গল্প: মাটির দেহ

গল্প: মাটির দেহ

মাটির দেহ
মৃধা আলাউদ্দিন

হালিমা বেগমের স্বামী শরফ আলিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যায়। তার দুদিন পর শরফ আলি লাশ বেপারিদের মসজিদের পিছনে ডাঙার পাশে পাওয়া যায়। তাও আবার অর্ধেক শেয়াল-কুকুরে খাওয়া এবং দূরে ডাঙ্গায় তখনও দুএকটা শেয়াল তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল। মানুষ দেখে শেয়ালরা দ্রুত জঙ্গলের ভেতর সরে যায়। সেই সঙ্গে একটা বেজিও ডাঙা সাঁতরে চলে যায় ওপারে এবং থরথর করে গতির হুল্লোলে কাঁপছে পানি।
ধরাধরি করে সবাই শরফ আলির লাশ বাড়ির ভেতরে উঠানে এনে রাখল, মুহূর্তেই লোকজনে ভরে গেল বাড়ি। … স্বামীর এ অবস্থা দেখে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে ধপ করে মাটিতে পরে গেল হালিমা বেগম। বড় মেয়ে সখিনার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠল।… কুকুটার ঘেউ ঘেউ শব্দেও কি যেনো একটা ব্যথা লুকিয়ে রইল।

জ্ঞান ফিরে হালিমা বেগম দেখল সবাই শুধু তার জন্য অপেক্ষা করছে, নইলে বহু আগেই দাফন পর্ব শেষ হয়ে যেত এবং এতো লোকের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে আরেকবার চিৎকার দিয়ে হালিমা বেগম স্বামীর পাশে গিয়েÑ ও আল্লাহরে মোর অ্যাহন কি অইবে। মুই অ্যাহন কই যামু। কি হরমু…
কে বা কারা যেনো হালিমা বেগমকে ধরাধরি করে ভেতরে নিয়ে গেল। কিন্তু কান্না থামে না অ্যাহন মুই কই যামু, পোলাপান লইয়া ক্যামনে বাঁচমু এবং আকাশের দিকে, শূন্যে তাকিয়ে সে আবার চিৎকার দিয়ে বলে উঠল… এ কার পাপে তুমি মোরে এতো বড় শাস্তি দিলা। এ কোন পরীক্ষা? … আল্লাহ তুমি কোথায়?

স্বামীর মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পরেই হালিমা বেগম নিজের হাতে নাকের ফুল, কানের দুল খুলে স্বযতেœ ট্রাংকে রেখে বাইরে নেমে এলো। শুরু হলো অন্য জীবন, অন্য নদীর গান। বাড়ি বাড়ি মানুষের কাঁথা সেলাই, ঢেঁকিতে ধান ভানা, বাসন মাজা। কিন্তু দুঃখের নদীতে চড়ে বেশিদিন হালিমা বেগম ঢেঁকিতে পা রাখতে পারল না, ঢেঁকির সেই পা একদিন জমিতে এসে ধান ক্ষেতের আলে রাখল এবং শুরু হলো মানুষের কৈছালি, ক্লেদাক্ত কুসুম জীবন।… জমি নিড়ানি, খেটে খাওয়া বদলা দেওয়ার দিন।
এভাবে বদলা দিয়ে তিন-চার দিন পর হালিমা বেগমের ছেলে মেয়েরা একদিন ভাত খেতে, তবে যেদিন বদলা নেই, সেদিন ভাতও নেই রুটিও নেই… সংসারনির্ভর করত কচু শাক আর গমের ছাতুর ওপর। কেননা, এখানে পুরুষ বদলারা দুই আড়াই টাকা করে পায়। মহিলার আরও কম। তবে মহিলাদের মধ্যে হালিমা বেগমই সবচেয়ে শক্তিশালী। সে একজন পুরুষ বদলার সমপরিমাণে কাজ করতে পারে। কাজের শেষে সবাই যথা বিশ্রাম নেয়, হালিমা বেগম সেই বিশ্রামের সময়টুকুতেও কাজ করে এবং জ্যৈষ্ঠের খর রৌদ্র এখানে বড়ই উত্তপ্ত।
বড় মেয়ে সখিনা করিম শেখের বাড়িতে টুকটাক কাম করে দ্যাঁয়। আর সে সেখানে খুদ-পানি পানতা মাঝে মধ্যে পায়, তাতে হালিমা বেগমের এ অভাবের সংসারের বড় উপকার হয়। তা ছাড়া করিম শেখের বৌ বড় ভালো মানুষ। তার ছেলেরা ঢাকায় বড় বড় চাকরি করে। তাদের অবস্থা ভালো।

