অঞ্জলি দে নন্দী, মমের অণুগল্প

মায়ের দেওয়া দ্বিতীয়বার
একবার তো গর্ভে ধরে, জন্ম দিয়ে ধরায় আনলো মা। মায়ের দেওয়া প্রাণ। মায়ের দানই তো জীবন। মায়ের জন্যই বড় হওয়া। বয়স বাড়লো। একটু একটু একটু করে পাঁচে পা দেওয়া। জীবন্ত।
হঠাৎ ভূমিকম্প। অনেকক্ষণ……..আশেপাশের বাড়ি হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। মা জলদী মেয়েটাকে টেনে নিয়ে প্রণাম করার মত, হাঁটু গেড়ে বসে, তার বুকের নিচে মেয়েটিকে রেখে দু হাত দিয়ে ধরে আগলে রইলো। ওদের বাড়ীটিও ভেঙে পড়লো। ভূমিকম্প থামলো। লোকজন এসে উদ্ধার কার্য চালাতে গিয়ে মৃতা মাকে পেলো। সরালো। নীচে থেকে বেরিয়ে পড়লো মেয়েটি। জীবন্ত। মায়ের দেওয়া দ্বিতীয়বার প্রাণ ওর।
ও ডাকলো, ” মা মা মা!!! ওঠো আর ভয় নেই। “
মা কোনোই সারা দিল না।
কারা যেন মাকে একটা গাড়ী করে কোথায় যেন নিয়ে চলে গেলো। আর ওকে একটা নতুন জায়গায় রেখে এলো। এখানে ওর মত কতজন আছে। হ্যাঁ, ওদেরও তো ওর মতই কারোরই মা নেই। অনেকেই আছে কিন্তু তারা কেউই মা নয়। সবাই তো আন্টি। সবাই খুব ভালোবাসে তবে মায়ের মত নয়। ওরা যখন কোলে নেয় কই মায়ের গায়ের মত সুবাস তো পাই না? মায়ের মত ওরা তো কেউই ওকে ‘মা’ – বলে ডাকে না। সবাই তো নাম ধরেই কথা বলে! ইস! যদি মায়ের একটা ছবি থাকতো। কত ভালো হত! ছবির সাথেই না হয় কথা বলতাম। কত কিই না সদ্য মা হারা ও ভাবে।
দেখতে দেখতে দেখতে অনাথ আশ্রমে ও বড় হল। খুব ভালো আঁকে। দেশে বিদেশে খুব নাম করেছে। কী আঁকে? আবছা আবছা আবছা স্মৃতির পাতায় পাতায় পাতায় যে সব মায়ের ছবি ভেসে ওঠে, ও তা ই রং ও তুলিতে ক্যানভাসে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলে। আর মনে মনে মনে ভাবে – নাই বা থাকলো মায়ের ক্যামেরায় তোলা ফোটো, আমি তো একদম অবিকল মাকে আঁকি। যেন ছবি নয়। সত্যিকারের মা।
অনেকদিন কেটে গেল। ও বিয়ে করল। ওর একটি কন্যা হল। হুবহু ওকে ওর দিদিমার মত দেখতে হয়েছে। ও ওকে কোলে নিয়ে ভাবে – আগে মা ওকে কোলে নিত। আর এখন ও মাকে কোলে নিচ্ছে। সময় এগিয়ে যায়…….পিছু ফিরে না চায়……..কিন্তু জীবন পিছু ফিরে চায়…
জাঙ্গলিক-মাঙ্গলিক
এ এক জাঙ্গলিক ব্যাপার।
কনকনে শীত।
জঙ্গলে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান চলছে।
চলছে নৃত্য-গীত।
কলা-কুশলীরা নেশায় টলছে।
আমি এক বট বৃক্ষের নীচে শুয়ে আছি।
গায়ে আমার জড়ানো র্যাপার।
লোকজন নেই কাছাকাছি।
দূর থেকে ভেসে আসছে সঙ্গীত।
এমন সময় হঠাৎ আমার সামনে বাঘ।
বৃহৎ যত বৃক্ষের ফাঁকে ফাঁকে ফাঁকে
উঁকি দিয়ে, ঢুকে পড়া জ্যোৎস্না আলো।
তাতে দেখলুম তাকে।
দেখা গেলো না, অতটা ভালো।
একে তো ঠান্ডা মাঘ।
তার ওপরে এই বাঘ।
আমার তো দাঁতে দাঁতে ঠকঠকাঠক
শব্দ হতে শুরু করেছে।
তাই না দেখেশুনে বাঘ
মানুষের কন্ঠে কথা বলল।
ও তো বলেই চলেছে।
করছে বক বক বক…….
ততক্ষণে আমার ভয়টা সরেছে।
সাহসে মন ভরেছে।
ও বলল,
এখন ও চলল
ওই অনুষ্ঠানে নাচতে।
ওকে ওখানকার সবাই নাচতেই বলেছে।
বিনিময়ে আজ রাতে
নেশা ফ্রী তে পাবে।
আর তার সাথে
অন্য খাবারও খাবে।
আমি বললাম, তুমি কেনো বাঘ সেজেছ?
