গল্প: লোবানের গন্ধমাখা গল্প

গল্প: লোবানের গন্ধমাখা গল্প

লোবানের গন্ধমাখা গল্প

মো. আরিফুল হাসান

বিজয় ক্লাসিকে কনভার্ট করে তোফাজ্জল লেখতে বসলো। সে একরাতের একটি লাশের গল্প লেখবে। গল্পটি লেখার জন্য কেউ তাকে অনুপ্রাণিত করেনি। কিন্তু সে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়, গল্পটি তাকে লেখতে হবে। তফাজ্জল লাশের পাশে বসে যায়। বসার আগে মফিজুদ্দীন তাকে অনুরোধ করেছিলো, সে যেনো রাতটি তাদের সাথে জাগে আর লাশের পাশে বসে কোরআন তেলাওত করে। তোফাজ্জল ও মফিজুদ্দীন জামিলকেও অনুরোধ করেছিলো, কিন্তু জামিল বসেনি। চাচাতো বড়ভাই মফিজুদ্দীনের সামনে না না বললেও, তোফাজ্জলকে কানে কানে জানিয়ে দিয়েছে, তার শরীর আজ ভালো নেই। অগত্যা তোফাজ্জল একাই বসলো লাশের পাশে, তার সাথে এসে যোগদিলো ভাতিজা তামিম, মফিজুদ্দীন ও লাশের বড় চাচা তৈবুর মল্লিক। মফিজুদ্দীন তৈবর মল্লিককে অনুরোধ করে বললো, আপনি তামিমকে নিয়ে যান এবং মেঝো ভাইয়াকে সান্তনা দিন, এবং নিজেও একটু শুয়ে বিশ্রাম নিন। মফিজুদ্দীন এই ফাঁকে কিছুটা খেয়ে এসেছে। দুপুরের পর থেকে খাবার নেই তার। সে সন্ধ্যায় খাইয়েছে, মেঝো ভাই ও ভাবিকে নিজে বসে থেকে খাইয়েছে। ভেবেছে নিজে খেয়ে নেবে শোবার আগে, কিন্তু তার আর খাওয়া হয়নি। এখন, এই মাঝরাতে একমুঠো কড়কড়ে ভাতে গরম ডিম মেখে দ্রুত লুকমায় খাবার শেষ করে আবার বসেছে।

তোফাজ্জল কুরআনুল ক্বরীমের প্রথম পাতা থেকে শুরু করে। আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। আর রাহমানির রাহিম। মালিকি ইয়াও মিদ্
দ্বীন। মফিজুদ্দীন তার বড় ভাই তৈবুর মল্লিকের কাছ থেকে পাঞ্জেগানা অজিফার কিতাব হাতে নিয়ে চুমু খায়। দরুদ শরীফ পড়তে পড়তে কিতাবটি খুলে। দরূদে তাজ পড়ে এবার দেখে দেখে, তারপর সুরা ইয়াসিন, সুরা আররহমান পাঠ করে বেশ সুললিত কণ্ঠে। পাঠের সময় তার দরদী দীলের কতটুকু গলে গিয়েছিলো তা তোফাজ্জলের মনে নেই। কিন্তু সেই রাতের গল্পগুলো, যা সে করতে শুনেছে তার মা, তার চাচী, মফিজুদ্দীন আর তার বাবার কাছ থেকে সেগুলো সে লেখে রাখতে চায়। তোফাজ্জলের মনে হয়, এ কথাগুলি লিখে রাখা দরকার, নাহলে এসব মূল্যবান স্মৃতির নহর যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। মানুষ তো ভুলোমন জীব, আজব জীব! বাপ মরে- ভুলে যায়, মা মরে- ভুলে যায়, সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে পিতার হৃদয় শতগুন মরে- তবুও ভুলে যায়!

