গল্প: বংশ পরিচয়

বংশ পরিচয়
শামীমা সুলতানা
জমির আইল ধরে ক্ষেতের ফসল দেখছে ফজু শেখ। লক লকে ধানের শীষগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয় পরম মমতায়।যেন আদরের পুত্র সন্তান।ভবিষ্যতের একমাত্র অবলম্বন।বাবা –মায়ের মানিক রতন।আঁধার ঘরের চাঁদ।সোনালী ছোঁয়ায় আনন্দাশ্রু গড়ায় দুই ফোঁটা।শিহরিত হয় প্রাণ মন।
বড্ড খুশি বড্ড আহ্লাদিত ফজু শেখ।আইলের উপরে সিজদা দেয় গভীর ভালোবাসায়।খোদাতায়ালার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতায়।
এইবার সলুকে বিয়া করামু। আমার সাত রাজার ধন সলু।পরীর ল্যাহান বউ নাইগবো তার নাইগা। আমার জমির এই ধানের নাহোল। দেখলেই জানি পড়ানডা জুড়াইয়া যায়। আমার উডান জুইরা নাতি নাতকুল আইসবো খেলবো।ব্যানবেলা কিচির মিচির কইরবো চড়ুই পহির মতো। মুরগির খোপ খুইল্লা দিলি যেবা হইরা আস(হাঁস) মুরগী কল কলাইয়া বাইর অয় অবা হইরা বাইর অইবো।
ফজু শেখ বাচ্চা কাচ্চা খুব পছন্দ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার মাত্র চারটে সন্তান। তার আবার তিনটাই মেয়ে।একজন আদরের বংশ প্রদীপ লকলকে হয়ে উঠেছে মাত্র। বাপ মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান সে। আদরের মাত্রা তাই ঢের বেশী। তিন বোন বিদেয় হয়েছে বাপের বাড়ির আগাছা ছিল যারা।তাদের যত তাড়াতাড়ি সাফ করা যায় ততই ভালো।এমন বিশ্বাসী ফজু শেখ বিয়ে দিয়েছেন সব কয়টা মেয়েকে। এখন তার একমাত্র কূল রক্ষাকারী বংশ প্রদীপ সলু বাড়ি ঘর উজ্জ্বল করে আছে।আসমানের একমাত্র চান।
আসলে নাম তার শেখ মোহাম্মদ সোলায়মান। তিন মেয়ের পরে যখন এই রাজপুত্রের মতো পুত্র সন্তান জন্ম নেয় নামাজ কালামে ইমানদার ফজু শেখ শৌর্যে বীর্যে খ্যাতিমান পয়গাম্বারের নামে নাম রাখে।আর আল্লাহর কাছে দুই হাত তুলে মোনাজাত করে,ইয়া আল্লাহ আমাক তুমি এতো দিন পর রহম হরছো। একটো ব্যাটা দিছো ।আমি কি কইয়া শোকর জানামু খোদা জানি না। এরে তুমি আমার উপযুক্ত বংশধর কইরা বড় কইরবার দিও। গাও গতরে পালোয়ানের মতো শক্তি দিও।তাক একশো বচ্চর আয়ু দিও।
আরও কত কিছু দোয়া করে এই সাত রাজার ধন মানিক রতনের জন্যে। শুধু দোয়া করা হয় না আল্লাহ তুমি ওকে মানুষ বানিয়ে দিও দেশ দশের উপকারের জন্য।
সেদিন থেকে ফজু শেখ যেন ভুলেই যায় তার আরও তিনটে কন্যা সন্তান আছে। সংসারে সোলায়মানের সেবায় সবাই নিয়োজিত। এই কাজ অবশ্য তিন বোনে আনন্দের সাথেই করে। কেউ খাইয়ে দেয় কেউ গোসল করিয়ে দেয় কেউবা কাপড় পালটিয়ে সাজিয়ে গুজিয়ে পাড়া বেড়াতে যায়।ফজু শেখ তার জন্যে আকিকা করে। দশ গাঁয়ের মানুষ খাওয়ায় ঢোল পিটিয়ে।বাড়ির আলানে পালানের চৌদ্দ বিঘা জমির সব ফসল কেটে জায়গা বের করে। সেখানে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে দেয় সবার জন্যে।মাটিতে চট বিছিয়ে দেয়।কচি কচি কলার পাতায় বারান্দায় ভরে যায়। আশেপাশের দশ গাঁয়ের মানুষ সেই মজলিসে আসে। পেট পুড়ে খায় গরুর মাংস ভাত।কলার পাতায় বেড়ে দেওয়া খাবারের ঘ্রাণ আর খাবার শেষের মিষ্টি দই বহু বছর মনে রাখে মানুষজন।ধন্যি ধন্যি সাড়া পড়ে এলাকায়।দান খয়রাত করে ভিখারি মিসকিনের মাঝে।
ইমানদার পরহেজগার ফজু শেখ। তার ইমানের বড্ড বড়াই। সেখানে যায় ঢোল পিটায় নিজ মুখে। কেউ কেউ আড়ালে আবডালে মুখ টিপে হাসে। কিন্তু সামনে কিছু বলে না।তোয়াজ করে কেউ কেউ। সালাম আদাব দেয়। আবার দুই কদম পিছনে গিয়ে তারাই কুৎসা করে নানা রঙ তামাশায়। আজ ধান ক্ষেত থেকে ফিরতি পথে তার চোখ ছানাবড়া।
একলা এক মাইয়া ব্যানবেলা কনে যায়। ও গেদি এ্যাল্লা খাঁড়াছিন দেহি।
মমতা ফজু শেখের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে যায়। কিছু কইবেন কাকু।
তুমি কার বিটি গো ?
