প্রবন্ধঃ রসসাগর বিদ্যাসাগর

রসসাগর বিদ্যাসাগর
রেখা রায়
কে যেন বলেছিলেন …রসিক না
হলে বড় মাপের মানুষ হওয়া যায় না। বড় মানুষদের কারুর কারুর চরিত্রের নানান দিক হাতড়ে আমারও সেই রকমই বিশ্বাস। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যেমন মানুষ ছিলেন, আমৃত্যু যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে সমাজের , দেশের, দশের মঙ্গল চিন্তায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন তাতে তাঁর জীবনে রসিকতার অবসর বেশ কম বলেই মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে। আমার মত হয়তো অনেকেরই ধারণা। কিন্তু তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্তিতে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে জানলাম তা নয়। আমার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। এই মহাজীবন যে আপাদমস্তক ভালোরকম একজন রসিক মানুষ ছিলেন সে বিষয়ে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ নেই। বলা যায় ছোটোবেলা থেকেই ঈশ্বরচন্দ্র যেমন জীবনরসিক তেমনি রসসাগরও।
একবার স্কুলে পন্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের ক্লাসে এক ঘন্টার মধ্যে পাঁচটি পান্ডিত্যপূর্ণ শ্লোক লিখে মাস্টারমশায়কে চমকে দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন ছাত্রের কবি প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিলেন মাস্টারমশায়। সেবার এই মাস্টারমশায়ের বাড়িতে সরস্বতী পুজোর আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হলেন সদলবলে। সেখানে মাস্টারমশায়ের থেকে সরস কবিতা লেখার নির্দেশ পেলেন ছাত্ররা। ঈশ্বরচন্দ্র তো সঙ্গে সঙ্গে লিখে ফেললেন……
“লূচী কচূরী মতিচূর শোভিতং
জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম্
যস্যাঃ প্রসাদেন ফলারনাপ্নু মঃ
সরস্বতী সা জয়তান্নিরন্তরম্।।”
(লুচি, কচুরী আর মতিচূর শোভা পাচ্ছে,জিলিপি, সন্দেশ,গজা বিরাজ করছে, যাঁর প্রসাদে এমন ফলারের ব্যবস্থা, আমরা নিরন্তর সেই সরস্বতীর জয়গান করি।)
মাস্টারমশায় বললেন…এতে রস কোথায় ঈশ্বর ?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর…কেন, ঐ যে মতিচূর, জিলেপি, গজা…ওতেই তো প্রচুর রস।
একবার জয়গোপাল তর্কালঙ্কার মশায় ক্লাসে ঢুকেই ছাত্রদের বললেন সংস্কৃত ভাষায় কবিতা লিখতে হবে। আর সেই কবিতার প্রতি চতুর্থ পংক্তিতে “গোপালায় নমোহস্তু মে” কথাগুলি থাকতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর দাঁড়িয়ে বললেন…আপনি তাহলে গোপালের লীলা বর্ণনা করতে বলছেন।
মাস্টারমশায় তো মাথা নেড়ে সায় দিলেন। এবার ঈশ্বর কী বললেন?
বললেন…এক গোপাল তো আমাদের সামনে রয়েছেন, আর এক গোপাল বহু পূর্বে বৃন্দাবনে লীলা করে গেছেন। এখন আমরা কোন গোপালের লীলা বর্ণনা করব মাস্টারমশায়?
মাস্টারমশায় আর কী বলবেন…তাই তো রে, আমিও তো গোপাল। মনে ছিল না তো ! তা বাবা আমার লীলা লিখে আর কাজ নেই, বৃন্দাবনের গোপালের লীলা বর্ণনা কর!