তোফাজ্জল লেখতে শুরু করে। ব্রেইনে চাপ পড়েছিলো বাচ্চাটির, জন্ম হবার সময়। তারপর আর বাড়িমুখো হবার সময় পায়নি। হাসপাতালে হাসপাতালে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতেই তার মৃত্যু হয়েছে। প্রথমে নিয়েছিলো কুমিল্লা। রাতটা রাখার পর সকালে বড় ডাক্তারদের পরামর্শে আবার ছুটতে থাকে এম্বুলেন্স। সাথে রুদ্ধশ্বাসে ছুঁটতে থাকে তৈবুর মল্লিক, বাচ্চার বাবা-মা, মামানী ও মফিজুদ্দীন। মফিজুদ্দীনের অফিসিয়াল জরুরি কাজ থাকায় সে তার বাসার পথে নেমে যায়। তৈবুর মল্লিক রাজধানীর পদ্মা জেনারেল হাসপাতালে ভাতিজাকে লাইফ সাপোর্টে রেখেও জলস্পর্শ করে না। মফিজুদ্দীন জানায়, আমি যেতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু সারারাত আমি দুই চোখের পাতা একত্র করতে পারিনি। মফিজুদ্দীন দিনক্ষণটি মনে করতে পারে না, সেটি কী ঢাকা নেওয়ার প্রথম দিন, নাকি দ্বিতীয় দিন তা তার মনে নেই, তবে মনে আছে, সে রাতে, কখন যে একপশলা ঘুম এসে তার চোখে লেগেছিলো তা সে টের পায়নি। এরপর একটি কান্নার আওয়াজ তার ঘুম ভেঙ্গে দিলো। সে চোখ খুলে দেখে, সকাল হয়নি। হাতের কাছে মোবাইলটা নেই, একটু দূরে ওয়ারড্রোবের উপর চার্জে দেয়া আছে। মফিজুদ্দীনের উঠে যেতে মন সায় দিচ্ছে না, কেমন যেনো ভয় ভয় করছে। অবিকল শিশুর মতো কেঁদেই চলছে তার জানলা ঘেষা গাছটিতে বসে একটি রাতজাগা পাখি। মফিজুদ্দীনের মনে হয়েছিলো এটি শয়তান কাঁদছে। এবং সে প্রাণপণে ফজরের আজানের অপেক্ষা করতে থাকে। সে জানে, আজানের শব্দে শয়তান পালিয়ে যায়, তাই সে কায়মনোবাক্যে ভোরের প্রার্থনা করে। দেখতে দেখতে ভোর হয়, ফজরের আজান পড়ে। বৃহৎদুটি পাখা ঝাপটিয়ে তীরোর্ধ্ববেগে পাখিটি পূর্বদিকে পালিয়ে যায়, মফিজুদ্দীন স্পষ্ট বুঝতে পারে।