কদিন থেকে সখিনার মার ভীষণ জ্বর যাচ্ছে, সে বিছানা থেকে একদম উঠতে পারছে না। সখিনার আয়ও বন্ধ। করিম শেখ তার বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকা গেছেন; এক লাখপতির একমাত্র কন্যাকে ছেলের বউ করে ঘরে আনতে। বড় লোকের বিয়ে, খুব বেশি ধুম ধাম হওয়া চাই।… বিয়ে নয় যেনো দস্তুর মতো একটা প্রতিযোগিতা। গহনায়, শাড়িতে, চুরিতে কে কতো বেশি টাকা খরচ করতে পারে সেই প্রতিযোগিতা। কার্পণ্য করা চলবে না। ছেলেদের ইচ্ছায় করিম শেখ দুহাতে টাকা ঢালছে।
সকাল বিকাল সখিনা মায়ের মাথায় পানি দেয় সেই সঙ্গে পানি পট্টি। আর হালিমা বেগমের এই জ্বর দেখতেই ছুটে আসে পাশের বাড়ির লিটনের বিধবা মা। লিটন ছাড়া এই বিশ্বসংসারে বিধবার আর কেউ নেই। লিটনকে গর্ভে রেখেই তার বাপ মারা যায়, ছয় মাসের গর্ভে। লিটন মামাদের, বিশেষ করে ছোট মামার প্রচুর সাহায্য পেয়েছে। তবে হ্যাঁ, বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে মামারা বিয়ে করে আলাদা হয়ে যায় এবং সেখান থেকে এখন আর লাউটা, শাকটা আসে না। নিজের জমির ফসলেও সারা বছর হয় না। নিরুপায় হয়েই সে অন্যের জমিতে বদলা দেয়, কাজ করে, মাটি কাটে। আর তাতে মা-ছেলে বলা যায় বেশ সুখেই আছেন।
লিটনের মা হালিমা বেগমের গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বলে সখি! তোর মার নিমুনিয়া অইছে?
নিমুনিয়ার কথা শুনে সখিনার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়, গলা দিয়ে কথা আসে না। তবু বহু কষ্টে চলে কইতে পারি না। তয় মায় কিছু খায় না।
অ্যাহন আর ভাত দিস না। রুডি বানাইয়া দে, নইলে সাগু। ভাত পামু কই, ঘরে তো চাউল নাই। রুডিই দেওন লাগব।
হালিমা বেগমের এই অভাবী সংসারে চাউল না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবুও চাউল নাই শুনে লিটনের মার গলা ধরে এলো। তিনি কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। তারপর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো সখি তুই ল মোর লগে। বলেই দ্রুত সখিনার হাত ধরে বাইরে চলে এলেন এবং তখনও উঠানে দুইটা মোরগ ঝগড়া করছিল। আর তাদের আসতে দেখে সশব্দে পালিয়ে গেল মোরগদ্বয়। কুকুরটা খ্যাক করে লেজ উঁচিয়ে অন্য জায়গায় গিয়ে বসলো।

