ভ্রমণ কাহিনিঃ ভুটান, অজানা উঠানে

ভ্রমণ কাহিনিঃ ভুটান, অজানা উঠানে

ভ্রমণ কাহিনি
ভুটান, অজানা উঠানে
আবিদ ফায়সাল

সূচি
পারোগ্রিনে আপেলপ্রভাত
শুরুর বৃত্তান্ত
থিম্পুপথে
ভ্রমণানন্দের থিম্পু
দোচলা পাস
লাল রোদে পুনাখা দর্শন
জীবন্ত জন্তুর সহবতে
পথিক ও স্বাগতকারিণী
কেন্ডেল নাইট
পথনামা, পারো ও টাইগার নেস্ট
ভোরের ফুলের মত পারোর বিকেল
বাঘের ডেরা, জঙ্গলগ্রাম
ফেরা, বিরহের শুরু।

পারোগ্রিনে আপেলপ্রভাত

ভুটানের রাজকীয় বায়ুদূত ড্রুক এয়ারে ঝিমুনি এসেছিল। নিশি জাগরণের ঘোর ও ক্লান্তি তখনও কাটেনি। কিন্তু ঘুমকে প্রশ্রয় দিইনি। হিমালয় দর্শনের অবিশ্বাস্য উত্তেজনা মাথার ভিতরে জেগে আছে। দার্জিলিংয়ের টাইগার হিল থেকে কাঞ্চনজংঘা আর নেপাল থেকে হিমালয় দেখা ইতঃপূর্বে আমার বরাতে জোটেনি। বায়ুযানে বসে কী সহজে সম্ভব হল এই হিমালয় দেখা! কী অপূর্ব দৃশ্য! এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আকাশে মায়াবী রোদ্দুর। বরফের গায়ে টুকরো টুকরো আগুন। আগুন কী, সোনার বরফ। বুভুক্ষু নয়নে দেখলাম কয়েক লহমা। এই স্বপ্নস্পর্শী জ্যোতির্ময় রূপের এবং বিস্ময়ানন্দের বর্ণনা দিতে আমি যে অক্ষম। অপারগ।
এই মনোহর রূপদর্শনের মিনিটকয়েক পর আত্মপ্রসাদের পরিবর্তে একটা ভয়ের অনুভূতি আমাকে জড়িয়ে ধরল। বিমান উচ্চতা হারিয়ে সবুজ পাহাড়ের উপর দিয়ে চলছে। ঘোষিকার কণ্ঠে ভেসে আসছে-‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা পারো বিমানবন্দরে নামব।’ জুম হয়ে চোখে স্পষ্ট হচ্ছে তুমুল সবুজে খাড়া খাড়া দুধারে পাহাড়। সমতল ভূমি কোথায়? ‘ভূ-উত্থান’ থেকে ভুটান নামের সার্থকতা বোঝা গেল পাহাড়ের মাঝে ভুটানের একমাত্র বিমানবন্দর পারোতে পা রেখে। নামার সময়ে মনে হল বিমানের দুই ডানা ভয়ংকর গিরিশৃঙ্গে বুঝি লেগে যাবে! অমঙ্গলের চরম শঙ্কায় একটা কাঁপুনি লাগল ভিতরে ভিতরে। কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরও পাহাড়বেষ্টিত। তবে এর সমতল ভূখণ্ডটি অনেক বিস্তৃত। ভুটানের তুলনায় ঝুঁকি কম। বিশাল বিশাল পাহাড়ি বাঁকানো ফাঁকে একটা বেয়াড়া ঝাঁকি দিয়ে বিমান নামতে দেখে আমার হাত-পা সব হিম। দেখলাম মন্থর গতিতে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে বিমান আটকে গেল সমতল একটি বড়োসড়ো মাঠের মতন এক চিমটি ভূখণ্ডে! এত ছোট্ট বিমানবন্দর এবং একফালি দৌড়ক্ষেত্র আর কোথাও আছে কি না জানি না। আমি রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে একবার রানওয়ে নজর বুলিয়ে নিলাম।
বাংলাদেশ ও ভুটান একই সময়াঞ্চলের দেশ। লক্ষ করলাম মুঠোফোনে এগারোটা আঠারো মিনিট। রোদভরা দিবালোক আর মনের ভিতর নতুন জায়গা দেখবার শিরশিরে উত্তেজনা। বিমান থেকে নেমেই ঘাড় ঘুরাতে গিয়ে নজর আটকে গেল বরফে পাহাড়ে। সোনার থালায় যেন রোদ পড়ে চিকচিক করছে। এই দৃশ্য পেছনে রেখে অনেকেই ছবি তুলছেন ফটাফট। আমার দু-সঙ্গীও এই কর্মে অতি উৎসাহী। এই সুযোগটা আমিও কাজে লাগালাম মোহময়ী এক আকর্ষণে। ছবি তোলা শেষ হলে, আমার তাড়িত গলার হাঁক শুনে তাঁরা টার্মিনাম ভবনে ঢোকেন। ভবনটি ভুটানি স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্যে নির্মিত। এর দেয়াল বিশেষ ঘরানার নকশা এবং বর্ণময় অলংকরণে সজ্জিত। রঙের আধিক্য রয়েছে ছাদের উপরে কাঠের ছাওয়া, টিনের ঢালু চাল। এই স্থাপত্যে তিব্বত এবং নেপালের প্রভাব মনে হয়েছে। এই নির্মাণরীতি সবখানেই লক্ষ করা যায়।
টার্মিনাল ভবনে ঢুকে আমরা একটা লাইন ধরে এগোচ্ছিলাম। আমি আগে আগেই। ভবনে ঢুকেই চোখ পড়ল ছবির ওপর। দেয়ালে সাঁটানো আছে পাঁচজন রাজার ছবি। বর্তমান রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকসহ অতীতের আরও চারজনের ছবি ক্রমে শোভা পাচ্ছে। প্রথমে রাজা উগেন ওয়াংচুকের ছবি। এই ওয়াংচুক রাজপরিবার আঠারো শত একষট্টি সাল থেকে ভুটান শাসন করছে। কিন্তু এঁদের ছবির প্রতি ভালো করে তাকানোর সময় পেলাম না। চোখ পড়ল ইমিগ্রেশন কাউন্টারে। ছোটো লাইনে দাঁড়ানো ভ্রমণার্থী। সামনে বেজায় ভিড়। আমরা ছড়িয়ে পড়লাম বিভিন্ন কাউন্টারের লাইনে। ফিতা দিয়ে এই লাইনকে বাঁকিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, অল্প জায়গায় অনেক যাত্রী যাতে দাঁড়াতে পারেন। ভিসার ঝামেলা নেই, বাংলাদেশিদের জন্য পূর্বানুমতি বা ভিসা লাগে না। প্লেনে চেপে বসলেই হল। ভুটানের জাতীয় বিমান ড্রুক এয়ার ঢাকা থেকে সপ্তাহে তিনদিন সরাসরি পারো আসে। অন্য কোনও এয়ার লাইন্স এখনও চালু হয়নি। রিটার্ন টিকিট হলেই হল। মাত্র পঞ্চাশ মিনিট উড়ানে ঢাকা থেকে পারো পৌঁছে যাওয়া যায়। ভুটানের থিম্পু ঢাকার সবচেয়ে কাছের রাজধানী শহর। তবু শান্তমুখে হোটেলের নাম জানতে চাইলেন অভিবাসন অধিকর্তা। বুকিংয়ের কাগজ দেখতে চাইলেন। আর তা দেখাতেই সিল মেরে পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে ভুটানে স¦াগত জানালেন। এর পর কাস্টমস এরিয়া থেকে ট্রলি ব্যাগটি সংগ্রহ করে বাইরে এলাম।
ত্রিন দর্জি প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন এয়ারপোর্টের গেটেই। ত্রিদর্শী দলের মোড়ল খতিবুর রহমান জামাল ইংরেজিতে তাঁর নাম লেখা দেখে প্রথমে দর্জিকে কুশল জিজ্ঞেস করেন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে : হাউ আর ইউ? উত্তরে ফাইন বলে সৌম্য হাস্যোজ্জ্বল লোকটি করমর্দন করলেন। ভুটানি পোশাক আর ইংরেজি বলার ভঙ্গি দেখে মনে হল একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আসলে তিনি আমাদের গাড়ির চালক ও পথের দিশারি। পরে জেনেছি গাইডেড ট্যুর দেওয়া তাঁর পেশা নয়, নেশা। শক্তসমর্থ পঞ্চান্ন বয়েসি দর্জি থিম্পুর বাসিন্দা। চোখমুখ ভারি শান্ত। তাঁর একছেলে ও একমেয়ে এবং প্রথম স্ত্রী আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। আর তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী ও এককন্যা নিয়ে ভুটানে আছেন। আমাদের তিনজনকে তিনি কুর্নিশ করেন। এবং প্রত্যেকের সঙ্গে হাত মেলান। বারকয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে আমরাও জানান দিলাম তাঁর কয়েক দিনের আত্মীয়, বন্ধুও বটে।
এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে দর্জির ধাঁধানো নতুন প্রাডো গাড়িখানা। কিন্তু গাড়িতে ওঠার আগেই নিসর্গসৌন্দর্যে নজর নিবিষ্ট হল। এবং মনে হল ধুলোযুক্ত মর্ত্য থেকে স্বর্গের সবুজে যেন পা রেখেছি। মিনিটকয়েক আগে রোদ ছিল। এখন মেঘলা আকাশ দেখে আরেক প্রস্থ অবাক হলাম। এবং প্রায় দুপুরকে প্রভাতই মালুম হল। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে বলেছেন, ‘ও যেন দিনের বেলাকার রাত্তির’, পারোর বেলা সাড়ে এগারোটা যেন আলো ফোটা প্রাতঃকাল নয়, কিন্তু প্রভাতপ্রতিমই মনে হল! ভোরের স্নিগ্ধতা নিয়ে চারদিকে বইছে পুষ্পিত বাতাস গায়ে পুলক জাগিয়ে। শান্ত আনন্দের মত বইছে মিহিন একটা অনুচ্চ সুর বুকে তুলে ‘পারো চু’ নামের পার্বত্য নদী। নদীর পাশে জ্বলন্ত সবুজ আর আপেলবাগান। তবে ফল নয়, সমস্ত অন্তর রাঙিয়ে ফুটে আছে ফুল। আহা কী সুন্দর, ভুটান আমাদের বরণ করে নিয়েছে আপেলপ্রভাতে!
পারো, ১২ এপ্রিল ২০১৯