রান্নায় তো ঈশ্বর পোক্ত ছিলেনই। খাওয়াতে ভালোবাসতেন খুব। খাবার পরিবেশনের কায়দা নিয়েও তাঁর মজার একটি ছড়া তাঁরই লেখা…
“হুঁ হুঁ দেয়ং দেয়ঞ্চ শীরশ্চালনে
হস্ত সঞ্চালনে দেয়ং,
ন দেয়ং ব্যাঘ্রঝম্পাটে।”
(খেতে বসে কেউ যদি পরিবেশনকারীকে বলে” হুঁ হুঁ”, তাহলে দেবে,” হাঁ হাঁ” করলেও দেবে, মাথা নাড়লে বা হাত নাড়লেও দেবে। কিন্তু যদি ব্যাঘ্রঝম্পট অর্থাৎ বাঘ যেমন করে তার শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি যদি নিমন্ত্রিত ব্যক্তি পাতের উপর ঝুঁকে “না না” বলে, তখন দেবে না।)
ঈশ্বরচন্দ্র খেতে ভালো বাসতেন, খাওয়াতেও। একবার এক ভোজন সমিতি গড়লেন বন্ধুরা মিলে। মেম্বার হলেন তিনিও। সমিতির সভ্যদের কাজ হল সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান্ডেপিন্ডে খাওয়া। একবার এক বিরাট ভোজে খেয়ে একজন সভ্যের বেজায় পেট খারাপ হল। অন্যরা তাঁকে সমিতির সদস্য রাখতে চাইলেন না। কেননা তাঁর কাজে সমিতির অপমান। বিদ্যাসাগর বললেন…এটি হতে দেয়া যায় না। এই তো প্রকৃত সভ্য। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে খেয়ে শহীদ হয়ে যাচ্ছিল যে !
ঈশ্বরচন্দ্রের সখ ছিল … বই কিনে যত্ন করে বাঁধিয়ে রাখা। এতে বহু টাকা খরচ করতেন তিনি। বেশির ভাগ সময় বইয়ের থেকে বাঁধানোর দাম বেশি পড়ে যেত। একবার এক ধনীব্যক্তি কলকাতার বাদুড়বাগানে ঈশ্বরচন্দ্রের বাড়িতে এসে টেবিলের ওপর সুন্দর করে বাঁধানো সোনার জলে নাম লেখা বই দেখে জানতে চান… কোথা থেকে বইটি বাঁধানো আর খরচ হয়েছে কত।
ঈশ্বরচন্দ্র বলেন যে বইটি তিনি বিলেত থেকে বাঁধিয়ে এনেছেন, খরচ পড়েছে দশ টাকা আর বইটির দাম পাঁচ টাকা।
যে সময়ের কথা হচ্ছে সে সময় দশ টাকার মূল্য অনেক। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন…অবাক করলেন মশাই। এমন পাগলামি কেউ করে?
ঈশ্বরচন্দ্র তৎক্ষণাৎ এক পয়সার একটি দড়ি কুড়িয়ে হাতে নিয়ে বললেন…আচ্ছা আপনার ঘড়িতে বাঁধা ঐ সোনার চেনটার দাম তো পাঁচশো টাকার কম হবে না। ঘড়িটার দাম বড় জোর পঞ্চাশ টাকা। এই দড়ি দিয়ে ঘড়িটা বাঁধলে দিব্যি কাজ চলে যেত। তা না করে পঞ্চাশ টাকার ঘড়ির জন্য পাঁচশো টাকা খরচ করলেন ! কেন বলুন তো? এও নিশ্চয়ই আপনার পাগলামি।
বেথুন স্কুলের হেডমিস্ট্রস ছিলেন এক ফিরিঙ্গী মহিলা। ঐ স্কুলের পণ্ডিতের ওপর খুব রাগ তাঁর। তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানালে তাঁরা ঈশ্বরচন্দ্রের ওপর ভার দেন ফয়সালা করার। কেননা, তখন ঈশ্বরচন্দ্রই স্কুলের সেক্রেটারি। ঈশ্বরচন্দ্র দেখলেন পণ্ডিতমশাই নির্দোষ। কমিটি মেম্বাররা যেহেতু সাহেব, তাঁরা মহিলার পক্ষে। সুতরাং তাঁরা নির্দেশ দিলেন…পণ্ডিতকে কিছু দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হোক।
বিদ্যাসাগর বললেন…yes, do it, if you think some sacrifice is necessary to appease her.
