রম্যরচনাঃ অনুকরণের অনুলিপি

অনুকরণের অনুলিপি
স্বপন নাগ
ক্রোধ এই রিপুর সহিত রাগ ও রক্তের মত শব্দ দুটির সংপৃক্ততা লক্ষ্য করিয়া থাকি। রাগের বশবর্তী হইয়া কত যে রক্তারক্তির ঘটনা ঘটিয়াছে তাহার বৃত্তান্ত ইতিহাসে বিবৃত রহিয়াছে। অথচ অনুরাগবশত সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করিয়া মজ়নু লায়লার প্রতি অনুরক্ত হইয়া কী ভয়ঙ্কর অত্যাচার সহ্য করিয়াছে, তাহাও আমাদিগের নিকট অজানা নহে। লায়লা-মজ়নুর প্রেমগাথা নিছক কল্পনা বলিয়া ধরিলেও এই ভব সংসারে এরূপ অজস্র বিপজ্জনক অনুভবের ফল্গু স্রোত চোখ-কান উন্মুক্ত রাখিলেই আজও দেখিতে ও শুনিতে পাই। আসলে, অনুভব এমনই বিচিত্র প্রকৃতির, কোনো নির্দেশ বা শাসন দ্বারা তাহাকে রোধ করা যায় না। এমনকি, সহস্র অনুরোধেও তাহাকে নিরস্ত করা একপ্রকার অসম্ভব হইয়া উঠে। যেরূপ আমার পিতামহ। যৌবনে এক সুশীলা মহিলার প্রেমে হাবুডুবু খাইতেছিলেন। তাহার রূপে এতই বিমোহিত ছিলেন যে অনুরূপ সুন্দরী আরও কেহ হইতে পারে, ভাবিতেই পারিতেন না। ভালোবাসিয়া তাহাকে বিবাহ করিবার বাসনা তাহার পিতার সমীপে করিবামাত্র প্রতাপশালী তাহার পিতা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইলেন। তৎকালীন সময়ে সমাজে তাহার প্রভূত মান-যশ। পুত্রের এ-হেন মতি দেখিয়া অনুমতি দেওয়া তো দূর অস্ত্, তৎক্ষণাৎ তাহাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করিলেন। তাহা যে অভিমানবশত, এত বৎসর পরেও আমরা তাহা অনুমান করিতে পারি। অগত্যা, পিতামহ অনুদার পিতার সহিত সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করিয়া পৃথক হন এবং পিতামহীকে বিবাহ করেন। শুনা যায়, এই অনুষঙ্গে পিতার প্রতি পিতামহের কোনপ্রকার অনুযোগ ছিল না। কিয়ৎকাল পরে রাজস্থান প্রবাসকালে ভয়াবহ গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহের প্রাবল্যে তাহার পিতা অসুস্থ হইয়া স্বল্পকালেই মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে পিতার সন্নিকটে থাকিতে না পারিবার অনুতাপ ও অনুশোচনার কথা শেষ জীবনে প্রিয়জনদের সমীপে ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। পিতামহের ছিল অগাধ পান্ডিত্য। বিশেষত ইংরাজি লিখন ও অনুবাদ দক্ষতায় তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ। ফলত অচিরেই একটি সরকারী চাকুরী জুটাইয়া লইতে বিশেষ পরিশ্রমের প্রয়োজন পড়ে নাই। অনুবাদ বাদেও ঊর্দ্ধতন সাহেবদের সাক্ষাৎকারের অনুলিখন তাহার কলমে অপরূপ রূপে ফুটিয়া উঠিত এবং প্রভূত প্রশংসা অর্জনে সক্ষম হইত। পরবর্তী সময়ে পিতামহ কলিকাতার আহিরীটোলায় আসিয়া স্থায়ী বসত গড়েন। পিতামহী সহ পাঁচ পুত্র এবং একমাত্র কন্যা কমলাসুন্দরী।