গল্প: হোসনেয়ারা

হোসনেয়ারা
দীলতাজ রহমান
হোসনেয়ারা বেগমের এক বান্ধবী সেতারা বেগম একদিন তার চলমান গাড়ি থেকে হোসনেয়ারা বেগমকে বললেন, আমি একটা কাজে উত্তরা এসেছিলাম। এখন ফিরে যাচ্ছি। আজ দিনভর আমার আর কোনো কাজ নেই। তোমার আজ সময় থাকলে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে তোমার বাসায় আসতে পারি।
হোসনেয়ারা বেগম উদগ্রীব হয়ে বললেন, এসো ! এসো! ঠিকানাটা আমি মেসেঞ্জারে লিখে দিচ্ছি!’ বলেই ফোন রেখে দিলেন।
হোসনেয়ারা বেগমের বাড়ি দক্ষিণখানের কোথাও। রাস্তার জ্যাম ঠেলে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে সেতারা বেগম যখন পৌঁছুলেন, হোসনেয়ারা বেগম দরজা খুলতে খুলতে বলতে লাগলেন, তুমি যখন ফোন করেছো, তখন আমি অফিসে। তোমার আসার কথাশুনে আমি হাতের কাজ ফেলে ছুটি নিয়ে ছুটতে ছুটতে চলে এসেছি। তারপর ঊর্দ্ধশ্বাসে রান্না শেষ করে বসে আছি, তোমার খোঁজ নেই।
সেতারা বললেন, রাস্তায় জ্যাম প্রচণ্ড। তাই বলে এতো সময় লাগবে তা ভাবিনি! কিন্তু যতো কষ্টই হোক, এসেই তোমার বাড়ির সামনে দীঘির মতো বিরাট পুকুরটি দেখে আশ্চর্য হয়েছি!’
হোসনেয়ারা বললেন, এই জন্যই তো এতো ভেতরে এসে বাড়ি করলাম। যেনো এই নান্দনিকতাটুকু জীবন যাপনের সাথে থাকে! জীবনে নান্দনিকতা উপভোগের বাসনা ছাড়া আমরা দু’জনের কেউ প্রতিপত্তির লোভ করিনি!
সেতারা বেগম বললেন, তাই তো দেখছি!
: উত্তরা বা অন্য কোনো অভিজাত এলাকায় বাড়ি করলে তোনিজের ফ্ল্যাটখানা ছাড়া বাইরের আকাশও অন্যবাড়ির চূড়া দখল করে রাখে।
পঞ্চাশ অতিক্রান্ত হোসনেয়ারা এবং সেতারা কথা বলতে বলতে সেখানে এসে হাজির হলেন, হোসনেয়ারার স্বামী এম নূরুল আমিন।
দরজার কাছেই প্রথম দেখা হওয়া স্ত্রী’র বান্ধবীর সাথে একপ্রস্থ আলাপ শেষ হলে নূরুল আমিন সাহেব স্ত্রী’কে বললেন, এখানে দাঁড়িয়েই আলাপ শেষ করবে, নাকি যা রান্নাবান্না করেছো, মেহমানকে খেতেও দেবে!
হোসনেয়ারা সেতারার সামনে ডাইনিং টেবিলে একেক পদ এনে রাখছেন, আর বলছেন, দেখো গরুর মাংস রান্না করেছি। ইলিশ মাছ ভাজছি এবং মোরগের রোস্ট করেছি। আর এই যে বেগুনভাজি…।’
সেতারা বললেন, তার মানে আমার কত দেরি হয়েছে আসতে, যে তুমি তোমার অফিস থেকেও এসেছো। আবার এতকিছু রান্নাও করেছো?
: যখন ফোন করেছো, তখন বেলা বারোটার মতো ছিলো। আর এখন গড়ানো বিকেল। রান্নাবান্না করে পথের দিকে তাকাতে তাকাতে চোখ অন্ধ হওয়ার দশা!
: আবার পথের দিকে তাকিয়ে চোখ অন্ধ করারও সময় পেয়েছো?
: আমি রান্না করতে ভালবাসি না। শুধু তুমি আসতে চেয়েছো, তাতেই আমার আনন্দ উথলে উঠেছে। তুমি ফেসবুকে কী সব লেখো, আগে মনে হতো, আহা যদি এই মানুষটিকে কখনো চোখে দেখতে পারতাম! তার পরে দেখলাম, একদিন তুমি আমাকে নিজেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছো!
: আসলে আমি নিজে তো আর সে অর্থে লিখি না। তাই যারা লেখেন, তাদেরকে আমার ভিন্ন গ্রহের মানুষ মনে হয়। আমি বাস্তব-জীবনেও খুঁজে খুঁজে লেখক বের করে বন্ধুত্ব করি! তবে আজ তোমার এখানে আসা আমার দ্বিগুণ সার্থক হয়েছে। তোমার বাড়ির সামনে ওই পুকুর আর বিস্তৃত ফাঁকা জায়গা দেখতে পেয়ে।ঠাসাঠসি বাড়িঘর দেখতে দেখতে, ফাঁকা জায়গা আমার কাছে তাজমহলের থেকেও আকর্ষণীয় মনে হয়।
নূরুল আমিন সাহেব বললেন, তাহলে পিছনের হাওড় দেখে সেতারা আপা কী বলবেন কে জানে!