শুরুর বৃত্তান্ত

বাইরোডে ভুটান যাবার কথাছিল। কবি এ কে শেরাম ও কবি এনায়েত হাসান মানিকসহ আমরা কয়েকজন। কিন্তু দিনদুই আগে খতিবুর রহমান জামাল আমাকে প্রস্তাব করে বসলেন উড়োযানে প্যাকেজ ভ্রমণে যেতে। প্যাকেজমূল্য অবশ্য আকাশছোঁয়া নয়। স্থলপথে ভুটান যেতে হলে এক চিলতে ভারতভূমি পার হতে ডাবল এন্ট্রি ভারতীয় ভিসা লাগবে। এর জন্য বেশ হ্যাপাই না পোহাতে হবে। সময়ের পুঁজি দিনপনেরো লাগবে। সেটা মুলতবি রেখে এ-ই জামালের বিনয়ী প্রস্তাব। তাঁরই বেফিকিরি আয়োজনে ইতঃপূর্বে আমি বহু জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি। গাইডেড ট্যুরের সুচারু ব্যবস্থা তিনিই করেছেন। সহৃদয় অমায়িক বন্ধু, ভ্রমণোদ্যোগী। তবে সময়খেলাপি। নভেলি চরিত্র তাঁর-কোন সময়ে কোন দিকে মোড় নেন বোঝা যায় না। বিপরীতে আমি ঘড়িমান্য ভ্রামণিক। বাইরে-দূরে কোথাও যাবার কথা থাকলে আর তর সয় না। তাঁর জোরাজুরিতে সম্মত হলেও একটা সন্দেহ-সংশয় মনে উঁকি দেয়। এরও কারণ আছে। বছরদুই আগে তাঁকে নিয়ে আমার মালয়েশিয়া যাবার কথাছিল। ভিসা-টিকিট কনফার্ম করার পরেও যাওয়া হয়নি। রওনা হবার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি একটি ক্লিনিকে তাঁকে ভর্তি করাই। কখন যে তাঁর শরীর এবং মন বিগড়ে যায়, তা বলা মুশকিল। তাই এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে কাউকে বলি না। ভিতরটা উশখুশ করে বটে, স্ত্রীপুত্র- স্বজনদের বলিনি এ-যাত্রায়ও। যাঁদের সঙ্গে দিনানুদিনের কর্মযজ্ঞে ডুবে থাকি-নাগরী প্রকাশনের কবি মালেকুল হক ও নাট্যকার সুফি সুফিয়ানকেও বলিনি। গোপনীয়তা রক্ষার অবশ্য একটা সর্ত ছিল আমাদের মধ্যে। কোথাও যাবার আগে বৃন্দস¦র সভ্যদের সঙ্গে আমি মোলাকাত করি। এর গোষ্ঠীপতি কবি শামসুল আলম সেলিম প্রশ্ন করলেন, কোথায় যাওয়া হচ্ছে? শিল্পীদ্বয় খোকন ফকির ও ইকবাল সাঁইও এর আগে সাগ্রহে জানতে চেয়েছিলেন। আমার সিলেটছাড়া হলে, সেলিমভাই ঘরবাইর করেন, দেশের বাইরে গেলেও মোবাইলে ফোন করে বারবার খোঁজখবর নেন। তাঁর সামনে কৌশলী উত্তরে সকলকে জানিয়ে দিই : ঢাকা যাচ্ছি। মিথ্যা তো বলিনি! এ-দিন ঢাকাই যাই। পরদিন না ঢাকা ত্যাগ করি।
সারা রাত জেগে বাসে চেপে ভোরে পৌঁছলাম আমরা ঢাকায়। শুক্রবার, সকাল নয়টায় বিমান ছাড়বে। সাতটায় রিপোর্টিং টাইম। চা-নাস্তা খেয়ে যথাসময়ে আমরা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করলাম। এবং আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জানতে পারলাম ফ্লাইট একটু দেরিতে ছাড়বে। ডিউটি ফ্রি শপে কিছুক্ষণ ঘুরে-টুরে, চা-টা খেয়ে তৃষিত সময় কাটল। জামালের কাটে স্মোকিং জোনে। আমরা যে বিমানে ভুটান যাব সে বিমানে সেদিন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বাংলাদেশে চারদিনের সফরে এসেছেন। জামাল মজা করে বললেন, এই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ভার নাকি তাঁকে দিয়েছেন। আমরা ফেরার পর লোটে শেরিং এই বিমানে চড়েই তাঁর দেশে ফিরবেন। বোর্ডিং কার্ড নিয়ে সুটকেস বিমান কোম্পানির হেফাজতে রেখে শুরু হয় অপেক্ষা। তারাপদ রায়ের কথা মনে পড়ে : বিমান অত সহজে ছাড়ে না। অত সহজে ওড়ে না। আর রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাপান-যাত্রী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘যাত্রা করবার মানেই মনের মধ্যে চলার বেগ সঞ্চয় করা।’ এই যাত্রা করবার অপেক্ষা করতে যাওয়াটা দুঃসহ। এই দুঃসহ অপেক্ষার পর একসময়ে ইলেকট্রিক বোর্ডে ফ্লাইটের নম্বর জ্বলে উঠল। এবং প্লেনে ওঠার ডাক পড়ল।
নিরাপত্তা তল্লাশি চলল সকলের। পায়ের জুতো, কোমরের বেল্ট, হাতের ঘড়ি, হ্যান্ড-ক্যারি ব্যাগ, মোবাইল সেট স্ক্যানিং মেশিনে দিতে হয়। আমরাও এই মেশিনে সবকিছু সমর্পণ করলাম। এতে একটু বিরক্তি ভাব এলেও এই নিরাপত্তা তল্লাশির দরকার ছিল। এই আড়গড়া পার হয়ে আমরা লাউঞ্জে কয়েক মিনিট অপেক্ষার পরই বিমানের সিঁড়িতে পা রাখলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভুটিয়া সুন্দরীদের দেখতে পেলাম। তাঁরা হাত জোড় করে বললেন, গুড মর্নিং। প্রতিউত্তর দিয়ে বিভোর আনন্দে নির্ধারিত সিটে বসলাম। জানালার পাশে জুটল আমার আসন। আবুবকর সিদ্দিক পারভেজ আমার পাশে। তাঁর ওপাশে জামাল। একবার দাঁড়িয়ে দেখলাম, মাঝারি আকৃতির পুরো প্লেনটি প্যাকড আপ, এত পর্যটক ভুটানে যান! সতর্কবার্তা শোনার আগেই সিট বেল্ট বেঁধে ফেলেছি। সিট বেল্ট কীভাবে বাঁধতে হয়, অক্সিজেন মাস্ক কীভাবে পরতে হয়-এয়ার হোস্টেস দেখাতে লাগলেন। জানালা দিয়ে দেখছি ঢাকার জমি ভেজা, তবে আকাশে রোদ্দুর। প্রায় সাড়ে দশটায় এয়ারবাসটি গর্জন করে উঠল। তারপর রানওয়ে ধরে বুকে গভীর দম নিয়ে দ্রুত ছুটল। এবার তাহলে সত্যি আমরা ভুটান যাচ্ছি! উড়ালবার্তায় জানানো যায়-আকাশে ধাতবপাখি
স্বদেশে স্বজন রাখি।
ঢাকা, ১২ এপ্রিল ২০১৯

থিম্পুপথে

আমরা একটা চনমনে ভাব আর আনন্দ আমেজে গাড়িতে উঠলাম। জামাল বসেছেন চালকের পাশের সিটে এবং পারভেজ আর আমি পেছনের সিটে বসেছি। ত্রিন দর্জি রেডিও অন করে চালাতে লাগলেন গাড়ি। রেডিওবার্তায় শোনা গেল : শেখ হাসিনা বিমানবন্দরের ভিভিআইপি লাউঞ্জে লোটে শেরিংকে অভ্যর্থনা জানানোর পর সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার দেয়। এ সময়ে উনিশবার তোপধ্বনি করা হয়। পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। শেরিংও তাঁর সফরসঙ্গীদের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পরিচয় করান।
গাড়ি নদীপার ঘেঁষে চলল একটা সমতল পথে। জামাল বললেন, আমি ক্ষুধার্ত নই, তবে তৃষিত। পারভেজ বললেন, আমরা চায়ের দেশের লোক, চা না-হলে চলে না। আমিও চা পানে সম্মত হলাম। চা পানের কথা দর্জিকে জামাল জানালে তিনি বললেন, ঠিক আছে। যথাস্থানে চা পান করা যাবে। এই পানের প্রসঙ্গ এলে, জামাল কহতব্য নয় এমন বিষয়-আশয় নিয়ে কথা বলা শুরু করেন। অপরিচয়ের ভেদরেখা ঘুচে দিতে দর্জির পারিবারিক তথ্য জানতে চান।
প্রায় পাঁচ কিলোমিটার ড্রাইভ করে নড়হফবু নামক স্থানে ড্রাগন হোটেলের সামনে এসে গাড়ির ব্রেকে পা রাখেন। এটি লজ এবং বার। আমরা এর ভিতরে প্রবেশ করলাম। কাস্টমার নেই। বেত এবং কাঠের তৈরি সোফায় গিয়ে আমরা বসলাম। ভিতর থেকে সহাস্যে এগিয়ে আসেন একজন তরুণী। দর্জি চারকাপ চা দিতে বললে মিনিট পাঁচের মধ্যেই তিনি লাল চা পরিবেশন করেন। একটি করে চিনির প্যাকেট দেওয়া হয়। গায়ে লেখা : ংঃরৎ রঃ ঁঢ় রিঃয নৎড়হি ংঁমধৎ। দেখতে গুড়ের মত মনে হল। আমরা চা আয়েশ করে পান করলাম। জামাল বাড়তি সুযোগ নিয়ে ধূমপানতেষ্টা মেটালেন। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ধূমপান সরকারিভাবে নিষিদ্ধ। প্রকাশ্যে বিক্রি হয় না। কিন্তু মদ্যপানে কোনও বাধা নেই। পানের দোকানেও মদ কিনতে পাওয়া যায়। অবশ্য বার-লজে ধূমপান চলে। নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া খেলে জরিমানা। জামাল কুল্লে একখানা সিগারেট পোড়ালেন। এ বাবদ পাঁচ আর চার কাপ চায়ের জন্য ষাট মিলে ভুটানি পঁয়ষট্টি ‘নু’ গুনতে হল। ডলার ভাঙানো যায়নি বলে দর্জিই পঁয়ষট্টি ‘নু’ দিলেন, অবশ্য পরে আমরা তাঁর ঋণ পরিশোধ করি।
ভুটানের প্রথম চা আমরা ঠোঁটে ছুঁইয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ি ফের ছুটল রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশ্যে। পারো থেকে এর দূরত্ব পঞ্চান্ন কিলোমিটার। পথে লোকজন নেই। কেমন নির্জন নিস্তব্ধ। টাউনবাস আর পর্যটকবাহী কয়েকটি গাড়ি চোখে পড়ল। সহযাত্রী দুজন গাড়ির দুলুনিতে ঘুমঘোরে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সরু আঁকাবাঁকা পথ ধরে গাড়ি চলছে। পথের দুপাশে বনাঞ্চল। সবুজের সমারোহ। সারি সারি সাইপ্রাস গাছ। ভুটানের জাতীয় বৃক্ষ। পাইন ও সাইপ্রাস শীতপ্রধান দেশে দেখা যায়। পাইনও দেখা গেল। সঙ্গে জাতীয় ফুল নীল পপি। তবে এক ঝলক। আর ফাঁকে ফাঁকে নদী। ‘পারো চু’, ‘থিম্পু চু’ মিলে গেছে। মিলেমিশে ত্রিবেণীসংগমে নেমে গেছে ‘ওয়াং চু’। বৃক্ষ আর নদীর শোভা আর বুনো ফুলের ঝলক দেখে চোখ জুড়ায়। মনও রাঙিয়ে দেয়। আর রাঙানো মন নিয়ে সবকিছুই রমণীয় দেখায়।
এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে আর দর্জির সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম পঁয়তাল্লিশ মিনিটে থিম্পু শহরে। কিন্তু শহরভাগের অদূরে থেকেই চড়চড়ে রোদে গরমের তাত গায়ে লাগে। তবে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির তাপানুকূল যন্ত্রটি চালু করেন দর্জি।
থিম্পু প্রবেশের আগে একটা গেইট নজরে পড়ল। প্রত্যেক এলাকায় এমন গেইট বানানো আছে। এটা ভুটানের ট্র্যাডিশন। একটা উঁচু বাঁকে এসে গাড়ি থেকে নেমে খানিক দাঁড়িয়ে শহরটা এক লহমা দেখে নিলাম আমরা। একই ধাঁচে তৈরি বাড়িঘর। এরপর গাড়ি থেকে শহর দেখতে দেখতে হোটেল। একটু উঁচু মহল্লার মত জায়গায় আমাদের পান্থশালা। পাশে আরও কয়েকটি। নির্মাণের সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। এই জঞ্জাল দেখে আমাদের দেশের একটা ছোঁয়া পেলাম। নতুন হোটেল, বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে। হোটেলের বাঁয়ে এবং সামনে অনতি দূরে পাহাড়। ডানে এবং পেছনে শহর। ইধনবহধ ঞযরসঢ়যঁ-র চবসধষরহম ঠরষষধ নামক হোটেলটা গলির ভিতরে। এর এক চিলতে প্রাঙ্গণে গাড়িটি থামলে দুইজোড়া কেতাদুরস্ত তরুণতরুণী ছুটে এলেন। ‘ওয়েলকাম স্যার’ বলে ব্যাগপত্র নিয়ে গেলেন।
কক্ষে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসেন হোটেল মালিক আর তাঁর স্ত্রী। তরুণ দম্পতি। আরও দুইজন তরুণী ট্রেতে করে শরবত নিয়ে এলেন। অভ্যর্থনাকক্ষটি সুন্দর, মহার্ঘ আসবাবে সাজানো-গোছানো। হোটেল ম্যানেজার রিনচেন হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন। কুশল জিজ্ঞেস করে বিনয় বচনে পাসপোর্ট চাইলেন। আমরা জমা দেবার পর দ্রুতই নামটাম লিখে পাসপোর্ট ফেরত দিলেন। রুমের চাবি গছিয়ে দিয়ে একজন ওয়েটারকে আমাদের নিয়ে যেতে বলেন। ওয়াইফাই পাসওয়ার্ডও তিনি জানিয়ে দিলেন সারল্য মাখানো হাসিমুখে। এরপর লিফটের দিকে আমরা পা বাড়াই। ঢাউস লিফট গিয়ে তিনতলায় আটকে। বেয়ারাকে অনুসরণ করে আমরা ঢুকে পড়ি রুমে। ততক্ষণে ব্যাগপত্র বয়ে নিয়ে এসেছেন তরুণীদ্বয়। রুমে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বেশ বড়োসড়ো একটা রুম, এর ভিতরে আরও একটা রুম। কার্পেটে মোড়া মেঝের ওপর সোফা, তিনটি প্রশস্ত খাটে ধবধবে শাদা নরম বিছানা, টিভি, টেলিফোন, ড্রেসিং টেবিল, একপাশে ওয়ার্ডরোব, সংলগ্ন কায়দাদুরস্ত বাথরুম, বড়ো বাথটাব, বেসিন এবং শাওয়ারে ঠান্ডা ও গরম জলের ট্যাপ আছে। এসব ব্যবস্থা এবং আসবাবপত্র সিজিলমিছিল দেখে মনে মনে রাজকীয় অতিথি ভাবতে নিজেদের ভালো লাগে।
হোটেলে বেশিক্ষণ থাকার ইচ্ছে নেই। বাথরুম থেকে ভারমুক্ত ও ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।
নিচতলায় অফিস কক্ষের পাশে ডাইনিং হলটা বিশাল। ওখানে দুপুরের খাবার সাজানো আছে বুফে আয়োজনে। থরে থরে সাজানো নানান পদের খাবার। ভাত, রুটি, তরিতরকারি, মাছ, সবজি ইত্যাদি। যার যার পছন্দমতো তুলে নিয়ে খাচ্ছেন।
এই হোটেল আলয় দেখলাম, বিমানের প্রায় যাত্রী উঠেছেন। জরিপ-নয়নে তাকাতে গিয়ে প্লেনে দেখা এক মুখপরিচিত ব্যক্তিকে পেয়ে গেলাম এবং জানতে পারলাম তাঁরা ঢাকা থেকে এসেছেন ছুটি-সম্ভোগী চল্লিশজনের একটি দল, একটা বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করেন; আরও এসেছেন অভিসারকামী যুগল ও দুজন নারী। সকলেই বাংলাদেশি। একটুকরো স¦দেশে যেন বাড়তি আনন্দ মনে জবর জম্পেশ করে আহারলোভন খাবার আমরা খেলাম।
এই মধ্যাহ্নভোজের পরিতৃপ্তি নিয়ে এবার আমরা থিম্পুর আকর্ষণকেন্দ্রগুলো দেখতে আনন্দোচ্ছ্বাসে বের হলাম।
থিম্পু, ১২ এপ্রিল ২০১৯

