মোহাম্মদ আন্ওয়ারুল কবীরের অণুগল্প

জাতিস্মর স্মৃতি
আমার জন্মান্তর হয়েছে তাও তো অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। সেই শেয়ালডাকা শিশুপল্লীটি তো কবেই ছেড়েছি। গ্লোবালাইজড যুগের কল্যাণে এখন তো আমি বার্লিনবাসী। বটবৃক্ষের মতোন এ শহরেই আজ আমার শাখাপ্রশাখা ঝুরি ছেড়েছে। আমার চাকরি, গবেষণা আর আমার পরিবার। ছাত্রজীবনের ভালবাসা ভিনদেশী মেয়ে ক্রিশ্চিন আর আমি যেন দুজনে দুজনা। দুজনের ভালবাসার ফসল চাষ আর শান্তিকে নিয়ে এই প্রাচুর্য গৃহই তো আমাদের স্বর্গোদ্যান।
পূর্বজন্মের অনেক গল্পগাথাই আজ বিস্মৃতির অতলে। তবু জাতিস্মর স্মৃতি করে তাড়া। আজো অম্লান সেই কিশোরী মুখ । রাতের গভীরে নির্জনে আসে চুপিচুপি। করে প্রশ্ন, ‘আসলেই কি সুখে আছো তুমি?’ ওর প্রশ্নে আমি হারিয়ে যাই, শিশির ঝরা সেই শীত ভোরে… বকুল তলায়। ফুল কুড়ানোর নেশায় আসতো ও, আমিও যেতাম নেশায় নেশায়। কীসের নেশায়…ও কি তখন জানতো তা ! ফুল কুড়ানো শেষে অঞ্জলীতে এক মুঠো ফুল ধরতো আমার নাকের কাছে, সুঘ্রাণে হতাম মাতোয়ারা। একদিন বললো ” আমি কইতাছি বকুল ফুলের মতই সুন্দর হইবো তুমার জীবন। সেইদিন হয়তো আমার কথা ভুইলা যাইবা।” স্পষ্ট মনে আছে, এ কথার জবাবে বলে উঠি, “একটা থাপ্পর মারবো তোরে । তোরে ভুইলা যামু! তুই-ই তো আমার বকুলফুল। সারা জীবন থাকবি আমার সাথে সাথে।”
তারপরই তো হয় জন্মান্তর। বাবার বদলী চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় আসা, ঢাকা কলেজে প্রি-ইউনিভার্সিটি, জার্মানে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়া, বাবা-মার অমতে বিয়ে করা, জার্মান নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়া, বিদেশ বিভুঁইয়ে ভালো চাকুরীর সুযোগ পাওয়া। চাকুরী, গবেষণা আর ফুরসুত পেলেই ক্রিশ্চিন, চাষ আর শান্তিকে নিয়ে হলিডে করতে বেরিয়ে পড়া। কোথায় যে হারিয়ে গেল বকুল আর বকুলের সুঘ্রাণ!
ইনসোমোনিয়া রাতে প্রায়ই ক্রিশ্চিন ঘুমিয়ে গেলে বিড়াল সন্তর্পণে স্টাডিতে যাই অসমাপ্ত কোন পেপার শেষ করবো বলে। চারপাশে মৌ মৌ বকুলের ঘ্রাণে হই আপ্লুত… শূন্যে দেখি ভেসে আছে পূর্বজন্মের মুখস্ত হওয়া সেই কিশোরী মুখ। আমাকে প্রশ্ন করে, ‘সুখে আছো? আসলেই কি সুখে আছো তুমি?’