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, পুকুর দেখে যদি তোমার এতই ভালো লেগে থাকে, তাহলে এক পুর্ণিমা রাতে এসে আমার এখানে থাকো।প্লিজ…।
স্ত্রী’র কথায় সায় দিলেন নূরুল আমীন সাহেবও। তিনি পল্লী বিদ্যুতের জিএম ছিলেন। মাত্রই অবসরে এলেন। হোসনেয়ারা বেগম এবং এম নূরুল আমীন দম্পতির তিন কন্যা। বড় কন্যা শাচ্চী ও মেজো কন্যা শাওনের বিয়ে হয়ে গেছে। জামাই দু’জনইসেনা অফিসার। ছোট মেয়েটি’র নাম সপ্তর্ষি। সে কলেজে ফার্স্টইয়ারে পড়ে। সেতারা বেগম বুঝতে পারলেন, ছোট মেয়ের নামেই এই বাড়ির নাম ‘সপ্তর্ষি’!
কন্যা সপ্তর্ষি তার রুমে ছিলো। দূর থেকে ঈশারায় তাকে দেখিয়ে সেতারা বেগম হোসনেয়ারা বেগমকে বলেছিলেন, এখন এই মেয়েই তোমাদের দু’জনের প্রাণের আরাম। নাহলে দু’জনের জীবনই এখন পোড়া মাটির মতো ঠেকতো! মনে হতো সব দায়-দায়িত্ব শেষ, এবার শেষ যাত্রার অপেক্ষা চলছে। ওই মেয়েই এখন তোমাদের মুখর করে রেখেছে। তা তোমরা ওকে পরিকল্পনা করেই দুনিয়াতে আনো, বা অপরিকল্পিতই হোক।
সেতারা বেগমের কথায় হোসনেয়ারা বেগম ও নূরুল আমীন সাহেব হেসে ফেললেন। যে হাসিতে সব প্রশ্ন ঢেকে থাকে।
সেতারা বেগম বলতে লাগলেন, আমাদের দেশে অনেককে তিন নম্বর সন্তানের সামনেই বলতে শুনেছি, ‘দুর্ঘটনার ফসল’। চাইনি তবু হয়ে গেছে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো ঘুরে জেনেছি, একই বিষয় তারা অন্যভাবে প্রকাশ করছে। তাদেরকে যদি বলো, ছোটটার বয়স অন্যগুলোর থেকে এতো তফাৎ…। তারা বিষয়টি বুঝে বলবে, চাইনি, কিন্তু গড গিফট দিয়েছেন!’ দুটি বিষয় পাশাপাশি কল্পনা করে দেখো। আমরা যা উত্তর দিচ্ছি তাতে আমাদের অনাকাঙ্ক্ষিত সন্তানটির মনটা ছোট হচ্ছে। আর একই বিষয়ে ওরা যা উত্তর দিচ্ছে, তাতে ওদের বাচ্চাটির মন বড় হচ্ছে, সে তার মা-বাবার প্রতি ঈশ্বরের গিফট ভেবে।
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, ভালো বিষয় শিখিয়ে দিলে বন্ধু। ছোট মেয়েকে নিয়ে মানুষের প্রশ্নে সত্যি আমরাও একটু বিব্রতবোধ করছি উত্তর দিতে। এখন ও বড় হয়ে গেছে। প্রশ্নও উহ্য হয়ে গেছে।
সেদিন হোসনেয়ারার বাসা থেকে সেতারা যখন বেরিয়ে গেলেন, তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। তবে তাকে কথা দিয়ে আসতে হলো, এইযে ক’দিন পর সামনে যে পূর্ণিমা আসছে, তখন তিনি সন্ধ্যার আগেই হোসনেয়ারার বাসায় এসে পৌঁছাবেন। আকাশে পূর্ণিমার ডগডগে চাঁদ উঠবে, আর সেদিন তারা দুই বান্ধবী পুকুরমুখো ঝুলবারান্দায় বসে পুকুরের টলটলে জলের ভেতর মনের মাধুরী মিশিয়ে সে বিম্ব যেমন দেখবেন, তেমনি দেখবেন আকাশের চাঁদকেও!
পূর্ণিমার বাকি যে ক’দিন ছিলো, হোসনেয়ারা সেতারাকে তা ফোনে প্রায় প্রতিদিন মনে করিয়ে দিতেন। বলতেন, দেখো সেতারা, তুমি কিন্তু সেদিন হাতে কোনো কাজ রেখো না। কোনো অজুহাতে যেন মিস করো না। আমি কিন্তু খুব আশার করে আছি।
সেতারা বলেন, না রে ভুলবো না। আমারও তোমার বাড়িটা যেমন ভালো লেগেছে, তেমনি তোমার বরকেও! তুমি খেতে দেয়ার আগে তোমার বর আমার জন্য সোকেস থেকে নতুন প্লেট-গ্লাস-বাটি বের করে তোমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, সেতারা আপাকে এগুলোতে খেতে দাও।’ দেখো, এই বিয়ষটা কিন্তু আমার মনে লেগে আছে এবং তোমাদের সম্পর্কের যে রসায়ণ দেখলাম, তোমাদের পাশে যারা থাকবে, তাদেরই চিত্ত ও চক্ষুকে তা আরাম দেবে!