Appease শব্দটি দেবী সম্বন্ধে প্রযোজ্য। সাহেবরা রসিকতাটি বুঝে উপভোগ করলেন। এমনিই ছিল তাঁর বাক-বৈদগ্ধ্য।
বিদ্যাসাগর বৃদ্ধদের দ্বিতীয়পক্ষের বিয়ে নিয়ে খুব মজা করতেন। একবার তাঁর পরিচিত এক সাব জজ বৃদ্ধ বয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। তারপর পথে একদিন দেখা ঈশ্বরচন্দ্রের সঙ্গে। ঈশ্বরচন্দ্র উৎসাহের সঙ্গে উপযাচক হয়ে বললেন…দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন, এবার আপনার স্বর্গে যেতে বাধা নেই।
জজ তো খুব খুশি। তবু জানতে চাইলেন…কেন কেন, দ্বিতীয়পক্ষে বিয়ে করলে স্বর্গলাভ কেন?
ঈশ্বরচন্দ্র বললেন…স্বর্গের দারোয়ান মৃত্যুর পর প্রত্যেককে জিজ্ঞেস করে সে কতটা পাপ বা কতটা পুণ্য করেছে। সেই মত তাকে স্বর্গে বা নরকে চালান করে। একবার এমন একজন এল যে বৃদ্ধবয়সে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। তাকে স্বর্গের দরজা খুলে দিয়ে স্বর্গেই যেতে বলল দারোয়ান। ব্যক্তিটি তো ভারি অবাক। দারোয়ান বলল…তুমি তো পৃথিবীতে পুরোপুরি নরক যন্ত্রণা ভোগ করেই এসেছ, এখন স্বর্গসুখ ভোগ কর।
রামকৃষ্ণদেব আর ঈশ্বরচন্দ্রের প্রথম সাক্ষাৎকারের কথা তো কমবেশি সকলেরই জানা। রামকৃষ্ণ বললেন…এতদিন খাল বিল নদী দেখেছি, এখন সাগরে এলাম।
ঈশ্বরচন্দ্র হেসে বললেন…তাহলে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান।
রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন…তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও, তুমি যে বিদ্যার সাগর। আর তুমি তো সিদ্ধ আছই। আলু পটল সিদ্ধ হলে নরম হয়, তোমার মনে এত দয়া, তোমার মনটি বড় নরম।
উত্তরে ঈশ্বরচন্দ্র বললেন…কিন্তু কলাইবাটা সিদ্ধ হলে যে শক্ত হয়।
দুজনেই রসের সাগর একেবারে।
ব্যাকরণ কৌমুদী আর উপক্রমণিকা সকলেই পড়েছি। সেখানে “নর” শব্দ তুলে “গজ” শব্দ বসিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র। তাঁর বড় মেয়ের ছেলে কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন…প্রথমে ভেবেছিলাম তুই আর তোর ভাই বুঝি মানুষ। তাই “নর” বসিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম তোরা “গজ”, তাই নর কেটে গজ করলাম।
ছোটখাটো কত রসিকতা যে তাঁর জীবন জুড়ে প্রাত্যহিক যাপনে ছিল, তা বলে শেষ করা যাবে না।
সেই এক বৃদ্ধের “দুরাবস্থা”-কে “দুরবস্থা”-য় নিয়ে আসতে কত কষ্টই না করতে হয়েছে তাঁকে। একবার নাতিদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এক বর্ষার দিনে জিজ্ঞেস করেছিলেন…এখন কী ভাল লাগবে তোদের বলতে পারিস?