উত্তর পাড়ার ইদ্রিস মণ্ডলের মেয়ে আমি কাকু।
তা এই ব্যানবেলা কনে যাও একলা একলা।
কাকু আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি তো, সাইন্স নিয়েছি। কিন্তু আঙ্গোর গাঁয়ে ভালা টিচার নাই। আমার অঙ্ক সমস্যা।স্কুলে স্যারের কাছে পড়ি। এরপর ক্লাশ করে বাইত আসমু।
আইচ্ছা। তা তোমার বাপজান বাইত আছে নাহি।
আব্বা আহুন দোহানে গেছে।
আইচ্ছা। তুমি যাও। আর হোনো ম্যালা ডাঙর অইছো। মাতাত কাপড় দ্যাও। সইল ঢাকো বালো হইরা। আঙ্গর গাঁয়ের এক খান মান ইজ্জত আছেনা! এবা হইরা ডিঙ্গি মাইয়া একলা বাইর অও। আমি দেহি তোমার বাপের হাতে কতা কই। দুনিয়াডা রসাতলে যাইবো দেখতাছি। গাও গতরে ডেঙ্গি মাইয়া জজ ব্যারিস্টার অইবো আর কী। বিয়া দিলি যাইবোগা জামাইর বাইত। এগো পড়াইয়া কি লাব অইবো। মণ্ডলরে আইজ জিগাই দেহি। জত্ত সব নাফরমানের দল।ভাত পায় না থিক্তহাক।দোকানীর দোকানী আবার রঙ ঢঙ্গ।
মমতা কিছু না বলে সালাম জানিয়ে চলে যায় নির্ভয়ে। সে জানে যত কিছুই বলুক তার বাবা তাকে পড়াবেই। কারণ তার বড় বোন যখন ক্লাস এইটে পড়ত একটা বিয়ে হয় হয় অবস্থা। সে কেঁদে কেটে তার স্কুলের মনু আপাকে জানায়। মনু আপা খুব স্মার্ট বিজ্ঞান টিচার। তাঁকে দেখেই তার পড়াশোনায় আগ্রহ বেড়েছে। তার স্বপ্ন মনু আপার মতো হবে। কি সুন্দর করে কবিতার মতো করে কথা কয় আপা। পরাণডা জুড়াইয়া যায়। তো যেদিন তার বোনের বিয়ে ঠিক হয় সেই দিন মনু আপাকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে মমতার বোন। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে সবার প্রিয় মনু আপা যখন জানতে পারল ক্লাশ এইটে পড়া মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তিনি হেডস্যারকে সাথে নিয়ে ইদ্রিস মণ্ডলের বাড়ি যান। তাকে বুঝিয়ে আসেন মেয়েদের শিক্ষার কতটা দরকার। তিনি আরও জানান—
এই যে আমাকে দেখেন। আমি বাবা মায়ের পাঁচ মেয়ের মাঝে তিন নাম্বার সন্তান। বাবা- মা শুধু মাত্র ছেলে সন্তানের জন্যে পাঁচ মেয়ে জন্ম দিয়েছেন। এক সময় পুত্র সন্তানের অভাববোধ করতেন। এখন কিন্তু করেন না। কারণ আমরা পাঁচ বোন যথাযোগ্য। বাবা- মায়ের দায়িত্ব পালন করি পুত্রের চেয়েও বেশী। তাই দয়া করে মেয়েদের এই বয়সে বিয়ে দেবেন না। আপনার ছয় মেয়েকে যোগ্য করে তুলুন। আরও অনেক কথা বুঝিয়ে বলেছেন মনু আপা। সেদিন থেকে ইদ্রিস মণ্ডল সম্পূর্ণ ভিন্ন মানুষ।
তাদের স্বপ্ন এখন শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া।
ফজু শেখ রাগে গজরাতে গজরাতে চলে। হনহন করে হাঁটছে সে।ভাঙাচুরা খানাখন্দে হোঁচট খায় বার কয়েক। দোয়া কালাম পড়তে পড়তে হাঁটছে সে। ক্ষিপ্র গতি। পারলে দৌড় দিত। একবার আসমানে চায় আবার সামনে তাকায়। রাগে গজরায়।বার দশেক বলা হয়েছে নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ।
হাঁটতে হাঁটতে ইদ্রিস মণ্ডলের দোকানের কাছে যায়।দোকানের সামনে বেঞ্চ রাখা আছে দুইটা। লোকজন এসে চা বিড়ি খায় গাল গল্প করে।ইদ্রিস নানা রকম গৃহস্থালি টুকিটাকির সাথে চা ও পান রেখেছে।একাজে সাহায্য করার জন্য একজন মানুষ রেখেছে। ছেলেটা খুব চটপটে।ফজু শেখকে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি বেঞ্চ পরিষ্কার করে দেয়।সালাম দিয়ে বসতে বলে।
নাহ, আমি ইহিনে বসপার আসি নাই। আমার অতো আজাইরা সময় নাই।
হুম, তা ইদ্রিস কেবা আছো তুমি? আইজকাইল দেহাই যায় না তোমাক। তোমার মাইয়া পোলা কয় জন মনে পড়ত্যাছে না- মুখটা রাগত বেজার।
কেবা হইরা মনে থাইকবো, আপনি তো এম্মুক আইসেনই না।
হ, তা ঠিক কইছ।কি হরমু কও এতো গুইলা ধান চাইলের ক্ষ্যাত এক কামলা কি আর হরবো।তাছাড়া দিন মজুরীর লোকও ইদানিং পাওয়া যায় না। হক্কোল সময় কাম নিয়া এতো ব্যস্ত থাকি ! তার উপুর নামাজ কালাম তো আছেই। এক খান ছেলে পাইছি তার ভুতভবিষ্যৎ নিয়া ভাবতি অয়।
আপনি তো ভাইজান এক পোলা পাইছেন। আমার তো ছয় মাইয়া।এগোর খাওয়া খাদ্য নেহাপড়ার খরচ চালাতিই হিমশিম। অপসর কই পামু।মাশাল্লাহ কষ্ট অলিও মাইয়াগুলা আপনেগো দোয়ায় খুবই ভালা। দোয়া কইরেন ভাই জান।
তা দুই একটা বিয়া থা দিছো নাহি?