হোসনেয়ারা বেগম বললেন, আহারে তুমি কেমন মনে রেখেছো! তুমি এসো, নূরুল আমীন সাহেবও তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি বলছেন, সেতারা বেগম কিছুক্ষণের জন্য এসে বাড়িটাকে মাতিয়ে তুলছিলেন।
হোসনেয়ারা বেগম একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত্রী। সেতারা তার বাসায় গেলে সারা ঘর খুঁজে হোসনেয়ারা ফেসবুকে পরিচিত হওয়া, তার প্রথম দেখা বন্ধু সেতারা বেগমকে তার চারখানা বইয়ের সবই দিলেন। ‘বিজন পথের বাঁকে’ ‘জলেরযৌবন’ ‘জল ও জ্যোৎস্নার প্রেম’ এবং ‘প্রমিত প্রণয়’। সেতারা বেগম নিজে কবিতা অতো বোঝেন না। তবে কবিতার ভেতর থেকে যেনো একেকটি গল্প তিনি টেনে বের করে ব্যক্তি মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা করেন। তাও আর কতটুকু পারেন! তবে বোঝেন, হোসনেয়ারার কবিতা তার মতোই সহজ-সরল। আপন আনন্দে লেখা। সেতারা মনে মনে ভাবেন, এও কমকি! ‘… তোমার যা আছে তা তোমার আছে/ তুমি নও গো ঋণী কারো কাছে/ তোমার অন্তরে যে শক্তি আছে/ তারি আদেশ পেয়েছ।। ও জোনাকী কি সুখে ওইডানা দু’টি মেলেছ/ আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণঢেলেছ…।’ সেতারার মনে হয়, রবীন্দ্রনাথের এই জোনাকীর ভীড়ে কবি হোসনেয়ারা বেগমও আছেন!
হোসনেয়ারা বেগম যখনই সেতারা বেগমকে ফোন করেন, আসন্ন পূর্ণিমাতে সেতারার যাওয়ার বিষয়টা প্রতিবার ঝালিয়ে মজবুত করতে বলেন, আমি কিন্তু খুব আশা করে আছি, তুমি আসবে, আমরা দুই বান্ধবী সারারাত জেগে গল্প করবো সেদিন।
হোসনেয়ারার বাড়ির সামনের ওই পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে গিয়ে সন্ধ্যা থেকে সারারাত জেগে দোতলার ঝুলবারান্দায় বসে আকাশও পাতালে একসাথে সোনার থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদটি দুইভাবে দেখতে পাওয়া সেতারার জন্যও খুবই আনন্দের বিষয় হবে। সেতারাও ভয় পাচ্ছিলেন, না জানি সত্যিই সেদিন তার নিজের কোনো জরুরী কাজ এসে হামলে পড়ে। তাই পূর্ণিমা যেদিন এসেই গেলো, সেদিন সকাল সকাল বনানী ব্যাংকে তার এমনি একটা কাজ পড়ে গেলো। সেতারা সুযোগটা কাজে লাগিয়ে একসাথে বেরিয়ে পড়লেন। একরাত থাকতে হলে দু’দিনের জন্য যা নিতে হয়, তার সব নিয়ে বের হলেন।
বাড়িটি আগেই চেনা থাকায় আজ আর দেরি হলো না। বনানী ব্যাংকের কাজ সেরে দুপুরের আগেই দক্ষিণ খানের ‘সপ্তর্ষি’তেপৌঁছে সেতারা ড্রাইভারকে বললেন, কাল সকালে এসে আমাকে নিয়ে যেও। তবে ফোন দেয়ার পর রওনা হইও।
হোসনেয়ারা বেগম রান্নাবান্না করতে পছন্দ না করলেও নিশ্চয় বাড়িঘর গোছাতে, বাগান করতে পছন্দ করেন। নাহলে বাড়ির প্রতিইঞ্চি জায়গা অতো পরিষ্কার, অতো নিপুণভাবে সাজানো থাকে! ছাদের বাগানও ভীষণ নিকানো। কত ফলফুল সেখানে। বাড়ির সামনে পুকুর। পিছনে হাওড়ের মতো ফাঁকা। অবশ্য পুরোটা জুড়ে তখন আশ্বিনের হাঁটু পানি। সেখানে কেউ আগাম জমি পরিষ্কার করছে। কেউ মাছ ধরছে। সারাদিন দু’জনের এইসব দেখতে দেখতে সময় কেটে গেলো। সেতারার সাথে পরিচয় করাতে বিকেলের আগে হোসনেয়ারা খবর দিয়ে আনলেন তার আরো দুই বান্ধবী পারমিতা ও জান্নাতকে। সেতারা বেগমের মনেই ছিলো না তিনি আসলে চাঁদ দেখতে এসেছেন। কিন্তু এতো আড্ডা-গল্প, এতো কিছু দেখাদেখির ভেতরও, হোসনেয়ারা চাঁদের জন্যই যেন ব্যাকুল হয়ে আছেন। তিনি পারলে তখনি ডেকে আনা মেহমান বিদায় করে হলেও পর্দা টেনে সন্ধ্যা নামান প্রিয় বান্ধবী সেতারাকে নিয়ে মগ্নহয়ে চাঁদ দেখতে। আর তার সাথে আপন অন্তরীক্ষ হতে শক্তি এনে স্ত্রী’কে সঞ্চারিত করছেন, নূরুল আমীন সাহেবও! যেন তারা জোড়া শালিকের মতো এমনি এমনি একই রকম দু’জন দু’জনের পায়ে ঘুরঘুর করছেন!
