গল্প:শিকড়
শিকড়
জাহ্নবী জাইমা
ফুরফুরে মেজাজে টয়োটা করোলা ড্রাইভ করছিলো রিয়া।অক্টোপাস যানজটে ছেয়ে আছে গোটা শহরটা। শাখা প্রশাখা বেয়েচিতার গতিতে ছুটছে শহর, শহরতলির গন্তব্যে। রিয়ার গাড়িরগতি তার ভালোলাগা অনুভুতি আরত্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে আজইরেজাল্ট বেরিয়েছে। সে ম্যানেজমেন্টে ফাস্টক্লাস পেয়ে এমবিএপাশ করেছে। কী দারুণ পড়াশোনা থেকে আনুষ্ঠানিক মুক্তি। ইচ্ছেহচ্ছে গাড়িটাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলি “মম, আই হ্যাভ ডান ইট।” কিন্ত তার ভাবনায় ধাক্কা খেয়ে হার্ড ব্রেকেথেমে গেল গাড়িটা। থমকে গেল শহরটা। যন্ত্রণাদায়ক অবসরেচোখে পড়ে একটি বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনটি দৌড়ে ভ্যানিশ হয়ে গেল, সান্ধ্য শহরটা মায়াবী লাগছিল রিয়ার। যদিও শহরের পাশেইবস্তিতে খানিকটা সেকেলে গন্ধ লেগে আছে, তবুও তাকে মাটিরসাথে মানুষের সাথে মিশতে হবে। প্রায় কুড়ি মিনিট পর যানজটেরঅবসান ঘটে। রিয়া গাড়িটাকে ফ্লাই সসারের মত ছোটাল।দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো, মা-বাবা দুজনেই তখনজেগে থাকবে। নিজের মুখেই রেজাল্টের খবরটা দিতে চায় সে।রিয়া জানে মা কতটা খুশি হবে। বাবার খুশি অখুশি সবটাই নির্ভরকরে মুডের উপর। ফ্লাইওভার থেকে নামতেই আরেক ঝামেলাহাজির। গাড়ির ইন্ডিকেটর বিপ বিপ শব্দ করে গ্যাস ফুরিয়েআসার বার্তা প্রেরণ করছে। এক্ষুণি না ভরলে আর চলবে না।একটা ফিলিং স্টেশনে নামলো রিয়া। লম্বা লাইন, এখানেওদাঁড়িয়ে থাকতে হবে, ভেবে মেজাজ বিগড়ে গেল ধুত মরণেও এইশহরে লাইন দিতে হবে। কিন্তু অগত্যা অপেক্ষা হাইড্রোজেন নাভরলে যে বাড়ি পৌছানোই দায়। পকেট থেকে ন্যানো সেল ফোনবের করে তার থেকে কলিং বেল অন করার মুহূর্তে রিয়া শুনতেপেল ঘরের মধ্যে বাবা মার কথা কাটাকাটি। বাবা বেশ উচ্চস্বরেবলছে। “এবার মেয়েকে নিজের পথ দেখতে বলো। ‘মা বিস্মিতগলায় জিজ্ঞেস করল, “কী বললে”? “সোজা বাংলায়ই তো বলছিবুঝতে পারলেনা একুশ বাইশ বছর ধরে খাইয়েছি পরিয়েছি আমিআর পরের বোঝা বইতে পারব না। ‘মেয়েটাকে পরের বোঝাবললে? আজ হোক কাল হোক ও তো একটা কিছু জুটিয়ে নেবে।