সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অন্তর – বাহির

সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অন্তর – বাহির

সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতার অন্তর – বাহির

অশোক অধিকারী

প্রয়াণের পর ব্যক্তির মূল্যায়ণ একটি সহজাত পরম্পরা।সৃষ্টিকর্মের দায় বলে একটি পরিচর্যা নানা আঙ্গিকে স্রষ্টা
সচেতন প্রজ্ঞায় ব্যক্তিকে যখন স্পর্শ করে তখন তার একটা হেস্তনেস্ত হয়ে যায় একপাক্ষিক অধ্যবসায়ে।পাঠ উদ্ধারের আত্মবলয়ে তাই কবিকে জানা অপেক্ষা তাঁর লেখায় মনোনিবেশ করা একটি জরুরি অভীষ্ট। সদ্য প্রয়াত (০৬.০৯.২০২০) কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতা প্রথম যখন পড়ি তখন আমাদের তুমুল অন্বেষায় একটা বোধ কাজ করেছিল। কবিতার নাম ‘দোপাটির ইচ্ছে’(১৯৬৬,দেশ)। “রক্ত বড় ঠাণ্ডা লাগে বহুদিন উষ্ণতা পাইনি,/ আয়ুর ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তোর কাছে তো যাইনি, ” এ জাতীয় স্পর্ধাবর্ণের জীবন নিষিক্ত ব্যাজস্তুতি কবির আন্তরিক জীবন চর্যায় মুখ রাখে। আসলে এক নিদাঘ সময়ের পুরন্দর কবি সাধনা নিজের কথন ভঙ্গির সঙ্গে দ্বিচারিতা করেননি। ঠাণ্ডা ধমনীর রক্ত সঞ্চালন তাঁর বিবিক্ত উষ্মায় উষ্ণতা প্রার্থনা করে। উষ্ণতা মানে সেই অন্তর্গত স্রোত যা নিষিক্ত প্রজ্ঞায় শুদ্ধতার ডায়ালিসিস করে। সাধনার এ উজান কাব্যের প্রকাশকাল ১৯৭০। কালচেতনায় এক পীড়িত
সময়ের আয়ুষ এ সময়। রক্ত ক্লেশ যাতনার উল্লম্ফন আবেগ সহস্র ‘দোপাটির ইচ্ছে’র অপর্যাপ্ত পরিণাম ভাবনায় মুখর। প্রতিস্পর্ধা যেন নতুন সৃষ্টির মাতাল অন্ধকারে মুখ রেখে ভোরের প্রাজ্ঞতায় বিশ্বাসী।সাধনার কবিতার ভেতরেই থাকে স্থানুকে ভেঙে জঙ্গমতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বর।তিনি বিশ্বাস করেন সেই অলক্তিক উপমায়।শব্দ গাঁথেন মুগ্ধ পয়ারের নিত্যতায়। তাই, “চিরায়ত গোলাপের অমরতা আমি তো চাইনি” বলেও লিখতে ভালোবাসেন,“রোদ্দুর পোহাতে শুধু বেঁচে থাকি বার্ধক্যের শীতে”। ‘রোদ্দুর’ ও ‘ বার্ধক্য’ দুই ভিন্নতার ভেতর শূন্যতা অতিক্রমের মিথুন স্বয়ম্বর কবিকে আশাবাদের যোজন অলিন্দে পৌঁছে দেয়। আমরা সময়কে যেমন উত্তরের অপেক্ষায় না রেখে পয়গম্বর বানিয়ে এক শাশ্বত ব্যাখ্যায় আর সব কিছুর মূল্যায়ন করে যাই,কবিতাও তেমন কবিকে থোড়াই কেয়ার করে নিজের শয্যাসঙ্গী করে নেয় কবিতার আস্তিক্যবাদকে।