ভ্রমণানন্দের থিম্পু

আমাদের ভুটানদর্শন শুরু হয় বুদ্ধ টেম্পল নামের সুখ্যাত স্থাপনা পরিক্রমা দিয়ে। পথে যেতে যেতে নজর বোলাচ্ছিলাম-এখন শুধু দেখার পালা। চোখে পড়ল একটা বিশাল স্কুল, খোলা মাঠ, চ্যাং লাইম থ্যাং স্টেডিয়াম, বনভূমি, সুন্দর সুন্দর দোচালা, চারচালার মত ঘর, বাড়ির সামনে সবুজ লন।
অনেকখানি পাহাড়ি মোড় পেরিয়ে কয়েক ধাপ বেয়ে যেতে হয় বুদ্ধা ভিউ পয়েন্ট। এখান থেকে যেমন গোটা থিম্পু এসে যায় চোখের সীমানায়, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও দেখা যায় স¦র্ণকান্তি গৌতম বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। আকাশের মহামৌন ভার নিয়ে বুদ্ধ পাহাড়ের চূড়ায় আসন পেতে বসে আছেন প্রকৃতিকে কোলে নিয়ে। তাঁর সঙ্গে চারপাশে বহু স¦র্ণকান্তি বুদ্ধ দেবী জেল্লা নিয়ে নীরবে দাঁড়ানো নাতিদূরে। প্রখর সৌন্দর্যচেতনা আর শিল্পবোধ থেকে তৈরি এই তিনমানুষ সমান ঝাঁঝাঁ রোদে চকচকে মূর্তির রূপ দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কাছে থেকে, দূরে থেকে আমি বারবার মূর্তি কটি মুগ্ধকর চোখে দেখলাম। এবং মনে হল দেবীমূর্তিগুলো হৃদয় কাঁপানো সৌন্দর্যের, আর বুদ্ধমূর্তিটি গাম্ভীর্যের চেতনা নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে।
বুদ্ধমূর্তি যে-ভবনের উপরে বসা সেই ভবনের ভিতরে একটি মিউজিয়াম আছে। এখানে রয়েছে ব্রোঞ্জের এক লক্ষ ছোটো বুদ্ধমূর্তি। অতিশয় চকচকে। এগুলোও সোনার প্রলেপে নির্মিত। ভিতরে লেখা : ঘড় চযড়ঃড় ওহংরফব ঞযব ঞবসঢ়ষব। আমি ভিতরটা ত্রস্ত চোখে দেখলাম। চোরা ক্যামেরায় ছবি তুলতে চাইলাম। কিন্তু ভিতরেও বাতাস। বাইরে তো দাঁড়াবার শক্তি পাচ্ছিলাম না। হাওয়ার দাপট এখানে মারাত্মক! মনে হয়েছে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমার কয়েকটি ছবি তুললেন দর্জি। অবাধ্য চুল এসে মুখ ঢেকে দেয়। চোখ বন্ধ করে দেয় ঝড়োবাতাসে। আমি এক নজরে দর্শন করলাম মাত্র। কিন্তু সর্ব ইন্দ্রিয় সজাগ রেখে ভ্রমণ করতে হয়। তৃষিত হৃদয় দিয়ে সৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করতে হয়।
চারপাশে সবুজে পাহাড়ে পাহাড় ঘেরা, মাঝখানকার অল্প সমতলে থিম্পু-হাতের তালুর মত ছোট্ট জনভূমি। পর্বতমালার সুউচ্চ শিখররাজি যেন পাহারা দিচ্ছে এই থিম্পু শহরকে। পাহাড়ি দেশটির সর্বনিম্ন ভূ-উচ্চতা সমুদ্রপীঠ থেকে একশত আশি মিটার আর সর্বোচ্চ সাত হাজার পাঁচশত পঞ্চাশ মিটার। নগরনির্মাণে প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সবুজবেষ্টিত প্রতিটি বাড়ি। অফিস-মহল্লা গিরিবর্ত্মের উপরে ছড়ানো। স্থাপনাগুলোর বিশেষত্ব হল প্রতিটির গায়ে গায়ে হাতের নশকা করা। ত্রিন দর্জি মনাস্ট্রির পাশে ভিউ পয়েন্ট থেকে আমাকে আঙুল দিয়ে সামরিক আস্তানা দেখান। পাহাড়ের পাদদেশে ছোটো ছোটো ঘর। এগুলোর শোভা ও স্থাপত্যও দেখতে একই রকমের।
জংটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শান্ত ও আবিষ্ট ধরনের প্রশস্ত অঙ্গন। আমার দু-সঙ্গী ছিটকে পড়েছেন, বিশাল জঙের কোথাও-বা মোবাইল-ক্যামেরা ঝলসাচ্ছেন। একা পেয়ে আমি দর্জির কাছ থেকে জেনে নিলাম প্রয়োজনীয় তথ্য। সবকিছু জানার একটা আমার অদম্য আগ্রহ। কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতা আছে। এবং আমারও। উভয়েই ভাষা বিনিময়ে অপারগ। বুদ্ধ টেম্পলে একশত কুড়িটি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। আমরা সিঁড়ি না-বেয়ে গাড়ি চড়ে এর তোরণগোড়ায় এসে নামলাম। বৃহদায়তন জুড়ে এই মনাস্ট্রি এলাকা। গেটের ভিতরে দুপাশে দুটি প্রার্থনাচক্র। দেখলাম প্রার্থনার লক্ষ্যে চক্র দুটি প্রদক্ষিণ করছেন স্থানীয় পুণ্যার্থী কজন। এবং গেটের বিপরীতে দুটি সুন্দর স্থাপনা। একটি তিনচালা, অপরটি দোচালা। দোচালা ভবনটি বেশ বড়ো। মনাস্ট্রির গায়ে একটি শ্বেত হাতি-খুদাই করা চিত্রার্পিত হয়ে। মনোহর নম্রসহ দেবীমূর্তিও। চাক্ষুষ করলে চোখ ও মন তৃপ্ত করে।
বুদ্ধ টেম্পল দেখার পর ত্রিন দর্জি বললেন, আগামীকাল থিম্পু শহর ইচ্ছেমতো বেড়াতে পারব। তিনি এর আশপাশ দেখাবেন এবং কেনাকাটার সুযোগ দেবেন। আমি প্রপোজ করলাম, আমরা পুনাখা যেতে চাই। প্রাচীন রাজধানী পুনাখা না-দেখে বাংলাদেশ ফেরা মানে ভুটান দেখা না-দেখা সমান। জবাবে বললেন,‘প্যাকেজে দ্রষ্টব্যের তালিকায় পুনাখা নেই। যেতে হলে বাড়তি খরচ লাগবে এবং এখনই তিন হাজার রুপি জমা দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে পারমিশনের পেপার কালেক্ট করতে হবে। একটু পরই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।’ থিম্পুর বাইরে কোথাও যেতে হলে ইমিগ্রেশন অফিস থেকে পারমিশন নিতে হয়। জামাল জানতে চাইলেন, লাঞ্চের খরচ কে বহন করবে? হোটেলঅলা তো আগেই নিয়ে নিয়েছে। দর্জি বললেন, ‘আমি সমঝোতা করব।’ পারভেজ ঝটিতি জবাব দিলেন, তাহলে তো কথা নেই। এক হাজার করে তিন হাজার রুপি দিতে আমরা রফানিষ্পত্তি করে নিয়েছি। পর দিন পুনাখা ভ্রমণে যেতে চাই।
হাতে বিশেষ সময় ছিল না। রাস্তার পাশেই ছোট্ট পার্কিং লট। এখানে গাড়িটি রেখে আমরা ডলার ভাঙাতে দর্জির পিছু নিলাম। তিনি বেছেগুছে একটি দোকানে নিয়ে গেলেন। সহযাত্রী তিনজনই ডলার বিনিময় করলাম। একশত ডলার ভাঙিয়ে আমি পেলাম ছয় হাজার আটশত ভুটানি ‘নু’। এখানেই বলে রাখি ‘নু’ ভারতীয় রুপির সঙ্গে যুক্ত। সমমূল্য। কিন্তু বৈধ মুদ্রা হিশেবে রুপির কদর সম্ভবত বেশি। পরে বুঝেছি ‘নু’ রেখে রুপি দিতে চায় না অনেক দোকানি। ‘নু’ চালু হয়েছে সবে উনিশ শত চুয়াত্তর সালে। এখনও ভারতই ভুটানের অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করছে।
‘নু’ আর আমাদের পাসপোর্টের ফটোকপি নিয়ে দর্জি ইমিগ্রেশন অফিসে এবং মন্ত্রণালয়ে গেলেন। দুটিই কাছেপিঠে। একটি ঝঅঅজ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ঋঁহফ নির্মিত ইযঁঃধহ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ইধহশ-এর পাশের ভবনে। অন্যটি রাস্তার বিপরীত অন্য ভবনে। যাবার আগে তিনি বললেন, ‘দোকান-টোকান ঘুরে দেখুন, পুখানা যাবার অনুমতিপত্র নিয়ে আসি।’ দর্জির কথায় আমরা সানন্দে রাজি হলাম। দেখতে এসেছি, ঘুরবো না! নতুন জায়গা পায়ে পায়ে হেঁটে দেখার আনন্দ আর অভিজ্ঞতা অন্যরকমের।
অসহ্য শহুরে ভিড়ভাট্টা নেই। রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। পাহাড়ের ফাঁকে-ফোকরে বসতি বলে রিকশা বা ভ্যান চলে না। বেবিটেক্সিও নেই। দু-চারটা গাড়ি-বাস আছে, কিন্তু যানযন্ত্রের গর্জন নেই। ট্র্যাফিক সিগন্যাল নেই। পাহাড়ের নিস্তব্ধতা সবখানে। পুরো দেশটাতে লোকসংখ্যা প্রায় সাত লাখ সাতানব্বই হাজার সাতশত পঁয়ষট্টি জন, আর থিম্পুতে নব্বই হাজার! দোকানবাজার দুধারে থাকলেও উচ্চগ্রামে কথাবার্তা, রাগারাগি নেই। শান্ত পরিবেশ, ধুলোমুক্ত পথঘাট। পরে লক্ষ করছি অন্যান্য শহরেও একই চিত্র। ভদ্রাভদ্র মানুষের অকাতর চলাচল সবখানেই।
রাস্তায় হকার নেই। তবে হ্যান্ডিক্রাফটের অনেক দোকান আছে। শহরের শিরদাঁড়ার পাশে। সার্কভবনের বিপরীতে। এই সার্কভবনে প্রথম সার্ক-সম্মেলন হয়। দেখলাম, বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রসমূহের পতাকা উড়ছে।
ত্রিন দর্জির স্ত্রীও হ্যান্ডিক্রাফটের একটি দোকানের মালিক। মহিলামহল দোকানি।
আমরা পোশাক-গয়না, ছোটো ছোটো দোকানে স্থানীয় শৌখিন সামগ্রী দেখে দেখে, ঘুরে বেড়ালাম। আধঘণ্টাটেক পরে পুনাখার পারমিট নিয়ে ফিরলেন দর্জি। ফিরেই ফের থিম্পু দেখাতে তাঁর তাড়া। তিনি নিয়ে গেলেন ন্যাশনাল মেমোরিয়াল কর্টেন দেখাতে। এটি একটি স্মৃতিস্তম্ভ। ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংগচুকের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে উনিশশত চুয়াত্তর সালে এই স্তূপ নির্মাণ করা হয়েছিল। ভিতরের বিভিন্ন পেইন্টিং এবং স্ট্যাচু বৌদ্ধ ফিলোসফির রিফ্লেকশন। ধর্মীয় স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও ঐশ্বর্যের প্রদর্শনী।
থিম্পুর জিরোপয়েন্টে একটি ক্লক-টাওয়ার। দোতলা সমান উচ্চতা। পাশে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুললাম। পাশের শপিংমলে ঘুরলাম। ইচ্ছেছিল মিউজিয়াম দেখবো। কিন্তু পাঁচটার পর বন্ধ হয়ে যায়। দেখা হয় না, ফাজু-দিং গুম্ফা, তাংগু গুম্ফা, চেরি গুম্ফা। এই সবকিছু কি একবারে দেখা যায়? এই দেখা না-দেখাই ভ্রমণের ভবিতব্য।
এখন গরমকাল। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই ঠান্ডা অনুভূত হল আমাদের দেশের শীতকালের মত। এবং সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে ঠান্ডা তত বাড়তে লাগল। এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা তেরো থেকে আঠারো আর শীতকালে শূন্য দশমিক দুই থেকে বারো সেন্টিগ্রেড। আজ মনে হচ্ছে আট বা দশ। বাইরে আর না।
প্রথম দিনেই থিম্পু চাক্ষুষ করার তৃপ্তি নিয়ে আমরা হোটেলে ফিরছিলাম। ফিরেই ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যারাতে নৈশাহারে বসলাম। নেপালের মত ভুটান রাত-জাগা শহর নয়। নানা রকমের নাইটক্লাবও নেই। জগঝম্প গানবাজনার আয়োজন নেই। প্রমোদপাড়াও নেই। ফলে সন্ধ্যারাতেই নৈশাহার সাঙ্গ করলাম।
সারাদিনের ধকলে আর গতরাতের অনিদ্রায় বেশ ক্লান্ত আমরা। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। কাল সকালে উঠতে হবে, পুনাখা বেড়াতে যাব।
থিম্পু, ১২ এপ্রিল ২০১৯