সন্ধ্যাপর পরে লিটন এলো সখিনার মাকে দেখতে। বাড়িতে ঢুকেই সখি সখি বলে ডাকতে লাগল। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের এই লিটন দেখতে বেশ সুন্দর। স্বাস্থ্যও ভালো। গরিবের ঘরে অর্ধাহারে অনাহারে থেকে সখিনা যে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে ঠিক তা নয়, বলাবাহুল্য এই অর্ধাহারে অনাহার তার রূপের কোনো ঘাটতি করতে পারেনি। অল্প বয়স। শ্যাম বর্ণ। কিন্তু চেহারায় চমৎকার একটা আর্ট আছে। দামি ফ্যাশন ভূষণ গায়ে জড়ালে তাকে রাজকুমারী বলতে কেউ ভুল করবে না। মোটকথা হালিমা বেগমের এই অভাবী সংসারে সখিনা যেনো একটি আতঙ্ক।… ভাগ্য ভালো ওর ওপর এখনও কোন নরপিশাচের লোলুপ দৃষ্টি পরেনি।
লিটনের ডাকে সখিনা ভিতর থেকে বাইরে এলো। আরে লিটু ভাই! ভিতরে আও। বও।
না বমুনা, চাচির বলে অসুখ?
হয়।
কই দেহি। বলেই লিটন ভিতরে ঢুকল।
চাচি! কি অবস্থা তোমার?
ভালো না। আর বলো না, বলেই হালিমা বেগম প্রায় কেঁদে ফেলল। চোখে পানি এলো, ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ল কয়েকটা।
চাচি! তুমি কান্দো ক্যা?
কই বাজান, মুই তো কান্দি না। চোখ মুখ নিচু করে কান্না লুকাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
ঐ যে, তোমার চোহে পানি।
হি হরমু, কোত দিন জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসের রৌদ পিডে লাগাইলাম। কিন্তু মোর চোখের পানি তো হুগায় না।… গরিবের চৌক তো পানি না থাকলে অয় না। হালিমা বেগমের এসব কথায় অন্ধকার ঘর আরও অন্ধকার হয়ে এলো। লিটন সখিনা কারও মুখে কোনো কথা নাই এবং বোধকরি লজ্জায় সখিনা নীরবেই চলে গেল পাছ দুয়ারে। সেখানে তার ছোট ভাইবোন কচুর শাক দিয়ে গমের ভাত খাচ্ছে। ঘরের প্রদীপটা সেখানেই। এদিকটা আধো আধো অন্ধকার আর এ অন্ধকারেই নীরব হয়ে চকির কোণে বসে আছে লিটন… এবং যন্ত্রণাকাতর এই দুটি প্রাণী বহুক্ষণ নীরব থাকার পর হালিমা বেগমই প্রথম কথা বললো। তিনি বললেন : লিটু, কাইল তোর লগে সখিরে মাডি কাটতে লইয়া যাবি। না খাইয়া তো আর থাহা যায় না।
লিটন অধিক আশ্চর্য হয়ে সংক্ষেপে শুধু এটুকুই বললো : চাচি!
হয় কাইল সখিরে তোর লগে লইয়া যাবি। প্রায় উল্টাদিক মুখ করে বললো হালিমা বেগম।
মাইনষে খারাপ কইবো।Ñ ম্লান মুখে বললো লিটন।
মাইনষে কইতে পারব। ভাত দিব না।
না, সখি ঘরেই থাকপে। প্রায় আবদারের সুরে বলেই উঠতে চাইল লিটন। কিন্তু উঠতে পারল না, সে হাত গরম স্পর্শ অনুভব করলো। দেখল হালিমা বেগম তার হাত ধরে আছে। বলছে : মোর অনুরোধ, তোর লগে কাইল সখিরে লইয়া যাবি।
লিটন কোনো কথা না বলে জোর করে হাত ছাড়িয়ে ঘরের বাইরে এলো। কিন্তু বোধকরি বাইরে যন্ত্রণা আরও বেশি, বাতাসে মিশে আছে সখির কান্না।… অন্ধকারে দিকবিদিক হাঁটছে কুকুরটা। কান প্রচণ্ড খাড়া করলে শোনা যাবে দূরে দুএকটা পেঁচা বা শেয়ালের ডাক। তারই মধ্যে দিয়ে ব্যথায় ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরে গেল লিটন।