তোফাজ্জল লেখে, তারপর মফিজুদ্দীনের কথা তার মা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বলে, হ্যাহ! আমাদের বেলাও এমুন, যে রাইতে আনাসের মৃত্যু হইলো, তার আগের রাইতে, সারারাইত, একজোড়া পাখি আমাদের বারান্দার লগে তোমাদের কড়ুই গাছটাতে বইয়া নিম্ নিম্ ডাকছে। হ, সারারাইত। এক্কেবারে ফজরের আগ পুঞ্জত্ত। আনাস নামটি শুনে মফিজুদ্দীন চমকে উঠে না। সে বুঝতে পারে, কিছুদিন আগে মৃত্যুবরণ করা তোফাজ্জলের ভাতিজাটির নামও আনাস রাখা হয়েছিলো। সে যোগ করে, আল্লাহর কী লীলা খেলা! গতদুদিন আগে, বড় ভাইয়া ফোন করে জানালো ভাতিজার নাম রাখতে হবে। সুস্থ্য হোক অসুস্থ হোক পাঁচদিনের দিনে নাম রাখতে হয়। বললো, স্নিগ্ধা নাম রেখেছে আনাস; পিতা ও অন্যান্য বোনদের নামের সাথে মিলিয়ে। মফিজুদ্দীন হাসপাতালের বিছানায় গিয়ে মেঝো ভাইয়া ও ভাবিকে জানায়। ভাবির ক্ষাণিক আপত্তি ছিলো, বলেছিলো, বড় মেয়েটা তাকে ইয়াসিন ডাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু শিশুটির অবস্থার কথা বিবেচনা করে এ নিয়ে আর কেউই কোনো কথা বলতে আগ্রহ পায়নি।
বাচ্চাটিকে আবার কুমিল্লায় নিয়ে আসা হয়েছে। ঢাকার ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এখন চোখের সামনে অন্তিম নিঃশ্বাস ফেলার জন্য অপেক্ষমান নবজাতককে নিয়ে তো আর ঘরে বসে থাকা যায় না, তাই মৃত্যুবন্ডে স্বাক্ষর করে তার পিতামাতা সর্বশক্তিমান আল্লার অপার কৃপায় বিশ্বাস করে কুমিল্লাতেই ভর্তি করিয়ে রেখেছে। এখানে আসার দ্বিতীয়দিন থেকে মফিজুদ্দীন থাকছে হাসপাতালে। আর সেদিনই বাচ্চাটির বয়স হয় পাঁচদিন, আর সেদিনই বাচ্চাটির বড় জেঠা তৈবুর মল্লিক ফোন করে বাচ্চাটির নামকরণের বিষয়ে কথা বলেন, এবং জানান যে নবজাতক শিশুটির নাম হবে আনাস।

অনেক্ষণ ধরে চুপ করে ছিলো তোফাজ্জলের বাবা। তিনি একটু দেড়িতে উঠেছেন। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা শ্রমের শেষে এই বুড়ো বয়সে চোখ লেগে গেলে খুব গাঢ় একটি ঘুম আসে; সহজে ভাঙতে চায় না। তোফাজ্জলের মা গিয়ে ডেকে তুলে এনেছেন তাকে। আসার পর কিছুটা সময় তিনি যেনো ঘোরের ভেতর ছিলেন। প্রয়াত বড় ভাইয়ের চাঁদরে ঢেকে রাখা হয়েছে শিশুটিকে। তোফাজ্জলের বাবা বড় ভাইয়ের চাঁদরটি এতোদিন পর দেখে একঝলক কেঁদে ফেললেন মনে মনে। তারপর যখন তিনি চাঁদরটি উঠিয়ে শিশুটির মুখের দিকে চাইলেন, তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। চুপ করে গিয়ে চেয়ারের সাথে মিশে বসে রয়েছেন। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত তিনি একটি শব্দপর্যন্ত করেননি এবং একবারের জন্যও বসা থেকে উঠেননি। এই প্রথম স্ত্রীর মুখে নিজের নাতির মৃত্যুর কথাটি উচ্চারিত হওয়ায় তার ভেতরের ঢেউ আবারও জেগে উঠে। তিনি হিসেব করে বলেন, দেখছো, একই দিন পড়ছে। তারপর সবাই হিসেব করে দেখে যে তোফাজ্জলের ভাতিজা এবং মফিজুদ্দীনের ভাতিজা দুজনেই সোমবারে মৃত্যুবরন করে এবং একজনের বয়েস ছিলো চার মাস আর আরেকজনের বয়স সাত দিন। কী আশ্চর্য যে তাদের উভয়ের নামই রাখা হয়েছিলো আনাস আর তারা দুজন মৃত্যুবরনও করে সোমবারে।

