতের জনক।
মনির আহমেদ খান – বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মীর কাশেম খান – একুশে পদকপ্রাপ্ত সেতার বাদক, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক।
মুশফিকুর রহমান – প্রাক্তন সচিব‚ বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক ও রাজনীতিবিদ।
মোফাজ্জল হোসেন – বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মোবারক হোসেন খান – একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীত গবেষক এবং লেখক।
মোহাম্মদ আশরাফুল – জাতীয় ক্রিকেটার।
মোহাম্মদ ছায়েদুল হক – রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।
মোহাম্মদ হোসেন খসরু – উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী।
রিনাত ফৌজিয়া – সেতার বাদক।
রুমিন ফারহানা – রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।
লুৎফুল হাই সাচ্চু – রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের ২ ও ৩ নং সেক্টরের গেরিলা উপদেষ্টা।
শান্তি ঘোষ – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী বিপ্লবী।
শামসুল হক – বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শাহজাহান সিদ্দিকী – বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শাহাদাত হোসেন খান – একুশে পদকপ্রাপ্ত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সরোদ বাদক এবং সুরকার।
শেখ সাদী খান – জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার।
সানাউল হক খান – একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি।
সামসুল হক – বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সুনীতি চৌধুরী – ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী।
সুফী জুলফিকার হায়দার – একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি।
সুবল দাস – সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার।
সৈয়দ আব্দুল হাদী – জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সঙ্গীতশিল্পী।
হারুন আল রশিদ – রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী।
হাসনাত আব্দুল হাই – বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত ঔপন্যাসিক।
সাংবাদিক হাবিবুর রহমান মিলন (১৯৩৯-২০১৫) – ২০১২ সালের একুশে পদক প্রাপ্ত । দৈনিক ইত্তেফাকের উপদেষ্টা সম্পাদক এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন ।
আকবর আলি খান – অর্থনীতিবিদ,তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
অলি আহাদ – ভাষা সৈনিক ও স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ প্রাপ্ত
সালেহউদ্দিন আহমেদ – বাংলাদেশ ব্যাংকের নবম গভর্নর
আনন্দময়ী মা (১৮৯৬-১৯৮২) – আধ্যাত্মিক সাধিকা
ওস্তাদ আফজালুর রহমান – সরোদ, বেহালাবাদক।
রুবা – সরোদ, বেহালা বাদক এবং সংগীত শিল্পী
টুংটাং -সরোদ, বেহালা বাদক এবং সংগীত শিল্পী
অমিতাভ রেজা চৌধুরী – চলচ্চিত্র পরিচালক ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা ।
মারুফুল ইসলাম – বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি, শিশু সাহিত্যিক, গীতিকার।
আলমগীর – বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত নায়ক, অভিনেতা।
আঁখি আলমগীর – জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী, গায়িকা, অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা।
সাজু খাদেম – অভিনেতা
জাকিয়া বারী মম – অভিনেত্রী এবং মডেল
জিয়াউল রোশান – অভিনেতা
সাবরিনা পড়শী – সংগীতশিল্পী
প্রান্তি নুসরাত – সংগীত শিল্পী
তাসনুভা হক এলভিন – অভিনেত্রী এবং মডেল
দেলোয়ার জাহান ঝন্টু – চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রমুখ।

বাংলার বার ভূইয়ার শ্রেষ্ঠ ঈসা খাঁর লালন ভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বাংলা ভাষার মূল স্রোতধারায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেন এক অমিয় প্রাণসত্ত্বা। ছান্দসিক কবি আবদুল কাদির, প্রবোধ চন্দ্র সেন, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, কবি আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। নবাব সৈয়দ সামসুল হুদা, ব্যারিস্টার আবদুর রসুল, বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অলি আহাদ, আবদুল কুদ্দুস মাখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। অপরদিকে এই জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন বিশ্বখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ফখরে বাঙাল আল্লামা তাজুল ইসলাম। জন্মগ্রহণ করেছেন ভাষা সৈনিক গোলাম আযম যিনি পরে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বিতর্কিত অবস্থানের জন্য রাজাকার হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেন।