প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত তাঁর ‘কবিতাপ্রসঙ্গ’-য় লিখেছে, “ আমি যতটা পালটেছি, আমার কবিতাও ততটা পালটেছে। আমি যতটা বদলাব,আমার কবিতাও ততটা বদলাবে। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, আবার সমস্ত ভাঙচুর, সমস্ত পরিবর্তনের অচ্ছিন্ন আছে একটি যোগসূত্রঃ আমার চরিত্রের ভ্রূণ।” স্বীকারোক্তির মোহপর্ব ছলছুতোর দাক্ষিণ‍্যে কবির ব্রাত্য অন্বেষণেে শব্দের জঙ্গলে বোহেমিয়ান হয়ে যায়। বদল যেমন জরুরি তেমনই তার উপযোগী হয়ে ওঠার চর্চায় কবিকে হাওয়া মোরগ লাগাতেই হয় কবিতার কার্নিশে। সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় অন্যতর হেতুর বহমান নিহিত আবশ্যিকতায় নিজের উৎকর্ণ হয়ে থাকার মধ্যেই স্থায়ী থাকে তাঁর জীবনবোধ। সেখানেও পরবর্তী ঘোষণায় মগ্ন তিনি নিজেকে ভেঙে আরও এক নির্মাণে ভাস্কর হন। লেখেন,“ আমার আনন্দ নেই এই শিরোস্ত্রাণে/ অর্জনের ইতিহাস আজও বাজে প্রাণে।” অথ, “তোমরা যে দাম দাও সেই তো এ গৌরবের দাম/ঈর্ষার অনুদ্রেকে কবেই এ খুলে রাখতাম”(শিরোস্ত্রাণ)। প্রণবেন্দুর যে ‘অচ্ছিন্ন’ থাকার ‘যোগসূত্র’ তারই প্রায়োগিক ডাইমেনশন দেখি এ কবিতায়। যেখানে অর্জন এক আবশ্যিকতা। নিজস্ব ভূমির কর্ষণ। বাস্তবিক ইতিহাস উল্লেখিত গৌরব চিহ্ন।
ষাটের কবি সাধনার ‘আকাশ কন্যা’-র প্রকাশকাল ১৯৬০। তারপর, ‘দোপাটির ইচ্ছে’,‘ছন্দকদলী কৃষ্ণচূড়া’, ‘একদা রাজধানী’,কবিতার আদালত’,‘প্রত্যূষের ফুল,’ ‘রমণী গোলাপ’, ‘ক্যাপটেনের স্ত্রীর রবীন্দ্র সংগীত’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থগুলি পরপর প্রকাশ পায়। ভূগোল দিদিমণি হিসেবে শিক্ষকতায় সুনাম ছিল তাঁর।বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকায় শিশুদের উপযোগী করে কঠিন বিষয়কে সহজ করে লেখায় দঢ় ছিলেন তিনি। তাঁর,‘জানা অজানা,’ ‘পৃথিবী ঘুরছে,’ বইগুলি বিশেষ ভাবে সমাদৃত। এছাড়া,‘রান্না করে দেখুন,’‘পুরনো কলকাতার রান্নাবান্না,’ ইত্যাদি বইগুলির এখনও সমান চাহিদা বইমেলায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় পাই, ”কবিকে সত্যদ্রষ্টা বলাটা হয়তো বাড়াবা, কবিতা লিখে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তাও অবাস্ত, তবু, কেউ মানুক বা না মানুক, কবিকে এই বিশুদ্ধকরণের কথা বলে যেতেই হয় ”(নতুন করে দেখা)। বিশুদ্ধতায় কখনো কখনো আপেক্ষিকতা নিয়ে নানান কথাবার্তা উঠলেও তার একটি সারাৎসার গচ্ছিত থাকে ঐতিহাসিকতায়।কবি কেন বিশুদ্ধকরনের পথ মাড়াবেন তা বললেই শাশ্বত অর্থে একটা দায় বর্তে যায় নিজের কাছে,নিজের লেখার কাছে। সেখানে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সমাধান হয়ে গেলেও প্লুত দূরত্বের পরিধির সাথে কবির বোঝাপড়া বাকি থেকে যায়।কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় যখন লেখেন