মেয়েটা বাড়ি থেকে যাবে কোথায় ? আর কেন যাবে? কোথায় যাবেতা দেখার দায়িত্ব আমার? অকারণে উটকো ঝামেলাটা পাকিয়েছ? চুপ কর ও আমার মেয়ে। ভুলে যেও না তোমার এই চাকচিক্যব্যবসার উন্নতি সব কিছু ওর জন্য। নইলে কোথায় ভেসে যেতে? বাবা হেসে উঠল ও তোমার মেয়ে? বিয়ের পর তুমি শরীর ভাড়াখাটিয়ে টাকা আয় করেছ। স্বামী হিসাবে সেই টাকাই আমারওশেয়ার ছিল রাইমা। হ্যাঁ ওই টাকা খাটিয়ে আমি বিষয় আশয়করেছি এটা ঠিক। তাতে ওর কোনও অধিকার থাকার কথা নয়।রিয়া আমার মেয়ে নয় ? দশ মাস ধরে আমি ওকে পেটে ধরিনি? হ্যাঁ পেটে ধরেছ ঠিক। তাই বলে ও তোমার মেয়ে প্রমাণ করতেপারবে? বাকাস্বরে হাসল লোকটা। না, না রিয়া আমার, বলেই হু হুকরে কেঁদে উঠল রাইমা, ‘তুমি চুপ করো। চুপ করো রিয়ার আসারসময় হয়েছে।’’ দরজার সামনে আবছা অন্ধকারে সম্পর্ক শূণ্যতায়মুহ্যমান হয়ে গেল রিয়া। হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে। বাবা, বাবানয়। মায়ের পেটে জন্মেছি অথচ মা, মা নয়। তা হলে সে কে ? বাবা রাসেলের বরাবরই সম্পর্কের দূরত্ব বজায় রেখে ছিলো। তারআগ্রহহীনতা, উদাসীনতা রিয়াকে ছোট বেলা থেকেই কষ্ট দিত, আবার মানুষটা কোনও কোনও দিন চমৎকার ব্যবহার করত।তখন ধুয়ে যেত সব দুঃখ অভিমান বোধ। কিন্তু মায়েরভালোবাসায় কোনও খুঁত ছিলো না। পাখির ডানার মতো আগলেরেখেছে তাঁর আঁচলে, আবার ডেটিং এর দিন গুলোতে বন্ধুর মতোসহযোগিতা করেছে। এই যুগেও মানুষের রক্তে এমন হাহাকার বোধহয়। রিয়ার শিরদাড়া ইস্পাত কঠিন হয়ে যায়। মাকে জিজ্ঞেসকরতে হবে লোকটা যা বলছে তা সত্যি কি না? বাড়িটা গুমোটমেরে আছে। এই গুমোটে লোকটার হেলদোল নেই। লনে বসে সেবহাল তবিয়তে গ্রাফিন রাগবি খেলছে। গ্রাফিন চাদরে তৈরি এলসি ডি স্কিনের উপর ধাবমান কনা এসে পড়ছে আর মসলিন কার্বনমৌল চাদরে ফুটে উঠছে সহস্যময় ব্রক্ষ্মা-। অ্যাকসেস কন্ট্রোলসিস্টেম অপারেট করে রাসেল স্কিনে তৈরি করছে রাগবি ঘোড়া।ঘোড়ার সঙ্গে ধাবমান কনার লেগে যাচ্ছে দৌড় প্রতিযোগিতা। কেহারে কে জেতে ? তার রাগবি জিতলেই সে অট্টহাসি হেসে উঠছেআর চুরোটে দিচ্ছে টান, “কেল্লাফতে ” ফিউশন ইউ আরডিফিটেড? লোকটার অট্টহাসি অন্তর ভেদ করে যাচ্ছিল রিয়ার।জানালায় বসে ¯িœকার গেঞ্জি পরা লোকটাকে দেখছিল তবুলোকটাকে সহ্য করা যায়। রাত থেকে মা থমথমে মুখে তার কাছথেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। মা কি সত্যি সত্যিই রিয়ার সামনেদাঁড়ানোর ক্ষমতা হারিয়েছে ? বড় বোন রোজার মধ্যে তো কোনওপরিবর্তন নেই। সকালবেলা তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল স্মাইল, স্মাইল