অণুগল্পঃ বিয়ে

বিয়ে
লুনা রাহনুমা
নীলার একমাত্র দেবরের বিয়ের আয়োজন চলছে গত দুই মাস থেকে। বাড়ির বড় বৌমা হিসেবে নীলার উপর সব দায়িত্ব পড়েছে। মেহমানের তালিকা তৈরী করা। তালিকা ধরে সবার ঠিকানায় বিয়ের কার্ড পাঠানো। বিয়ের জন্য কমিউনিটি হল ভাড়া করা। বাড়িতে গায়ে হলুদের স্টেজ কোথায় বসবে তার ব্যবস্থা করা। সিঙ্গাপুরে সোনার দাম কম তাই নতুন বৌমার গহনা আর কসমেটিকসের আইটেমগুলো সিঙ্গাপুরে গিয়ে কিনে আনা হবে। সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের দুটি টিকেট কেটে রাখা হয়েছে। নীলা ও তার স্বামী পারভেজ যাবে আগামী মাসে সিঙ্গাপুর। দেবরের বিয়েতে এটা হবে ওদের পক্ষ থেকে দুজনের জন্য দোয়া ও উপহার।
নীলা থাকে যৌথ পরিবারে। ওদের দুই মেয়ে, শশুর-শাশুড়ি আর দেবর। এই সাতজন ওরা তিন বেডরুমের একটি ফ্ল্যাটে। একমাত্র ননদের বিয়ে হয়েছে নীলার বিয়ের পাঁচ বছর আগে। সবাই উত্তরা তিন নাম্বার সেক্টরে থাকে।
“পরশু রাতে সজলের বিয়ের অনুষ্ঠান আছে সী শেলে। তুমি যাবে?” নীলাকে জিজ্ঞেস করে পারভেজ।
মাথা নিচু করে অন্যমনস্কস্বরে নীলা বলে, “না গো। আমাকে টেনো না। আমার খুব অস্থির লাগে এইসব সামাজিকতা। ভীড় বাট্টা।”
পারভেজ কথা বাড়ায় না। জিজ্ঞেস না করেও জানে নীলা বিয়ের দাওয়াতে যাবে না। আঠারো বছর আগে ওদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর নীলা সব অনুষ্ঠানে যেত খুব আগ্রহ করে। তারপর থেকে কি যেন হয়েছে ওর। কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হয় না। জন্মদিন, কুলখানি, আকিকা, সুন্নাতে খাৎনা, প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী, পিকনিক, করর্পোরেট মিটিং – আরো যত সভা সমাবেশ হয়, কোথাও যেতে আপত্তি নেই নীলার। আপত্তি কেবল বিয়ে ও বিয়ে সংক্রান্ত অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত থাকায়।
মহা আগ্রহে এই যে দেবরের বিয়ের সব কিছু নিজের হাতে গুছাচ্ছে, পারভেজ জানে গায়ে হলুদের দিন সকাল থেকেই নীলার খুব শরীর খারাপ হবে। বাড়ি ভর্তি মানুষের ভেতর গা ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে পড়বে কোথাও না কোথাও মেয়েটা। কেউ ওকে টেনে দেবরের হলুদের স্টেজের কাছে নিতে পারবে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে না। বৌভাতেও না।
“মা আপনার ঘরে এরোসল স্প্রে করে দিয়েছি। এক ঘন্টা পড়ে ঘুমাতে যাবেন।”
“বাবা, আপনার ওষুধগুলো খেয়ে নিন, আমি অপেক্ষা করছি।”
বাড়ির সবার প্রতি খুব খেয়াল নীলার। পুরো বাড়ির একমাত্র কর্তৃত্ব তার হাতে। কখনো কেউ নীলার মুখে রাগ দেখেনি। সব সময়ই মিষ্টি একটি হাসি লেগে থাকে ঠোঁটের কোনে।
সকালে ননদ আসে বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে। নীলার জন্য কয়েকটি বেলিফুলের মালা কিনে এনেছে রাস্তা থেকে।
“ভাবী এই নাও। তোমার জন্য দশ সুতোর ভালোবাসা। কি ফ্রেশ আছে এখনো দেখো। মনে হয় এইমাত্র গাছ থেকে ফুলগুলো তুলে মালা গেঁথেছে।”
মিষ্টি হাসে নীলা। বেলিফুলের মালাগুলো নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকে প্রাণভরে।
রাতে টিভিতে নাটক দেখতে বসেছে ওরা সবাই। নীলা, পারভেজ ও শাশুড়ি। নাটকে মেহনাজের গায়ের রং কালো বলে তার বিয়ে ভেঙে দিয়েছে প্রেমিকের বাবা। মেহনাজ মনের কষ্টে বিষ খেয়ে মরতে চায়।
নীলা টিভির সামনে থেকে উঠে বারান্দায় চলে যায়। সহ্য হয় না ওর। আবার বিয়ে! আবারো সেই বিয়ে ভাঙার কষ্ট! সেই একই নিয়মে মুরুব্বি আর কিছু আত্মীয় নিয়ে মেয়ের বাড়ি এসে আংটি পরিয়ে বিয়ের দিন-ক্ষণ ঠিক করে যাওয়া। তারপর দুপক্ষই মেহমানদের যখন দাওয়াত করে ফেলেছে, বিয়ে হতে কয়েকটিমাত্র দিন বাকি, তখন ছেলেপক্ষের মন বদলে যাওয়া। বিয়ে নামক সামাজিক সওদায় কালো মেয়ে ঘরে এনে ঠকে যাবে মনে করে টেলিফোনে এক কথায় বিয়ে ভেঙে দেয়া। আবারো সেই কালো মেয়ে জন্ম দেয়ার অপরাধে ভোরের জায়নামাজে বসে আব্বার বুক ফাটা কান্না! তারপর চোরের মতো পালিয়ে কাজী অফিসে অচেনা কতগুলো মানুষকে সাক্ষী রেখে কোনরকমে বিয়েটা সেরে নেয়া। আর সেই বিয়েই টেনে নিয়ে বছরের পর বছর একসাথে থাকা! সবাইকে ক্ষমা করে দিয়ে সুখী মানুষের পোশাকের অন্তরালে বিক্ষত জীবন যাপন করা!
বারান্দার ওপাশে রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষেরা কথা বলে। খিলখিল হাসির শব্দ আসে পায়ের জুতোর শব্দের সাথে ঘষে ঘষে। দূরের মসজিদে হালকা আজানের সুর। এশার নামাজ পড়তে হবে এখন।
নীলার কানে এখনো পরিষ্কার বাজে সেই কথা। বিয়ের তিনমাস পর মাথা নিচু করে প্রথম যেদিন পারভেজদের বাড়িতে আসে, আদরের একমাত্র ননদ নীলাকে দেখে মুখ ভেংচিয়ে সবার সামনে বলে ছিল, “প্রেমেতে মজিলে মন- কিবা চাষা কিইবা ডোম!”