না, আহুনও দেই নাই। চার মাইয়া স্কুলে কলেজে পড়তেছে। আগামী বছর আবার আরেকটোক ভর্তি করামু। আরেকটো তিন বছর বয়স। আর পোলাপান নিমু না।
কি কও এইন্না। ব্যাটা নাইগবো না তোমার? বংশপ্রদীপ না অলি বুড়াকালে দেখবো কেডো, তাছাড়া তুমি মইরা গেলি কেউ তো তোমাক মনেই করবো না। ভিটায় ঘুঘু চরবো তহন। আর বিটি গুইলা বিয়া দ্যাওনা কেন? এ্যাগোর কি জজ ব্যারিস্টার বানাইবা।আর বানালিই বা কি আইসে যায়। বিয়া দিলিই এরা পর। জামাই গোরে বাইত যাইবো। তোমার কি লাব অইবো কও।তাছাড়া ইসলাম কইছে মাইয়া গোরে পর্দার মইধ্যে রাইখতই।তারা অইলো কইটার জিনিস।তাগো তুমি উদাম রাখছো।আল্লাহ মাপ করুক তোমাক,হেদায়েত দিক। তুমি তো বহুত নাফরমানি করত্যাছো মিয়া।বহুত নাফরমান। আইজ বিয়ান বেলা দেখলাম তোমার মাইয়া একলা একলা স্কুল যায়।
হুম, ওডো আমার তিন নাম্বার মাইয়া। ক্লাশ নাইনে পড়ে।খুব ভাল ছাত্রী।
ক্লাশ ফাইবে বৃত্তি পাইছে। ক্লাশ এইটে ও বৃত্তি পাইছে।আমার কোন খড়চা দেওন লাগে না।
ফজু শেখ রাগে গজরাতে থাকে। লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলে বাড়ির উদ্দেশ্যে। হাঁটা পথে অবাক হয়ে চেয়ে দেখে অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য।তার সলু তার একমাত্র পুত্র ধন সিগারেট টানছে। সাথে আরও কিছু সমবয়সী গোল হয়ে বসে আডডা দিচ্ছে।হতচকিত শেখ কি করবে বুঝে পায় না। সেকি ওই খানে যাবে, নাকি তার সন্তানকে বাড়ি ফিরতে দেবে আগে।মাথা থেকে টুপিটা খুলে ঢিলে পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে নেয়। নীরবে চেয়ে থাকে অপলক চোখে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এখন আর তার স্লুকে দেখতে পায় না। কিছু আবছায়ার মতো দৃশ্যপট। একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার পা বাড়ায় বাড়ির পথে। মনকে সান্ত্বনা দেয়-
ডাগর হয়েছে পোলা এ্যাল্লাম্যাল্লা খাইবারই পারে।মনকে সান্ত্বনা দেয় ।
রেহেনা বানু শেখ পত্নী। সহজ সরল গ্রাম্য জীবন যাপন । দুনিয়া বলতে শেখের ভিটা আর ফেলে আসা বাপ মায়ের ঘর। মা-বাবার পরিবার ছেড়েছে সেই কোন অতীতে ভুলতে বসেছে সব।পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই নারীর সংসার জীবন চল্লিশের কোটায়। তিন মেয়ে বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনীর মুখ দেখা হয়েছে সে অনেক আগে। কোন কোন নাতনী হয়ত বিয়ের উপযোগী।ভাগ্য ভাল বহু দিন হয় তার মেয়েলী অসুখ সেরে গিয়েছে অথবা কোন অসুস্থতার জন্যেও হতে পারে , নইলে মা-মেয়ে হয়ত একই সাথে সন্তান জন্ম দিত।শেখের ব্যাটার খুব ছেলে পুলের শখ।তবু গ্রামের আর দশটা মানুষের মতো সে যে নতুন করে পুতুল বউ আনে নাই সেটাই রক্ষে।
ফজু শেখ হনহনিয়ে ঘরে ঢোকে রেনু রেনু বলে চিৎকার করতে থাকে।এখানেও শেখ মিয়া ব্যতিক্রম।গাঁও গেরামের মানুষ বউকে নাম ধরে ডাকে না। কিন্তু শেখ মিয়া তাই করেন।
কি হরো হারা দিন তুমি বাইতে।হারা বাইতে একটো ব্যাটা তার খয় খবর কিছু রাহো? আইজ তাক দেকলাম বিড়ি টাইনতে।পুবের ভিটাত বইসা কয়জন মিসকিনের পোলার হাতে বিড়ি খাইত্যাছে।
রেনু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে।হাত পাখা দিয়া বাতাস করে।
বইয়েন আগে। পরে হুনমানি। পাঞ্জাবী খোলেন। ঘাইমা যে ডুব দিয়া উঠছেন।বইসেন তো।
পরম যত্নে হাত ধরে খাটের কোনায় বসায়।নিজ আঁচলে মুখ মুছে দেয় রেনু।ঠাণ্ডা পানির অর্ডার দেয় কাজের মেয়েকে।
পতি ভক্তি করে বেহেস্তের চাবি অর্জনের শত চেষ্টা রেনুর।কী না করে স্বামীর জন্য। স্বামীর সুখের জন্য মাঝে মাঝে গৃহকর্মী জুয়ান মাইয়াদের নিজ বিছানায় ফজু শেখের খেদমতে পাঠিয়ে দেন।স্বামীর হুকুম পালনে অষ্টম জান্নাতেরর দুয়ার খুলে যায়। তার সুখের জন্য যে নারী জীবনের সব সুখ ত্যাগ করে তার আর বেহেসতের চিন্তা কী?