মাথা যায় আওলাইয়া। সুখ? সুখ কাকে বলে রে বকুলফুল…
মার্গারেট থেকে ম্যাগি
সাগর পাড়ে ছোট্ট ছিমছিমে ইউনিভার্সিটি শহর সোয়ানসি। চারদিকে সবুজের সমাহার, কোথাও কোথাও উঁচু পাহাড় কিংবা টিলা। প্রেমে পড়ার মতোন ল্যান্ডস্কেপ। অনেকটা আমাদের চিটাগাং-এর সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ডর্মে স্থান না হওয়ায় প্রাইভেট হাউজের শরাণাপন্ন হতে হল। ল্যান্ডলেডিকে দেখে মনে হলো বয়স ত্রিশের উপরই হবে। আন্টি আন্টি ভাব দেখে প্রথম আলাপেই আন্টি ডেকে সম্বোধন করি। আমাকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘তোমাদের সাব-কন্টিনেন্টের ছেলেমেয়েদের সমস্যা এটিই, কারো সাথে পরিচয় হলেই আত্মীয় সম্পর্ক পাতিয়ে ফেলো। আমার এটা পছন্দ না। আমার নাম মার্গারেট… বয়সে তুমি ছোট, তাতে কী! তুমি আমাকে মার্গারেট নামেই ডাকবে।’
যশ্মিন দেশে যদাচার।
হয়তো বা সেদিন থেকেই শুরু। মার্গারেট থেকে কীভাবে যে একদিন সে আমার ম্যাগি হয়ে যায়।
ইচ্ছাকৃত কিংবা মনের ভুলে
পুরোটাই আকষ্মিক। তিনদশক পরে দেখা ওদের। হিথরো এয়ারপোর্টে এক কফিশপে মুখোমুখি বসে আছে এখন। আসুন, দূর থেকে শুনি ওদের কথপোকথন-
আহ, কতদিন পরে দেখা! ফয়সল, তুমি কিন্তু একটুও বুড়ো হওনি …
টাক পড়ে যাওয়া মাথায় হাত বুলিয়ে হাসে ফয়সল। জুঁই, তুমি বোধ হয় সেই সময়কার আমাকে দেখছো। আশ্চর্য, শরীরের উপর সময়ের আঁচড় কি তোমার চোখে পড়ল না! তবে তুমি একটু মুটিয়ে গেলেও বদলাওনি খুব একটা। পঞ্চাশের কাছাকাছি এসেও যে কীভাবে ফিগার ধরে রেখেছো ভাবতে অবাক লাগছে …
জুঁইয়ের মুখে লজ্জার আভা ভেসে আসে। হ্যাঁ, বয়স তো কম হল না। ছেলে বিয়ে করেছে। গতমাসে নাতিও পেয়েছি একটি।
ও, তাহলে তো তুমি এক জেনারেশন উপরে উঠে গেছো। আমার তো তা হবার জো নেই। ছেলেমেয়ে নেই, তাই নাতি-নাতনি পাওয়ার কোন আশাও নেই। বুড়ো বয়সেও বুড়ো হব না … হা হা হা হা…
তোমার হাসিটা কিন্তু সেই আগের মতনই প্রাণখোলা। আচ্ছা, শুনেছি তুমি বিয়ে-শাদি করোনি… আমার জন্য এভাবে জীবনটা নষ্ট করলে কেনো বলো তো?
ফয়সল হাসে। কোন উত্তর দেয় না। চোখে ভেসে আসে মার্গারেটের মুখ। যার সাথে গত দশ বৎসর লিভ-টুগেদার করে আসছিল সে। জুঁই নয়, মার্গারেটই শিখিয়েছিল তাকে ভালোবাসার মানে। হঠাৎ অ্যাক্সিডেন্টে … পরানের গহীনে এখনো সে জীবিত।
কি কোন উত্তর দিচ্ছ না যে? তুমি যে আমাকে এতটা ভালবাসতে তখন কিন্তু বুঝিনি …
ফয়সল এবারো হাসে। মোবাইলে সময়টা দেখে বলে আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে। তুমি তো যাবে নিউয়র্কে … আমি যাচ্ছি প্যারিসে, বিজনেস ট্রিপ ..,
কিয়দক্ষণ পরে আমরা দেখি জুঁইকে আলতো একটি হাগ দিয়ে ফয়সল এগিয়ে যাচ্ছে এয়ার ফ্রান্সের কাউন্টারের দিকে। নাহ, কোন কার্ড কিংবা মোবাইল নম্বর বিনিময় করতে দেখা গেল না তাদেরকে। বিষয়টি কি ইচ্ছাকৃত নাকি মনের ভুলে!