সিস্টার। হোয়াই উইথ দ্যা ক্লাউডি ফেস্ ? চল ব্রেকফাষ্টকরবি। রিয়া সাড়া দেয়নি। তার মনে হয়েছে দু’জনার মধ্যে চিনেরদেওয়াল। কী বিরাট অনতিক্রম সীমারেখা। দুপুরে খাওয়ারটেবিলে মায়ের মুখোমুখি হল রিয়া। খাবার দিয়ে মা চলেযাচ্ছিলো। রিয়া, ভাঙা গলায় ডাকলো “যেও না মা।” কেন ? তুমিকিছু বলতে চাও মা ? নির্দিধায় বলতে পার। আমি মনকে শক্তকরে নিয়েছি। না না, আমি কিছু বলতে চাই, তা হলে আমারকথার উত্তর দাও। আমি এ বাড়ির কে? তোমার সঙ্গে আমারসম্পর্ক কি। রোজা খাচ্ছিলো। সে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল“ননসেন্স হোয়াট আর ইউ সেয়িং”। মা ভারী গলায় বলল“রোজা, খেয়ে নিজের ঘরে চলে যাও। রোজা আর কথা বাড়ালোনা। খাবার ফেলে রেখে গজ গজ করতে করতে মেজেনাইন ফ্লোরেচলে গেল। মা চেয়ার টেনে রিয়ার পাশে বসল। দুজনেই দু’জনারমুখের দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তাদের চোখের পাতাব্যথায় ভারী হয়ে আছে। রাইমা রিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেদিতে বলল তুই আমার মেয়ে অন্য কার কী তা আমি জানি না।‘তোমার জেনেটিক চাইল্ড?’ তোকে আমি গর্ভে ধরেছি। দশ মাসতিলে তিলে তুই আমার অনুভূতিতে বড় হয়েছিস। আমার সত্তাথেকে রস নিংড়ে তোর কোষের পুষ্টি হয়েছে। এর পর আর কীবলতে চাস? তুমি শুধু বল মা, আমি তোমার জেনেটিক চাইল্ড।রাইমা রিয়ার মুখের দিকে চেয়ে থাকলো অনেকক্ষণ চুপ করে। পরেবলল আই অ্যাম ইয়োর সারোগেট মাদার। রাসেলের সঙ্গে সেইঅর্থে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু ওকে ভুল বোঝ না। হিওয়াজ ভেরি মাচ সার্পোটিভ টু মি। তখন আমার বয়স ত্রিশ বত্রিশহবে। রোজার বয়স চার বছর। রাসেল এক ঋণের সাগরে ডুবেছিলো, পাওনাদারের তর্জণ গর্জণে দিশেহারা। সে সময় আমি নেটেবিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। মিস শ্রাবন্তি নামে এক ভদ্র মহিলাসারোগেট মাদার খুঁজছে। রাসেল কিছুতেই রাজি ছিল না। আমিবলেছিলাম রোজার জন্য একটা চান্স নিতে দাও। আমাদের ঘুরেদাঁড়াতেই হবে। ও সম্মতি দিল। মিস শ্রাবন্তীকে বার তিনেকদেখেছি। প্রথমবার এগ্রিমেন্ট সাইন করতে এসেছিল। গর্ভভাড়া, গর্ভবস্থায় ট্রিটমেন্ট ও মেনটেনেন্স বাবদ সব টাকা অগ্রিম সেদিনেইমিটিয়ে দিয়েছিল শ্রাবন্তি। তার পর হস্পিটালে ওভাম দিতেএসেছিল। ইনভিট্রো ফার্টিলাইজেসন এমব্রায়ো ইনপ্লান্ট করা হলজরায়ুতে। দশ মাস আমি তোকে একা গর্ভে বয়ে বেড়িয়েছি।