তোফাজ্জলের বাবা নাতিটির কথা স্মরণ করে বলে, তাকে চাইর মাসের মনে হইতো না, মনে হইতো আটমাসের বাচ্চা; এতো পুর-পার, লম্বাচওড়া আছিলো! তারপর উপস্থিত সকলে মফিজুদ্দীনের ভাতিজার লাশের দিকে চেয়ে বলতে থাকে যে, তাকে দেখেও সাতদিনের বাচ্চা বলে মনে হয় না, মনে হয় চারমাসের বাচ্চা। তোফাজ্জলের চাচি বিলাপ করতে করতে বলে, এ… থাকত না বুইল্লাই দেহাই গেছে! এমুন বাচ্চা আমার এই জীবনে খুব কমই দেখছি। তারপর মফিজুদ্দীনের মনে পড়ে যায় তার সোফিয়া আপার কথা। সে গলা খাকারি দিয়ে শুরু করে, আমার সোফিয়া আপাকে তো আমি দেখিনি, আমার জন্মের দুতিন বছর আগেই তিনি মারা গেছেন- জন্মের চল্লিশ দিনের মধ্যে। কথাটি বলে সে একটু দ্বিধায় পড়ে যায়, চল্লিশই তো! তোফাজ্জলের মা তার কথায় সায় দিয়ে বলেন, হ্যা, চল্লিশের মধ্যেই। তখন তোফাজ্জলের চাচি আবার কথা বলে উঠেন, এমন রূপ জগতে আছিলো না। রেজু কাহা একটা চিল্লান দিয়া কইছিলো, এমুন রূপ হাবেজ সাবে ভুলবো ক্যামনে? তারপর তিনি আবারও লাশের মুখের চাদরটা সরিয়ে নবজাতক শিশুটির লাশের নাকে মুখে কপালে স্নেহের হাত বুলাতে থাকেন, অবিকল আমার জালের নাকটা, আহারে…! তারপর তোফাজ্জলের মা ও তার চাচি মফিজুদ্দীনের মায়ের কথা মনে করে কাঁদে। তারা বলতে থাকে, মরা নাতির মুখ দেইখ্যা না জানি এখন জালে কী অবস্থাটাই করতো!

তোফাজ্জলের লেখতে লেখতে ঘুম পাচ্ছিলো। সে ঘুম তাড়াতে একগ্লাস জল খেয়ে আবারও কম্পিউটারের কীবোর্ডে হাত চালাতে থাকে। সে রাতের স্মৃতিটা তাকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছে। প্রথমে ভেবেছিলো সে হয়তো সারারাত জেগে থাকতে পারবে না। এই কৈশোরউত্তীর্ণপ্রায় সময়ে লাশের পাশে সারারাত জেগে থেকে পাহাড়া দেয়াটা হয়তো তার পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু এখন কেমন যেনো ঘুম-চুক সব উধাও হয়ে গেছে। চোখের মধ্যে যেনো কেউ এঁকে দিয়েছে ভোরের সূর্যমুখী রোদ। মফিজুদ্দীন তোফাজ্জলকে একটু শোতে বলে, বলে, আমরা তো জেগে আছি, তুমি ছোট মানুষ একটু ঘুমাও। কিন্তু তোফাজ্জলের দুই চোখের পাতায় কোনো ঘুম নেই। সে আবিষ্ট হয়ে শুনে লাশের পাশে বসে থাকা তার মা-চাচি, বাবা ও মফিজুদ্দীনের করা গল্পগুলি। এই কচি বয়েসে তার মনে এই গল্পগুলো গভীর রেখাপাত করে। তোফাজ্জলের মা বলতে থাকে, আমরার আনাসের মা, হেইদিন, হেই রাতে এগারোটা পর্যন্ত তো হজাগই আছিলো; তারপর কীযে কালঘুম ঘুমাইল! ফজরের আগডাত হাত দিয়া দেহে বরফ, নিথর। ঘুমের মধ্যে মইরা রইছে। তোফাজ্জলের বুকের ভেতরটা আবার দুমরে মুচড়ে যেতে থাকে, হাহাকার করে উঠে।