সেতারাকে নিয়ে হোসনেয়ারা বারান্দায় বসে আছেন যখন থেকে, তখনো সন্ধ্যা নামেনি। তবু আগে থেকে হোসনেয়ারা সেতারাকে নিয়ে সাজানো বাগানের ঠাসাঠাসি গাছ, লতাপাতার ভেতর জায়গা করে বেতের মিনি সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসেছেন। যেন প্রয়োজনে এখানেই রাত পার করা যায়, চাঁদের মোহ যদি তাদের টেনেই রাখে! কিন্তু সন্ধ্যা পার হয়ে যাচ্ছে পুকুরে চাঁদ দেখা যাচ্ছেনা! হোসনেয়ারা আকাশে খুঁজছেন, সেখানেও নেই! তিনি ছাদে গেলেন, আজ তবে চাঁদ কোনদিকে উঠলো, তাই দেখতে! না কোনোদিকেই নেই! সবদিকে আজ সমান অন্ধকার! হোসনেয়ারা ফিরে এলে সেতারা একটু মজা করে বান্ধবীকে বললেন, রান্নাঘর থেকে ডালঘুটনিটা নিয়ে একটু হাওড়ের জলটা ঘোটা দিয়ে দেখে এসো!
তটস্ত হোসনেয়ারা বললেন, কেন?
সেতারা বললেন, আধুলির মতো না আবার চাঁদ সেখানে খসেপড়ে কাদায় তলিয়ে আছে!
স্ত্রী’র আহাজারি শুনে শুনে নূরুল আমিন এগিয়ে এলেন।বললেন, দেখছো না সন্ধ্যার ঠিক আগে থেকে হঠাৎ আকাশে মেঘ জমেছে? চাঁদ আজ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। হয়তো রাতে মেঘ কাটবে। মাঝরাতের বৃষ্টিভেজা জোছনা, তার সৌন্দর্যও কম নয়! তখন না হয় দুই বান্ধবীকে আমি জাগিয়ে দেয়ার জন্য নিজে জেগে থাকবো!
হোসনেয়ারা বললেন, হায় হায়, বলো কি? আমি সেতারাকে কত সাধ করে ডেকে আনলাম সন্ধ্যা থেকে …!’
আমিন সাহেব বললেন, তুমি এতো অধীর হয়ে আছো, যে মেঘ বিকেল থেকে মাথার ওপর ভেড়ার পালের মতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা তোমার নজরে আসছে না। তা তোমাদের সব সাধ কী ওই এক চাঁদেই জমা রয়ে গেছে? দিনভর এক বিছানায় দু’জনের এতো গড়াগড়ি, আরো দু’জন ডেকে এনে চারজনের এতো হৈহৈ গল্প, সবাই মিলে ছাদে গিয়ে চা খাওয়া, ছবি তোলা, ফেসবুকে পোস্ট দেয়া, বড় চোখে মিনি হাওড় দেখা, খোলা প্রান্তরে বিকেলের গড়ানো রোদ দেখা এসব কিছুতে আবেগের কিছুই তোমার খরচ হয়নি?’
সেতারা বেগম বললেন, ঠিক বলেছেন ভাই। আমার আর চাঁদ দেখার অতো সাধ নেই। চাঁদ না ওঠাতে হোসনেয়ার যে আক্ষেপ দেখলাম, আমার মনে হয়, জীবনে কিছু অভিযান ব্যর্থ হওয়ার দরকার আছে। কারণ বিফল মনোরথই নিজের মতো একটা পথের ছবি আঁকতে পারে, আঁকা সে পথে সে চলতে না পারলেও। আর পায়ে হেঁটেই কেন চলতে হবে! মনকেও তো তার মতো ছেড়ে দিয়ে কখনো খেলা দেখতে হয়!
আমিন সাহেব বললেন, ঠিকই বলেছেন আপা, সাপ ছেড়ে দিয়ে খেলা দেখার কথা তো আমাদের পূর্ব পুরুষরাও তাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শুনে আসছেন! আর উপমিত সাপটি তো মানুষের মনই। তাই এখন না হয় মেঘে ঢাকা চাঁদের বিহরলাবণ্যে আমরা সার্থকভাবে আধুনিক কিছু করি! যেমন একালের কোন লেখকের কোন বই কে কোনটা পড়েছি এবং তা কেমন লাগলো তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমিন সাহেব এবার স্ত্রী’র কপালেদৃষ্টি বল্লমের মতো তাক করে বললেন, খালি লিখলেই তো হবে না! তোমার সময়ে কে কী লিখছেন তাও তোমাকে জানতে হবে। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমের নাম পেড়ে না এনে।তোমাদের সাথে এই আলাপের জন্য আমি প্রস্তুত! তার আগেচুলোয় চায়ের পানি আমি নিজেই চাপিয়ে আসি!