“…স্থির বিশ্বাস ছিল,/যা- কিছু হয়েছে লেখা,/পুরনো যা-কিছু শেখা,/হাস্যকর;আমরাই একদিন ভরে দেব সৃষ্টির বন্ধ্যতার বুক।”(আমার আলোকতীর্থের বন্ধুরা),তখন দূর ভবিষ্যৎ কৃত্যালির সম্ভাব্যতা যেমন কবিকে নিশ্চিত গম্যতা সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলেনা,তেমনই প্রস্তুতি পর্বের আলোকতীর্থের বন্ধুরা সাধনা সহ জেনে নিশ্চিত যে ,”_ বিদ্যে জাহির করে তর্কের ঝড় তুলতাম”। এত অকপট হয়েই কবিদের কলম ধরতে হয়। ব্যক্তিক গম্ভীরতা সৃষ্টিকে ভাঙিয়ে নেয়। দেয়না কিছুই। অথচ সেই নির্লিপ্ততার ভেতর জন্ম নেয় হয়ে ওঠার অবিনশ্বর বিজ্ঞান। কবি ততদিনে সেই দূরকে দেখে নিয়েছেন। নিজের লেখার প্রতি বিনম্র আস্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন। সৃষ্টির বন্ধ্যতার অন্ধকার দশার মুক্তি আলোকতীর্থের বন্ধুদের দ্বারাই সম্ভব হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সাধনা। “আসলে মসৃণ হতে হলে/নির্মম আঙুল চাই/পরগাছা তোলবার/এমন কি স্বশরীরজাত শ্মশ্রু/মমতায় ক্ষৌরী না করে দিলে/ঢেকে দেয় চিবুকের
/ ইঙ্গিতবহনকারী গঠন বাহার”(নির্মম আঙুল)। কবি সাধনার কবিতার দায় ও মুক্তি এখানেই। সরলতার আশ্চর্য দ্রোহ থেকে অঙ্গার তুলে নিয়েই নিজেকে শুদ্ধ হতে হয়। নির্মমতা এক বোধ। এক মাতৃত্বের অহংকার। পিতৃপুরুষের কালাপাহাড়। যে নিজের মসৃণতার জন্য পাড়ি দিতে পারে মন্থন। গরলের ঐশ্বরিক ভাণ্ড থেকে মানবিক অমৃত তুলে জীবন দেয় নিজস্ব হলফনামা। ঠিক এভাবেই তাঁর কবিতার উত্তরণ দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে, যে বৃহত্তর প্রসেনিয়াম থেকে তিনি কলম ধরেন,সেখানে পরাবাস্তবের অলীক ধূম্রতা তাঁকে এনে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়নি মহাকালীন অস্বচ্ছতায়। এমনকি জাদুবাস্তবের বিস্ময়কর আগ্রাসন থেকে মুক্ত হয়ে কবিতায় হয়ে উঠেছেন অন্তরওবাহিরের প্রতিসাম্য আন্তর্জাতিক।সাহিত্যের উত্তরণ বলে যদি কোনও অধ্যায় সংযুক্ত থাকে। তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় বলতে হয়,“বাংলা কবিতায় বিমূর্তধারা বিশেষ প্রয়োজন ছিল, আরও প্রয়োজন ছিল তাকে অতিক্রম করার।” স্রষ্টাকে অতিক্রম করার খেলায় পঞ্চাশের কবিদের অসহায়তা, অন্তর্গত অস্বস্তি কিছুটা সজীব থাকলেও ষাট ও মধ্য ষাটের তুমুল ভাঙনের গানে মুখর হয়ে উঠেছিল কবিতার জগত। অনেকের সঙ্গে সঙ্গতে হাত ও মত লাগিয়েছিলেন কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়। ‘দোপাটির ইচ্ছে’ তাই, “বেজে ওঠে বারবার মুগ্ধ তার গুনগুনানি শুনে/ আবার ইচ্ছে হয় লাল হয়ে পুড়তে আগুনে”।