গল্পঃ হাশেম আলী মাষ্টর

হাশেম আলী মাষ্টর
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা
হাইওয়ের হলুদ নিয়ন আলো প্রখর-তীব্র হতেই মকবুল সাহেবের বাসায় আজকের মতো টেবিল ব্যবসার স্যাটার টেনে বাস স্টপিজ-এ পৌঁছলো রাশেদুল হাসান রাশেদ। হাতের কব্জি ঘুরিয়ে দেখে,রাত এগারটা ত্রিশ। খুব সাধারণ জীবন রাশেদের। ছোটবেলায় বাবা-মা দুজনই গেছেন না ফেরার দেশে। তবুও তার জীবন যাচ্ছে জীবনের মতো করে।
এগারোটা ত্রিশের নিস্তব্ধতায় যানবাহন শূন্য রাজপথ। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শ্রমজীবী-কর্মজীবীদের দলে সে ও একজন। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর। কী করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। শ্রবন ইন্দ্রিয়ের তালা খুলে অবশেষে। ছিন্ন-বিছিন্ন হয়ে থাকা কিছু লোকের মুখে মুখরোচক গল্প শোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।
পথচারীদের একজন বলল-হালুয়া রুটির ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ শ্রমিকদের হাতাহাতি-সংঘর্ষ। কেউ বলে মাল বোঝাই ট্রাক উল্টে জ্যাম লেগেছে। আবার কেউ বা আগ বাড়িয়ে বলে বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ গেলো চার হতভাগ্য গার্মেন্টস কর্মী।
এসব লোকের মুখের কথা কতটুকু সত্যতা বহন করে সে তর্কে না গেলেও বাস্তবিক অর্থে রাশেদের বুঝতে অবশিষ্ট রইল না-নিশ্চিত অপ্রত্যাশিত কিছু একটা ঘটেছে। তা নাহলে,এ দীর্ঘ সময় ধরে ব্যস্ততম সড়কটিতে কেন যানবাহন শূণ্য থাকবে?
পথে যা কিছু ঘটুক না কেন,সেই সব নিয়ে তার মাথা ব্যথার কোনো কারণ নেই। তার চিন্তা একটাই। ক্লান্ত এই দেহটাকে নিয়ে সে কোন পথে পা বাড়াবে?
বন্দরের দিক হতে হেঁটে আসছিলো এক দঙ্গল পথচারী। তাদের একজনকে জিজ্ঞাস করে- বদ্দা,ও বদ্দা কি হইয়ে যে ? গাড়ি নহ্ আইয়ের ক্যায়া ? হুইন্নন্যা কিছু?
তাৎক্ষণিক জবাবে ঐ পথচারি বললো, ’হ বদ্দা বাস ডাইভারজ্জ্যা একলগে তিনজনরে লোইয়ে’।
পথচারির মুখে এই কথা শুনে মুহুর্তে তার ভাবনায় এলো-কার মা’র বুক খালি হলো কে জানে? কেউ কি হলফ করে বলতে পারতো এইরকম বেসামাল পরিস্থিতির শিকার হবে? কোনো সলিউশন বের হলো না মস্তিষ্ক হতে। কিন্তু এই মুহর্তে সে কি করবে? হেঁটে গেলে এতক্ষণ অনেক দূর পৌঁছানো যেত। আচমকা ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ এসে তার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। অনুনিত কন্ঠে বললেন- ’বাবা,কোথায় যাবেন আপনি’ ?