দোচলা পাস

পুনাখা দেখতে যাব বলে সকালেই ঘুম ভেঙে গেল। স্নানাদি সেরে, তৈরি হয়ে আমরা নাস্তার টেবিলে এসে দেখলাম সব ঠিকঠাক। দুধ প্লাস কর্নফ্ল্যাক্স, ব্রেড প্লাস জেলি, মাখন, পরোটা প্লাস সবজি, মুগের ডাল, সঙ্গে চা এবং কফি রাখা আছে যথাস্থানে। বুফে ব্যবস্থা। আমরা ব্রেকফাস্ট শেষ করে অভ্যর্থনাকক্ষে এসে দেখতে পেলাম দর্জি সোফায় বসে আছেন। দেখেই বললেন, গুড মর্নিং! লেটস গ। আমরাও প্রতিউত্তর জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
পুনাখা যাবার আগে সিনড্রম নামক স্থানে ছবি তুললাম। এখান থেকে বৌদ্ধ টেম্পলসহ বিশাল জায়গাজমির দৃশ্য চমৎকার দেখা যায়। নিচের প্রাকৃতিক দৃশ্যও শীতল সবুজ। সবুজ বলতে শুধু কয়েকরকম সবুজ নয়, চোখের পক্ষে অন্তত স্নিগ্ধকর। কিন্তু এই দৃশ্য দেখনদারের সংখ্যা খুবই কম। ফটাফট ছবি তুলেই দর্শনার্থীরা ছুটছেন দোচলার উদ্দেশ্যে।
থিম্পু শহর থেকে পুনাখা বাহাত্তর কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আর পুনাখার পথেই দোচলা পাস। থিম্পু থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে। উচ্চতা প্রায় দশ হাজার দুইশত চল্লিশ ফুট। এখান থেকে পাওয়া যায় হিমালয়ের একটা প্যানারমিক ভিউ। দোচলা চত্বরে অজস্র দর্শনার্থী। এই দোচলা নাম শুনে এবং আকৃতি দেখে আমার মনে পড়ে গেল গ্রামবাংলার দুই চালাবিশিষ্ট ঘর বা মন্দিরের কথা। বাংলাদেশের মন্দির-স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য এমন।
আকাশ একটু মেঘলা। কুয়াশা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। একই সঙ্গে উড়ন্ত মেঘের দলে চারপাশ ঘেরা। মেঘের ধোঁয়াশা ডিঙিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছি। আবার নিচের অগাধ অতল গভীর খাদ আকাশ পাতাল ছদ্মবেশ ধারণ করেছে। হাতের বাঁদিকে বিশাল স্থাপনা। ডান দিকেও। মাঝামাঝি স্থানে আছে সারি সারি একশত আটটি চৌকোনা স্মৃতিস্তম্ভ। দোচলার স্থাপত্য শোভাকে প্রাকৃত শোভা মনোরম করে তুলেছে।
দোচলার আগেই সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প। এই ক্যাম্পে পুনাখা যাবার অনুমতিপত্র দেখাতে হয়, ফেরার সময়েও দেখাতে হয়। এর কাছে ফলের দোকান। ভুটানি মেয়েরা আপেল, কমলা বিক্রি করছেন। এখানকার আপেল খুবই টুকটুকে লাল আর খেতেও ভারি মিষ্টি। জামাল আপেল কিনতে নেমে পড়েন। দেখাদেখি আমরাও।
রেডিও বেজেই চলেছে। গানের ফাঁকে ফাঁকে খবর শুনতে পাই-ভুটানের, বাংলাদেশের।
গাড়ি থামিয়ে, চোখভোলানো সৌন্দর্যে তাকিয়ে, জিরিয়ে, জুড়িয়ে, চা-জল বারকয়েক পান করে পুনাখা আমরা পৌঁছলাম।
দোচলা, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

লাল রোদে পুনাখা দর্শন

পুনাখা জং একটি প্রাচীন নজরদার বৌদ্ধ মঠ, প্রসিদ্ধ দ্রষ্টব্যস্থান। ইতিহাসখ্যাত দুর্গের আদলে তৈরি। ষোলোশত সাঁইত্রিশ সালে নির্মাণ করেন লামা শার্বদুং নাওয়াং নামগে। উনিশশত সাত সালে এখানেই অভিষেক হয়েছিল ভুটানের প্রথম রাজা গংসার উগেইন ওয়াংচুকের। মনোরম স্থাপত্যশৈলীর পাঁচতলা ভবনের এক অংশে বর্গাকার বিশাল চত্বর। উপরে রয়েছে অগণিত বুদ্ধমূর্তি। মাঝে আরেক ভবন। ধাপে ধাপে ছোটো হতে হতে উপরের দিকে উঠেছে। এই জং যতটা না প্রশাসনিক, তার চেয়ে ধর্মীয় দিক দিয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেই বর্তমান রাজা জিগমের সঙ্গে প্রেমিকা জেৎসুন পেমার বিবাহানুষ্ঠান ধর্মীয় আচারনীতি মেনে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। ভোর চারটায় শীত কুয়াশা উপেক্ষা করে রাজা-রানির ওই বিবাহোৎসব দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন ভুটানবাসী।
এখানে থাকেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা। এ নিয়ে নানা কিংবদন্তি চালু আছে, জঙের দুপাশে নদীপারে ভবনের দেওয়াল ঘেঁষে স্তূপাকারে জমে থাকা পাথরসমূহ নাকি নিজ থেকে গড়িয়ে এসেছে এবং পরস্পর ঠাঁই নিয়েছে। নদীর স্রোতের টানে ভবনের ধস ঠেকাতে। ভবনের কাঠগুলোও নাকি যথাস্থান দখল করে আছে নদীজলে ভেসে এসে। ভবনের উপরে কাঠের ছাউনি এখন আর নেই। কাঠের কাঠামো বসিয়ে ঢালু চাল ছাওয়া হয়েছে টিন দিয়ে। শুধু ইতিহাস নয়, স্থাপত্যেও পুনাখা জং বৈচিত্র্যময়, সমৃদ্ধ।
পুনাখা জঙের দুপাশে দুটি নদনদী। হিমালয় থেকে বরফ গলে নেমে আসা দুই শক্তিমত্ত-‘পো চু’ ও ‘মো চু’। ভুটানি ভাষায় ‘চু’ মানে নদী এবং ‘পো’ পুরুষ আর ‘মো’ নারী। পাহাড়ি নদনদী স¦ভাবত ভয়ংকর খরস্রোতা হয়। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়েছে দুটির স্রোতে পাহাড়ি নদীর দুর্বারতা নেই। হয়ত শুকনো মৌসুম এজন্য। আমি ভাটির মানুষ। জলের প্রতি একটা বাড়তি টান রক্তে। শুনেছি এখানে জলের প্রতি কারও তেমন টান নেই। তবে পর্যটকেরাই বোট নিয়ে জলক্রীড়া করেন জলমৌসুমে। জলমৌসুমে নৌকো পেলে আমিও ভাসতাম এই খেলায়। কেউ বাধা দিতে পারত না।
থিম্পুর তুলনায় এখানে বেশ গরম। পয়লা বৈশাখে আমাদের ঘেমো গরম জাপটে ধরল গাড়ি থেকে নামতেই। কিন্তু আকাশ রাঙানো রোদ। লাল রোদ পড়ে ঝলঝল করছিল দ্রষ্টব্যটি। ইন্টারনেটে, ফেসবুকে এবং পত্রপত্রিকায় পুনাখার ছবি দেখেছি। চোখ পড়তেই চেনা মনে হল।
নদীর ওপারে জং। নদী ধরেই হাঁটার রোমাঞ্চকর অনুভূতি শুরু হয়। জঙে ঢোকবার মুখে কাঠের লম্বা-চওড়া বড়োসড়ো ছাউনি দেওয়া পুল। কোনও নদীর সৌন্দর্য দেখতে হলে অনেকক্ষণ মাঝবরাবরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দেখতে হয় জলের চরিত্র। জলের চরিত্র সর্বত্র এক নয়। নদীর একদিকে নিস্তরঙ্গ জল। অন্যদিকে একটু প্রবাহ। পুলের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা নদী আর পাহাড়ের মনকাড়া দৃশ্য দেখলাম।
ভ্রমণ বিখ্যাত পুনাখায় দেখা পেলাম নানান দেশের পর্যটকদের। ভারতীয় একজন আমাকে দেখে বললেন, ভিতরে টিকিট ছাড়া যাওয়া যাবে না। দক্ষিণা না দিয়েই এর চত্বরে ঘোরা যায়। কিন্তু ভিতরে যাওয়া যায় না। কেউ ভুটানে বেড়াতে গেলে অবশ্যই দ্রষ্টব্যের মধ্যে পুনাখা রাখবেন এবং এই পর্যভূমির ভিতর-বাইর ঘুরে দেখবেন। আমার সঙ্গীরা যেহেতু ভিতরবাগে যেতে রাজি নন, আমিও একা দর্শনে সাহস করলাম না। ভারতীর কাছেই জেনে নিলাম কী কী আছে। এক কথায় দু-কথায় অনেক জানা হল, তথ্যের সন্ধানও মিলল। এছাড়া চীনা এবং ইউরোপীয় দর্শনার্থী পাওয়া গেল। অন্যদেশেরও। একজনের হাতে ব্যান্ডেজ। সুইজারল্যান্ডবাসী এই সত্তরোর্ধ্ব মহিলার সঙ্গে জামাল উদ্যোগী হয়ে গল্প করছিলেন। তাঁকে জড়িয়ে ধরে সেল্ফি তোলেন। পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বের করে হাতে দিলেন।
এখান থেকে অল্পদূরে পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ। ‘ফো চু’ নদীর উপর নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু। তিনশত পঞ্চাশ মিটার লম্বা সেতুটি দেখবার সুযোগ দেননি দর্জি। বললেন, সামনে তেমন কিছু দেখার নেই।
বারোটা পঁচিশে পুনাখা জং ত্যাগ করলাম। আমরা পড়ন্ত দুপুরে রওনা হলাম থিম্পুর উদ্দেশ্যে। এর আগে স্থানীয় একটি স্মারক বিপণিতে ঘোরাঘুরি করে নিই। এখানে দোকানের একপাশে জেনানামহল পোশাক বুনছেন, নানা সামগ্রী বিক্রি করছেন। কিন্তু আমাদের কেনার তেমন কিছু নেই। নানান জিনিশ দেখাটাই মূল উপভোগ্য। কিন্তু উপভোগের সঙ্গে গ্রহণের একটা সম্পর্ক জড়িত থাকে। এবার আমাদের খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। সকলের পেটেই ছুঁচোর কীর্তন অনুভূত হচ্ছে। দর্জি সহজেই তা উপলব্ধি করে বললেন, চলেন কিছু খেয়ে নেব।
পুনাখা, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