জেলার সাহিত্য ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় সাধক কবি মীর্জা হোসেন আলী থেকে অদ্যাবধি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য বৈশিষ্ট্য বিশেষ গৌরবজনক। মানুষ ও মনুষ্যত্বের বিষয়ে আপসহীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য পরিবেশ মীর্জা হোসেন আলী থেকে কবি আল মাহমুদ এবং সাধক কবি মনোমোহন থেকে অদ্বৈতমল্লবর্মণ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্যের উজ্জ্বল অধ্যয়। মীর্জা হোসেন আলী, বানচন্দ্র তর্কালঙ্কর, মুন্সি ছমির উদ্দিন, দেওয়ান রামদুলাল নন্দী, কৈলাসচন্দ্র সিংহ, সাধক মনোমোহন ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন, কবি সুফী জুলফিকার হায়দার, কবি আব্দুল কাদির, কবি জমিলা বেগম, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, গবেষক আ কা মো. যাকারিয়া, ইতিহাস গবেষক ড. অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, কবি সানাউল হক, কবি ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খান, কবি আহমদ রফিক, সাহিত্যিক মিন্নাত আলী, কবি মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, কবি ফজল শাহাবুদ্দীন, কবি আল মাহমুদ, মোবারক হোসেন খান, সাংবাদিক ও গবেষক মুহম্মদ মুসা, কবি মনজুরে মওলা, কথা সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই, তিতাস চৌধুরী, কবি শিহাব সরকার, শিশু সাহিত্যিক আলী ইমাম প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক ও গবেষকগণ জেলা সাহিত্য চর্চা ও বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছেন এবং বর্তমানেও রাখছেন।

তৎকালীন পূর্ববঙ্গের অগ্রসর অঞ্চলগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্যতম। আধুনিক শিক্ষার প্রভাবে জেলা জন্ম দিয়েছে অনেক শিক্ষাবিদ, রাজনীতিক, সমাজ সংস্কারক তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঈসা খাঁ মসনদ এ আলা, নবাব সিরাজুল ইসলাম, রামকানাই দত্ত, মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, বিপ্লবী অখিল চন্দ্র দত্ত, ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল, মাওলানা মোহাম্মদ হুসাইন (রহ.), মাওলানা রুকন উদ্দিন, বিশ্ববিখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ অধ্যাপক গোলাম আযম, বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, কৃষক নেতা আব্দুল মালেক, মৌলবী জিল্লুর রহমান, আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক হরলাল রায়।

ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যুগে যুগে অসংখ্য ধর্ম প্রচারকের আগমন ঘটে এই অঞ্চলে। তারা এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারে ব্যাপক অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য– হযরত সৈয়দ আহমদ গেদুদারাজ কল্লা শহীদ, হযরত কাজী মাহমুদ শাহ, হযরত শাহ সুফী আব্দুল খালেক, ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম, হযরত মৌলানা আসগর আহমদ আল কাদরী, হযরত মাওলানা হাছান শাহ, মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দিন, সৈয়দ আব্দুল রাবী শাহ প্রমুখ। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে শ্রী শ্রী মা আনন্দময়ী, সাধক আনন্দ নন্দী, সাধক মনোমোহন প্রমুখ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলো হলো- সরাইলের আর ফাইলের মসজিদ, জেলা সদরের উলচাপাড়া মসজিদ , জেলা সদরের কাল ভৈরব মূর্তি ও মন্দির, সরাইলের বাসুদেব মূর্তি, ঐতিহাসিক হাতিরপুল, কসবার কৈলাঘর দুর্গ, জেলা সদরের ভাদুঘর মসজিদ, নবীনগরের বাঁশীহাতে শিবমূর্তি, সরাইলের আনন্দময়ী কালী মূর্তি , সদরের আর্কাইভ মিউজিয়াম ইত্যাদি।