নাতিরা চুপ। তাদের বন্ধু বলল…দাদু, যা ভালো লাগে, বর্তমানে তোমার নেই, আমারও নেই।
সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র তার হাতে দশটি টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন…ওরে তোর বিরহ লেগেছে। শ্বশুরবাড়ি চলে যা।
সেই যে সেই ভুলোমনা এক ভদ্রলোক লাঠি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন, ঘরে ফিরে বিছানায় লাঠিটি শুইয়ে দিয়ে নিজে সারারাত দরজার কোনে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজেকে লাঠি ভেবে। সকালে বৌ এসে তাঁকে বিছানায় শুইয়ে দিতে হুঁশ আসে তাঁর। এতো বিদ্যাসাগরেরই রচনা। আর হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ কার সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎকার ঈশ্বরচন্দ্রের? সেও তো সকলেই জানে। টেবিলে পা তুলে সাহেবকে অভ্যর্থনা করেছিলেন তিনি। হাস্যরসের মধ্যে ব্যঙ্গের চাবুকটিও লক্ষ্য করার মত। যাকে আমরা satire বলি।
একবার কয়েকজন অবাঙালী পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে বললেন…ভারতের সকলে পাগড়ি পরে, বাঙালীরা পরে না কেন?
তখনি বিদ্যাসাগর বললেন…বাঙালীরা কিছুই করেনি জন্মভূমির জন্য। পাগড়িটি ত্যাগ করে কিছুটা অন্তত মাতৃভূমির ভার লাঘব করেছে। এখানেও সেই satire.
ঈশ্বরচন্দ্র যে কী পরিমান রসিক ছিলেন, তার নমুনা পাই তাঁর কিছু রচনায়। সেগুলি হল…
১/ অল্প হইল(১৮৭৩)
২/ আবার অতি অল্প হইল(১৮৭৩)
৩/ ব্রজবিলাস(১৮৮৪)
৪/ রত্নপরীক্ষা(১৮৮৬)
এগুলিতে তিনি ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। “কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য প্রণীত” …এই ধরণের ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। এগুলি শাণিত ক্ষুরধার তরবারি যেন। প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতদের satire দিয়ে ফালা ফালা করতে তিনি তুলনারহিত। গুরু তারানাথ বাচস্পতিকেও তিনি ছেড়ে কথা কন নি। “অতি অল্প হইল” এবং “ব্রজ বিলাস”-এ তারানাথকে ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছেন।
সেক্সপীয়রের Comedy of Errors -এর অনুবাদ করে “ভ্রান্তিবিলাস” নাম দিলেন তিনি। পাত্র পাত্রীর নাম বদলে দিলেন। এই কাহিনির বাংলা আর হিন্দি চলচ্চিত্ররূপ আজো আমাদের মুগ্ধ করে। অনাবিল হাসির জন্য খুব জনপ্রিয় হয়েছিল একসময়।
“তাঁর হাস্যরস ঈশ্বর গুপ্ত বা গুড়গুড়ে ভট্টাচার্যের মত নয়, সকলের সাথে বসে উপভোগ করার মত।”…একথা বলেছেন প্রাবন্ধিক সত্যপ্রসাদ সেনগুপ্ত । এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ড. জনসনের সাথে তুলনা করেছেন। ঈশ্বরচন্দ্রের বুদ্ধিদীপ্ত হাস্যরস বোঝার মত খুব কম লোকই ছিল সে সময়। দুঃখের বিষয় আমরা ঈশ্বরচন্দ্রকে গুরুগম্ভীর সমাজসংস্কারক এবং পুস্তকপ্রণেতা বলেই ক্ষান্ত হই। আপাতগম্ভীর এই মানুষটির মধ্যে হাসির ফল্গুধারা আজীবন বহমান ছিল। এমন রসিক মানুষ খুব কমই দেখা যায়।
(উদ্ধৃতিতে বানান যথাযথ আছে)
তথ্য ঋণ
১) সাগর পরিক্রমা সংকলন গ্রন্থ
২)বিদ্যাসাগর চরিত…রবীন্দ্রনাথ
৩)বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্র পত্রিকা