এই সব অবশ্য শেখ সাহেবের শেখানো জ্ঞান।
রেনু বিবি বেহেসতের সুখ কল্পনা করে এখনই রোমাঞ্চিত। আর কয়দিন বাঁচবে সে।আসল যায়গার সুখ তৈরিতে ব্যস্ত রেনু।
ফজু শেখের ধমক খেয়ে রেনু বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে। এটা নতুন কোন বিষয় না। দিনে রাতে বহু ধমক খেতে হয় তাকে। বোকা লোক অতি চালাকের সাথে থাকলে যা হয়।তার বুদ্ধি কোন কালেই পরিপক্ক হয়না। হবে কী করে?দশ এগারো বছরের একটা বালিকা বধূ যেদিন এই বাড়িতে আসে মা বুকে জড়িয়ে বলেছিল—আইজক্যা এই যে পাল্কিত চইরা জাইত্যাছস মা এডাই তোর শেষ যাওয়া।মনে কর বাপের বাড়ি আহুন পর। ওরা জেবা হইরা তোক হিকাইবো হেবাই চলবি। এ্যার বাইরে এক পা চলবি না।তাইলেই অমঙ্গল অইবো।
পরিবারের মঙ্গল চিন্তা করতে গিয়ে বোকা রেনু আর নতুন কিছু শিখল না।পৃথিবীতে এই বোকারাই সুখে থাকে।তারা অন্যের শেখানো বুলি সত্য ভেবে জীবন পার করে দিতে পারে। রেনুও তাই বোকা থেকেই সুখী।
দিন গড়িয়ে বহু কাল পেরিয়ে । সময়ের স্রোতে জীবন ভেসে যায় নিয়মের তোয়াক্কা না করে। কারো জীবন এক জায়গায় থেমে নাই।ভাঙ্গা গড়ার হিসেব নিকেশ করতে গিয়ে জীবন কখন অস্তমিত সূর্যের সাথে ঢলে পরে কেউ বলতে পারে না। উত্থান পতন জীবনের ভাঁজে ভাঁজে। জীবনের শত কষ্ট যাতনা তীর ভাঙা বহমান নদীর মতোই। নীড় ভাঙে আবার গড়ে তোলে নতুন স্বপ্ন মেখে জীবনের সুখ পেতে। কারো সুখ উছলিয়ে পড়ে আনন্দ বন্যায়। কারো সুখ জল উছলিয়ে ধুয়ে নিয়ে যায় অতল গহ্বরে। বেদনা বিধুর বাকী জীবন চলে ক্ষীণ স্বরে। তবু জীবন টেনে টেনে নিয়ে যায় শেষ বেলায়। ইচ্ছে করলেই জীবন ছেড়ে চলে যাওয়া যায়না।জীবনে যতই দুঃখ আসুক। জীবনকে বয়ে নিতেই বাধ্য মানুষ।
ফজু শেখের একমাত্র বংশধর সলুকে বিয়ে করিয়েছে পাঁচ বছর আগে অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিকে। লকলকে ধান ঘর যেমন ভরিয়ে তুলেছে তেমনি দূরবর্তী গাঁয়ের ব্যবসায়ী মোল্লার সুন্দরী কন্যাকে ঘরে তুলেছে ঘর আলো করে।এই কয়বছরেই তার ঘরে দুই দুইটি নাতি হেসে খেলে বেড়ায়।নদী পাড়ের উর্বর জমির মতো নারীরা ও যেন একটু বেশী উর্বর। বছরের এই মাথা ওই মাথায় সন্তান। যেন জমিন খালি না যায়। এক শস্য থেকে আরেক শস্য ঘরে তোলা। তবু তরুণী বউ তরুণী মা হয়ে নিজ দেহের যত টুকু সঞ্চিত খাদ্য কণা থাকে তাই দিয়ে নয় মাস লালন করে গর্ভে। বড্ড অবাক কাণ্ড! বিধাতার অপরিসীম শক্তি যেন নারী দেহে স্থাপন করে দেয়া।যে মেয়েটির দৈহিক বর্ধন এখনো শেষ হয় নাই সেই দেহের খাবার খেয়ে বাড়তে থাকে আরেক মানব দেহ।
সলু তার তৃতীয় সন্তান আগমনের অপেক্ষায় আছে।একমাত্র সলুর ঘরে দুই বংশপ্রদীপ জ্বলেছে। তিন নাম্বারও তাই হবে ধাত্রী অগ্রিম সংবাদ দিয়েছে। দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পর ধাত্রী রেনুকে বলেছে-
হোন গো মিয়ার বিটি।তোমার বউমা তো রাজকপাইল্লা।এরপরের বারও তো দেখত্যাছি তোঙ্গর নাতি অইবো। দেহো,নাড়ের মধ্যে কত গুইলা গাইট। এইগুইলা অইলো পোলা অয়নের লক্ষণ। আমাক এবার এক জোড়া কাপড় দেওন ন্যাইগবো কইলাম।
রেনু খুশিতে ডগোমগো। হুইনছেন সলুর বাপ।দাই কি কইলো। আঙ্গোর সলুর নাহি আবার পোলা অইবো।