বাংলাদেশের আঞ্চলিক বা মফস্বল সংবাদপত্রের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ ক্ষেত্রে একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। উনিশ শতকের শেষার্ধে ত্রিপুরা জেলা তথা বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সংবাদপত্র ও সাময়িকীর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্থানীয় সংবাদপত্র মাসিক ঊষা (১৮৯৩) এবং মাসিক হীরা (১৮৯৪) প্রকাশিত হয়। সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত ঊষা, হীরা, জয়ন্তী ও সেবক পত্রিকা বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। গ্রাম থেকে পত্রিকা প্রকাশ বিশেষ করে চুন্টা প্রকাশ ও ‘পল্লী প্রদীপ’ জেলার সংবাদপত্র ও সাময়িকীর ইতিহাস এক উজ্জ্বল সূচনা করেছে। জেলায় সংবাদপত্র প্রকাশের ১১৮ বছরের এক সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে। জেলা সংবাদপত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– মাসিক ঊষা (১৮৯৩), মাসিক হীরা (১৮৯৪), মাসিক সন্তান (১৯১৩), মাসিক পল্লী প্রদীপ (১৯২০), মাসিক চুন্টাপ্রকাশ (১৯২৬), মাসিক জয়ন্তী (১৩৪৬ বাংলা), মাসিক মা (১৯৬৯), মাসিক ভোলা (১৯৬৮), ত্রৈমাসিক আল বুশরা, প্রবাহ, সাহিত্য লোক, মান্দাল, ধূমকেতু, সাপ্তাহিক ত্রিপুরা বিকাশ, সেবক, তিতাস মা, প্রতিচ্ছবি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সাকিয়াত তিতাসের খবর, দৈনিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া, প্রজাবন্ধু, আজকের হালচাল, তিতাস কণ্ঠ, রাহবার, সমতট বার্তা, দিনদর্পন ইত্যাদি।

ক্রিকেট,ফুটবল,ব্যাডমিন্টন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনপ্রিয় খেলা । ঐতিহ্যবাহী খেলার মধ্যে রয়েছে – নৌকা বাইচ, লাঠিখেলা, গরু দৌড়,আসিল মোরগ লড়াই । ২০১৪-১৫ মৌসুমে চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্রিকেটের শিরোপা জিতেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনূর্ধ্ব-১৬ ও ১৮ দল । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ক্রীড়াঙ্গনের মূলকেন্দ্র নিয়াজ মোহাম্মদ স্টেডিয়াম । তৎকালীন এসডিও নিয়াজ মোহাম্মদ খান ১৯৩৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন , যা দেশের প্রাচীনতম স্টেডিয়াম। এ জেলার বিখ্যাত খেলোয়াড়দের মধ্যে রয়েছেন ক্রিকেটার প্রবীর সেন , যিনি ডন ব্র্যাডম্যানের বিপক্ষে খেলেছিলেন । বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ আশরাফুল।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া অতুলনীয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লোকমানসের ঐতিহ্য ধারণ করে হাজার বছরের লোককাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। পুতুল নাচের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিখ্যাত। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পুতুল নাচের প্রচলন করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে গড়ে ওঠা জনপদের কৃষ্ণনগর গ্রামের বিপিন পাল। তিনি তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে নিজস্ব স্টাইলে পুতুল নাচ করতেন। তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ব্যবসায়িক পুতুল নাচের স্রষ্টা বলা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডার ধন মিয়া কৃষ্ণনগর গ্রামের গিরীশ আচার্যের পুতুল নাচের দলে পুতুল নাচের তালে তালে গান করতেন। পরে ধন মিয়াই পুতুল নাচের সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখেন। পুতুল নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন কাহিনী প্রদর্শন করে ধন মিয়া দেশে, বিদেশে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছেন। ধন মিয়া রাশিয়ার মস্কো, তাসখন্দ, সমরখন্দ, প্রভৃতি শহরে ২০ দিন অবস্থান করে পুতুল নাচ দেখিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছিলেন। তিনি দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রচারে পুতুল নাচকে ব্যবহার করেছেন। বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফার ছেলে মোস্তফা মনোয়ার ধন মিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে পুতুল নাচের অনুষ্ঠান করিয়েছেন। তার পুতুল নাচের দলের নাম ছিলো ‘বীণা অপেরা ‘। ধন মিয়া ছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডার কালু মিয়া, মোঃ রাজ হোসেন, কাজীপাড়ার শরীফ মালদার পুতুল নাচের প্রদর্শনী করতেন। বছরের বিশেষ সময়ে গ্রামীণ মেলাগুলোতে পুতুল নাচের প্রদর্শনী হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে শত শত বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ হয়ে আসছে। সুদূর অতীতকাল থেকে মনসা পূজা উপলক্ষে ভাদ্র মাসের প্রথম তারিখে তিতাস নদীতে এই নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
” সখি গো করি মানা, কালো জলে ঢেউ দিও না গো সখি
কালো জলে ঢেউ দিও না। ”
উল্লেখিত গানের কলিটি ইংরেজ আমলে তিতাস নদীর নৌকা বাইচের একটি গানের অংশ।
ত্রিপুরা জেলার গেজেটীয়ার থেকে জানা যায় যে,১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা।ঐ নৌকা বাইচ আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরা এবং কুটির ইংরেজ পাট ব্যবসায়ীরা বহু সোনার মেডেল দিয়ে নৌকাবাইচে অংশগ্রহণকারীদের পুরস্কৃত করেছিলেন।
ত্রিশের দশকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সংলগ্ন তিতাসের বুকে অতি জাঁকজমকপূর্ণভাবে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো।বিজয়ী নৌকাকে মেডেল, কাপ, শীল্ড, পিতলের কলস, পাঁঠা ইত্যাদি ট্রফি দেয়া হতো। এখনো ঐতিহ্য বহাল রেখে তিতাসের বুকে গণ উৎসব নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়। বিজয়ী নৌকাকে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন ইত্যাদি উপহার দেয়া হয়।