ফজরের আজানের পর পর সখিনার ঘুম ভেঙে যায়। ছেঁড়া কাঁথার ভেতর থেকে উঠে সে বাইরে আসে। আবার ফিরে যায় ঘরে, পাছ দুয়ারে।… মায়ের গায়ে মাথায় হাত রাখে, জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে হালিমা বেগমের সমস্ত গা। হঠাৎ এতো জ্বরের কারণ বুঝতে না পেরে সখিনা ব্যতিব্যস্ত হয়ে মাকে দুতিনটা ডাক দেয়। মা, মা, কিন্তু মা লা-জওয়াব। কোনো শব্দ নেই… এবং সখিনা কাঁদতে কাঁদতেই পানি দিতে থাকে মায়ের মাথায়। পানি দেয়া শেষ হলে সখিনা ছুটে যায় লিটনদের বাড়ি। পেছন পেছন ছুটে আসে কুকুরটা। কিন্তু সে অল্পক্ষণ এবং কুকুরটা ফিরে যায় তার আপন গন্তব্যে। ছাইয়ের গাদিতে।
লিটন উঠানোর শেষ প্রান্তে আসতে না আসতেই সখিনা এসে হাজির।
কিরে তুই?
হয় তোমার লগে যামু।
না।
সখিনা আশ্চর্য হয়ে বললো… না! তয় খামু কি?
লিটন এ কথার কোনো জবাব না দিয়ে বললো, বাড়ি যা।
না।
বারবার সখিনার মুখে না শুনে লিটন বললো, তোর ভাত-কাফুর আমিই দিমু। এ্যাহন বাড়ি যা।
এই কথা আগে কইতে পারলা না?
এ্যাহন তো কইছি।
ঠিক আছে যামু। তয় বাড়ি না, তোমার লগে, মাডি কাডতে।
মুহূর্তেই এ কথার কী জবাব হতে পারে খুঁজে না পেয়ে লিটন রাগে গজগজ করতে করতে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। তবে তার হাঁটায় কোনো ডান ছিল না, বাম ছিল নাÑ যন্ত্রণায় অর্ধেক জবাই হওয়া গরুর মতো ছটফট করে হাঁটছিল লিটন এবং সখিনাও পেছন পেছন হাঁটতে লাগল।

পূর্বের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সামনের সন্ধ্যার পরই অন্ধকার রাত্রি এবং সখিনা পাখিদের নীড়ে ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে ফিরল। সঙ্গে ছিল লিটন, অথচ কারও মুখে কোনো কথা নেই, বোবায় বধিরে শেষ হল দীর্ঘ পথ।
বাড়ি ফিরে ছোট বোন বেলাকে নিয়ে সখিনা রান্নায় গেল। বেলা বুবুর দরদ বোঝে। সে মায়ের কাছে শুনেছে, তার বুবু অনেক দূরে মাটি কাটতে গেছে। তাই সে বুবুর সামনে তেলটা-নুনটা এনে রাখে। শাকটা, পাতাটা কুটে দেয়। রান্না শেষ হলে সখিনা গোসলে যায়। অন্য দিন এ সময় ঘাটে কেউ থাকে না। আর তার ব্যতিক্রম।
ঘাটে একটা তক্তায় বসে লিটন তখনও শরীর ঘঁষামাজা করছে। তার শরীরে কাপড় বলতে ছোট্ট এক টুকরো ছেঁড়া গামছা, তাও আবার ভিজে লেপটে আছে। ভেজা শরীরে লিটনকে কোনো কামযুক্ত দেবতা মনে হচ্ছিল। লিটন সখিনাকে দেখে ঝুপ করে পানিতে লাফ দিল। ঘন ঘন কয়েকটা ডুব দিয়ে পাশ কেটে উঠে চলে গেল বাড়ি। যেনো পৃথিবীতে এ দুটি প্রাণীর কথা বলা সম্পূর্ণ নিষেধ অথবা এরা কোনোদিন কথা বলেনি পৃথিবীতে।