খুশিতে ফজু শেখ উল্লসিত। তার বউমা লক্ষ্মী প্রতিমা। আহারে কি ভাল মাইয়াই না পাইছি।
দাইকে তার চাহিদা পূরণে বাঁধা নাই।
আমাদের সলুর কোন ভাবনা নেই। ঘরে স্ত্রী পুত্র মা-বাবার আনন্দ হাট। সে শুধু খায় দায় আনন্দে থাকে বন্ধু মহলে। বিড়ি সিগারেট তাস আড্ডা আর ও আনন্দের যদি কিছু থাকে তা প্রাপ্য তার।বাবার সংসারের একমাত্র উত্তরাধিকারী। শুধু হুকুম করলেই পাওয়া যায়। যার মাথায় বটবৃক্ষ, সক্ষম অর্থশালী বাবা আছেন।তার আর ভাবনা কিসে।
আর ওই দিকে আমাদের দোকানদার ইদ্রিসমিয়া হাজার টানাটানির জীবনে ছয় সন্তান লেখাপড়া করায়। বড় মেয়ের আগামী মাসে বিয়ে। নিজ পছন্দের ছেলের সাথে। ছেলেটা ইদ্রিস মিয়ার মেয়ের কর্পোরেট অফিসের সহকর্মী।বড় মেয়ে ফাতিমা তার হবু বরকে বাবার আর্থিক অবস্থা সব খুলে বলেছে। তাকে বিয়ে করতে চাইলে কি করতে হবে বেশ হিসেব কষে নিয়েছে আগেই। বিয়েতে কোন অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান নয়।শুধু মাত্র আনুষ্ঠানিকতা। বাবাকে কোন অর্থ কষ্টে ফেলতে চায়না ফাতিমা। নিজ সঞ্চয়ের কিছু অর্থ বাবার হাতে তুলে দেয় তা যেন বাবার সম্মান রক্ষায় ব্যবহৃত হয়। সেই চিন্তা ফাতিমা আগে থেকেই করে রেখেছিল।
আমাদের নদীগুলো বড্ড মায়াবী। উর্বর মাটি দিয়েছে জমিনে পলির পরত। ধান পাট আঁখ কলাই আরও কতো কিছু ফলায় মনের আনন্দে গান ধরে জারি সারি ভাটিয়ালী। পাকা ফসল যখন বাতাসে ঢেউ খেলে কিষাণের দেহ নেচে ওঠে শিহরণে।জড়িয়ে আদর করতে মন চায়।প্রেয়সীর ভরা যৌবন যেন অঙ্গ জুড়ে। কি যে সুখ সেই সোনালী অঙ্গে!কিষাণের প্রেম ভরা মন ছাড়া কে আর বোঝে। দূর চরাভুমিতে স্বপ্ন রেখে ঘরে কিষাণীর সাথে আগামীর স্বপ্ন বোনে।সংসার সুখের হাজার বায়না রাখে স্বামীর কানে কানে। ধান ঘরে তুলে কত রকম আহ্লাদ পূরণের স্বপ্ন দেখিয়ে চলে !!গ্রামের মেঠো কিষাণ কিষাণীর অন্ন বস্ত্র বাসস্থান সব স্বপ্ন আশা এই ফসল ভরসা। যে বছর ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ে সে বছর তাদের দুখের সীমা থাকে না।
আশা নিরাশা প্রকৃতির খেলায় চলে। এবার প্রচুর ধান জন্মেছিল। গোলা কানায় কানায় পূর্ণ রেখে পাট লাগিয়েছে মাঠে। কচি পাটের ডগা হাওয়ায় দোলা দিয়ে চলে ঘোমটা পরা বধুর মতো । কি যেন অন্য রকম ফসল দিচ্ছে এবার মাঠে। কতদিন মনে হয় এমন ফসল ফলে নাই। নিচু জমি গুলোতে আউশ ধানের শীষ দেখা যাচ্ছে। আশে পাশের গাঁও গেরামের মানুষের কত স্বপ্ন চোখে। এবার সব স্বপ্ন পূর্ণ হবে সেই ভরসায় দিন গোনে গাঁও গেরামি। বৈশাখের শুরু থেকেই আবহাওয়া বদলাতে থাকে। কালো মেঘে ছেয়ে যায় চারপাশে। বজ্রপাত আর ঝড় । গরু মরে কারো বা খেত পোড়ে। দুই একজন মানুষ ও মরেছে লোক মুখে শুনেছে গ্রামবাসী।
হঠাৎ আনন্দ খুশী কমতে থাকে।
আজ ইদ্রিস মিয়ার দোকানে আলাপ চলছিল। নদীর বাঁধের মুখে নাকি ফাটল ধরেছে।যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে এমন থাকলে বাঁধ ভাঙতে পারে।সবার আশঙ্কা কাজ করে।
ফজু মিয়া হাঁক ডেকে কয়—চুপ থাকো মিয়ারা।হোন মিয়ারা, এই দুবলাই গাঁয়ের মানুষ এমন কোন পাপ করে নাই যে আল্লাহ আঙ্গোর এমন শাস্তি দিবো।
চাচা নদী কী পাপ পুণ্যি বুঝে ?