মোঘল আমল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ঐতিহ্যবাহী হাঁসলি মোরগের লড়াই চালু হয় বলে জানা যায়। বিশেষ করে সরাইলের দেওয়ানদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মোরগ লড়াই এই অঞ্চলে বিশেষ তাৎপর্য লাভ করে। হাঁসলি মোরগ অত্যন্ত জেদি যোদ্ধা হয়ে থাকে। দুধর্ষ জাতের এই মোরগগুলো পরাজয় বরণে পিছু হটে না। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। সরাইলের হাঁসলি মোরগের উচ্চতা, ক্ষিপ্রতা, দৈহিক শক্তি ও কষ্ট সহিষ্ণুতার জন্য বিখ্যাত। মোরগ লড়াই উপভোগ করতে বিভিন্ন বয়সের মানুষেরা জমায়েত হন।

ঘোড় দৌড়ের কথা আমরা সবাই জানি কিন্তু গরু দৌড়ের কথা খুব একটা শোনা যায় না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাঞ্চারামপুর উপজেলার রূপসদী গ্রামে ঐতিহ্যবাহী গরুর দৌড় অনুষ্ঠিত হয়।

বাঙ্গালীর হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলেমিশে আছে বিভিন্ন পার্বণ উপলক্ষ্যে মেলা বা লোক জমায়েতের সংস্কৃতি। সম্রাট আকবর যখন নতুন খাজনা আদায়ের ক্যালেন্ডার প্রণয়ন করেন তখন খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখ মাসের ১ তারিখ ক্ষেত্র বিশেষে তারিখ পরিবর্তন করে বিভিন্ন এলাকায় খাজনা আদায় করা হতো । দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজনের খাওয়া দাওয়ার সুবিধার্থে আনুসাঙ্গিক বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসত ব্যবসায়ীরা । পরবর্তীতে এই জমায়েতটাই একটা উৎসবের রূপ লাভ করে মেলাতে পরিণত হয় । বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজকীয় বা সামাজিক আচার অনুষ্ঠান যেখানে অনেক লোকের সমাগত হতো এ সকল স্থানেই কালক্রমে মেলা জমে উঠে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে বিভিন্ন মাজারের উরশ শরীফ কে কেন্দ্র করে ২/৩ দিন আবার কোন কোন স্থানে সপ্তাহ ব্যাপী মেলা উদযাপিত হয়। সুদূর প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা চৈত্র মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশী শতভিষা নক্ষত্র যুক্ত হলে যে বারুনী যোগ হয় এবং সেই যোগে গঙ্গাস্নানের নাম বারুনী স্নান। সরাইল উপজেলার ধিতপুরেও এ ধরনের বারুনী স্নান অনুষ্ঠিত হয় বলে গবেষক লুৎফুর রহমান তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন । ভাদুঘরের বান্নী ১৪ বৈশাখ প্রতি বৎসর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে । বারুনী স্নান নামক ধর্মীয় আচারকে উপলক্ষ্য করে ভাদুঘরের বান্নী অনুষ্ঠিত হয় বলে জনশ্রুতি আছে। অনেকে এও মনে করেন, ভাদুঘরের মেলা খাজনা আদায়কে উপলক্ষ্য করেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকবে । তবে যে কোন উপলক্ষ্যেই মেলার প্রচলনটি শুরু হোক না কেন একথা আজ অনস্বীকার্য বর্তমান সময়েও এই মেলার আয়োজনে কোন ব্যত্যয় ঘটেনি এবং সকল ধর্মীয় লোকজনের এক মহামিলনে রূপান্তরিত হয়েছে এই মেলা । মেলা উপলক্ষ্যে ভাদুঘর এবং আশেপাশে গ্রামসমূহে এক উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে । দূর দূরান্ত থেকে এ সকল গ্রামের অধিবাসীদের আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে মেয়েরা নাইওরী ও পুত্র বধুদের আত্মীয় স্বজনদের অন্ততঃ এক সপ্তাহ আগেই নিমন্ত্রণ করে আনা হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই বিশাল মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