জীবন্ত জন্তুর সহবতে

লবিসা নামক স্থানে দুপুরের আহারের ঠাঁই পাতলাম। ঈযরসর খযশযধহম ঈধভবঃবৎৎরধ-এর একপাশে স্বল্প খেতিজমি, খামার, মাটির পথ ধরে অনতিদূরে গ্রাম। পল্লিপরিবৃত সবুজ শোভন আবাস। ভুটানের আবাদযোগ্য ভূমি মাত্র সাত দশমিক আট শতাংশ। উৎপন্ন হয় ধান, গম, জয়ার, ভুট্টা, আলু, সরিষা, মরিচ ও সবজি। এবং সত্তর ভাগ মানুষ কৃষি ও পশুপালনের ওপর নির্ভরশীল। রাজ্যের অর্থনীতির প্রধান খাতও এই কৃষি ও পশুপালন। শিল্প-কারখানা নেই বলা চলে। হাতে তৈরি কুটিরশিল্প আর দু-চারটি কেমিক্যাল শিল্প প্রধান সম্বল। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান রফতানি পণ্য পাথর ও কাঠ। এ-টি ভুটানের অফুরন্ত সম্পদ। এর পর রয়েছে আপেল ও কমলা। রফতানিযোগ্য পণ্য। এই ফলবাগানের মালিক ও দখলদার রাজপরিবারের সদস্যরা। অন্যরাও অল্প অংশের মালিক। ভুটানের আমদানি-রফতানির প্রধান অংশীদার ভারত।
রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই নজরে পড়ল মানুষ সমান উচ্চতা নিয়ে কাঠের তৈরি উত্থিত একটা পুরুষ লিঙ্গ। অ্যান্টেনার মত। জিনিশটা প্রথম আলগোছে দেখিয়েছিলেন খতিবুর রহমান জামাল, থিম্পুর হ্যান্ডিক্রাফটের দোকানে। উত্তরে জামালের প্রতি বিস্ময় : আরে এ তো আমাদেরটা! আমার এমন রসোত্তেজিত মন্তব্য শুনে পারভেজের মরচে পড়া রক্তে যেন টান পড়ে। তিনি মুখ টিপে হাসেন। আমিও হাসি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সমবেতভাবে হাসি। সেদিন প্রথমে হাসি পেলেও যখন দেখলাম প্রতিটি দোকানে দোকানে, বাড়িঘরে, নানা স্থানে শোভা পাচ্ছে, এমনকী মেয়েদের কানের দুল, চাবির রিং এবং কাঁধের ব্যাগে, তখন আর অপ্রতিভ বোধ করিনি। সহজভাবে আমরা গ্রহণ করি। এটাকে একটা ফোর্স (জোর) হিশেবে ভুটানিরা দেখে। ফার্টিলিটির (উর্বরতার) প্রতীক হিশেবে বিশ্বাস করে।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে আরও নজরে পড়ল, প্রচুর খদ্দের। লাঞ্চের সময় এবং পর্যটনকেন্দ্র বলে হয়ত। এছাড়া সর্বত্র একটা নির্জনতা বা জনশূন্যতা বড্ড বেশি। যেখানেই গেছি জনমানবহীন মনে হয়েছে। ফলে এ চিত্র ভুটানের নয়।
ভাত তরিতরকারি লবণ আর মশলাবিহীন ভালো লাগে না। কিন্তু খিদেপেটে খাদ্যবস্তু বিস¦াদ লাগে না। কোনও আপত্তি না-তুলে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম। আমাদের পথপ্রদর্শক দর্জি তৃপ্তিভরে খাচ্ছেন সুপ নুডলস। রাস্তার পাশে হাটুরে বাজারে কলা দেখে আমি জব্বর আগ্রহী হলাম। পারভেজ কলা আর কেক কিনে আনেন। অবশ্য কলা আমরা খেতে পারিনি। হরিণই সাবাড় করে! সে-কথাই বলছি একটু পরে।
কফি ব্রেক দিই পুনাখার গবহপযঁহধ জবংঃধঁৎধহঃ-এ। এটি একটি অভিজাত রেস্তোরাঁ। মহোন্নত কারুকাজ করা একটি কাঠের প্রাসাদে আমরা প্রবেশ করলাম। ভিতরে একপাশে একটি দোকান-স্মারকসম্ভার থরে থরে সাজানো। চড়া দাম। এই সময়টা কেনাকাটার নয়, ভাতঘুম ধরবার। তাই কফিতে চুমুক দিলাম। কফি কী?-নদীবনপাহাড়ের স্বপ্ন পান করলাম। গরম কফির উষ্ণ স¦াদ মুখে আর সবুজ বাতাসে প্রাণ ভরে নিয়ে আমরা বাহনে চড়ে বসলাম। পাহাড়ের সযতেœ নির্মিত মসৃণ সর্পিল পথ ধরে ছুটছে গাড়ি। দুপাশে জঙ্গল। ঘন বনময়। শুনলাম বন্যপ্রাণী আছে। আচমকা পেলামও একটা হরিণ! দেখে দর্জি গাড়ির গতি কমিয়ে দিলেন। ষাঁড়ের মত তেজ নিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ায় হরিণটা। থোড়াই-কেয়ার করে। করবে কেন? অরণ্য পশুর মা, আর মাটি হচ্ছে মানুষের।
আমি দুঃসাহসী কি না জানি না। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম, আমার দেখাদেখি জামালও নেমে পড়েন। একজন হরিণের সামনে, অন্যজন পেছনে। আমরা খুবই সন্তর্পণে, প্রথমে তফাতে দাঁড়িয়ে, পরে একে গায়ে হাত বুলিয়ে বাগে আনতে চাচ্ছি দেখে জানে ভীতু পারভেজ গাড়ির গ্লাস খোলেন। আর এই সুযোগে হরিণটি গলা ঢুকিয়ে দিল ভিতরে। চিৎকার দিয়ে ওঠেন গতরে ভটলা পারভেজ। জামাল কটাক্ষ করেন : ‘এই ভটকু কলা দে।’ তাঁর কথামতো পারভেজ কলাগুলো বাড়িয়ে দেন পশুটির সামনে। কলা খাওয়া দেখে হরিণটির প্রতি একটা অকারণ বিষণœ মায়া বোধ করলাম। আবার আমিই জামালকে গাড়িতে ওঠার তাড়া দিলাম। বন্যপশুর সংসর্গে বেশিক্ষণ থাকতে নেই, শাস্ত্রের নিষেধ আছে। ভাবলাম কলা না-পেয়ে গুঁতো দিতে পারে। তাই মুখের কলা শেষ হবার আগেই আমরা গাড়িতে তড়বড় করে উঠে পড়লাম। অবশ্য আখেরে হরিণের গুঁতোগুঁতির মতিগতি ছিল না।
আরও একটু সামনে চরতে দেখা গেল খচ্চর, গোরু ও ইয়াক। ইয়াক লোমঝোলা বিরাট গরুর আকৃতির প্রাণী। এ দুটি প্রাণী পাহাড়ি এবং গৃহপালিত। বাতাসে শুকানো ইয়াকের মাংস ভুটানিদের খুবই উপাদেয় খাদ্য। কিন্তু ইয়াকসহ বন্যপশুপাখি হত্যা করা ভুটানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নদীর মাছও নাকি তাঁরা শিকার করেন না। তাহলে প্রশ্ন উঁকি দিতেই পারে, তাঁরা খেতে পান কীভাবে? তিব্বত সীমান্ত থেকে ইয়াক আর ভারত থেকে গোরু-মুরগ, মাছ ইত্যাদি আসে। তিব্বত ও ভারতের একটা স¦ায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র ভুটান। ভুটানের ভাষায় এই দেশকে বলে, দ্রুক ইয়েল বা ঞযব খধহফ ড়ভ ঃযব উৎধমড়হ। এর উত্তরে ও পশ্চিমে তিব্বত এবং পশ্চিম দক্ষিণে ও পূর্বে ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও অরুণাচল প্রদেশ। ভুটানের আয়তন প্রায় ছেচল্লিশ হাজার ছয়শত আটান্ন বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বনাঞ্চল সত্তর শতাংশের বেশি আর অভয়ারণ্য ছাব্বিশ শতাংশ ন্যাশনাল পার্কসহ। প্রসঙ্গত ভুটানের একটা রেকর্ডের কথা উল্লেখ করতে হয়। দুই হাজার পনেরো সালে মাত্র এক ঘণ্টায় পঞ্চাশ হাজার গাছের চারা রোপণ করে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের বুকে নাম লিখিয়ে নিয়েছিল।
ইয়াক এবং গোরুর ছবি আমরা তুললাম। আসার সময়ে দোচলার কাছেপিঠে ভুটানের জাতীয় প্রাণী টাকিনের (ঞধশরহ) দেখা পেলাম। এটি ছাগল ও গোরুর মিশ্র আকৃতির এক বিস্ময়কর প্রাণী। যার মাথাটা ছাগলের কিন্তু দেহটা গোরুর। এই এট্রিলোপ গোত্রের পাহাড়ি ভেড়া নিয়ে একটি উপভোগ্য কাহিনি আছে। পঞ্চদশ শতকে ভুটান ভ্রমণে এসেছিলেন বৌদ্ধমুনি দ্রুকপা কুনলে। তিনি ছিলেন খামখেয়ালি স¦ভাবের এবং অলৌকিক ক্ষমতাবান। এজন্য তাঁর পরিচিতি ছিল ‘পাগলা সাধু’ নামে। তাঁর ক্ষমতা দেখতে বহুলোক সমাগম হল। তাঁকে অনুরোধ করা হল অলৌকিক কিছু দেখাবার জন্য। মুনি বললেন, ক্ষুধার্ত, খাবার আগে চাই। কথা শুনে একটা গোরু এবং একটা ছাগল আনা হল। তিনি গোগ্রাসে দুটোই খেলেন। হাড়গুলো ছাড়া। এরপর পরম তৃপ্তির সঙ্গে গোরুর আর ছাগলের মাথা দেহ থেকে আলাদা করে নিলেন এবং ছাগলের মাথা বসিয়ে দিলেন গোরুর দেহে। এবং নির্দেশ দিলেন চলাচল করতে! সৃষ্টি হল এই প্রাণী-টাকিন। ভুটানিদের দাবি, কেবল তাদের দেশেই এ কিম্ভূত প্রাণীটি দেখা যায়। মোটিথাং নামক স্থানে রয়েছে এর অভয়ারণ্য-টাকিন রিজার্ভ ফরেস্ট। আমরা ওখানে যাবার সুযোগ পাইনি। তবে ধূসর-সোনালি পশমে আবৃত টাকিন দেখলাম, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য ভুটানের জাতীয় পাখি দাঁড়কাক আমাদের কারও দেখন্তিতে পড়েনি। এ নিয়েও পৌরাণিক গল্পগাথা প্রচলিত আছে, এক দেবতা দাঁড়কাকের সুরত ধরে নাকি ভুটান মুলুক ঐক্যবদ্ধ করবার পথ দেখিয়েছিলেন। তাই এই দাঁড়কাকের মাথা রাজ অভিষেকের মুকুটে স্থাপিত।
ভুটানে আরও একটা প্রাণী চোখে পড়েছে-কুক্কুর-কুক্কুরী। এদের বেশরম চলাচল দেখে দর্জি বললেন, প্রজনন মৌসুম চলছে। জামাল রস করে বললেন, এখানে বৈশাখে ভাদ্রের কর্ম চলে তাহলে! এ কথায় অট্টহাসির দমকা ওঠে। হাসির বাঁধ ভাঙেন পারভেজ। জামাল আর আমার তুলনায় তাঁর লজ্জাবোধ বেশি তাজা বলে, এই আদিরস তিনিই উপভোগ করছেন বেশ বেশি।
দর্জি একতরফা কথা শোনার পাত্র নন। তিনিও তুখোড় কথাবাজ। হো হো করে হেসে উঠলেন। কথাচ্ছলে তথ্য দিলেন। একটু গর্বভরে বললেন, আমাদের দেশে কুকুর, কুক্কুরীর ওপর চড়াও হলেও, পুরুষেরা নারীর ওপর হয় না। সম্মান করে। কোনও ক্রসকোয়াটার্স এখানে নেই। ক্যাসিনো, ডান্সবার এমনকী মেসেজপার্লারও নেই। অবশ্য সীমান্ত অঞ্চলে ভারতী ও নেপালি রূপোজীবিনীরা আছেন গোপন ডেরায়।
দর্জিই জানালেন, পৃথিবীর একমাত্র ধর্মরাষ্ট্র ভুটান, যেখানে সকল আইনকে ঈশ্বরের আইন বলে ধরে নেওয়া হয়।
ফুর্তিভরা আড্ডা তুঙ্গে উঠে গেছে। অবিশ্রান্ত রসালাপ উচ্চগ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে হাস্যালাপে। এরপর প্রচণ্ড ঝড়ের পর যেমন প্রকৃতি নিস্তব্ধ হয়, তেমনই হাসিঠাট্টা অনেকটা স্তিমিত হয়। আর তখনই জামাল তাঁর আসল কথাটি বললেন : বিদেশ ভ্রমণে এলে ভালো লাগে এই নির্বিঘœ আনন্দ। আপদবিশেষ এই মুঠোফোন বারবার কানে তুলতে হয় না। বাড়তি যন্ত্রণা নেই। রুটিনমাফিক একঘেয়ে চলাচল নেই। ভালো লাগে এই ভারমুক্ত স¦াধীন জীবন।
রসালাপ পুরোপুরি থামল দোচলা আসার পর। সকালের মেঘান্ধকার নেই, সেই কালো মেঘ আর ঘন কুয়াশা এখন অন্য রূপ ধারণ করেছে। হলদে বিকেল, রক্তিম আকাশ। নিচে সোনালি মেঘের ওপর আলোর বিচ্ছুরণ ভারি স্নিগ্ধকর। আমি চটপট নেমে পড়লাম। দর্জি সেইমতো ছবি তোলেন আমার। তারপর আর একটু বেড়িয়ে গাড়িতে উঠলাম। উঠে দেখলাম আমার সঙ্গীদ্বয় ঝিমোচ্ছেন এবং তাঁদের ঘুমে মজ্জমান রেখে থিম্পু পৌঁছলাম বিকেলে বিকেলে।
পুনাখা, ১৩ এপ্রিল ২০১৯