বিষণ্ণতার রাশ টেনে রাশেদ জবাব দেয়-চকবাজার। বৃদ্ধ লোকটি একটু দূরে সরে গিয়ে তফাতে দাঁড়ালেন। এরপর একটা সিগারেট জ্বালালেন।
সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে তড়তড় করে ঘুরে চলছে নিশুতি রাতের চাকা। গাড়ি আসার উৎকন্ঠায় যাত্রী-সকল। মোবাইল স্ক্রিনে সে সময় দেখে। রাত বারোটা বেজে বিশ। অনবরত ইনকামিং টিউন বাজছে বাসার সেলফোন হতে। ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁলে রাশেদের আদুরে কন্যা মাইশা’র অস্থিরতা তেতে উঠে। সে তার একমাত্র সন্তান। এই সময়টার মধ্যে রাশেদ বাসায় না পৌঁছালে তার মাথা গরম হয়। বাবাকে সে শাসায়,শাসন করে।
সম্বিৎ ফিরে পায় রাশেদ। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বৃদ্ধ লোকটির দিকে। লোকটি তখনও দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলেন,বিষন্নমনে। লোকটির কাছে সে এগিয়ে যায়। বৃদ্ধের হাড্ডিসার দেহ। মাথায় একঝাঁক কোকরানো
চুল। গায়ের রং গৌড় বর্ণের। পুরু ভুরুর নিচে শান্ত এক জোড়া চোখ। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট
প্রতীয়মান। রাশেদের বুঝতে অসুবিধা হলো না-বয়সের ভারে যতো না তিনি কাবু হননি,মনের ভারে তার চেয়ে
বেশি। বৃদ্ধের পরনে সফেদ পরিধান। রাশেদের মনে হলো না তিনি কোনো অশিক্ষিত কিংবা অবাঞ্চিত লোক।
বৃদ্ধ লোকটির আরও একটু কাছে এগিয়ে রাশেদ জিজ্ঞাস করে-আঙ্কেল,আপনি যাবেন কোথায় ?
-বাবা,আমার চকবাজার যাওয়া ছিল। কিন্তু গাড়ি পাচ্ছি না।
-বলছিলাম কী,একটা রিকশা নিয়ে নিই। দু’জন গল্প করতে করতে বাসায় পৌছা যাবে।
উল্টো দিক থেকে একটি রিকশা আসতে দেখে হাতের ইশারায় রাশেদ রিকশাখানি থামালো। রিকশা চালকের বয়স পনেরো কি ষোলো। চেহারা গোলগাল। স্বাস্থ্য ভালো। রাশেদ তার সাথে কথা বলে জানলো,সেও চকবাজারে যাবে। চকবাজার তার রিকশার গ্যারেজ।
কনকনে হাওয়া। এদিকে রাত গড়াচ্ছে। রিকশা চালকের সাথে দর কষাকষি করে সময় ক্ষেপন করা আক্ষরিক অর্থে অর্থহীন। পরে মাশুল গুনতে হবে। রিকশাটি নজর বন্দি হলো অনেকের। হুড়মুড়িয়ে ছুটে এসে কয়েকজন জড়ো হলো। এই সুযোগ অন্য কেউ লুফে নিবে,তা কি করে হয়? রিকশাচালক একশ টাকা বললে হুট করে চড়ে বসে রাশেদ। বৃদ্ধ লোকটির হাত ধরে,টেনে তুলে। চালক যুবকটি ক্রমশ দু’পায়ে শক্তি যোগান দিয়ে প্যাডেল চাপে। পা ফেলে দ্রুত হেঁটে চলে দূর-দূরান্তের ক্লান্ত-শ্রান্ত গার্মেন্টস কর্মীরা। তাদের দিকে দৃষ্টি ফেলে চালক ছোকরাটির মনের জোড় বেড়ে যায় দ্বিগুণ। কমিয়ে দেয় রিকশার গতি। প্যাডেল চাপতে চাপতে অশ্রাব্য মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় তাদের উদ্দেশ্যে। একটু থামে। খানিকপর একটা গানও ধরে বেসুরো গলায়-