বাড়িটি খুবই নান্দনিকভাবে সাজানো। তিনতলা বাড়িটির নিচেরতলা ভাড়া দেয়া। আর দোতলা, তিনতলা মিলে আপতত ওদের তিনটি প্রাণীর বসবাস। ওপরের ফ্লোরটা সাজানো- গোছানো পড়ে থাকে। জামাইসহ মেয়েরা এলে তিনতলা ব্যবহার হয়। দোতলার একরুমে ওদের ছোট মেয়ে থাকে। আরেক রুমে ওরাদু’জন। আর দুটি রুম ফাঁকা। নূরুল আমিন সাহেবের সাথে বইপড়া নিয়ে আড্ডা শেষে সেতারা ওদের দুজনের থাকবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেন। কারণ প্রথমদিন তাকে এই রুমেই এনে বসিয়েছিলেন হোসনেয়ারা। আজো দুপুরে খাওয়ার পরে এ ঘরেই দু’জন গড়িয়ে গল্প করেছেন। তাই পুরো বাড়িতে এই রুমটিই সেতারার বেশি চেনা। এ রুমটিই রাতে থাকার জন্য তাকে টানছে।
সেতারা শোয়ার পর হোসনেয়ারা তার পাশে খাটের কোনায় এসে বসলেন। হোসনেয়ারাকে জানার পর থেকে তাকে যতোটা নির্ভার-ফুরফুরে মেজাজের মনে হয়েছিলো সেতারার, এখন সেতারার তেমনটি মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, ওর ভেতর এখনো অনেক ভার আছে। আর আজ তাকে চাঁদের অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যান তিনি যেন কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারচ্ছেন না। তাই পিছনের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে সব রেখে ভেতরের বিষটুকু বহুগুণ করে উগরে দিচ্ছিলেন। যেন খানিকটা এরকম, চাঁদ ফিরে এলে গন্ডুষ বেয়েপড়া বিষের দাগটা যেনো তার নজর না এড়ায়।
হোসনেয়ারা গল্প বলতে বলতে বললেন, জানো, আমার ছোটমেয়েটা বড় দুটোর থেকে বেশ ছোট। বড় দুটো একেবারে পিঠাপিঠি। একসাথে বড়ও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মনের মতো সমন্ধ আসছিলো না। তাই বিয়ে দিতে দেরি দেখে, অনেকে বলেই ফেলতো, মেয়েমানুষ হচ্ছে কাঁচা তরকারির মতো। তরকারি যেমন প্রথমবেলা না বেচতে পারলে দাম থাকে না। তেমনি মেয়ে মানুষও।কিছুদিনের ভেতরই পরপর আমার দুটো মেয়েরই ভালো বিয়ে হয়েছে। দু’জনেরই আর্মি অফিসারের সাথে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু মানুষের ওই কথাটা আমার মনে ভিমরুলের কামড়ের মতো লেগে আছে!
সেতারা বেগম বললেন, এগুলো মনে রাখতে হয়? যাদের কাছে মেয়েমানুষ কাঁচা তরকারির মতো, তুমি কি সেই শ্রেণিতে পড়ো? তুমি নিজে এমএ পাশ করেছো। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকে উঁচু পদে চাকরি করছো। সাধারণ, পিছিয়ে থাকা মানুষের কথায় তোমার মন খারাপ হলে তো আমি বলবো, আসল শিক্ষাটা তোমার হয়নি! তুমি কি জানো পুরুষের থেকে নারীর সব শক্তিই বেশি?
হোসনেয়ারা বললেন, আমি ওইরকমই। একটুতে ভীষণ কষ্ট পাই।কিন্তু কাউকে তা বলিও না!
সেতারা বললেন, আবার যদি কেউ বলে এমন কথা, বলে দিও, তোমাদের মেয়ে কাঁচা তরকারি। আমাদের মেয়েরা চালতার মতো।কারণ তাদেরকে মেরুদণ্ড সোজা ও শক্ত করে তৈরি করা হয়েছে!
হোসনেয়ারা আবার বললেন, আমার আরো একটা কষ্ট আছে।তাও কাউকে বলি না!
: কি?
: এখনো কাউকে কোনোদিন তা বলিনি! অথচ, সে কষ্টটাও আমাকে কোনোদিন সুখি হতে দেয়নি!
