প্রবন্ধঃ করোনায় পরিবর্তিত জীবনে উৎসব

প্রবন্ধঃ করোনায় পরিবর্তিত জীবনে উৎসব

করোনায় পরিবর্তিত জীবনে উৎসব
শাহীন চৌধুরী ডলি

যুগে যুগে বিভিন্ন মহামারিতে মানব সমাজ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে। করোনা মহামারীতে আতংকিত গোটা বিশ্ব। করোনা বা ২০১৯- এনসিওভি নামক ভাইরাসটির প্রথম প্রাদুর্ভাব ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান নগরীতে। ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় কারণ রোগটি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১১ আগষ্ট ২০২০ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বের ২১৩ টির বেশি দেশে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়েছে। নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা ২,০০,১১,১৮৬ জন এবং মারা গেছেন ৭,৩৪,৭৫৫ জন। সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ২,৬৩,৫০৩ জন এবং মোট মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৪৭১ জন। করোনাকালের শেষ হচ্ছেই না। দুঃসময় যেন অক্টোপাসের মতন আঁকড়ে ধরেছে ।

করোনার মাঝেই জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। বাঙালি জাতির জীবনের সাথে বিভিন্ন উৎসব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এইসব উৎসবগুলো বাঙালি জীবনে আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে আসে। সবাই তখন দুঃখ ও হতাশার গ্লানি ভুলে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির বারো মাসে তেরো পার্বণের ঘনঘটা। আর এই করোনাকালীন সময়ের মধ্যেই এসেছে বাঙলির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করা বাংলা নববর্ষ। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে ধর্মীয় দুটি প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা উদযাপিত হয়েছে করোনা আতিমারীর মধ্যে। ১৭ মার্চ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী,২৬ মার্চ ছিলো দেশের স্বাধীনতা দিবস। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ২০২০-২০২১ সালকে মুজিব বর্ষ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত দেন। উৎসবগুলো যেভাবে উদযাপন করার পরিকল্পনা ছিলো তা করোনার জন্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। করোনায় জনসমাগম এড়িয়ে চলার নিমিত্তে প্রধানমন্ত্রী মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান স্থগিত করেন। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজনসহ সকল সভা সমাবেশ বাতিল করা হয়।

বাংলা ১৪২৬ সালকে বিদায় জানিয়ে বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বছর ১৪২৭। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে দেশ বর্ণিল উৎসবে মাতলেও এইবছর কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন বছরকে বরণ করতে হয়েছে। করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পহেলা বৈশাখে লোকসমাগমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। ঐতিহ্যবাহী রমনার বটমূলে হয়নি ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান। নববর্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিলো না। এমনকি গ্রামেও মেলা বা বান্নির আয়োজন অনুপস্থিত ছিলো। কেবল বেতার, সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়েছে।

লকডাউনের মধ্যে এবার ঘরে বসেই পালিত হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অত্যন্ত প্রিয় এবং অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এবারের রমজান একেবারেই অন্যভাবে কেটেছে। ইফতারের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা বসতে পারেনি। তারাবির নামায মুসল্লিরা ঘরেই আদায় করেছেন। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহার নামাযের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত দূরত্ব মেনে। ঈদের দিনগুলোতে সবাই মিলে একসঙ্গে নামায পড়া, আত্মীয় – বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, ঘুরেফিরে আনন্দ করা হয়নি। এবার ঈদুল আযহায় অনেকেই বন্যা ও করোনার কারণে কুরবানি দিতে পারেনি।গত বছরের তুলনায় এবার কুরবানি দাতা ছিলেন প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। কুরবানি না দিতে পারায় উৎসবের আমেজ ম্লান ছিলো। সাদামাটা ঈদ উদযাপনে সীমাবদ্ধ ছিলো এবারের ঈদুল আযহা। অর্থনৈতিক মন্দা আর প্রতিকূল পরিস্থিতি ভালোভাবেই কুরবানি ঈদে প্রভাব ফেলেছে। করোনার দুঃসময় অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের ঈদগুলোকে নিস্প্রভ করে তুলেছে।

একদিকে মহামারী করোনার দুর্যোগ, অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশে হানা দিয়েছিল ঘুর্ণিঝড় আম্পান। আম্পানের কারণে বাংলাদেশের ২৫টি জেলার দেড় কোটি মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমানোর লক্ষ্যে সরকার তৎপর ছিলেন। বিপুল সংখ্যক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয় তবু সরকারি হিসেবে ১৬ জন মানুষ আম্পানে মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে আম্পানে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল সাড়ে এগারোশ কোটি টাকা। একদিকে করোনায় বিপর্যস্ত জীবন, অন্যদিকে শুরু হয়েছে বন্যার তান্ডব। সরকারি হিসেবে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। করোনাভাইরাস প্রকোপের মাঝে বন্যার্তরা চরম অসহায় পরিস্থিতিতে রয়েছেন। ৩১টি জেলায় করোনা ভাইরাস এবং বন্যার মতন দুটি দুর্যোগ একসাথে মোকাবেলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

করোনায় প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। বিদেশে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে তারা দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। অনেক প্রবাসী শ্রমিককে বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অনেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। দেশেও কাজের সংস্থান নেই।
ঘুর্ণিঝড় এবং বন্যায় ফসল, মাছ ও গবাদিপশুর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। করোনায় অনেক কল-কারখানার চাকা ঘুরছে না।বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এখন বন্ধ। ভাসমান ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা চালাতে পারছেন না।সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সবমিলিয়ে করোনা আমাদের অনেক ক্ষতি করছে। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। হয়তো পূর্বের চেনা অবস্থায় পৃথিবী আর ফিরবে না। করোনা পরবর্তী জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে এখন থেকেই মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। খাদ্য সমস্যা উত্তরণে কৃষিখাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। ব্যয় সংকোচন নীতি মেনে চলতে হবে।

এত সংগ্রামের মাঝেও মানুষ বদলে যাওয়া জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। শৃংখলা মেনে ও সাবধানতার সাথে পথচলা অব্যাহত রেখে জীবনে নতুন ফুল ফুটাতে হবে।সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিচ্ছেন। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে গেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে থমকে যাওয়া জীবনের চাকা নতুন স্বাভাবিকতায় ঘুরিয়ে দিতে আমরাই পারবো।