বস্ত্রশিল্পে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে এককালে উৎকৃষ্ট মসলিন তৈরী হতো একথা আজকের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে চাইবে না । ১৮৭৬ খ্রীষ্টাব্দে রচিত ডব্লিউ, ডব্লিউ, হান্টারের “স্যাটেস্টিক্যাল এ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল, ভলিউম-৬”-এ উল্লেখ রয়েছে যে, বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে তনজের নামের অতি উৎকৃষ্ট মসলিন বস্ত্র তৈরী হতো। এ তনজের ঢাকার বিখ্যাত শবনম মসলিনের সমকক্ষ ছিল বলেও উক্ত গ্রন্থে বলা হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার একমাত্র চরকা ও কুটির শিল্প জেলা সদরের মেড্ডায় বরিশালের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণকারী গোপালগঞ্জ জেলার দেশহিতৈষী চিরকুমার বিশ্বরঞ্জন সেন কর্তৃক ১৯৭৩ সালের ৩০শে জানুয়ারী স্থাপিত হয় । পশ্চিম জার্মানীর এইড বাংলাদেশ কমিটির এক লাখ ৬০ হাজার টাকা সাহায্যের উপর নির্ভর করে মাত্র ২০ জন সুতা কাটুনী নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ আরম্ভ হয় ১৯৭৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। প্রতিষ্ঠাতার নিরলস প্রচেষ্টা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, ওয়ার্ল্ড ডিভিশন, রামকৃষ্ণ মিশন, টেরেডেস হোমস এবং বিসিকসহ বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের সাহায্য-সহযোগিতায় এটা দেশের কুটির শিল্পে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে । এতে ৫২ টি তাঁত, কর্মচারীদের বাড়িতে ৫০টিসহ মোট ৭৫ টি বাশেঁর চরকা, ৬০টি অম্বর চরকা এবং ৬০টি নলী ববিন রয়েছে । রয়েছে কয়েকটি সেলাই মেসিনসহ রং ছাপের ব্যবস্থাও । এসবসহ ডে কেয়ার নার্সারী এবং অন্যান্য মিলিয়ে ২১৯ জন শ্রমিক কর্মচারী রয়েছে এতে । নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গরীব কর্মচারীদের অন্নসংস্থানের মাধ্যম হিসাবে ঢেঁকি ও ইট ভাঙ্গার কাজের ব্যবস্থাও এখানে হয়ে থাকে। ব্যবস্থা রয়েছে কর্মচারীদের ছেলে-মেয়েদেরকে অক্ষর জ্ঞানদানেরও । এ মহতী প্রতিষ্ঠানটির সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো, এখানকার কর্মচারীরা এখানেই ট্রেনিংপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন । ৩২ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত চরকা ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানটিতে মার্কিন কাপড়, লেপ-তোশকের কাপড়, চাদর, বিছানার চাদর, বেড কভার, পর্দার কাপড়, টেবিলক্লথ, তোয়ালে, লুঙ্গি ও গামছা তৈরী হয়ে থাকে এবং এসব কাপড়ের বিক্রয়কেন্দ্রও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরেই । প্রতিষ্ঠানটির কিছু কিছু উন্নত মানের কাপড় দেশের সীমা ছাড়িয়ে নিউজিল্যান্ড ও পশ্চিম জার্মানীর মতো শিল্পোন্নত দেশেও রপ্তানি হয়ে থাকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তর প্রান্তে মেড্ডা গ্রামে কোকিল টেক্সটাইল মিলস নামে একটি সুতাকল রয়েছে । এতে ১৯৬৬ সালের জানুয়ারী মাসে উৎপাদন শুরু হয় । বর্তমানে এই টেক্সটাইল এর কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে । সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছে উপমহাদেশে প্রথম খদ্দরের কাপড় তৈরী হতো । সেখানে কারখানা ছিল দেশলাই ও ছুরি-কাঁচি তৈরিরও ।