পথিক ও স্বাগতকারিণী

পারভেজ-জামালের ব্যস্ততা দোকানে কেনাকাটা নিয়ে। আমার এ নিয়ে ব্যস্ততা নেই। তাঁদের দেখার দূরত্বে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তাঘাটের দৃৃশ্য আর মানুষ দেখছি। মানুষ দেখবার মধ্যে মানবিক তৃপ্তি লাভ হয়। শুনেছি ভুটানে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীই বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে আছেন নেপালি, যাঁরা হিন্দু। কিন্তু সকলেরই জীবন বাঁধা ভুটানি ঐতিহ্যে আর বৌদ্ধধর্মে। ভুটানে বৌদ্ধধর্ম এসেছে তিব্বত হয়ে। ‘বজ্রায়ন বৌদ্ধধর্ম’ নামের এক বিশেষ ধর্মীয় মতবাদের অনুসারী তাঁরা। ফলে তন্ত্রমন্ত্রে ঝোঁক আছে।
অদূরে সাধকপ্রবণ একপ্রৌঢ় বয়েসি লোককে দেখে আমি সালামের ভঙ্গিতে হাত উঠালাম। তিনিও শান্তস্নিগ্ধ দৃষ্টিপাত করে আশীর্বাদের মুদ্রা নিয়ে হাত উঠালেন আগন্তুকের দিকে। হাতে তসবি, মাথায় টুপি পরা পথিক প্রৌঢ়টি মন্থর গতিতে আমার কাছে এসে হাত ধরলেন। আমিও নরম করে তাঁর হাত ধরলাম। চোখ তুলে আমরা পরস্পর তাকাচ্ছি, মুখে কোনও কথা নেই। তবু যেন কত কথা বলছি, বুঝতে পারছি একে অন্যকে। মানুষে মানুষে আত্মীয়তা বোধ মানুষেরই একটা অর্জন। মানুষ যে মানুষের কত পরিচিত ও একাত্ম-এ-সত্যই প্রমাণ হয় বারবার। বারংবার। জইফ লোকটার হাতের উষ্ণতার আমেজ মনে গেঁথে থাকে।
এই প্রৌঢ়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কথা হল ত্রিন দর্জির স্ত্রীর সঙ্গে। প্রথম দিনই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়। আজ অবশ্য তাঁদের মেয়ের সঙ্গে মামুলি আলাপ-পরিচয়। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। বড়ো মিষ্টি মেয়ে। আমাদের দেখে শিষ্টভাবে দাঁড়িয়ে হাসল। মা-মেয়ের হাসিটি সুন্দর, যেন কতকালের আত্মীয়-হৃদয়। অসম্ভব শাদা দাঁতে হাসি ছড়িয়ে শ্রীময়ী দর্জি এটা-ওটা কিনতে বলেন তাঁদের দোকান (ঝবৎফযড়শ ঐধহফরপৎধভঃং) থেকে। সৌজন্যবশত জামাল-পারভেজ কিনেন মেয়েদের ব্যাগ। পথভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে দর্জি তাঁর মেয়ের পাশে দোকানের এক কোণে সটান শুয়ে পড়েন। আর আজকালকার কেতা অনুযায়ী মোবাইল নিয়ে গেইম খেলে তাঁদের শান্তশ্রী মেয়েটি। আমরা এখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
থিম্পু ছোটো হলেও ট্যুরিস্টদের খুব প্রিয়। হেরিটেজ জোন। বলা হয়-‘ল্যান্ড অফ দ্য পিসফুল থান্ডার ড্রাগনস’-ভুটান বেড়ানোর স¦র্গরাজ্য। এর মোহময় প্রকৃতি এবং শান্তিময় ভ্রমণ উপেক্ষা করা যায় না। গতকাল এক লহমায় পথঘাট চিনে নিয়েছি। তাই শহর দর্শনে আমরা হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে বেশ ভালো লাগছে, সুরভিত সবুজ দেখে চোখে আরাম লাগছে।
হস্তশিল্প ও স্যুভেনিয়র কিনতে আমরা খানিক উঁকি দিলাম একটা দোকানে। দেখলাম গায়ে হলুদ আগুন মেখে ভুটানি কর্মিণী উলের জামাকাপড় বুনছেন। কী মিষ্টি চেহারা! ঐশ্বর্যের ছাপ মুখচোখে। এয়ার হস্টেজ দেখবার পর একটা আগুরি ধারণা হয়েছিল ভুটানভূমের মেয়েরা অপরূপ। এবার ধারণা নয়, প্রকৃতই প্রত্যয় হয়। আমাদের নেত্রপাত দেখে অপরূপ সারল্যে দোকানে আহ্বান করেন নম্রকণ্ঠে। সত্যিই নরম স¦ভাব এদের। দেখে মনে হয় খেদ-ক্ষোভ নেই। সামনে গিয়ে আমরা সম্ভাষণের জবাব দিলাম। বললাম : একটা ছবি তুলতে পারি? অবশ্যই অবশ্যই-উদ্ভাসিত মুখ স¦াগতকারিণীর। জবাবে একটু চঞ্চলা মনে হল তাঁকে। এ-সুযোগে জামাল আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলেন। বালিকাকে প্রথমে ভিজিটিং কার্ড দিলেন, তারপর পাশের চেয়ারে বসেন, তার পর ত্যানা প্যাঁচানো কথা শুরু করে ফেসবুক আইডি জানতে চান এবং তাঁকে ঘনিষ্ঠ করে একখানা সেল্ফি তোলেন। আমি আর পারভেজ তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করলাম। অবশ্য দোকান ত্যাগ করে।
সুটকেস কেনা দরকার মনে হলে, আমি দোকানে দোকানে হানা দিলাম। কিন্তু প্রাইস ট্যাগে চোখ পড়তেই আর এগোতে পারলাম না। তিন হাজার রুপির কম নেই।
এক ঘণ্টাটাক পরে গাড়িবান দর্জি এলেন। আমরা তখন অনির্দেশ্য ঘোরাঘুরি করে এক জায়গায় দাঁড়ানো ছিলাম। বললেন, গাড়িতে ওঠেন। আরও একটু বেড়াবার ইচ্ছেছিল, কিন্তু সময় নেই। কেন্ডেল নাইটে যোগ দিতে হবে।
থিম্পু, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯

কেন্ডেল নাইট

আজ হোটেলে আমাদের সম্মানে নাচ-গানের আসর চলে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় ডাকা হয় বলরুমে। বলরুম বলতে বিশাল অভ্যর্থনাকক্ষই। তিনপাশে সোফা সাজানো।
ভুটানের জাতীয় পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন একদল যুবকযুবতী। জাতীয় পোশাক সম্পর্কে আবুল মোমেন বলেছেন, ‘নিজেদের তাঁতে তৈরি মোটা চেক কাপড়ে তৈরি হয় এগুলো। পুরুষদের গো অনেকটা ঢোলাহাতা হাউজকোটের মত, তবে কোমরে বেল্ট দিয়ে একটু উঁচু করে বাঁধা হয় বলে পোশাকটা পরার পর কিছুটা স্কার্টের মত হয়ে যায়, আর কোমরের কাছে লম্বা পকেট তৈরি হয় আপনিই। পায়ে থাকে দামি জুতো আর হাঁটু অবধি মোজা। মেয়েদের জামা বলতে তিনটি কাপড় জুড়ে তৈরি মোটামুটি ৫ ফুট দ্ধ ৮ ফুট আকারের রঙিন থানের কৌশলী ব্যবহারের মাধ্যমে তৈরি করা, অনেকটা জাপানি কিমোনোর মত। তবে আমাদের চাকমাদের মত পিনন আর ব্লাউজ বা জ্যাকেটও মেয়েদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। স্কুলে-কলেজে, সরকারি অফিসে, মঠে-মন্দিরে, কোনও আনুষ্ঠানিক কাজে ছোটোবড়ো সবাইকে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরতে হয়।’
এমনকী দৈনন্দিন দাপ্তরিক কর্মক্ষেত্রেও এই পোশাক পরতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। মহামতি শাবদ্রুং গাওয়াং নামগিয়েল নিজস¦ সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে সপ্তদশ শতকে এই নির্দিষ্ট পোশাক প্রবর্তন করেন। শাবদ্রুং গাওয়াং নামগিয়েলকে ভুটানের জাতিসত্তার ভাবগুরু বলা হয়ে থাকে।
আজ তাঁরা জাতীয় পোশাক পরেছেন। মেয়েদের পোশাকে সবুজ ও লাল রঙের প্রাধান্য। এই পোশাকে কাউকে দেখিনি ভুটান আসার আগে। কিন্তু তার পরও তাঁদের কাছের মানুষ মনে হয় আমার। মনে হয় কত পরিচিত। দিনটি যেহেতু পয়লা বৈশাখ, তাই মনের ভিতরে স¦দেশ-সংস্কৃতি জেগে আছে। মনে হয় বৈশাখের সাজপোশাকে তাঁরা যেন সেজেছেন।
টুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য নারী-পুরুষে জোড়া জোড়া, পুরুষে পুরুষে, নারীতে নারীতে নাচ করছেন, আবার নাচের সঙ্গে জঙ্খা ভাষায় গানও গাইছেন তাঁরা। বাদকদলের একজন কিপ্যাড, আরেকজন গিটার বাজাচ্ছেন, পাশে দুজন ঢোল পেটাচ্ছেন, আরও কয়েকজন গলা খুলে গান গেয়ে চলেছেন। এই গানের তালেই চলেছে অপূর্ব দেহভঙ্গিমায় সমবেত নৃত্য। নাচ-গান-পোশাকের মাধ্যমে তাঁরা ফুটিয়ে তুলছেন ভুটানের কৃষ্টি-ঐতিহ্য এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে। গানে যেমন উচ্চগ্রাম নেই, পোশাকেও নগ্নতা নেই। এখানে আমার কাছে তাঁদের শান্তশ্রী মেজাজ আর অপরূপ প্রকৃতির সঙ্গে অন্য অহংকার ধরা পড়েএই পোশাক।
একজন বাজনদার কথকেরও ভূমিকা পালন করেন। তিনি গান ও নাচের ফাঁকে ফাঁকে পৌরাণিক কাহিনি শোনান। এর ভিত্তিতেই শিল্পীরা পোশাক পালটে নৃত্য ও গান শোনান। ছেলেরা তিরধনুক হাতে নিয়ে যুদ্ধনৃত্য পরিবেশন করেন। সমবেত হাততালি দিয়ে আমরাও তাঁদের অভিনন্দিত করলাম। পরে হাজিরান সবাইকে তাঁরা নাচতে আহ্বান করেন।
নাচ এবং বাজনা খুবই ছোঁয়াচে। আমরা দাঁড়িয়ে হাতে হাত ধরে নৃত্যের মুদ্রায় ঘুরতে থাকলাম চক্রাকারে। পায়ে তাল ঠুকছি, হাত উপর দিকে উঠছে, গলায় গান এসে যাচ্ছে। আনন্দে আমরা গান ধরলাম, বাংলা গান। বিভিন্ন গানের এক লাইন, দুলাইন। মনে হল বাংলার কোনও উঠোনে ধামাইল গাইছি আমরা।
লাগোয়া কক্ষে জ্বলছে নানান রঙের মোমবাতি। আমাদের সম্মানে সোনালি আলো জ্বলছে। সাজানো হয়েছে রাতের খাবার। খানাপিনার দিলদার বন্দোবস্ত দেখে আমরা বিস্মিত হলাম। আরও বিস্মিত হলাম হোটেল মালিক দম্পতিকে দেখে। তাঁরাই খাবারের শেষে মিষ্টান্ন পরিবেশন করলেন। সারাদিন ভ্রমণের পর, সান্ধ্য বিনোদন শেষে রাতের আহার বেশ ভালো লাগল। মনে থাকবে থিম্পুর কেন্ডেল নাইট।
থিম্পু, ১৩ এপ্রিল, ২০১৯