ও বলল,
হবে যে বাঁচতে।
এই ছদ্মবেশেই তো আমার পেট চলছে।
আমি দেখলাম, হাত ঘড়িতে
রাত একটা বেজেছে।
ওকে বললাম, আমাকে কী ওখানে নিয়ে যাবে?
ও বলল, চল!
আমার পাশেপাশে ও চলছে।
ওর দেহে খুব বল।
শীতে কাবু নয়।
যখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হোলাম
তখন রাত আড়াইটে বেজেছে
আমার হাত ঘড়িতে।
ওখানে জনসংখ্যা কম নয়।
ওরা ঐ বাঘ সাজা লোকটিকে বলল,
আমরা সবাই আপনার চির গোলাম!
আমি অবাক হোলাম।
এরপর নাচ-গান, খানা-পিনা চলল।
পাঁঠা বলী
অঞ্জুর পোষা পাঁঠাটা আর সব সময়ের সঙ্গী। ব্যা ব্যা ব্যা করে ওর পিছনে ঘরে। তবে স্নান করার সময় বিন্দাস কিছুতেই খিরকি পুকুরে নামে না। অঞ্জু কত টানে – দৌড়ে পালায়।
স্কুলে ও যখন ক্লাসে থাকে। বিন্দাস জানলার পাশে, বাইরের জমিতে শুয়ে থাকে। অঞ্জু প্রতি ক্লাসের শেষে উঁকি দিয়ে দেখা করে। আর ওমনি বিন্দাস ব্যা ব্যা ব্যা করে ডেকে ওঠে। তবে ক্লাস চলা কালীন ও একটুও ডিস্ট্রাব করে না।
সন্ধ্যা জলদাওয়ায় অঞ্জু হ্যারিকেন জ্বেলে মাদুর পেতে পড়তে বসে। বিন্দাস পাশে বসে ঢোলে। অঞ্জু বলে, ” এই বিন্দাস পড়! বল – ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শীপ ……..” বিন্দাস কিছু বুঝতে না পেরে শুধু ওই ব্যা ব্যা শুনেই ডেকে ওঠে – ব্যা ব্যা। অঞ্জু বিন্দাসের কানমুলে দেয়। ওর কালো লোমে ভরা গায়ে হেলান দিয়ে অঞ্জু বসে। বেশ গরম।
একদিন কালি পুজোর অমাবস্যার রাত। সেদিন বিন্দাস রোজকার মতোই উঠোনের কোণে শুয়েছিল। পরের দিন সকালে ওকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। অঞ্জু খুব ডাকলো, ” ওরে ও বিন্দাস! একবার তো ব্যা কর! ” অনেক খুঁজে না পেয়ে ও কাঁদছে। এমন সময় ও পাড়ার কালিবাড়ি থেকে খুড়ি এসে পাঁঠার মাংসের প্রসাদ দিয়ে গেল। গত রাতের মা কালির বলী প্রসাদ। খুব সুবাস বেরোচ্ছে। এক বাটি মাংস। অঞ্জু বাটির সামনে গেল। সুবাস আরও বেশি। তখন খুড়ি বলল, ” অঞ্জু তোর খুব পুণ্যি হল রে। তোর পাঁঠাটা মায়ের শ্রী চরণে ঠাঁই পেল। ” ও হাউমাউ করে না থেমে কেঁদেই চলল। কেঁদে কেঁদে কেঁদে রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের ঘোরে বলছে, ” বিন্দাস! টুকি, আমায় খোঁজ! ” মা বুকে জড়িয়ে ধরে সারারাত রইল।
সেদিন থেকে অঞ্জু সারাজীবন আর কোনোদিনই আমিষ খেলো না।
বায়োলজির প্র্যাকটিক্যালের ব্যাঙ
দুয়ারের বাটনা বাটা শীলের নীচে দিনে লুকোনো ব্যাঙ রাতে ঘুরে খায় পোকা সারা দুয়ারে। অঞ্জুর বায়োলজির প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য দরকার তাই ঢাকনায় ফুটো করে সেটাকে টিনের ডাব্বায় ভরে নিয়ে গেল। ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ট্রেতে পিন দিয়ে আটকানো হল। যেই না ছুরি দিয়ে সেকশন করল সামান্যই ওমনি ওটি ধরাম করে লাফিয়ে উঠে পালালো। দরজা দিয়ে বেরিয়ে স্কুলের মাঠে। গিয়ে মাঠের পাশের খালে ঝাঁপ দিল। দেহের কিছুটা কাটা। কয়েকদিন পরে অঞ্জু দেখলো যে ওটি রাতে দুয়ারে জিভ দিয়ে পোকা ধরে ধরে ধরে খাচ্ছে আর ওর দিকে তাকাচ্ছে…
দিনে আবার সেই সে শীলের নীচে লুকিয়ে থাকছে। নিরাপদ না হলেও পুরোনো আস্তানা বড় মায়ার…