: তোমাকে দেখার আগে তো তোমার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিলোনা। কিন্তু দুইদিন দেখার পর থেকে আমার মনে হচ্ছে, তোমার মতো, মানে একঘরে থাকা তোমাদের দু’জনের মতো সুখি মানুষ খুব দুর্লভ। কারণ তোমরা দু’জনই একেবারে নির্লোভ-নির্ভার দু’জন মানুষ। নাহলে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই চাকরি করা দু’জন মানুষ এইখানে এসে বাড়ি করে? পিছনে হাওড়। সামনে পুকুর। রাস্তা স্যাঁতসেঁতে। অবশ্য এর জন্য তোমাদের দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। আর মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ওই সম্মান টুকুই দরকার। প্রয়োজনের বেশি সম্পত্তি আমার কাছে গাধার পিঠে চিনিবয়ে বেড়ানোর মতো মনে হয়। মানে বোঝা বইছে ঠিকই, কিন্তু চিনির স্বাদ সে নিতে পারছে না! তাহলে সে গাধা না তো কি! বলোতো কী হবে দামি জায়গায় বাড়ি করে মানুষের মনের চোখে যদি অসম্মানীত হয়ে থাকতে হয়!
: তুমি তো আমার আরেকটা কষ্টের কথা জানতেই চাইলে না!
: কষ্টকে প্রশ্রয় দিতে নেই। কাউকে বলা মানে, সে কষ্টের গোড়ায় পানি ঢেলে তাকে আবার সজীব করে তোলা। আর কাউকেই নাবলতে বলতে দেখবে তুমি নিজেই বিষয়টি ভুলে গেছো!
: না, এতাদিনে যখন ভুলিনাই, এটা আর ভুলবো না!
: আচ্ছা, ঠিকাছে বলো!
: আমিন সাহেকে তো তুমি দেখলেই। ওর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে গার্জিয়ানদের ইচ্ছেয়। তবু তাকে পেয়ে মনে হয়েছিলো, আমি ঠিক এই মানুষটাকেই জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছিলাম।বিশ্বাস করো, আমার জীবনে কোনো অপূর্ণতা ছিলো না।
: বলো কি? কোন ফাঁক গলিয়ে আবার তোমার সর্বনাশা অপূর্ণতা এসে ঢুকলো তবে? তাও আবার আমিন সাহেবের মতো মানুষটিকে নিয়ে। তোমাদের দু’জনকে একসাথে দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে তোমাদের একজনের জন্যই আল্লাহ আরেকজনকে বানিয়েছেন!
: আমি তোমাকে বলি কি? বিয়ের পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত আমারও তাই মনে হয়েছিলো!
সেতারা বেগম একথা ওকথা দিয়ে আমিন সাহেবকে নিয়ে হোসনেয়ারার দুঃখের প্রকাশটা ঠেকিয়ে রাখতে চান! কিন্তু সবকথাই একসময় ফুরোয়। এমন কি চাঁদটির অনিবার্য উদ্ভাসও যে সম্পূর্ণ ব্যাহত হলো, সে দুঃখটাও হোসনেয়ারা এখন বেমালুম ভুলে গেছেন আমিন সাহেবের দেয়া দুঃখের কথা মনে পড়ে।
একসময় হোসনেয়ারা বলতে থাকেন। তোমাকে তো বলেছি, জীবনে ওকে স্বামী হিসাবে পাওয়া আমার প্রত্যাশার চেয়ে অনেকবেশি পাওয়া। কারণ আত্মীয়-স্বজনের ভেতর দেখেছি তো, আমার থেকে তাদের মেয়েরা আরো বেশি সুন্দরী-শিক্ষিত। কিন্তু নূরুল আমিনের মতো জামাই কেউ পায়নি। উনি জীবনে অনেকগুলো চাকরি করছেন। একটা ছেড়েছেন আরেকটায় ঢুকেছেন। সব উচ্চপদে। সবদিক থেকে ওনার মতো আমাদের আর কারো জামাই নয়!
সেতারা এবারও প্রশ্ন করেন না, দুঃখটা কী দিলেন উনি তাই বলো!’ হোসনেয়ারা নিজেই পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে এসে টানা বলতে থাকেন, আমি যেমন ওকে পেয়ে ধন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আবার উনিও আমাকে পেয়ে। হানিমুন করতে নেপাল গিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তারপরও কতখানে বেড়াতে নিয়ে গেছে। ওই ঘটনার আগে প্রতিবারই মনে হতো নতুন করে হানিমুনে যাচ্ছি। সব অনুষ্ঠান, সব পর্টিতে ও নিজে আগ্রহ করে আমাকে নিয়ে যেতো।বন্ধুদেরকে দাওয়াত দিয়ে এনে আমাকে দেখাতো। আমাকে নিয়ে সে যে গৌরব বোধ করতো, এটা আমি বুঝতাম।’
সেতারা এবারও বলেন না, তাহলে দুঃখটা কি?