”যদি একখান
সোন্দর মুখ পাইতাম
বকশি হাডোর পানোর খিলি তারে
বানাই খাবাইতাম।”
এই গানটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রাণী শেফালী ঘোষের। ছেলেটির কন্ঠ ভরাট। গানের সুর-লয়-তাল যদিও অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবুও সে মনের আনন্দে গান ধরে,রিকশা টানে। গতি বাড়ে-কমে। রাশেদ মিনমিনে গলায় বললো-হারামজাদা,যাত্রী ঠেকিয়ে শেফালীর ঘোষের আঞ্চলিক গান গাস্! মনের জোশ বাড়াস! ভাগ্যিস! আজ শেফালী ঘোষ বেঁেচ নেই। যদি থাকতেন,তোর অসামঞ্জস্য সুরের গান শুনলে ভীষণ কষ্ট পেতেন। নয়তো তোকে কাছে পেলে দফা-রফা করে ছাড়তেন। এই দুই যাত্রী কে কি ভাবলো,সেদিকে তার খেয়াল নেই। তার দ্রুত পায়ের ছন্দ ও গান শুনতে শুনতে এগোতে থাকলো এই দু’সহযাত্রী। কিছুদূর এগুনোর পর তার সহযাত্রীর নিরবতা ভাংগে। জিজ্ঞেস করলেন- বাবা, এখানে কী কোন কাজে এসেছো ?
রাশেদ উত্তর দেয়-নাহ্।
-কিসে আছো ?
-একটি শিপিং কোম্পানীতে কাজ করি,আঙ্কেল।
-এতো রাত অব্দি এখানে কাজ হয়?
-ঠিক তা নয়। অফিস ছুটির পর এই এলাকায় দুটো টিউশন করি।
-ওহ্ তাই বুঝি।
-সেলারি কত পাও ?
রাগ ঢাক না রেখে রাশেদ বলল-আঙ্কেল,পার্টটাইম যখন টিউশনি করি,তখন বুঝতেই পারছেন কী ধরনের
স্যালারি হতে পারে?
-এক্সট্রা কিছু আসে না?
-আসে। তবে,মা’র আদেশ মানতে গিয়ে কখনও ছুঁয়ে দেখিনি।
-সে-ই ভালো। সৎ ভাবে বেঁচে থাকার মধ্যে একটা বাড়তি সুখ থাকে। শান্তি আসে।
-বিয়ে করেছ?
-জ্বি।
-পরিবারে কে কে আছেন ?
-মা,স্ত্রী আর একমাত্র কন্যা।
-এক্সসেলেন্ট! কন্যা সন্তান ভালো। ওরা বাপ-মা’র কষ্ট বোঝে। মেয়েকে স্কুলে দিয়েছো?
-জ্বি।
-কোন ক্লাসে পড়ে?
-ক্লাশ থ্রিতে পড়ছে।
সৌজন্যতার খাতিরে রাশেদও তাঁর সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে-আঙ্কেল আপনি?
-বাবা,টিউশনি করি। তবে তোমার মতো পার্টটাইম নয়,ফুলটাইম।
-এ বয়সে এতদূর আসা? সোর্স অব ইনকামের কেউ নেই?
বৃদ্ধ একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এ যেন গুমোট বাঁধা মেঘের হুশফাঁস! হৃদয়-উদ্যানে একটা শোক জমাট বেঁধেছে বহুকাল আগে। বললেন-ঐ যে লোকে বলে না ’অদৃষ্টের লিখন না যায় খ-ন।’
রাশেদ লক্ষ্য করলো,কথাটা বলতে গিয়ে বৃদ্ধের গলার স্বর জড়িয়ে আসছিলো। অপ্রাসঙ্গিক কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবে সেই আশঙ্কা থেকে তিনি কথার বাঁক ঘুরিয়ে দিলেন। বললেন-’আঙ্কেল সিগারেট চলবে?’