পথনামা, পারো ও টাইগার নেস্ট

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। জানালা খুলেই দেখলাম মেঘ ঘাড়ে নিয়ে পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকশ গজ দূরে পাহাড় আর হাতছোঁয়া মেঘদল দেখে চমকে গেলাম! খতিবুর রহমান জামাল, পারভেজ দুজনই উঠে পড়েছেন। নাস্তা সারতে না সারতে ঘড়িধরা ঠিক সাড়ে আটটায় ড্রাইভার এসে হাজির। আমরাও ছুট-ছুট-ছুট। আজ থিম্পু থেকে পারো যাবপারোভ্রমণের স¦াদ নেব। সেখানেই রাত্রিবাস।
দর্জির গাড়িটা আস্তে আস্তে ছুটল। হল্লা জুড়ে ছুটল পথের দুপাশ দিয়ে ব্যায়ামপ্রিয় যুবক ও বয়েসি নরনারী জগ্ করতে করতে। পথেই পড়ল বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিস, ইন্ডিয়া হাউস, তাশিছো জংমানে জ্যোতির্ময় দুর্গ, ভুটানের শাসন পরিচালনা কেন্দ্র। এক সময়ে এটি গড়ে তোলা হয়েছিল স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অনন্য নিদর্শন হিশেবে। এখন ব্যবহারের প্রয়োজন না-থাকায় গড়ে তোলা হয়েছে রাজ্যের প্রধান প্রশাসনিক কার্যালয়। এখানেই বসে সুং ডুবা বিধানসভা অধিবেশন।
এই জঙের পাশেই দেখা গেল সবুজ গাছের সারিসমৃদ্ধ একটি অঢেল নির্জন গেইটঅলা বাড়ি। গেইটে প্রহরী আছে কি নেই বোঝা গেল না। এটি রাজবাড়ি! বড়োই শান্তশ্রী। আমরা গাড়ি থেকে বাড়িটি দেখে নিলাম উৎসুক্যনয়নে।
দেখছি থেকেই আজ ত্রিন দর্জির মনমরা ভাব। তাঁর মুখে হাসি নেই। চোখে নেই খুশিখুশি ভাব। কেন? জামাল জানতে চান, শরীর ঠিক আছে কি না। জানালেন শরীর ভালোই আছে। ডিভোর্স দেওয়া স্ত্রী এবং সন্তানদের নিয়ে চিন্তিত কি না। জামালের ফের প্রশ্ন। জানালেন, তাও নয়। আমাদের প্রতি তাঁর প্রীতি জন্মানোর ফল কিনা এই মনভার করা। একান্তও হতে পারে। অবশ্য একান্ত দুঃখবোধ কেউ হাটে এসে ঘোষণা করতে চায় না। কত কত বেদনার ভার মানুষ একাই বহন করে।
এবার উত্তরে সন্তুষ্ট না-হয়ে আদিরসাত্মক গল্প শুরু করে দেন জামালভাই। এ-সবই প্রাইভেট জোকস পর্যায়ের। আমরা শুনে হো হো করে হাসলাম। তিনিও হাসেন। সবার আনন্দে একটা উত্তেজিত সুখ।
ভুটানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। পথে পড়ল পাহাড়। রাস্তার দুপাশে পাহাড়। একপাশে একটা অজানা সরু নদী। বেশ খরবেগে। নদী আর রাস্তাকে দুটি পাশাপাশি চলা শাদাকালো নাচুনে সর্পিকা লাগছে। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে খানিকটা চলেছে। নদীর উপর সেতু। চারপাশে শাদাকালো মেঘ। এই পরিবেশ দেখবার সুযোগ খুব কম আসে। এখানে দেখতে পেলাম কয়েকজন পর্যটককে। আমরাও চটজলদি গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। ছবি তুললাম। একটু সময় কাটিয়ে আবারও পথ চলা। কিছু পরেই দেখলাম আপেলবাগান। গাড়ি চলল দুধারে বাগান রেখে।
লোকালয় দেখে জামাল দর্জিকে প্রস্তাব করেন কোনও ধরনের পানীয় গিলবেন কি না। এখানে দোকানে দোকানে অ্যালকোহল পাওয়া যায়। এদের নিজস¦ প্রডাক্ট। দর্জি রাজি হলেন না। বললেন, চা খাওয়া যায়। পারোর একটি ঘরোয়া রেস্তোরাঁয় খাওয়া হল। কর্তা-গিন্নি মিলেমিশে পরিবেশন করেন। চুমুকে চুমুকে চাঙা হয়ে উঠলাম। চায়ে ভালোবাসা তাঁরা পুরে দিয়েছেন মনে হল!

গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছিল থিম্পু থেকে। অবশ্য মুষলধারায় বর্ষে না। এখানে আসা ইস্তক দেখছি স^র্ণরেণু ছিটিয়ে রোদ উঠেছে। খোশমেজাজেই চা পান করে আমরা রওনা হলাম, খুব কাছেই হোটেল।
যে-হোটেলে আমাদের ঠাঁই হল তার নাম ঞধশঃংধহম চধৎধফরংব। পারো বিমানবন্দর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। জায়গাটা পাহাড়ের সংবর্ধনা। তিনদিকে পাহাড়ে সবুজে আর ফুলের বাগানে ঘেরা অপূর্ব নিরালা। আশেপাশে মনোরম হোমস্টেপল্লিশ্রীমণ্ডিত এক-টুকরো জঙ্গুলে পরিবেশ।
দোতলাবিশিষ্ট হোটেলের উপরে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা। ছোট্টমুট্ট রুম, কিন্তু খুব ছিমছাম। নিচে অভ্যর্থনাকক্ষ। এর পেছনে হোটেল-কর্মীদের থাকার জায়গা এবং কিচেন রেঞ্জ। বাম পাশে বিশাল হলঘরের মত ডাইনিংরুম। দুপুরের খাবার এখানেই খেলাম। তবে হুজ্জত হল, খাবার তৈরি ছিল না। ত্রিন দর্জি পারোর অন্য একটি হোটেলে আমাদের লাঞ্চ করানোর কথাছিল। থিম্পুর ওই হোটেল থেকে এখানকার হোটেলের নাম ও কাগজ আনতে ভুলে গেছেন। এ বাবতে তিনি লজ্জিত হলেন। কী আর করা? আমাদের কাফফারা বাবদ বাড়তি টাকা গুনতে হল।
দর্জিকে বললাম, কী খাবেন? একগাল হেসে বললেন, রুটি আর সবজি। অর্ডার মত রুটি, ভাত, শাকসবজি আর ডাল দিয়ে প্রাক দুপুরে মধ্যাহ্নভোজন সেরে বেরিয়ে পড়লাম পারো দর্শনে আমরা।
পারোতে দ্রষ্টব্য কী কী আছে, আভাস দিলেন দর্জি। প্রথমে নিয়ে গেলেন টাইগার নেস্ট দেখাতে। টাইগার নেস্ট দেখতে পুরো একটা দিন লাগবে। অত্যন্ত দুর্গম স্থান। অষ্টম শতাব্দে তিন বছর, তিন মাস, তিন দিন, তিন ঘণ্টায় তৈরি হয়েছে এই বিশেষ স্থাপনা। স্থাপনার ভিতরে মন্দির। এই মন্দির দর্শনে দৃঢ় মনোবল আর অপরিসীম ধৈর্য থাকতে হবে।
একটা অরণ্যের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলছিল। পাহাড়ের উপরে একটা সমতল স্থানে গাড়ি থামল। চারপাশে বিশাল বিশাল খাড়া খাড়া বৃক্ষ। শ্যামলিমা পরিবেশ। গাড়ি ছেড়ে পদব্রজে এবার ভ্রমণ। গাছের নরম ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে দেখলাম একটা গেইট। ভিতরে দুসারি দোকান। এখানেও ভুটিয়া মেয়েরা। মজুরনিদল পসরা সাজিয়ে বসে আছেন। মজুরনি বললাম, চেহারা এবং পোশাক-আশাকের হাল দেখে। মালিক হয়ত তাঁরা নন, কিংবা আমার ভুলও হতে পারে। যাক, পসরা অবশ্য সেই স্মারক দ্রব্যাদিদেশজ শিল্পের কারুকর্ম। এখানে বাড়তি একটা জিনিশ পাওয়া যায়লাঠি। পাহাড়ে ওঠার জন্য খুব দরকারি। এটি ভাড়াও পাওয়া যায়। আমরা ওখানে খানিক দাঁড়িয়ে আরেকটু এগিয়ে দেখতে পেলাম লাঠিগুচ্ছ নিয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষমাণ কয়েকজন। ঘোড়াগুচ্ছ নিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন।
সমতল থেকে পাক্কা পাঁচ কিলোমিটার দূরে উপরে টাইগার নেস্ট। হেঁটে উঠতে হয় দশ হাজার ফুটের উপরে। এজন্য কেউ কেউ ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে, কেউ কেউ লাঠি ভর দিয়ে পিক পয়েন্টে উঠতে চান। দেখলাম কেউ কেউ উপরে উঠছেন, কেউ কেউ নিচে নামছেন। বেশির ভাগই সাহেবগোছের। পর্যটনের সবকিছুই সাহেব-নির্ভর। পুখানা এবং দোচলায়ও দেখেছি ইউরোপিয়ান পর্যটক। এখানেও তাঁরা।
ভুটানি নারীপুরুষেরা আমাদের ঘিরে ধরেন। দ্রষ্টব্য স্থানে নিয়ে যেতে চান। আমি টাইগার নেস্ট দেখবার জন্য ব্যগ্র। কথা বললাম এক ঘোড়াওয়ালির সঙ্গে। তাঁকে আটশত ‘নু’ দিতে হবে। জামাল বললেন, একা যাবেন কী করে? আমরা যাব না, সময় নেই। তাঁর কথা শুনে মন তেতো হয়ে যায়, এর পরিবেশ ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব আমার কাছে যে অপরিসীম, তা কীভাবে বোঝাই? আমি রুষ্ট হয়ে তাকালাম। আমার মনের গঠন ও কাঠিন্য তাঁর জানা আছে। আছে তাঁর সমঝে চলার রসবোধ। তাই তিনি সঙ্গে সঙ্গে ওই মেয়েকে ইঙ্গিত করে আমার উদ্দেশে হাসি দিয়ে বললেন, ঘোড়া চড়তে গিয়ে যদি মানুষ চড়ে বসেন?
পারভেজও চুপ থাকতে পারেন না। তরল রসিকতা করে বলে বসেন : মেয়েটা সুন্দরী। ইচ্ছে হলে বলুন, সুযোগ দেওয়া যাবে।
এই ফুর্তিবাজদের কথায় আমার বিষাদ এবার হাসিতে গড়াল। রসালাপ করতে করতে আমরা এর প্রায় পাদদেশে ঘোরাঘুরি করলাম কিছুক্ষণ। দেখলাম বহু দর্শনার্থী। অনেক উপরে এবং দূরে টাইগার নেস্ট ছোটো দেখা যাচ্ছিল। পরে যখন হাতে সময় নিয়ে আসব, তখন উপরে উঠে দেখবএমন আশা নিয়ে নেমে এলাম।
এরপর তাথচাং অরণ্য দর্শন। পাথুরে পাহাড়ে রুখু পথে গাড়ি ছুটে চলল। অরণ্য আবৃত পরিবেশ। চারপাশে তেজালো সবুজ। দূরে পাহাড়ের গায়ে সবুজ রোদ্দুর। দেখে যেন ইন্দ্রিয় সবুজ হয়ে যায়। দেখা গেল পাহাড়ের বিপজ্জনক উচ্চতায় সমাধি, ধর্মীয় আস্তানা, মানুষের বিরল বসতি। এই ঘন সবুজ অরণ্য নিয়ে নিশ্চয় কোনও রূপকথা আছে। এই সমাধি-মন্দির-মঠ নিয়ে আছে কথকতা। কিন্তু কিছুই হয়নি জানা। এই অধ্যায়টি ক্ষত হিশেবে রয়েই গেল। শুধু এইসব টুকরো টুকরো দৃশ্য এবং অন্যান্য স্থান চাক্ষুষ করতে করতেই অনেকটা সময় চলে গেছে। পারো শহরটা দেখাই এবার জারি থাক।
পারো, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