হোসনেয়ারা তার গল্পের ধারাবাহিকতায় এক সময় বলেই ফেললেন, একদিন নূরুল আমিনের অনেকগুলো বন্ধু একসাথে বাসায় এসেছেন। বাবুর্চি টিপট ভর্তি করে চা দিয়ে আসছে।কিছুক্ষণের ভেতর আমিন সাহেব আমাকে ডাকলেন তাদের ভেতর। আমি সেখানে গিয়ে দেখি সবার হাতে হাতে গরম চা।ধোয়া উড়ছে। এর ভেতর নূরুল আমিন তার এক বন্ধুর কথারপিঠে একটু জোরেই বলে উঠলো, আসলে আমার ওই সময় বিয়েটা করা ঠিক হয়নি! আমেরিকায় পিএইচপি করতে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছিলাম, যাওয়াই উচিৎ ছিলো!’ বিশ্বাস করো, সেই আমার নিপাট সুখে চিড় ধরলো! অথচ এইটা নিয়ে আমি তাকে ওই সময় তো কিছু বলিইনি। কোনোদিনই তাকে কিছু বলিনি, যে তুমি এমন কথা কেন আমার সামনে এতোগুলো মানুষের কাছে বললে?’
সেতারা হোসনেয়ারার কথার পরে কী বলবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। তবে মনে মনে ভাবছিলেন, আমিন সাহেব জীবনে আর একটি দুঃখও না দিতে পারার জন্য, সেই সে জীবনের প্রথমদিকের মৃদু বেদনাটা এখনো হোসনেয়ারার বুকে সেতারের মতো ঝংকার তুলছে এবং সেতারা এও বুঝতে পারছেন, বেদনা ওই একখানাই! এরপর হোসনেয়ারাকে কিছু একটা বলতে হয়, তাই বললেন, ওই দুঃখেই কি তুমি কবিতা লেখো?
: ওই দুঃখে কি না জানি না। তবে দুঃখটা এসে যায়।
: শোনো দুঃখ কাউকে দুঃখি করে না। ধনী করে। মানে সমৃদ্ধ করে।তবে ভাগ্যিস উনি তোমাকে আর দুঃখ দেননি। তাহলে ওই চারুবেদনা পানসে হয়ে যেতো। আজকে যা হেম হয়ে গেছে, তা বেনোজলে যেতো ভেসে! যা তা দুঃখ দিয়ে তো আর কবিতা হয় না! তোমার ওই আকাশের চাঁদ ও পুকুরে চাঁদের বিম্ব, কিছুই মনে লাগতো না। সব শরতের মেঘের মতো চোখের ওপর দিয়ে জীবনের সব সৌন্দর্য নিয়ে ভেসে চলে যেতো বাদাড়ে।
: কিন্তু সেই থেকে ধীরে ধীরে না দেখা কারো জন্য আমার ভেতর একটা অপেক্ষা কাজ করে।
: তুমি কি সেই অপেক্ষাকে ভরাট করে তুলতে কবিতা লেখার কথা ভাবলে?
: প্রথম তো কিছু ভেবে লিখতে শুরু করিনি। তবে ওই যে দোয়াতের কালিতে কলম চুবিয়ে ছোটবেলায় যেমন লিখেছি, কবিতা লিখতে গেলে মনে হয়, ওই বেদনায় কবিতা লেখার কলম আপনা থেকে চুবে আসে! কিন্তু এতো ভাষা কোথায় পাবো তাকে কাজে লাগাতে। তারপর মনে হয় তা কলমের নিবেই শুকায়।
: আচ্ছা একটা সত্যি কথা বলো তাহলে, তোমার ওই ফাটল চুইয়ে, কখনো অন্য কারো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করেনি?
: ইচ্ছে করেছে! ওই যে বলেছি, একটা অপেক্ষা আছে কারো জন্য…।
: তুমি চাকরি করা মানুষ। সর্বচ্চো ডিগ্রিটি তোমার আছে…!
: সত্যি বলতে কি, বড় রাস্তার পাশে যার বাড়ি, সে আর গলির ভেতরের বাড়ি পছন্দ করবে না বসবাস করতে! যাদের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করা যেতো, তারা কেউই নূরুল আমিনের থেকে বেশি নাম্বার পাওয়ার যোগ্য নয় আমার কাছে। পেলে বোধ হয়, টলে যেতাম!