তা নদীডারে চালায় কেডো কও ছিন বাপুরা?
এই মহান আল্লাহ।
আল্লাহ দয়ার সাগর। তিনি বান্দার কষ্ট অয় এবা কাম হরে না বুঝলা?
মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে গ্রামের মানুষ ঝড় বৃষ্টি নিয়ে ঘরে বসে থাকে।
অতি বৃষ্টিতে নদীর পানি ফুঁসে ওঠে।মাঝরাতে উজানে বাঁধ ভেঙে প্রচণ্ড খড়স্রোতে পানি ঢুকে পড়ে।চারপাশে প্রচণ্ড পানির চাপে আশে পাশের দুই চার গ্রাম ডুবে যায় মুহূর্তে। তলিয়ে যায় জমির ফসল। সব চেয়ে করুণ অবস্থা তৈরি হয় ভাঙা বাঁধের আশে পাশে। কয়েকটা বাড়ি ঘুমন্ত মানুষ সহ ভাসিয়ে নিয়ে যায়। তাদের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি কখনও। ঘরের সঞ্চিত ফসল মাঠের যৌবনা স্বপ্ন ফসল সব নিমিষেই তলিয়ে যায় বানের পানিতে। গোয়ালের গরুগুলো হাবুডুবু খায় ঘর যায় মানুষ যায়। নৌকার অভাব চারপাশ। মানুষ বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। চেয়ে চেয়ে পশুগুলোর আর্তনাদ দেখা ছাড়া কিছু করার থাকে না।গগনবিদারী চিৎকার আর্তনাদ বাতাস ভারী হয় কান্নার জোরালো শব্দে। মায়ের বুকের মানিক ছিটকে পড়েছে পানিতে। খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে।নদী যেন রাগে ফুঁসতে থাকে। বেপরোয়া উল্লাসে মেতে দুই চার গ্রাম তলিয়ে ডুবিয়ে ভাসিয়ে শান্ত হয় অবশেষে। রাত শেষে বুঝার উপায় নেই এখানে কোন ফসলী জমি ছিল।সোনার সংসার ছিল হাসি ছিল স্বপ্ন ছিল ভালোবাসা ছিল জীবনের উচ্ছলতা ছিল পাখির কলতান ছিল।
চারদিকে পচা লাশের গন্ধে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ঝুম বৃষ্টি বন্যায় বেঁচে থাকা বন্দী মানুষ অথই সাগরে ডুবতে থাকে। জলযোগের স্থানাভাব,খাবার পানির অভাব, চারপাশে অভাবের হাহাকার। ঘরে ঘরে কলেরা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।এক বাড়িতে একজন আক্রান্ত মানে ঘরে যেন মড়ক লাগা। কান্নার রোল পড়ে কোন না কোন ঘরে। মানুষ ভয়ে দরজা খোলে না। ওলাবিবি যদি তাদের ঘরে ঢুকে পড়ে সেই ভয়। মৃত প্রিয়জনকে কবরস্থ করার উপায় না পেয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেয়।কারণ চারপাশে মাটির চিহ্ন নেই শুধুই পানি।
এর মাঝেই চলে ভয়াবহ ভাঙন। পানির তলে কতদূর নদী এগিয়েছে বোঝার উপায় নেই। শুধু যেদিন পরিচিত ঘরগুলো খুঁজে না পাওয়া যায় তখন মানুষ কষ্টে বুক চাপড়ায়। কষ্টগুলো গা সয়া হয়ে যেতে থাকে। যারা বেঁচে থাকে কটু গন্ধে সাপ পোকামাকড় সাথে নিয়ে মানবেতর জীবন চলে।
শুরু হয় নতুন জীবন নতুন সংগ্রাম ।দুবলাই গাঁও আর সেই আগের মতো নেই। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সোনালী মাঠ সবুজ প্রান্তর নরম ঘাসে ছেয়ে যাওয়া জমিনের ফাঁকের সেই সরু আইল। জমির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট খাল নেই ।বাড়ির সামনের কচুরিপানায় ভরা পুকুর নেই।স্কুল মাঠটা ছোট খাট টিলার মতোন।
বন্যার পর চারপাশ শুকিয়ে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন মাস।এই তিন মাসের করুণ জীবন নতুন কোন সুখ সন্ধান ছিল না। বন্যা পরবর্তী জীবন নিয়ে চিন্তিত মানুষজন। যখন দেখতে পারে তার সোনালী ক্ষেত আর ক্ষেত নেই। অচেনা এক টিলা। তার বাড়ির মাছ চাষ করার পুকুর ভরে গেছে বালিতে।পূবের তিন বিঘা জমি নদীর পেটে বিলীন। যেখানে ছিল আউশ আর পাটের বাড়ন্ত যৌবনা ফসল। আজ সব অলিক স্বপ্ন যেন।