বাড়ি ফিরে সখিনা মাকে গরম ভাত দিল, নিজেও ছোট ভাইবোনদের নিয়ে খেতে বসলো। অথচ কিছুক্ষণ পরে সখিনা মায়ের চোখের দিকে চেয়ে দেখে সেখানে পানি। মা খাচ্ছে না। চোখে টলমল পানি নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। সখিনা উঠে এলো মায়ের কাছে।
কি অইছে মা খাও না ক্যা?
মায়ের মুখে কোন কথা নেই, তাই সে আবার বললো ভাত সামনে লইয়া বইয়া থাকলে আল্লায় গুনা দেয়। আল্লাহর কথা শুনে হালিমা বেগম একটু নড়ে উঠে বললো আল্লা কোতায় মা? আমাগো এই দুঃখের দিনে হেরে তো দেখলাম না।
সখিনা এ কথার জবাব খুঁজে না পেয়ে কিছুক্ষণ নীরব রইল, তারপর কি একটা বলতে গিয়েও মায়ের জন্য পারল না। মা নিজেই আবার বাধা দিয়ে বললো, আল্লা গরিব মাইনষেরে লইয়া এমন খেলাই খেলায়… মাইনষের জুয়ান মাইয়া দিয়া মাডি কাডায়, বদলা দেওয়ায়। আর ঠিক এমন সময়েই ঘরে এলো লিটনের মা। ওকে দেখে হালিমা বেগম তাড়াতাড়ি আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। বললোÑ
বহ বুবু, ওই চৌকির কোণায় বসো।
ভালো আছি তয় থাইক্কা থাইক্কা জ্বর ওঠে। ব্যানে তো জ্বরের লাই কথা কইতে পারি না।
অ্যাহনও গায় জ্বর আছে?
হয়। আছে। পানির গ্লাস নামিয়ে রেখে।
গায়ে যহন জ্বর, তয় আর ভাত খাও ক্যা। রুডি খাইতা।
আবার হালিমা বেগমের চোখে পানি নেমে এলো এবং সে কোনো ভাত না ছাড়াই বললো।
সখিনা চাউল আনছে আর মুই ভাত খামু না? এইডা কেমন কথা।
হয়। সখিনার কতাই কইতে আইছি।… ও আর মাডি কাটতে যাইতে পারব না।
কেন, মুখে গম্ভীর হয়ে হালিমা বেগম আবার বললো,
কাইলও সখি মাডি কাডতে যাইবো।
না, যাইবো না। কথায় আদেশের সুর।
ফিরাইতেও পারবা না।
তোমার মান-সম্মানের ভয় নাই?
গরিতের আর কি মান সম্মান।… একটু থেমে হালিমা বেগম আবার বললো কাম না হরলে খামু কি? না খাইয়া কয়দিন থাহা যায়?
দ্যাশে অভাব আইলে দুঃখ কষ্ট তো এটটু হরনই লাগব।
দুঃখ-কষ্ট আর না খঅইয়া থাকা এক না। অসুস্থ শরীর নিয়ে হালিমা বেগম আর কথা বাড়াতে চাইল না। তবু না বলে পারল না। বিরক্তি ভরেই বললো অভাব কি মোর একলার ল্যাই আইছে?
অভাব কি এবং কার জন্য এসেছে, লিটনের মা এর পুঙ্খানুপুঙ্খ জবাব দিতে না পেরে গরম সুরে বললো, তোমার লগে কতা কইয়া পারমু না। তবু জিগাই, সখিনা কি কাইলও মাডি কাডাত যাইবো?
একটা দীর্ঘশ্বাস, আর একটু নীরব থেকে হালিমা বেগম বললো, হয়। যাইবো।

পরের দিন খুব ভোরে উঠেই সখিনা কাজে গেল। পশ্চিম আকাশে ভোরের লাল সূর্য সোনার থালার মতো জ্বলজ্বল করছে। আর ঠিক তখনই পাশের বাড়ির মালেক মাঝির বউ সখিনাদের উঠানে এসে চিৎকার দিয়ে উঠল। বলল, মরিচ গাছ তোর কোন ভ্যাতারে লাগইছে? পোলা পাডাইছো চুরি হইর‌্যা আনতে। আর হেই পোলাডাই বা কই? সামনে পাইলে আত কাইড্ডা দিতাম।
কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে মালেক মাঝির বউ আবার বললো, অ্যাহন আর কারও মুহে কথা ফোডে না? না আতে নাতে ধরা পইর‌্যা মুক বুইজ্যা গ্যাছে?
ভিতর থেকে কোনো শব্দ এলো না, আসার কথাও না। সামান্য ক’টা মরিচ নিয়ে প্রতিবেশী এমন রূঢ় আচরণ করতে পারে তা হালিমা বেগমের জানা ছিল না। কেননা, সেও দুনিয়ায় তার কম উপকার করেনি।
মালেক মাঝির বৌ এদিক-ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর আরও মোটা করে আরেকবার বললো, ভালো ব্যবসাই ধরেছো, মাইয়া পাডাইছো ব্যাডাগো লগে মাডি কাডতে আর পোলাডারে দিয়া মরিছ চুরি…
এতক্ষণে হালিমা বেগমও প্রায় সক্রোধে বাইরে এলো; অথব বলতে পারলো না কিছুই, শুধু এইটুকু ছাড়া, চুরি না। চাইয়্যা আনতে পাডাইছিলাম। কিন্তু মোর পোলায় তোর লাহান ঐ জংলির ডে চাইতেও পারে নায়। তাই না কইয়াই দুইডা আনছে।
একটু থেমে হালিমা বেগম আবার বললো, এই নে তোর মরিচ।… হালিমা বেগম থামলেও মাঝির বৌ থামেনি, সে অনবরত খানকি, মাগি, তুই ভাতার খাইছো। তোর মাইয়্যায় প্যাড বাজাইবে, তোরা মরবি ইত্যাদি বলে মাটিতে দপদপ শব্দ করে আহত বাঘের ন্যায় তর্জন গর্জন করতে করতে বাড়ি ফিরতে লাগল। যদিও সে বাড়ি ছাড়ার আগে হালিমা বেগম তার পায়ের সামনে চার-পাঁচটা মরিচ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সে তা নেয়নি, বরং সব দুমড়েমুচড়ে দিয়ে গ্যাছে হালিমা বেগমদের সকালের পানতা খাওয়ার একমাত্র সম্বল কাঁচা মরচি।