শ্রাবন্তী এক বারের জন্যও আমার গর্ভবতী পেট ছুয়ে অনুভব করারচেষ্টা করেনি কেমন আছিস তুই। শেষবার এসেছিল তুই জন্মাবারপর মিনিট দুই দেখলো তোকে। চলে যাওয়ার আগে আরও বেশকিছু টাকা দিয়ে আমাকে মিস শ্রাবন্তী বলে ছিল আই ওয়ান্টেড টুবি আ মাদার বাট দ্যাট ওয়াজ অ্যান ইমোশনাল অ্যাক্ট। আমিবাচ্চার ঝামেলা পোহাতে চাই না। আশা করি টাকার পরিমাণ কমনয়। শ্রাবন্তী চলে গেল। তাকে কিছু বালার সুযোগ পেলাম না। সেই শেষ দেখা। রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, লোকটি কে, আমাকে সন্তান হিসেবে দাবি না করলেইও আমাকে অন্তত পিতৃপরিচয় দেয়ার সুযোগ করে দিতে পারতো। দুঃখ করিসনে রিয়া”।সেই লোকটি যে কে? যার রক্ত বইছে তোর শরীরে আজও আমিজানি না। তখন অবশ্য অদৃশ্য লোককে নিয়ে আমার মাথা ব্যথাওছিল না। নথিপত্রে হয়তো ম্পার্মদাতার নাম ছিল। নানা মুখীঝামেলা আর গোলমালে সব কোথায় হারিয়ে গেল। কিন্তু শ্রাবন্তীতোকে ফেলে যেতেই আমার মাথায় হাত। এখন অবশ্য জন্মপরিচয় নিয়ে ক’টা লোকের মাথা ব্যথা আছে? অধিকাংশ পুরুষইনফার্টাইল। সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই। অথচ সেই লোকটাতোর মুখই দেখল না। আমি দশ মাস তোকে পেটে ধরেছি। প্রতিমুহূর্তে আমার অনুভূতিতে জড়িয়ে ছিলি। আমি কি করে তোকেঅস্বীকার করি। রাসেলই এগিয়ে এসে তোকে বেওয়ারিশ শিশুরতকমা থেকে বাঁচিয়েছে। তোর বার্থ সার্টিফিকেটে ওর নামই পিতারজায়গায়। রাতের কথা শুনে থাকলে ওর উপর রাগ করিস না মা”।রাত গভীর ঘুম আসছে না রিয়ার। নিঃসঙ্গ প্রাণের যান্ত্রণা গুলোকপাট খুলেছে। ইচ্ছে হল বেহালা বাজাই, কতদিন যে বাজানো হয়না। ধূলো জমে বেহালাটার বেহাল অবস্থা। রিয়ার খুব ইচ্ছা ছিলোবেহালা শেখার কিন্তু বেহালা বাদ্যযন্ত্রটাই প্রায় অপ্রচলিত হয়েগেছে। যন্ত্রটা যোগার করাই দায়। একদিন গুলশানের একঅ্যান্টিকের দোকানে হঠাৎ মিলল বেহালাটার দেখা। অবশেষেজোগাড় হল কিন্তু শেখার কোন গুরু নেই। সব গুরু মরে গেছেকিবোর্ডে। রিয়া নেট লাইব্রেরি ঘেটে স্বর লিপি ডাউন লোডকরেছিল। সে একটু একটু করে বেহালা বাজাতে শিখেছে।কয়েকটা ধুন আর রাগ তুলতে পারে কিন্তু শোনার বা ভুল শুধরেদেওয়ার লোক কোথায়? বেহালা বাজালে লোকে হাসে আর বলে“প্রিমিটিভ গার্ল” তাতে রিয়ার কিছু যায় আসে না। মনে হয়যন্ত্রটাকে বড় চেনা। বেহালার সুর রক্তস্রোতের সঙ্গে মিশে যায়।