-স্যরি,আঙ্কেল। অভ্যাস নেই।
-থ্যাঙ্ক ই্যয়ু বাবা। খুব ভালো কাজটি করেছো। ব্যাড হেভিট। একবার ধরলে ছাড়াই যায় না। সুপার গ্লু’র মতো আটকে থাকে। বৃদ্ধের কাশির মাত্রা উতলে উঠলো। একটি সিগারেট জ্বালালেন। মুহুর্তে কাশি থামলো। বাবা,আমি যে সিগারেট টানছি কোন বোরিং ফিল করছো নাতো?
-না আঙ্কেল। আপনি নিঃসংকোচে টানুন।
রাশেদের কথা শেষ হতে না হতেই আরও একটি সিগারেট ধরালেন বৃদ্ধ লোকটি। খানিক পর রাশেদ নীরবতা রনে ভংগ দিলো-আঙ্কেল,আপনার পরিবার?
মুহুর্তে মিলিয়ে গেল একটি দীর্ঘশ্বাস,হাওয়ার সাথে। বাবা,এই কথা শোনা কি খুব জরুরী? ক্ষোভ জড়ানো কন্ঠে বৃদ্ধ বললেন।
-স্যরি আঙ্কেল। কারও পার্সোনাল ম্যাটার নিয়ে..
-তা নয় বাবা। তুমি আমার ছেলের বয়সী। শোন,তোমাকে বলতে অসুবিধা নেই। বরং কমফোর্ট ফিল করবো।
এরপর দুই আঙ্গুলের মাঝখানে থাকা সিগারেটখানি ছুঁড়ে দিলেন শূন্য দিগন্তে। আবারও একটি সিগারেট জ্বালালেন। শুরু করলেন,তাঁর যাপিত জীবনের স্মৃতিবিজরিত কথা।
আমার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেটি বড়। মেয়েটি ছোট। ছেলে এমবিবিএস করে ওর পরিবার নিয়ে
ঢাকায় সেটেল্ড। মেয়েও স্বামীর সাথে কানাডায়। সেও এমবিএ ডিগ্রিধারী।
-তাহলে,আপনি আর আন্টির ডুয়েল লাইফ।
-বাবারে, যা ভাবছো-তা সত্যি নয়। শোন, আমার ছেলের বয়স পনেরো আর ছোট মেয়েটির বয়স দশ। সেই
সময় তোমার আন্টি স্টমাক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। বিদেশে এই রোগের চিকিৎসা থাকলেও এই দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপ্রতুল। তবুও হাল ছাড়ি নি। জায়গা-জমি যা কিছু ছিলো এক এক করে সব বিক্রি করে দিলাম। একটা এফডিআর ছিলো মেয়ের নামে। সেটাও ভাঙিয়ে নিই। ব্যাংক থেকে লোন নিই। তাও শেষ। তার রোগের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়ি। আত্মীয় স্বজনদের দ্বারস্থ হই-হাত পাতি। তাদের যতটুকু সাধ্য ছিলো,তাই দিলো। কেউ বা আবার তড়িয়ে দিলো নানা উছিলায়। ছোট ভাইটা ছিলো বেশ ধন-সম্পদের মালিক। তাকে লেখাপড়া শেখালাম। ঘুষ দিয়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দিলাম। বুকভরা আশা নিয়ে ছুটে গেলাম তার কাছে। অভাব-অভিযোগের নানা ফিরিস্তি শুনিয়ে সেও বিমুখ করলো। আশাহত হলাম। আত্মীয়-অনাত্মীয় এমন কোনো ব্যক্তি ছিলো না যে হাত পাতিনি। সব চেষ্টা বৃথা হয়ে জলে ভাসলো। তবুও হাল ছাড়িনি। চোখ গেলো অফিসের প্রফিডেন্ট ফান্ডের ওপর। কাজের কাজ কিছু হলো না। অবশেষে যা হবার তাই হলো। তাকে ফেরানো গেলো না। সে পাড়ি জমালো অন্য জগতে,আমাকে