বেশ কিছুদিন পর।
সখিনা বাড়ি ফিরে দ্যাখে মায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। মা কথা বলতে পারছে না, জ্বরে মার শরীর থরথর করে কাঁপছে। ভয়ে সখিনা দৌড়ে লিটনদের বাড়ি গেল, চাচি মায় যেনো কেমন হরে। শিগগির আও।
চাচি এলো, লিটন এলো, প্রতিবেশীরা এলো দূরদূরান্ত থেকেও এলো কেউ কেউ কিন্তু না কিছুতেই কিছু হলো না। যে যাবার সে চলেই গেল, শুধু কান্না থামল না সখিনার। বুবুর কান্না দেখে ছোট ভাইবোন দুটিও কাঁদল কিছুক্ষণ। কাঁদল লিটনের মা, প্রতিবেশীরাও কাঁদল কেউ কেউ।… কাঁদল না শুধু একজন সে লিটন, নিথর, নির্বাক হয়ে পরে রইল বারান্দায় ঐ কোণে। যেখানে মাটিতে হাঁস আর মুরগির খোপ…
কুকুরটাও লিটনের পাশে এসে মাটিতে মাথা দিয়ে বসে আছে, যেভাবে সে হালিমা বেগমের পাশে বসে থাকত। দেখত হালিমা বেগমের নিরবতা, কান্না। এদিকে খাট নিয়ে চলে যাচ্ছে গ্রামের লোকজন, সখিনা চিৎকার দিয়ে আরেকবার বিদীর্ণ করলো আকাশ-বাতাসÑ ব্যথায় ভারি করলো লিটনের কান, নড়ে বসলো লিটন, তারপর উঠে এক সময় হাঁটতে থাকল খাটের পেছন পেছন। সখিনাও হাঁটতে থাকল সেই পথে। লিটনের মা।… সব শেষ, সবার পেছনে কুকুরটাও হাঁটছে।
ধীর, মন্থর গতিতে হাঁটছে সে। অথবা আজ যেনো কুকুরটার হাঁটার কোনো দিন নেই, ডান নেই, বাম নেই।… ডাঙার পানির মতো চলে যাচ্ছে কোনো দিকে কে জানে, সাগরে?
গোরস্তানের পাশেই লাফালাফি করছিল কয়টা বেজি, দুইটা কাক, আকাশে অসংখ্য চিল… ফুলগুলোও ফুটে আছে প্রস্ফুটিত, ডাংগর হয়ে তার পাতায় চিকচিক করছে রৌদ্ররা। … আর ওখানেই ওরা শুইয়ে দিল হালিমা বেগমকে। তারপর ফিরে এলো মানুষ, পথিকজন।
রাত্রিরে জোছনা ভরা আকাশÑ সখিনা-লিটন ব্যথায় মুখ ভারি করে দাঁড়িয়ে আছে গোরস্থানের পাশে এবং নীরব নিশ্চল মাটিতে পড়ে রইল হালিমা বেগম। হালিমা বেগমের মাটির দেহ…