শহরটা ঘুমায় না। নিশাচরের মতো জেগে থাকে। মনের মধ্যেভেসে উঠছে কত কথা। কিন্তু কোথায় যে বেহালার বেদনাভরাসুরের মতো একটা করুণ সুর লুকিয়ে আছে। বেহালার ছড় রেখেরিয়া জানালার কাছে এল, বাইরে অন্ধকার। একটু হিমেল হাওয়াবইয়ে গেল শরীরময়। রিয়ার মনে হল, স্বার্থপর পুরুষ মহিলাদু’টোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “এ খেলার মানে কী’’?
কিন্তু শ্রাবন্তী অনেক গুলো ঠিকানা পালটেছে এই বাইশ বছরে।ওয়েব সাইটের নজর থেকে পালাতে পারেনি। ব্যক্তি স্বাধীনতারপরিধি যে কত ছোট তা নেট সাইট না খুললে বোঝা দায়।প্রতিনিয়ত ব্যক্তির জীবন লিপি বন্দি করে রাখছে এটি। শ্রাবন্তীরবর্তমান নিবাস চট্টগ্রাম শহরের অভিজাত খুলশি এলাকায়নিরিবিলি এক বিশাল বিলাস বহুল বাড়িতে। সে এলাকায়মানুষের আনাগোনা কম। খাওয়া আড্ডা পার্টি নিয়ে ব্যস্ত সকলেআত্মকেন্দ্রিক যারা সমাজের উঁচুতলার মানুষ স্বঘোষিত কিন্তুসমাজ কলুষিত করতে পাপ ফলাতে বিন্দু মাত্র কুণ্ঠা নেই। সমাজমানেনা নিজের মত বেপরোয়া জীবন যাপন করে। বাগান ঘেরাসুইমিং পুল জার্মান সেফার্ড কুকুর নিয়ে যাদের জীবন কাটে।যাদের সন্তান নেই সন্তান উৎপাদনের তাগিদ নেই নিজেকে সুন্দররাখতে। কংক্রিটের দেওয়ালে থাকতে থাকতে মনটাও যাদেরকংক্রিটের মত শক্ত দুর্ভেদ্ধ। নিয়ন আলোর ঝলকানিতে কাটেযাদের কৃত্রিম জীবন, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের আকর্ষণ নেই বিন্দুমাত্রতাদের জীবনে। রিয়া ঢাকা চট্টগ্রামের ব্যস্ত সড়কে একা একা গাড়িচালাচ্ছে পাশের সিটে বসে আছে রাইমা, রিয়ার ও তার মা। মুখেকোন কথা নেই। রিয়ার মনের মধ্য থেকে একটুও মায়ের আসনসরে নি। শুধু সম্পর্কটার সহজ গতি হারিয়েছে। ব্রিজ পেরিয়ে শেষেগাড়ি থামল শ্রাবন্তীর বাড়ির সামনে। দোতলা বাড়িটাও পলিফাইবারে তৈরি। রংবেরঙের পলি চাদর দিয়ে অন্য সব বাড়িওতৈরি হয়েছে। দরজা খুলে দিল এক মধ্য বয়সী লোক বললো“প্লিজ সিট ডাউন অব ইজ কামিং।” লোকটা ঘরের মধ্যে চলেগেল। মিনিট পাচেক পরে জিন্স পরা এক মহিলা কুকুর কোলেএসে বসল। রাইমা দেখেই চিনতে পারল শ্রাবন্তী চৌধুরী সামান্যবয়সের ছোঁয়া লেগেছে কিন্তু চেহারায় ব্যাপক কোন পরিবর্তন নেই, মডেল কন্যা এখনও ধরে রেখেছে রূপ যৌবন। একটা রকিং চেয়ারেবসল এবং পিছনে একটু দুলে সে বলল হ্যা বলুন। রাইমা তারদিকে তাকিয়ে বলল, আমি রাইমা আর ও রিয়া। শ্রাবন্তী চৌধুরীরমুখ কিছুটা গম্ভীর হয়ে গেল। সে চোখ ঘুরিয়ে দুজনকে দেখে নিল।