কমলাসুন্দরী বাল্যবিধবা ছিলেন। তাহার একাকীত্ব লাঘবের উদ্দেশ্যে পুনরায় বিবাহ দিবার প্রচেষ্টা পিতামহ করিয়াও সফল হন নাই। ঘটকও নিয়োগ করিয়াছিলেন তথাপি ব্যর্থ হইয়াছিলেন। পিতামহ অতিবৃদ্ধ হইয়া পড়িলে কমলাসুন্দরীর উপরই পরিবারের যাবতীয় দেখাশোনার দায়িত্ব ন্যস্ত করিলেন। বাল্যকালেই আমার মাতৃবিয়োগ হইয়াছিল। কমলাসুন্দরীই আমাকে কোলে পিঠে করিয়া মানুষ করিয়া তুলিয়াছিলেন। পিতা-মাতা, পাঁচ ভ্রাতা ও তাহাদের সন্তানাদি লইয়া কমলাসুন্দরী তখন এক বিশাল যৌথ পরিবারের শীর্ষ সদস্যার সম্মান অর্জন করিয়াছিলেন। যে-কোনো প্রকার সমস্যার সমাধানে তাহার ভূমিকা অনুঘটকের ন্যায় কাজ করিত। পিতামহ ক্রমশই তাহার কর্মক্ষমতা হারাইতেছিলেন। সম্পর্কের হিসাব অনুসারে কমলাসুন্দরী আমার পিতার দিদি হইতেন। আমার পিসি হইলেও বাল্যকাল হইতে মাতৃহারা আমিও তাহাকে দিদি সম্বোধনে ডাকিতাম। কমলাসুন্দরী ছিলেন অত্যন্ত নিষ্ঠাবতী মহিলা। নিয়ম করিয়া প্রতি প্রাতঃকালে সূর্য্যোদয়ের পূর্ব্বে অনুপান সেবন এবং এক ঘন্টার অধিককাল ব্যাপী অনুলোম-বিলোম অনুশীলনে নিজেকে ব্যাপ্ত রাখিতেন। কঠোর ছিল তাহার অনুশাসন। ফলত পিতা খুড়াদের মধ্য তাহার অনুগ্রহ পাইবার একটি প্রতিযোগিতা আমি সেই বয়স হইতেই লক্ষ্য করিতাম। তাহারা সার বুঝিয়াছিল দিদির পছন্দ অনুসারেই সকলকে চলিতে হইবে। সকলকে অনুচরের ন্যায় আচরণ করিতে হইবে। অন্যথায় কোনোপ্রকার অনুনয়-বিনয় সমর্থন পাইবার নহে—তাহারা বিলক্ষণ বুঝিতেন। অনুসন্ধান করিয়া দেখিয়াছি, সেই অনুপাতে আমার পিতৃদেব প্রতিযোগিতায় পিছিয়াই থাকিতেন। এমতাবস্থায় দিদির অনুমোদন ব্যতিরেকে আমাদের পরিবারে কোনো সিদ্ধান্তই গৃহীত হইবার সম্ভাবনাটুকুও ছিল না। তাহার কঠোর নির্দেশ অনুযায়ী তাহা সকল সদস্যকে অনুসরণ করাই আশু কর্তব্য বলিয়া দস্তুর ছিল। পিতা ও খুড়ারা দিদির প্রতি অনুগত, ইহা দেখিয়া, নিজস্ব ভাবনা বিসর্জন দিয়া আমরাও তাহাদের অনুকরণ করিতে বাধ্য হইতাম। কারণ, অন্য কাহারও দখলদারীর অনুপ্রবেশ দিদি তৎক্ষণাৎ নস্যাৎ করিয়া দিতেন। এই সমাজের চতুষ্পার্শে লুপ্তপ্রায় টিকিয়া থাকা টিমটিমে যৌথ পরিবারের সদস্য হিসাবে আমরা বিশ্বাস করিতে বাধ্য হইতাম -- দিদির আদেশ অনুধাবন করা আমাদের একান্ত কর্ত্তব্য ! দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে আমাদের বেড়ে-উঠা, ক্ষুধার উদ্রেক হওয়া, এমনকি শয্যাগ্রহণ ও শয্যাত্যাগের প্রবৃত্তিও যে পিসি তথা দিদিরই অনুপ্রেরণায়-ই বিশ্বাস অধুনা আমাদের মননে অবিরাম অনুরণন তুলিতেছে।