ছেড়ে। দিক-কূল দুটোই হারাই। তবে,ভেঙে পড়িনি। শোকের তপ্ত উনুন থেকে বের করে আনার প্রাণান্ত চেষ্টায় স্থির রাখি নিজকে। আমি ছিলাম সরকারি চাকুরে। বদলির চাকরি। তার রেখে যাওয়া কচিমুখ দুটোর দিকে যখন একদৃষ্টে তাকাতাম-আমার অসহায়ত্ব কিলবিল করতো হৃদ-ভূমে। বেরিয়ে আসতে চাইতো ছটফটিয়ে,হুড়মুড়িয়ে। ঐ মুহর্তে অস্থিরতার কালো মেঘগুলো হামলে পড়ে দখল করে নিতো আমার আমিত্বকে। সিদ্ধান্ত নিলাম-নাহ! এভাবে থাকা যায় না। চাকরি ছাড়তে হবে। নয়তো সন্তান দুটো বিপথে চালিত হবে। তাই হলো।
নানাভাবে,সময় অনেক দূর এগিয়ে গেলো। ছেলে ডাক্তার হলো। মেয়েও এর পরের বছর এমবিএ ডিগ্রিধারী হলো। নিজেই সুপাত্র দেখে মেয়েকে বিয়ে দিলাম। ছেলেরও বিসিএস ক্যাডারে চাকরি হলো,সরকারি মেডিক্যালে। ভাবলাম,এই ছেলে তার বাবার যাপিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিবে। হাড়ভাংগা খাঁটুনি নির্বাসনে দেবে। ওর জন্য পাত্রী খুঁজলাম। পাত্রীও পেলাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। অন্য ডিস্টিক্টের এক ডাক্তার কলিগকে বিয়ে কওে সে ঢাকায় সেটেল্ড হলো। প্রথম প্রথম দু’এক মাস যোগাযোগ রেখেছিল। এখন পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
রাশেদ লক্ষ্য করলো, তার সহযাত্রীর গলা ধরে আসছিলো। কিন্তু তার জানার আগ্রহ আরও বিস্তৃত হলো। জিজ্ঞেস করলো- ’আপনার কানাডাবাসী কন্যা?’
বাবারে! মেয়েটি ছেলের মতো বেঈমানী করেনি। আমার মেয়ে জামাইটিও খুব ভালো। পীর বংশের ছেলে। মন-মানসিকতা উদার। মাঝে-মধ্যে খোঁজ খবর নেই। আমাকে তাদের দেশে নিয়ে যেতে চায়। আমি তাদের সাফ কথা বলে দিয়েছি। তোদের দেশে যাবোনা। দেশ স্বাধীন করেছিলাম কী,ঐ দেশে মরতে? মরলে দেশের মাটিতে মরবো,তাদের দেশে নয়।
-ঠিকই বলেছেন।
-গত ছয়মাস আগে মেয়ে ও মেয়েজামাই এদেশে এসেছিল। যাওয়ার সময় জামাই আমার জন্য পঁচিশ লক্ষ টাকা ফিক্সড করে গেলো। আর কী বললো, জান ?
-কী বললো ?
-বাবা,এই বয়সে আপনি টিউশনি করেন শুনলে খুব কষ্ট লাগে। নানা জনের মুখে নানা কথা শুনতে হয়। আর আমি নিজেও চাই না আপনার মেয়ে দেশে বেড়াতে এসে এইসব কথা শুনুক। ব্যাংকে বেশ কিছু টাকা রেখে গেলাম। ব্যাংক আপনাকে যে ইন্টারেস্ট দিবে,তা আপনার একার পক্ষে ব্যয় মেটানো যথেষ্ট।
-সত্যি কথায়তো বললো। যে কথা আপনার ছেলের মুখে শোভা পেতো,সে কথা মেয়ে জামাই’র মুখে শুনলেন।
-বাবারে,মনের জোরতো এখনও আছে। নিঃশেষ হয়নি। চলার শক্তিও হারাইনি। কিন্তু কি দরকার? ওদের
কাছেই বা হাত পাতবো কেন? কেনইবা ওদের কষ্টের টাকা নিয়ে আমি আরাম-আয়েশে দিন কাটাবো?