তার চোখে মুখে ফুটে উঠল একটা অদ্ভূত মরিয়া ভাব, দেন ইউওয়্যার ইন সার্চ অফ মি ফর টুয়েন্টি টু ইয়ারস। শ্রাবন্তী চৌধুরীকেআমার একদিনের জন্যও ততটা মানবিক মনে হয়নি। যে বাইশবছর ধরে আপনাকে খুঁজতে হবে। শুধু কাল থেকে আপনাকেখোঁজার প্রশ্নটা হঠাৎ করে মাথা চাড়া দিয়েছে তাই। কারণ রিয়া ওরজেনেটিক ফাদার মাদারকে দেখতে চেয়েছে। ওই ভদ্রলোকই কিস্পার্ম দিয়েছিল সারোগেসির জন্য ? না না ও মিষ্টার লুইস আমারপার্টনার তার সাথে আমার লিভ টুগেদার। ও হ্যাঁ ইন ভিট্রোফার্টিলাইজেশনের জন্য অন্য এক জনের স্পার্ম নেওয়া হয়েছিল।লোকটার নাম ছিল অ অ..। এই যা মনে পড়ছে না। কত বছরআগের কথা বলুন। অধৈর্য হয়ে রিয়া বলে উঠল, সে কোথায়থাকে, তা তো বলা যাবে? শ্রাবন্তী এক দৃষ্টে রিয়ার দিকে তাকিয়েথাকলো তারপর ধীরে ধীরে বলল সে কোথায় থাকে তা আমিজানি না। তার সঙ্গে আমার কোনও দিন দেখা হয়নি। আমারমাথায় সেবার ভূত চেপেছিল সিঙ্গেল মাদার হওয়ার।
মডেল হিসাবে আমার মার্কেট তখন তুঙ্গে আমি শরীরের ঝুঁকিনিতে চাইনি পেশাগত ক্ষতির ভয়ে। আর আমি চাইওনিস্পার্মদাতার সঙ্গে আমার কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ হোক। রিয়াদাঁড়িয়ে পড়ল তা হলে সেই লোকটা এল কোথা থেকে। আমারপ্রতি সেই লোকটারও তো কিছু দায়িত্ব থাকতে পারত। শান্ত হওরিয়া আমি স্পার্ম ব্যাংক থেকে স্পার্ম নিয়েছিলাম তখন আমি ওরনামটা এক দুবার দেখেছি কাগজপত্রে। আসলে আমি চেয়েছিলামসব চেয়ে পুরনো সংরক্ষিত স্পার্ম। বিজ্ঞান তো এখন স্পার্ম অনন্তকাল বাঁচিয়ে রাখতে পারে। মিঃ লুইস একটি ট্রেতে নাস্তা নিয়েড্রয়িং কাম বেড রুমে ঢুকে বলল হোয়াট হ্যাপেন্ড। প্রবাবলি আইটোল্ড ইউ আরলিআর আই হ্যাড অ্যা স্যারেগেট চাইল্ড। ইট ইজরিয়া ও মাই নেমিসিস, সি ইজ কোয়াইট অ্যাডাল্ট। হাই রিয়া।রিয়া কোন উত্তর দিল না। নিষ্ঠুর মহিলা সন্তানের বদলে কুকুরেরমমতায় বিভোর তার মিথ্যা আভিজাত্যে। শ্রাবন্তীর দিকে তাকিয়েসে কাঁদবে না তার মডেল মুখ কামরে আঁচরে ফালা ফালা করেদেবে বুঝতে পারছে না। সে প্রায় ছুটে শ্রাবন্তীকে ধাক্কা দিল, তুমিএকটা ডাইনি, অমানুষ কোথাকার মিঃ লুইস চিৎকার করে উঠলস্টপ ইট। শ্রাবন্তী হাত দিয়ে তাকে বারণ করল ওকে বলতে দাও।