ঘরে আগুন লাগলে ঘর পোড়ে।ক্ষেত থাকে,জমিন থাকে। চাষের বলদ থাকে । প্রতিবেশির সাহায্য সহযোগিতা থাকে। মাথার উপুড়ে আত্মীয়-স্বজনের স্নেহ প্রেম থাকে, নতুন বাঁচার স্বপ্ন উদ্যোম থাকে। সর্বনাশা নদীর ভাঙনে সব বিলীন। যা দুই এক খণ্ড জমিন আছে নদীর ক্রোধের বালির নীচে চাপা পড়ে মৃত জীর্ণ আজ।চাল নেই, চুলো নেই গরু মহিষ কিছুই নেই।জমিও নেই।
নেই নেই আর নেই।
ফজু শেখের আনন্দ আঙিনায় আজ শুধুই হাহাকার। গোলার ধান পচে খাওয়ার অনুপযোগী।ফসলের জমির বেশীর ভাগ নদী গর্ভে বিলীন। বাকী জমির করুণ ইতিহাস। শক্ত সামর্থ্য ফজু শেখ এই কয় মাসেই বৃদ্ধ পথে বসা মিসকিন যেন। ঘরে তার নাতি-নাতনীর যোগান কম নয়। একমাত্র আদরের বংশপ্রদীপ সলু জীবন সম্পর্কে যার ধারণা নেই। ধনীর দুলাল আনন্দ আড্ডায় ছিল এতদিন ভর। বাস্তব জীবন তার চিন্তার বাইরে। সব সুখ তার দাসত্ব করেছে এতদিন। সে কি করে কষ্ট আর দুঃখ বুঝবে। সংসারের বেহাল দশায় মা-বাবা যেন তাকে আর আগের মতো ভালবাসে না। তার চাহিদা পুরনের সব যোগান দিচ্ছে না। উল্টো এই অভিযোগ শুনতে হয় ফজু শেখকে।
ইদানিং মুখে মুখে তর্ক করতে দ্বিধা করছে না। সংসারের কারো প্রতি কোন দায়বোধ তার নেই।
আজ সকালে ফজু শেখ ছেলেকে ডেকে বলেন—বাজান আমাগো আগের রাজার হাল তো আর নাই যে কামলা নিমু। প্যাট চালানো দায়। চল বাজান- যে জমি গুইলা আহুনো ভাঙে নাই বালু পইড়া ডুইবা আছে,হেগুলার বালু হরাই। দুই বাপ পোলা মিলা কাম হরলি অভাব কিছু অইলিও কমবো। আমি বুড়া অইছি বাজান। কি আর হরমু একলা একলা। এত্ত গুইলা মুখ আমি তো আর একলা পারি না। তুমি না ওগোর বাপ। আমরা ও বুড়া ওছি।তোমার আহুন কিছু হরা নাগবো বাবা।
এভাবে চলছে আদর সোহাগে কথা। আর যখন সইতে না পেরে বাবা ফজু শেখ বলতে বাধ্য হয়-তোর পোলাপানের দায়িত্ব আমি নিতে পারমু না। তগোর জন্য আমার আর কিছু করার নাই। নিজের পথ দেখ।
সলু রাগ করে ঘর ছাড়ে। সবাইকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি ওঠে। সলুর শ্বশুর তিনিও জোতদার মানুষ। অভাব অনটন নাই। মেয়ের কষ্ট শুনে তিনি বসে থাকতে পারেন না। তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন ধন সম্পদের মালিক ফজু শেখের ছেলের সাথে। আজ ফজু শেখের সম্পদ বিলীন নদী গর্ভে তাতে কারো হাত নাই। কি করা যাবে । আল্লাহর ইচ্ছায় সব হয়। ফজু শেখের ধন সম্পদ শেষ তাই তার সাথে সম্পর্ক শেষ।কিন্তু মেয়ে জামাই আর নাতি-নাতনি তাদের ফেলা যায় না। শশুর বাড়ির সম্পদে সলু আগের মতো না হলেও আবার আরাম আয়াশেই চলতে থাকে।
ফজু শেখের দিন বদল হয়েছে। আগের সেই ফজু নেই। সব গিয়েছে কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসী ফজু শেখের ধর্মীয় বিশ্বাসের জোরে এখনও বেঁচে আছে। বুড়ো বয়সে হাল ধরবে যে বংশপ্রদীপ সেই প্রদীপ সব আলো নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে নিজের সুখ সন্ধানে। আজ অন্ধ গহ্বর তার চারপাশ।শুধু টিমটিমে আলো জ্বলে ধর্মের ভক্তিতে। যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন।বান্দার ভাগ্য তিনি নির্ধারণ করেছেন। ক্ষতি কী বিধাতা যদি আজ তাকে এই অবস্থায় রাখেন। নামাজ রোজা আর ধর্ম কর্মে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন আরও।