ভোরের ফুলের মত পারোর বিকেল

ছোটাছুটি সাঙ্গ করে বের হলাম শহর-অভিযানে এবং শেষবেলাকার কেনাকাটা করতে। শহরের স¦রূপ বুঝতে হলে ঘুরতে হয় দোকানবাজারে, রাস্তাঘাটে।
ভোরের ফুলের মত পারোর বিকেল। একটু আগে ছিপছিপ করে বৃষ্টি নেমেছিল। এখন থেমেছে। বৃষ্টি ধোওয়া রোদ্দুরে চিকচিক চারপাশ। পাহাড়ের খাঁজে মেঘ নেই। বিস্তৃত সবুজ, পাহাড় সারির মাঝে রোদে ঝলমল, ছোটো দোকান, বিপণি, অফিস, স্থাপনা, মাঠ। পড়ন্ত বিকেলে রোদ্দুর কমতে থাকলে সোনালি হয়ে ওঠে এই আপেক্ষিক ল্যান্ডস্কেপ।
বলাই বাহুল্য, খুবই সাজানো-গোছানো এই পারো, সাজসরঞ্জামে নিজস¦ ঐতিহ্যের ছাপ, থিম্পুর তুলনায় প্রাণছোঁয়া মনে হল। দমচাপা নীরবতা নেই; আছে দৃপ্ত ব্যস্ততা, উষ্ণতা, প্রাণের কলরব। দেখলাম মুক্তভাবে তরুণতরুণীরা পরনে জিনস আর টি-শার্ট পরে বাজার করতে। যা থিম্পুতে দেখিনি। এদের মনে ও শরীরে পশ্চিমের রং ধরেছে দেখে অদ্ভুত রোমাঞ্চ বোধ হল।
তুলনামূলকভাবে থিম্পুর চেয়ে এখানে জিনিশপত্রের দাম সস্তা পেয়ে তিনজনই এটা-ওটা ক্রয় করলাম। বিশেষ করে শিশুদের জন্য চকোলেট। জ্যাম-জেলি। এদেশের এই জ্যাম-জেলির সমাদর নাকি বিশ্বজুড়ে। জামালের টাকা ফুরিয়ে গেলে বুথ খুঁজতে থাকেন আমাকে আর দর্জিকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু বুথে কাজ হয়নি বলে ডলার ভাঙাতে হল। দর্জি নিয়ে গেলেন একটি কফি পার্লারে। ভিতরে খদ্দের নেই। আমরা কফি খেলাম এবং দোকানি বালিকার কাছ থেকে জামাল ‘নু’ গুনে নিলেন। এখানে দর্জির নীরবতা দেখে একটা সন্দেহ দূর হয়। তিনি যখন থিম্পুতে ডলার ভাঙাতে নিয়ে যান, তখন ওই দোকানির সঙ্গে ভুটানি ভাষায় কথা বলেছিলেন। আমরা তাঁর পরসেন্টিজ নিয়ে সন্দেহপোষণ করেছিলাম। কারণ ভাষা বুঝি না। ভুটানি-মুদ্রার বিনিময় হার সম্বন্ধেও আমরা অজ্ঞাত। পারোতে দেখলাম ডলার একই মূল্যের। জামালের কাছে নুর চেয়ে সুদর্শনার রুজ-লিপিস্টিক মাখা হাসি মূল্যমানের মনে হল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষ্য হয়ত তাঁর মনে পড়েছে : ‘তাদের দিকে তাকালে তারা চোখ সরায় না, হঠাৎ-হঠাৎ হেসে ওঠে। টিয়াপাখির ঠোঁটের রঙের সঙ্গে তাদের ঠোঁটের মিল আছে।’ আমিও বিষয়টি লক্ষ করেছি। খতিবুর রহমান জামাল মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতার প্রচেষ্টা চালান।
এর আগ থেকে মোবাইল চার্জ করবার ছুতো ধরে তিনি উনিশ-কুড়ির ভুটানি মেয়েটির সঙ্গে স¦রগ্রামে রোমান্স ফুটিয়ে আলাপ শুরু করে দেন। মেয়েটিও সাধ্যমতো মেজাজে কথা বলেন। এদের একটি সুরেলা টান আছে। শুনতে মধুর শোনায়। শুধু বন্ধু জামালের নয়, আমারও ভালো লাগে। আমার বিশেষভাবে ভালো লাগে চিত্রকর্ম। কফি পার্লারকে চিত্রকর্ম দিয়ে শোভামান করা হয়েছে। এই ছবিগুলোতে ভুটানি মানসিকতার পরিচয় বহন করছে। ছবিগুলো দেখে আমার বিস্ময় জাগল।
মুদি, মনোহরি থেকে স্টেশনারি দোকানে ঘুরতে গিয়ে পারভেজ নিপাত্তা হয়েছে। পাঁচটার পরে আর এই স্থানে গাড়ি-পার্কিং করা যাবে না। নতুন জায়গা খুঁজতে ত্রিন দর্জি সঙ্গ ত্যাগ করেন। এবং গাড়ি-পার্কিং করে তিনি আমাদের খুঁজতে বের হন। আমরা খুঁজতে বের হলাম পারভেজকে।
শেষাশেষি সন্ধেবেলা বুকভরতি বায়ুসেবন করতে করতে আমরা বাঘের ডেরায় ফিরলাম!
পারো, ১৪ এপ্রিল ২০১৯

বাঘের ডেরা, জঙ্গলগ্রাম

হোটেলে জিনিশপত্র রেখে আমরা সামনে বেরিয়ে এলাম। ভালো করে দেখলাম আশপাশ। পেছনে সবজি বাগান। বাম পাশে একটা হোমস্টে। এর পেছনে পাহাড়। ডান পাশে একটু সামনে আরও একটা হোমস্টে। দুয়ের মাঝেই মনোরম বনালয়ে এই ঞধশঃংধহম চধৎধফরংব। তিনদিকে পাহাড়ে সবুজে এমনি জঙ্গুলে ঘেরা স্বপ্নময় নিরালাবাসিক; এর মধ্যে ঘরোয়া রাস্তাটি বিভিন্ন গাছ লাগিয়ে অরণ্যায়নের চেষ্টা! আর এর মধ্য দিয়ে সহজেই ধরা পড়ে আঞ্চলিক রূপ ও রোমাঞ্চ।
আমার বিলেতপ্রবাসী বন্ধু ফেরদৌস টিপু টাক্টসাং প্যারাডাইসের বাংলায়ন করেছে : বাঘের ডেরা। বাংলা ‘তখ্ত’ শব্দের অর্থের সঙ্গে স্পষ্টতই মিল আছে। কিন্তু এ তল্লাটে এককালে বাঘ থাকা অসম্ভব নয়।
প্রশস্ত আঙিনা। একপাশে অতিথি সেবার চালা। আঙিনা বা চালা থেকে দেখা গেল অনতিদূরে পাহাড়ের মাথা থেকে ঝরনার আছড়ে পড়া জল। কান পাতলে হয়ত শোনা যাবে জললোর না, নিশ্চয়ই আনন্দবোল। রাতে চাঁদ উঠলে না-জানি কত মোহনীয় দেখাবে! ট্যুরিস্টদের জন্য এ জায়গাটা অতিথিশালাই মনে হবে।
এখানে যথেষ্ট ঠান্ডা। হাড়ের ভিতরে শীতের আঙুল। আশপাশ চক্কর দিয়ে অতিথিশালার পাশে আরেকটি সুপারস্টোর থেকে জুসজাতীয় পানীয় ক্রয় করে ফিরে এলাম এই বনাশ্রমে।
একটি নাতিক্ষুদ্র আড্ডা জমিয়ে দিলাম হোটেল-কর্তার সঙ্গে। গল্প করলেন আন্তর মন নিয়ে তরুণ মালিক। এই গল্পের ফাঁকেই আমাদের শীতকাতরতার কথা জানালাম। শুনে হিটারের বন্দোবস্ত করে দিলেন তিনি। বললেন, ডিনার রেডি। ব্রেকফাস্ট হোটেল ত্যাগের আগে ভোররাতে আপনাদের সঙ্গে দেওয়া হবে। শুনে আমরা আনন্দ প্রকাশ করলাম সকৃতজ্ঞ মনে।
এখানকার ডিনারটি ছিল খুবই উপভোগ্য। ডাল, সবজি, মাছ, সসেজ, পুদিনার তাজা গন্ধসমেত খাবার ছিল সুস¦াদু। আমরা প্রত্যেকে খাবারের প্রশংসায় ছিলাম পঞ্চমুখ। মেয়েকর্মীরাও পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন চোখেমুখে একটা লালিত্য মেখে। বাঙালি বউ-ঝিরা যেরকম থাকেন। কত না খাতির করেছেন আপ্যায়িকাগণ।
বিমানবন্দরে খাওয়ার জন্য আমরা কিছুই কিনিনি। হোটেল থেকেই নাস্তা দেওয়া হবে আমাদের সঙ্গে। এই ভরসায় ব্যাগপত্র গোছগাছ সাঙ্গ করে আমরা দুগ্ধশুভ্র বিছানায় ঘুমোতে গেলাম পরম হরষে।
পারো, ১৪ এপ্রিল, ২০১৯

ফেরা, বিরহের শুরু

ঘুম কী, সারারাত আমাদের গোছগাছ চলল। এটা-ওটা নানা জিনিশ কেনা হয়েছে। রাত ধরে এসব গোছগাছে আর কথায় কথায় কাটিয়ে কাউকে না পেয়ে, হোটেলের কারও কাছ থেকে বিদায় না-নিয়েই পারো বিমানবন্দরে আমাদের যেতে হল ভোর পাঁচটায়। ঘুম থেকে উঠে দর্জিও সময়মতো তৈরি হন।
পরিতৃপ্তকর রাতের আহার শেষে ধারণা ছিল বিদায়ী মেহমান হিশেবে রসনাসমৃদ্ধ কিছু সঙ্গে দেবে, কথা তা-ই ছিল। কিন্তু ধারণাপযোগী খাদ্যবস্তু দেওয়া দূরে থাক, আমাদের ভাগ্যে লবডঙ্কা। সকলেই দায়িত্ব-উদাসী হয়ে কুম্ভকর্ণের মত বেঘোর নিদ্রায়। হোটেলকর্তা ও তাঁর নারী কর্মসহচরীদের এই অভুটানোচিত ব্যবহারে আমরা নিরাশ হলাম। সঙ্গে খাবারদাবার নেই বলে, আমাদের মন আনচান করল।
পারোর রাস্তায় ফুটি ফুটি ভোর। আলো-অন্ধকারে মেশা রহস্যসুন্দর পরিবেশ দেখে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তি মনে এল : আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মত এই অন্ধকার।
আঁধারের একটা নিজস্ব আলো আছে, সুগন্ধও আছে। সুগন্ধ বাতাস চিরে নিঝুম রাস্তায় গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের দিকে। মাত্র পাঁচ কিলোমিটারের পথ। জনশূন্য। মাঝেমধ্যে লম্বা লম্বা গাছ অতন্দ্র প্রহরীর মত দেখা গেল। এই দেখতে দেখতে দ্রুত শেষ হয়ে এল পথ। গাড়ি বিমানবন্দরে প্রবেশ করল। গাড়ি থেকে আমাদের ব্যাগপত্তর নামিয়ে দিয়ে ত্রিন দর্জি সকলের হাতে হাত মিলিয়ে, বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় দিলেনবিরহের শুরু করে দিয়ে। তার আগে ‘আবার আসতে হবে’ বলে কথা আদায় করেন। নির্ভাবনায়, নিরুদ্বেগে বেড়ানোর জন্য আমরাও তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম।
জগতের সব প্রাণী আহারকেন্দ্রিক। প্রাতরাশ করিনি বা সঙ্গে খাবার নেই, বিমানবন্দরে প্রবেশ করে এ-কথাই মনে পড়ল। এবং অসভ্যের মত বেশ খিদে অনুভব হল। নিমেষ না গত হতে ইমিগ্রেশনের সব ঝামেলা মিটিয়ে পাশের ফুডস্টলে ঢু মারলাম। পকেটে তখনও আটশত ‘নু’ আছে। রুপিও আছে হাজারখানেক। পছন্দসই খাবার কিছু খাবো। সঙ্গীদের জন্যও নিয়ে আসবো। ঘুরে দেখি রকমারি ভাজাভুজি আছে বটে, কিন্তু আমার মুখে রুচবে না। সক্রেটিস বোধহয় এমনাবস্থায় বিসি¥ত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এত অসংখ্য ধরনের জিনিশ আছে এই পৃথিবীতে! অথচ এর একটিরও আমার দরকার নেই।’ কী আর করি। খাঁটি মধু পেয়ে কিনলামমধুরসে প্রাণবশ হবে কিনা জানি না। দাম রাখল পাঁচশত ‘নু’। পকেটের সব ‘নু’ দিয়ে রুপি ফেরত দিতে বললাম। কিন্তু দোকানি দেননি। ভারতীয় মুদ্রার প্রতি তাঁদের এই দুর্বলতার কথা ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন। ‘নু’-ই ফিরিয়ে দিলেন। এই ‘নু’ পরবর্তী আমাকে ভুটানে ফিরিয়ে নিয়ে যায়!
ডিপার্চার গেটের পাশেই আসন। সঙ্গীদের পাশে বসতে গিয়ে পেলাম বঙ্গপর্যটকদের। এঁদের জনাকয়েক পুরোনো আলাপী। আমরা থিম্পুতে একই হোটেলে ছিলাম। পারোতে বিচ্ছিন্ন, আবার একই খাঁচার পাখি। উড়ালের অপেক্ষায়।
তাঁরা ব্রেকফাস্ট করছেন। তাঁদের সঙ্গে হোটেলকর্মীরা ঠিকই প্রাতরাশ দিয়েছেন। এই ভদ্রস্থ ব্যবস্থা দেখে ভালো লাগল।
উড়ার সময় পাকাপাকি হয়ে গেছে, কিন্তু সাত মিনিট দেরিতে পারোপাট চুকিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে বায়ুপাখি ডানাখানি আকাশে মেলবে সাতটা সাত মিনিটে। কানুনমাফিক কোমরবন্ধ এঁটে বিমানের আসনে বসে আছি, এবারও জানালার পাশে। এখনই বিমানে ফেরার হুকুম জারি হবে। বিমান ছাড়ল যথাসময়ে। রবিকরোজ্জ্বল আকাশে বিমান উড়ছে। উড়ার একটু পরেই দুই ভুটানি বিমানসেবিকা এলেন একটা ট্রলি ঠেলে। হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা প্যাকেট। প্যাকেটের ভিতরে একটা জুস, স্যান্ডউইচ আর পি নাটস। কোমরবন্ধ খুলে হাত-পা ছাড়িয়ে বিমনাসনেই শরীর এলিয়ে দিলাম। প্ল্যান তখন অগাধ আকাশে। পেছনে ভুটান। সামনে বাংলাদেশ। শ্যামলিমা মাভূমিতে ফেরার আনন্দে এই খাবারটুকুন খেতে খেতে আমি ওই হোটেলকর্তার মুখখানা ক্ষমার আলোয় মনে করলাম। আবার হয়ত দেখা হবে অজানা ভুটানে।
ড্রুক এয়ার, ১৫ এপ্রিল, ২০১৯