আমার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে আমাকেমানুসিকভাবে দুর্বল করে দিচ্ছে সময়। রিয়া, মাঝে মাঝে তোমাকেফেলে আসার জন্য অনুশোচনা হয়। আমার এই উচ্ছ্বন্ন জীবনবাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্পার্মদাতাকে কেন এত দিন জানতে চাইলামনা। তোমার ধাক্কা খেয়ে আমার মনে পড়ে গেল স্পার্ম ব্যাংকআমাকে দাতার একটি ইনফরমেশন ইনভেলব দিয়েছিল। আমিকোন দিন খুলি নি ওই খাম, খুলতেও চাইনি। এমনি নিষ্ঠুর আমি, শ্রাবন্তীর চোখ চিকচিক করে উঠল, রিয়া আমার শরীরে তোমার বাতার কোন অনুভূতি নেই। তবুও ভদ্র লোককে দেখতে এখন বড়ইচ্ছা হচ্ছে, তোমার সঙ্গে আমাকে নিবে ? গাড়ি ছুটতে থাকে গন্তব্যসেন্ট মার্টিন দ্বীপের পথে। রিয়া রাইমা শ্রাবন্তী হোটেল সিগালস্যুটে বসে আছে চুপচাপ সামনের সারিতে রিয়া, পিছনের সারিতেশ্রাবন্তী ও রাইমা বসার অবস্থান তাদের মধ্যে ত্রিভুজাকৃতি ধারণকরেছে। ত্রিভুজের তিন কোণে বসে থাকা তিন নারীর ভাবনা জুড়েবিবর্তিত হচ্ছে অচেনা মানুষটি। সম্পর্কের একক বিন্দুতে রিয়া। সেবাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কোষ্টাল ভিউ ছুটছে আর চোখেরসামনে ভেসে ওঠছে হারিয়ে যাওয়া জনপদের চিহ্ন। শাহ পরীরদ্বীপের পাশ দিয়ে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা দিয়ে ছুটছে গাড়ি। মনেউৎকণ্ঠা সত্যি কি রিয়া খুঁজে পাবে তার বাবার ঠিকানা। বাবাকেদেখে কি অনুভূতি জাগবে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে রিয়ার, রাইমা ওশ্রাবন্তী গল্পে মশগুল রিয়া তার অস্তিত্বের সন্ধান খুঁজে পেতেব্যাকুল। ভারাক্রান্ত ব্যাকুল অপেক্ষায় বিভোর অন্য মনোষ্ক হঠাৎসম্বিত ফিরে দেখে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পৌঁছে গেছে দ্রুত জাহাজ থেকেনেমে ভ্যান নিয়ে ছুটছে হোটেলের সন্ধানে। যতই সমুদ্রেরকাছাকাছি যাচ্ছে ততই সংকোচিত হচ্ছে ভাবনার পরিধি, অচেনামানুষটিকে ঘিরে। ভরা জনপদের পদভারে ধূসর প্রাণ ভেসে যাচ্ছেক্রন্দনে রিয়ার। হলদে হয়ে যাওয়া খামের মধ্যে বন্দি পুরুষ তারজেনেটিক ফাদারের কথা একমাত্র রিয়াই জানে। শ্রাবন্তী খামটা নাখোলা অবস্থায় রিয়াকে দিয়েছিল। তাকে নিয়ে যাচ্ছিল খামেরঅন্তর কথায়। আমার বেহালার সঙ্গে প্রেম হয়েছিল বেহালার সাথেহল আমাদের প্রেম আলাপ বেহালার তারে ছরী লাগালে কার নরমশরীরে জ্যোৎস্নার মত কবিতার অনুভুতি নেমে আসত, বেহালারকবিতা যেন প্রেমিকার নরম শরীর নিউ ক্লিয়ার ফিজিক্সে আমারগবেষণা সারা পৃথিবীতে স্বীকৃতির সুবাদে বিজ্ঞানী হিসেবে আমারখানিকটা