জেলার ব্যবসা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর শহর, আশুগঞ্জ, আখাউড়া, ফান্দাউক, চাতলপাড়, সিঙ্গারবিল, সিমনা বাজার, চান্দুরা, চইয়ারকুড়ি, পানিশ্বর, সাতবর্গ, নবীনগর, আজবপুর, রামচন্দ্রপুর, মানিকনগর, কুটি, বাঞ্ছারামপুর উল্লেখযোগ্য। রামচন্দ্রপুরের লুঙ্গি ও বাঞ্ছারামপুরের তাতেঁর কাপড় বিখ্যাত।কুটির শিল্পের মধ্যে বাঁশ-বেতের তৈরী পণ্যসামগ্রী, পাটের দড়ি ও শিকা, কাঠের আসবাবপত্র, স্বর্ণালঙ্কার, লৌহজাত দ্রব্য ও মাটির হাঁড়ি-কলস, বাসন-কোসন উল্লেখযোগ্য।

চলতি শতকের গোড়ার দিকে আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরায় ইংরেজ ব্যবসায়ীরা জুট বেইলিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে “ইর্স্টান বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজিটিয়ার্স টিপারা”- (রচনাকাল ১৯১০ খ্রী:) তে উল্লেখ করা হয়েছে । চান্দুরা এলাকায় উৎপন্ন পাট পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কোয়ালিটির পাট বলে কথিত এবং তা শুধু কথার কথাই নয়, বৃটিশ আমলে ডান্ডিতে চান্দুরার পাট ‘ চান্দুরা পাট ‘ পরিচয়ে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছিল ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রাধিকা অঞ্চলের টুপি শিল্পও উল্লেখযোগ্য প্রশংসার দাবিদার। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর থেকে পাঁচ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত সদর থানার রাধিকা নামের গ্রামটি তার বাসিন্দাদের হাতের কাজের পারদর্শিতার গুণে বিশিষ্টতা অর্জন করেছে । প্রায় ২০০ বছর ধরে এ গাঁয়ের ১০০ এর বেশী পরিবারের অনেকগুলো নিপুন হাত তালের ডায়গা আর জালি বেতের আঁশ দিয়ে টুপি তৈরী করে আসছে । বছরে চার মাস এ কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা । তাছাড়া এ শিল্পকর্ম রাধিকা গ্রামের ক্ষুদ্র গন্ডি অতিক্রম করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার মেড্ডা, ভাদুঘর, জগৎসার, হাবলাউচ্চ ও চানপুর গ্রামগুলোতেও সম্প্রসারিত হচ্ছে ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জাতীয় অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে। তিতাস গ্যাস ফিল্ড, সালদা গ্যাস ফিল্ড, মেঘনা গ্যাস ফিল্ড দেশের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস সরবরাহ যোগায়।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের নতুন একটি কূপে গ্যাস পেয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বাপেক্স। এ কূপ থেকে দিনে ১ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হতে পারে বলে বাপেক্স কর্মকর্তারা আশা করছেন। গ্যাস পাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বাপেক্স। তিতাস নদীর পাড়ে পাড়ে রয়েছে অনেকগুলো ইটখোলা । এসব ইটখোলায় গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি কাঠে পোড়ানো ইট স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলেছে ।