রিকশা এসে থামলো গুলজার টাওয়ারের সামনে। ভাড়ার পুরো টাকা নিজ পকেট থেকে দিয়ে দিলেন ঐ সহযাত্রী। আপত্তি শুনলেন না রাশেদের। নেমে যাওয়ার সময় বললেন-বাবা,আমার নাম হাশেম আলী। ডিসি রোডের তমিজ ভবনে থাকি। এই এলাকার সবাই ’হাশেম আলী মাষ্টর’ নামে চিনে। যদি কোনোদিন এই পথে আসো এই অধমকে স্মরণ করো। এলাকার যে কেউ তোমাকে পৌছে দিবে।
সময় বিড়ম্বনায় কথার পিঠে কথা চড়ালো না রাশেদ। দু’জন দু’পথে পা বাড়ালো। কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়ালেন ঐ বয়োবৃদ্ধ। পেছনে ফিরে ডাকলেন-রাশেদ, রাশেদ।
রাশেদ ঘাড় ফেরায়-ঐ বয়োবৃদ্ধ,হাতের ইশারায় তাকে ডাকছিলেন। রাশেদ আবার এগিয়ে যায়। পকেট হতে একশ টাকার একটি কচকচে নোট বের করে বললেন-বাবা,এই টাকাটা রাখো। আমার নাতনিটার জন্য কিছু কিনে নিয়ো।
ক্ষনিকের পরিচয়ে বৃদ্ধ লোকটির সহানুভূতিশীল আচরণে আবেগে আপ্লুত রাশেদ। কী যেন বলতে চেয়ে সে থেমে গেলো। আর রাশেদের মুখ দিয়ে কিছু শোনার অধীর আগ্রহে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন না।
রাত একটা বেজে দশ। রাশেদ পা বাড়ালো বাসার পথে। চারদিক সুনসান নীরবতা। প্রাণচাঞ্চল্য নগরী প্রাণস্পন্দনহীণ। আধো-আধো ঘুমে জর্জরিত নগরবাসী। পতিতা বহনকারী দু’একটা রিকশা টুং টাং শব্দ তুলে পাশ কেটে যায় রাশেদের। মিলিয়ে যায় কোনো এক অন্ধকার সীমান্তে। কøান্ত পরিশ্রান্ত রাশেদ এগোতে থাকে তার কাক্সিক্ষত পথ ধরে। খানিক পূর্বে সহযাত্রীর মুখে জীবনযুদ্ধের যে গল্প রাশেদ শুনেছিলো,তা একটি বিরাম চিহ্ন হয়ে সেঁটে থাকলো ক্ষুদ্র হৃদয়ের ক্ষুদ্র পরিসরে। মুহুর্তে শিহরীত হলো রাশেদ। ভাবনায় এলো,যে মানুষটি তরুণ বয়সে পাকিস্তানিদের সাথে লড়াই করে পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিলো আজ ঐ লোকটি জীবন সায়াহ্নে এসে কষ্টার্জিত শ্রমে গড়া সুশিক্ষিত সন্তানটির কাছে নিষ্পেষিত,নির্জিত,নিগৃহিত। অনন্ত কাল ধরে বেঁচে থাকার আশা নিয়ে ঐ হাশেম আলী মাষ্টাররা ভেসে ওঠে সমুদ্রবক্ষে। অযত্ন,অবহেলা ও স্বার্থপরতার ভারে তাঁরা নিমজ্জ্বিত হয় কিংবা তলিয়ে যায় কালের অতল গহ্বরে। তাঁদের বোবা কান্নার ভাগীদার কেউ হয় না।