নাম হয়েছে, কণায় কণায় বন্ধন রহস্যে আমি খুঁজেপেতাম বেহালার সুরের বন্ধন। বেহালার সঙ্গে প্রেমের গভীরতাআরও বেড়ে যেত। শয্যাসঙ্গি ছিল বেহালা, একদিন শরীরেরচাহিদার কাছে পরাভূত হলো বেহালা তার মধ্যে প্রেমিকার জীবিতসত্তা নেই। বংশ রক্ষার তাগিদ নেই। আমার বেহালার প্রেমআচ্ছন্নতা যখন কাটল তখন দেখলাম বয়স অস্তাচলের দিকে।নতুন করে সঙ্গী খুঁজলে বেহালার সতিন বাড়ত। কিন্তু আমি বাঁচতেচাই আমার বংশ ধারার মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলাম স্পার্ম ব্যাংকেস্পার্মদান করে যাব ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। “হে আগত আমাররক্ত ধারা, আমার সন্তান একবার এসো সমুদ্র দ্বীপ নারিকেলজিঞ্জিরায় আমার জন্মভূমি, যার সোদা গন্ধ মাখা মাটিতে আমিআশ্রয় নিতে চাই। আমার জীবনে বা জীবনের পরে একটু এসোদু’দন্ডের জন্য হলেও…।” চার কিলোমিটার দ্বীপের মধ্যে জেগেআছে যে ভূমি। তাতে হোটেল, ইকো কটেজ বানানো হয়েছেসেখানে আছে কেয়ার টেকার বাদে কিছু বেড়াতে আসা লোক জন।শান্ত নির্জন গোধূলি বেলায় তিন নারী অন্ধের মতো খুঁজতেলাগলো পুরোনো ইতিহাস শেষে তারা একটা ভাঙ্গাচোড়া সমাধিক্ষেত্রে এসে দাঁড়াল। এই পরিত্যাক্ত জায়গাটা বোধহয় ইতিহাসকেসম্মান জানিয়ে ফাকা রাখা হয়েছে। অধিকাংশ সমাধি প্রস্তরভাঙ্গা, বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছে। সমাধিগুলি জঙ্গলে ঢেকে গেছে, গায়ে কত কালের শ্যাওলার আবরণ। তিন নারীর গতি থমকেগেল একটা প্রাচীন বট গাছের নিচে এসে। আধভাঙ্গা একটাসমাধি সৌধ- মাথার দিকে স্মৃতি ফলক। সমাধি ফলকটা একটাপাথরের বেহালা। তার গায়ে খোদাই করে লেখা- এখানে শায়িতআছেন কবির চৌধুরী, পিতা কামাল চৌধুরী জন্ম ১৮৮৩খ্রিঃমৃত্যুঃ ১৯৯৯খ্রি। রাইমা ও শ্রাবন্তী চমকে উঠল, ও মাই গড। প্রায়শত বছর আগের স্পার্মে রিয়ার জীবন সৃষ্টি হয়েছে? রিয়ার সেদিকেখেয়াল নেই, সে কবির চৌধুরীর সমাধীর পায়ের কাছে বটেরঝুড়িতে ঠেস দিয়ে বসে আছে। প্রাচীন বটগাছে অসংখ্য ঝুড়িছুঁয়েছে মাটি। রিয়া কাঁধ থেকে বেহালাটা নামিয়ে ইমন রাগেবাজাতে লাগল। রিয়ার সুরে যেন সমাধি ফলকের বেহালা সুরমিশে যাচ্ছে। প্রাচীন বটগাছ, জেগে থাকা আইল্যান্ড প্লাবিত হতেথাকল এক অচেনা সুরে। যেন উদাসী হাওয়ায় মিশে গেল কতযুগ। রিয়া সমাধির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে ফিস্ফিস্ করেবলল, “বাবা আমি এসেছি।”