জেলার আশুগঞ্জ তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত । বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের আয়তন ৩১১ একর । পশ্চিম জার্মানী থেকে আর্থিক সহায়তা নিয়ে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় । ভবনসমূহের নিমার্ণ কাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সনের মে মাস থেকে । ১৯৬৮ সনের শেষ দিকে শুরু হয় মূল যন্ত্রপাতিগুলো বসানোর কাজ । প্রথম ইউনিটটি ১৯৭০ এর ২৭শে জুলাই ও দ্বিতীয়টি ১১ই আগস্ট চালু হয় । উভয় ইউনিটের ক্ষমতা ৬৪০০ মেগাওয়াট করে । কেন্দ্রটি স্থাপনের সময়ে এই ইউনিটগুলোর ক্ষমতা ১০০ মেগাওয়াট করে সম্পসারণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল । এছাড়াও দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি অতিরিক্ত ইউনিটে প্রায় ২০০ মেগাওয়াট সম্প্রসারণের ব্যবস্থা ছিল ।স্বাধীনতার পরে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা বেড়ে যায় দ্রুত হারে । এ চাহিদা মেটানোর জন্যে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্পাসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং প্রতিটি ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটো নতুন ইউনিট বসানোর পরামর্শ দেয় । পরবর্তীকালে ৩য় ও ৪র্থ ইউনিট স্থাপনের জন্যে প্রাপ্ত ঋণের কিছু অর্থ থেকে যাওয়ায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড একই ক্ষমতাসম্পন্ন আরেকটি ইউনিট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় । ১৯৮৪ সালের মার্চে ৩য় ও ৪র্থ ইউনিটের কাজ শুরু হয় আর ৫ম টির কাজ শুরু হয় ১৯৮৫এর নভেম্বরে । এই ইউনিট তিনটি যথাক্রমে ১৯৮৬ এর ডিসেম্বর, ৮৭ এর মে এবং ৮৮ এর মার্চে চালু হয় । বর্তমানে আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা ৭২৪ মেগাওয়াট ।এখানকার ষ্টীম ও গ্যাস উভয় ধরনের টারবাইনে জ্বালানী হিসেবে তিতাস গ্যাস ফিল্ড থেকে প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করা হয় ।

আশুগঞ্জ সার কারখানা দেশের চালু সার কারখানাগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম কারখানা । ইহা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত একটি অত্যাধুনিক সার কারখানা । আশুগঞ্জের সন্নিকটে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার তিতাস গ্যাস হইতে ইউরিয়া সারের প্রধান উপাদান গ্যাসের সহজলভ্যতা এবং সারা দেশের সাথে রেল, সড়ক এবং নদীপথে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা বিবেচনা করে সরকার আশুগঞ্জকে এ কারখানা নির্মাণের স্থান নির্বাচন করে । কারখানাটি বাস্তবায়নের জন্য সরকার ১৯৭৪ সালের অক্টোরব মাসে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার এন্ড কেমিক্যাল কোম্পানী লিমিটেড নামে একটি কোম্পানী গঠন করে । ১৯৮৩ সনের ১লা ডিসেম্বর কারখানাটির পরিচালনার ভার বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ কর্পোরেশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয় । ১৯৭৮ সালে কারখানার প্রকৃত নিমাণ কাজ শুরু হয় এবং ১৯৮১ সালে কারখানায় উৎপাদন আরম্ভ হয় । নির্মাণকালে প্রায় ২০০ বিদেশী কারিগরসহ দৈনিক প্রায় ৮,০০০(আট হাজার) লোক কাজ করে। কারখানাটির দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ১৬০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া এবং ৯৩০ মেট্রিকটন এ্যামোনিয়া । বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৫,২৮,০০০ মেট্রিক টন ইউরিয়া ।

পাদুকা শিল্পের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিখ্যাত। জেলা শহরের মধ্যপাড়া থেকে পীরবাড়ি এলাকায় জুতা শিল্পের ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে যা এ অঞ্চলের মানুষের পাদুকা চাহিদা মেটানোর পরও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করা হয় । এই সব শিল্প কারখানায় এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ফলে একদিকে যেমন বেকার সমস্যার সমাধান হচ্ছে অন্য দিকে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে । এ সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হলে ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিসরে বিস্তার লাভ করবে । অরুয়াইল, পাকশিমূলে নৌযান শিল্প গড়ে উঠেছে। আশুগঞ্জকে কেন্দ্র করে অনেক চালের মিল গড়ে উঠেছে।