তোফাজ্জলে বাবা ও মফিজুদ্দীনের বাবা আপন চাচাতো ভাই। মফিজুদ্দীনের নিজের কোনো আপন কাকা না থাকায় বিপদে আপদে এই চাচাতো কাকারাই পাশে দাঁড়ায়। আজও তারা এসেছে। তৈবুর মল্লিক হার্টের রোগি, আরও নানাবিধ রোগশোক তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। তাই ভাতিজাকে জোর করে অন্যঘরে শুইয়ে তোফাজ্জলের মা-চাচিরা লাশের পাশে বসেছে। কিন্তু মফিজুদ্দীনকে ঘুমাতে বললেও সে ঘুমাতে যায় না। লাশের পাশে বসে কখনো তোফাজ্জল, কখনো তোফাজ্জলের মা-বাবা অথবা তোফাজ্জলের চাচির সাথে গল্প করে। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে করে লাশের পাশে পাহাড়াদার লোকেরা চাঙ্গা থাকে এবং জেগে থাকে। মফিজুদ্দীন আবার গল্প করে, আনাসকে কুমিল্লায় আনার প্রথম দিন যেতে পারিনি। অফিসের কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। পরদিন দুপুরের পর যখন আমি হাসপাতালে গেলাম এবং ডাক্তারদের সাথে ব্যাক্তিগত আলাপ করলাম, তখন জানতে পারলাম যে ভাতিজার আশা একেবারেই নেই। তবুও দৌঁড়ে দৌঁড়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। ডাক্তারেরা বিরক্ত হননি, প্রতিবারই এসেছেন এবং একই কথা শুনিয়েছেন বারান্দায় ডেকে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে। মফিজুদ্দীন চোখের জল ধরে রাখতে পারে না, তার কণ্ঠ ভারি হয়ে আসে। সে বলে, গতকাল বিকেল থেকেই বাবুর হাতপা ঠাণ্ডা ও শক্ত হতে থাকে। ডাক্তারেরা অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। ক্রমশ খারাপের দিকে যেতে থাকে। আর আজ দুপুরের পর থেকে শুধুমাত্র নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসে বুকের উঠানামা ছাড়া তার সারা দেহ মৃদদেহের মতো ঠাÐা হয়ে যায়। মফিজুদ্দীন বলতে থাকে, তারপর, বিকেলের দিকে মেঝো ভাইয়া সন্তানের মুখের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, বাবুর শ্বাসপ্রশ্বাসটা এমন হয়ে যাচ্ছে কেনো? মফিজুদ্দীন দেখে যে বাবু মুখ হা করে গলা টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে অনেকটা ঊর্ধ্বশ্বাসের মতো। মফিজুদ্দীন আবার ডাক্তারের কাছে দৌঁড়ায়। সে সময় থাকা ডাক্তার এসে সবকিছু দেখে বলেন যে তাদের আর কিছু করার নেই। তবুও সৃষ্টিকর্তা বলে একজন আছেন, তিনি চাইলে সবকিছু পারেন।

তোফাজ্জলের কম্পিউটারে বিজয় ক্লাসিকের বর্ণগুলো যেনো কাঁদতে কাঁদতে সারি বেঁধে দাঁড়াতে থাকে। সে লেখে, তারপর মফিজুদ্দীন বলতে থাকে, সন্ধার পরপর আমরা দেখতে পাই যে বাবুর এই হা করে গলা টেনে শ্বাস ফেলার মাত্রাটা দ্রুতবেগে বেড়ে যাচ্ছে। উপায়ন্তর না দেখে আবারও দৌঁড়ালাম ডাক্তারের কাছে। একসাথে অনেকজন ডাক্তার এলেন এবার। ডাক্তার বাবুর বুকে অনেক্ষণ স্টেথোস্কোপ চেপে রেখে দীর্ঘশাস ছেড়ে আমার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে গেলেন, বললেন, এখন যে অবস্থা একে ডাক্তারির ভাষায় বলে গ্রেজলিং ব্রেথ। সময় গণনা করা ছাড়া এখন আর আপনাদের কিছুই করার নেই।