পূব আকাশে সূর্য ওঠার আগেই বৃদ্ধ ফজু লাঠি হাতে হাতরিয়ে হাতরিয়ে মসজিদে যায়। তখনও নামাজ শুরু হয় না। মোয়াজ্জিন ওঠে না, ইমাম সাহেব জাগে না।কিন্তু বৃদ্ধ ফজু আগেই হাজির হয় আল্লাহর ঘরে। কিছুক্ষণ বসে থাকে ইদ্রিস মিয়ার দোকানের বেঞ্চিতে।ঘরে তার মন বসে না।যে ঘর ছিল পুর্ণিমার হাঁট আজ তা শ্মশান।
ইদ্রিস মিয়ার দোকান আরও বড় হয়েছে। জাকজমকে চলে নতুন নতুন পণ্যে। একটা টিভি রেখেছে দোকানের সামনে। কর্মচারী তিন জন খাটে তার দোকানে। সেও ধার্মিক কম নয়। কিন্তু অন্ধ ধার্মিক না। আল্লাহর উপর সব ছেড়ে দিয়ে বসে নেই। আল্লাহ মাথায় জ্ঞান বুদ্ধি বিবেক আর সামর্থ্য দিয়েছেন।তার যথার্থ ব্যবহার দরকার। সেই আধুনিক চিন্তায় আজ সে সফল।
মেয়েরা যে যার অবস্থানে যোগ্য প্রতিষ্ঠিত। তার বৃদ্ধ বয়সের একেকটা হাত শক্তির আধার। স্নেহে আদরে মেয়েরা আজ তার মায়ের স্থান পূরণ করছে যেন আবার। বাবার সামান্য অসুখে হুলস্থুল করে ফেলে ডাক্তার চিকিৎসায়। তার নিজের দুই মেয়ে ডাক্তার। কত হাসপাতাল তাদের চিকিৎসা করার জন্য ধন্য হয়। সব চেয়ে যে ছোট তাকে কাছে রেখেছে জামাই সহ। কারণ গ্রামের স্কুলের শিক্ষক তারা দুই জন।
ঈদ পার্বণে আনন্দের ধুম পরে ইদ্রিসের বাড়ি। দল বেঁধে সব জামাই নাতি – নাতনী সমেত বাড়িতে আসে। সবাই একে অপরের বাড়িতে যাওয়ার চেষ্টা করে। বোনে বোনে এই মিল মহব্বত দেখে ইদ্রিস মিয়া আনন্দাশ্রু বিসর্জন করেন চুপিচুপি। আর এখনও সেই স্কুল শিক্ষককে মনু আপুকে দোয়া করেন। তিনি যদি তার মেয়েদের শিক্ষার গুরুত্ব না বুঝিয়ে দিতেন তবে আজ তার এই সুখের হাট বসতো না।
আজ ফজরের সময় ফজু শেখ বাড়ি ফিরতে গিয়ে পড়ে যায় রাস্তার ধারে। সবাই ধরাধরি করে বাড়ি নিয়ে যায় । সেবা শশ্রুষা করে রেনু। বোকা রেনু সংসারের এই বেহাল দিনে কি-ইবা করতে পারে। এই পৃথিবী তার কাছে অজানা। স্বামীর পায়ের নীচে যার সুখ ।স্বামীর সেই সক্ষম পা আর নেই। শেষ বেলার কষ্টের দিনে তাই সেই পায়ের তলায় সেবা দেয়া ছাড়া আর কি করণীয় জানা নেই রেনুর। তিন মেয়ে বিয়ে দিয়েছিল কিশোরী বেলায়। তারাও প্রতিবেশি গ্রামের ভাঙন কবলিত। কি বা করার আছে তাদের। মাঝে মাঝে এসে কান্নাকাটি করে বাবার মাথার কাছে। মায়ের কাছে তাদের হাজার কষ্টের কথা বলে।
রেনু বিবি সান্ত্বনা দেয়। এটা ইমানের পরীক্ষা মা। যে যত ইমানদার আল্লাহ তার তত বিপদ দেয়। এই দুনিয়ার সুখ কয়দিন। আল্লাহকে ডাক এক মনে। সব ঠিক অইয়া যাইবো। দুনিয়ার সুখ কিছু না মা।
কোন কিছুই ঠিক হয় না। এই অধম গ্রাম দিন কে দিন উজার হতে থাকে। আর হবেই না কেন? নদী শাসনের কোন ব্যবস্থা রাখে নাই ।এই দেশের হাজারও সমস্যা। এই সব রেখে এই গ্রাম ,নদী, গ্রামের মানুষ নিয়ে কে ভাবে?
ফজু শেখের কাহিল অবস্থায় ইদ্রিস মিয়া চুপ থাকতে পারে না। তাকে নিয়ে ভর্তি করে নিজের মেয়ের চাকরীরত হাসপাতালে।
আজ ফজু শেখ ইদ্রিসের হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। ইদ্রিস তুমিই ঠিক ছিলা। পোলারা বংশপ্রদীপ অইয়া আলো জ্বালায় এই কতা ঠিক না। মাইয়ারা বিয়া দিলি পর হেই কতাও ভুল। আমার জীবন থাইকা শিক্ষা নিলাম।
ইদ্রিস সান্ত্বনা দেয়। ভাই আপনার ভুল ভাঙলো তয় ম্যালা দেরিত। পোলা পানের দোষ কি? তাগো তো যোগ্য করে তোলেন নাই ভাই। আইজ যদি
পোলাপান শিক্ষিত করতেন তারাও আপনের দেখভাল করত।
ফজু শেখ স্বীকার করে তার দায়। পোলা নয় যোগ্য সন্তান হে পোলা হোক আর মাইয়া হোক হে-ই বংশপ্রদীপ মেনে নিলাম হিকা নিলাম।