বৃটিশ রাজত্ব কালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টি, ছানামুখি এর সুখ্যাতি দেশ বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মিষ্টির সুনামের পেছনে যে ব্যক্তির নাম জড়িত তিনি হলেন মহাদেব পাঁড়ে । তাঁর জন্ম স্থান কাশী ধামে । তাঁর বড় ভাই দুর্গা প্রসাদ কিশোর মহাদেবকে নিয়ে কলকাতায় আসতে হয় । বড় ভাই এর মিষ্টির দোকানে মিষ্টি তৈরী শুরু করেন বালক মহাদেব । কিন্তু বড় ভাই দুর্গা প্রসাদ পরলোক গমন করেন। নিরাশ্রয় হয়ে মহাদেব বেড়িয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশে । অবশেষে এলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে । শতাধিক বছর পূর্বে তখন শহরের মেড্ডার শিবরাম মোদকের একটি মিষ্টির দোকান ছিল । তিনি মহাদেবকে আশ্রয় দিলেন । মহাদেব আসার পর শিবরামের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে । মৃত্যুর সময় শিবরামের মিষ্টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুর সময় শিবরাম তাঁর মিষ্টির দোকানটি মহাদেবকে দিয়ে যান। জানা যায় যে, ভারতের বড়লাট লর্ড ক্যানিং এর জন্য একটি বিশেষ ধরনের মিষ্টি তৈরী করে পাঠানো হয়েছিল কলকাতায় । লর্ড ক্যানিং এবং স্ত্রী লেডী ক্যানিং এ মিষ্টি খেয়ে খুব প্রশংসা করেছিলেন । এরপর এ মিষ্টির নাম রাখা হয় ‘লেডি ক্যানিং’ মিষ্টি বর্তমানে যা ‘লেডি ক্যানি’ নামে পরিচিত। তাঁর তৈরী আর একটি মিষ্টির নাম ‘ছানামুখী’। এ ছানামুখী বাংলাদেশের অন্য কোথাও তৈরী করতে পারে না। ছানামুখীর সুনাম এখনও দেশ বিদেশে অক্ষুন্ন রয়েছে। ১৯৮৬ সনে ইসলামাবাদে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অফিসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াঊল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লেডী ক্যানি খেয়ে উচ্ছ্বখিত প্রশংসা করেছিলেন যা পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তালের বড়া এবং রসমালাইয়ের জন্যেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিখ্যাত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে জরুরী বিভিন্ন পণ্যের পাশাপাশি প্রচুর মাছ এবং ফল রপ্তানি হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া লাল মাটির অঞ্চলে প্রচুর কাঁঠাল উৎপন্ন হয় এবং লিচুর চাষ হয়। এখানকার কাঁঠাল, লিচু, বিলেম্বু গুণেমানে অনন্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে লিচুসহ অন্যান্য ফল এবং অর্কিড রপ্তানি হয়।

তিতাস একটি প্রাচীন নদী । তিতাস নদীর নামে ‘তিতাস গ্যাস’নামকরণ করা হয় । মানুষের জীবন যাত্রা ও ভূমি গঠনে এ নদীর বিশেষ প্রভাব রয়েছে । তিতাস নদীর ধারা যদিও পরিবর্তিত হয়েছে একাধিক বার । তথাপি এর বিভিন্ন উপ-শাখা নদী চোখে পড়ে । জেলার নদী-তীরবর্তী এলাকাগুলোর মাঝে মাঝেই জেলে সম্প্রদায়ের বাস । তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন মৎস্য শিকার করা । তাছাড়া কৃষকেরা ও নিজেদের খাদ্যের জন্য বিভিন্ন মৌসুমে খালে-বিলে মাছ ধরে থাকেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় প্রচুর হাওড়, খাল-বিল, জলাশয় থাকায় এখানে প্রচুর পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। জেলায় ছোট-বড় অনেক পুকুর রয়েছে যেখানে দেশী-বিদেশী প্রচুর মাছ চাষ করা হয় ।ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নদনদী ও হাওর অঞ্চলের মুক্ত জলাশয়ে ভাসমান খাঁচায় মাছচাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় অনেক বেকার যুবক এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ঝুঁকছেন। ব্যতিক্রমী এই মাছ চাষ পদ্ধতি দেখে অন্যান্য অঞ্চলের মাছচাষিরাও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। শুষ্ক মৌসুমে নদীনালা খাল বিলে মিঠা পানির মাছ অনেকটাই কমে যায়। বর্ষার আগ পর্যন্ত দীর্ঘ একটা সময় জেলেরা অলস সময় পার করতেন। কিন্তু আধুনিক প্রক্রিয়ায় নদ-নদীর মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের বেকার যুবকেরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শিল্প সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এবং দলমত নির্বিশেষে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল মিলন মেলা হিসেবে এ দেশের মানচিত্রে বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। সাম্প্রতিককালে বিচ্ছিন্নভাবে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার আলোকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আদাতলের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে শিল্প-সংস্কৃতির তীর্থক্ষেত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতি অবিচার করা হবে।