তোফাজ্জল লিখছে। গল্পগুলো সে সে রাতে মফিজুদ্দীনের মুখে শোনেছিলো। আরো অনেক গল্পই সে রাতে তার চাচি, তার মা, তার বাবা ও মফিজুদ্দীন করেছে। সে সবগুলো গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলো। কি করে মফিজুদ্দীনের মা তার সন্তানদেরকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতো, কীভাবে একটু জরকাশি হলেও সারারাত সন্তানের শিয়রে জেগে থাকতো, অথবা তার এখন যে বয়েস, মফিজুদ্দীন ঠিক এই বয়েসে থাকতেই তাকে খালে গোছল করা থেকে ডেকে তুলতে গিয়ে স্ট্রোক করে মারা যায় সে গল্পগুলো সে শুনে। মাস ছয়েক আগে তোফাজ্জলের নানার মৃত্যুর কথাও উঠে আসে তাদের আলোচনায়।
মফিজুদ্দীন আবারও বলে, সর্বশেষ রাতের দশটার কাছাকাছি সময়ে বাবুর শ্বাসপ্রশ্বাসের মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে কমে যেতে থাকে। সন্ধ্যার পরপর ডাক্তারের কথা শোনে মফিজুদ্দীন ভাই ও ভাবিকে জোর করে খাবার খাওয়ায়। সে বুঝতে পারে, আজ কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে বিপত্তি ঘটে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি। খাবার খেয়ে মফিজুদ্দীনের মেঝো ভাইয়া সন্তানের শ্বাসপ্রশ্বাস খেয়াল করে আঁৎকে উঠে। জোড়ে জোড়ে কলেমা পড়তে থাকে মৃত্যুপথযাত্রী নবজাতকের কানের কাছে। মফিজুদ্দীনের মেঝো ভাবি কান্নার তোড়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে থাকেন। মফিজুদ্দীন দেখে, কীভাবে টিকটিক করে চলতে চলতে ঘরির কাটা একসময় এসে থেমে গেলো!

মফিজুদ্দীন বলে, তারপর দ্রুত এম্বুলেন্স নিয়ে আমরা বাড়ি চলে আসি। তবুও রাত একটা বেজেছে আসতে আসতে। আসার পথে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে আগর, আতর ও গোলাপজল কিনেছি। তোফাজ্জলের বাবা লাশের শিয়রের কাছে আরও দুটো আগর ধরিয়ে দিতে দিতে চোখ মুছে। একসময় ফজরের আজান পড়ে যায়। মফিজুদ্দীন গিয়ে তার ভাইদের ডেকে তুলে, জোর করে তোফাজ্জল ও তোফাজ্জলের বাবা-মা-চাচিকে ঘরে পাঠায় ঘন্টাখানিক বিশ্রামের জন্য। সকালে আবার বাঁশ কাঁটতে হবে, নানা প্রকার ঝামেলা আছে। তোফাজ্জল ফিরে যায়, কিন্তু তার বুকের ভেতর গেঁথে থাকে সে রাতের গল্পগুলো। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে পাঁচরাতের আগের রাতের সে গল্পগুলো তার আবারও মনে পড়ে। তার মনে হয়, সত্যিই তো, ঘড়ির কাটার মতো চলতে চলতে একটা সময় এসে থেমে যায় মানবজনম। তারপর জীবিতরা আবার সবকিছু ভুলে পূনরায় জাগতিক যাপন শুরু করে, কিন্তু ভেতরে থেকে যায় গভীর সুস্পষ্ট শোকের ক্ষত। নতুন কোনো বিষাদের মুখোমুখি হলে আবার সেগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তোফাজ্জল নিজের পড়ার ঘরে গিয়ে কম্পিউটারটি ওপেন করে। দ্রুত হাতে ওয়ার্ড ফাইল খোলে বিজয় ক্লাসিকে কনভার্ট করে নেয় কিবোর্ড। তারপর কাঁপা কাঁপা কান্নামাখা হাতে লেখতে থাকে সে রাতে লাশের পাশে বসা মুরব্বীদের মুখ থেকে শোনা লোবানের গন্ধমাখা গল্পগুলো।