সেতারার ঝিমুনি টের পেয়ে ঘুমাতে বলে হোসনেয়ারা চলে গেলেন পাশের রুমে নূরুল আমিন সাহেবের কাছে। অপরিচিত বিছানায় একা শুয়ে মন্দ লাগছিলো না সেতারার। বাসায়ও তো তিনি একাই থাকেন। ছেলে মেয়েরা যে যার মতো নিজের নিজের ঘরে দরজা আটকে থাকে। সেতারার হাজবেন্ড নেই বহু বছর। বাকি রাত টুকু হোসনেয়ারার মনস্তত্ত্ব নিয়ে খেললেন সেতারা। ক্ষুদ্র একটু কাঁটার যন্ত্রণাও তো যন্ত্রণাই। তবে এমন অনেক কাঁটার ঘা যারা অহরহ খায়, তাদের বোধ আর সূক্ষ্ম থাকে না, এমন একটু সূক্ষ্ম বেদনা পোষার মতো! যেমন সেই সময়ে তিনি নিজের বুকজুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও একটু বেদনা পেলেন না, যাকে সঙ্গী করে, হাওড়ের দিকের জানালার একটি কপাট অন্তত খুলে, পর্দা সরিয়ে ভোররাতে নামা জোছনার প্লাবন দেখে রাতের বাকি সময়টুকু নির্ঘুম কাটাতে পারতেন। কিন্তু পারলেন না।
পরদিন সকালে সেতারা বেগম তার ড্রাইভারকে কল দিলেন, হোসনেয়ারা ঘুম থেকে ওঠার আগেই। কারণ ড্রাইভারেরও তো এতোটা পথ আসতে সময় লাগবে। সেতারার গাড়ি হোসনেয়ারার বাসায় পৌঁছলে সেতারা নাস্তা খেয়ে, ওদের দু’জনকে শুভ বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লেন। যতক্ষণ দেখা যায়, সেতারা ফিরেফিরে দেখলেন, হোসনেয়ারা বেগম ও নূরুল আমিন সাহেব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন তার গমন পথের দিকে। তারা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সেতারার সামনে চলে এলো দেলু নামের তেইশ/চব্বিশ বছরের একটি মেয়ে। তার আবার ছিলো তিন আর পাঁচ বয়সী দুটি মেয়ে। একসময় দেলু সেতারা বেগমের বাসায় ছুটাকাজ করতো। দেলুর মায়ের তিনটি মেয়ে ছিলো। দেলু ছিলো ছোট। তার বিয়ে হয়েছিলো যার সাথে, সে নারায়ণগঞ্জ একটি জুটমিলে কাজ করতো। লোকটির আগের স্ত্রী আছে। আছে আরো তিনটি ছেলেমেয়েও। তবু দেলু সেখানে খেয়ে পরে ভালোই ছিলো। কিন্তু একবার দেলুকে তার মায়ের কাছে বেড়াতে পাঠিয়ে সে লোক তার খোঁজখবর নেয়া বন্ধ করে দিলো। দেলুর মা কয়েকটি বাসায় ছুটা কাজ করতো। বাপ ছিলো না দেলুর। ভাইও না। শেষে দেলু ধারেকাছে তিন বাসায় ছুটা কাজ নিলো। তার ভেতর সেতারা বেগমের বাসা একটি। তখন দেলুর থেকে সেতারা বেগমের বয়সও খুব বেশি ছিলো না। হয়তো তার থেকে বছর পাঁচেক কম হবে দেলুর বয়স। তবু দেলুর কথা তার হঠাৎ হঠাৎই মনে পড়ে যায়।মেয়ে দুটিকে গেটের ভেতরে এনে ছেড়ে দিয়ে দেলু নিজে একা বাড়িতে ঢুকতো। তারপর বাড়িময় ছুটে কাজ করতে করতে দেলুর স্বগোক্তিগুলো আজো সেতারার প্রাণে বড়শির মতো বিঁধে আছে।দেলুকে মনে পড়লেই তিনি ভাবেন, আসলে সুখ-দুঃখ বিষয়টা যে ভীষণ আপেক্ষিক, সেটা সেই সংসার জীবনে ঢোকার কয়েক বছরের ভেতর দেলুই তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে।
দেলুর চেয়ে দেলুর মা-ই বেশি বাসায় কাজ করতো এবং সে অভিজাত এলাকায় বড়লোক দেখে কাজ ঠিক করতো। এর জন্য রিকশায় করে যাওয়া-আসা করতে হতো দেলুর মাকে। দেলুর মা সেসব বাসা থেকে প্রতিদিন কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতো। দেলু তার মায়ের ছোট মেয়ে হওয়াতে কন্ঠে আহ্লাদ ঝরতো কথা বলতে।সে সারাক্ষণ নরম স্বরে নিজের দুর্ভাগ্য নিয়ে একাই আক্ষেপ করতো। সেতারা বেগম কেন যেন তাতে বিরক্ত হতে পারতেন না! কখনো ধমক দিয়ে বলেননি, যতক্ষণ আমার বাসায় কাজ করবি, মুখ বন্ধ করে কাজ করবি! বরং সেতারা বেগমের কাছে সুখ-দুঃখের সংজ্ঞাটা ক্রমাগত যেন পাল্টে যেতো দেলুর প্যাঁচালের সাথে সাথে। বাসায় ঢোকার পর থেকেই তার শুরু হতো নিজের সাথে নিজের কথা বলা। আর তা সেতারা বেগম যেচে শুনতে না গেলেও যেটুকু তার কানে আসতো, যেন বোধের ভেতর পরত পরত এক ভাঙাগড়ার কাজ চলতো।
দেলু ঘরে ঢোকার সাথেই শুরু হতো, থাউক, আমার খুঁজ নিলেনে, না নিলে না নে! কিন্তুক তর মাইয়া দুইডার খুঁজ তো নিবি! একবার চিন্তা করবি না, তারা কী খাইতেছে। কেমুন আছে। তরইতো বাচ্চা! আমার কি বাপ বাইচ্চা আছে, নাকি আমার একটা ভাই আছে। বুড়া মা, জান পিডাইয়া মাইনষের বাড়িরতন খাওন আনে। তার একলার খাওনে আরো তিনডা মানুষ ভাগ বসাই।আর আমি ছাড়াও তো তার আরো দুইডা মাইয়া আছে। তাগোপাতেও তো কহনো চাইরডা ভাত দেওন লাগে। নাতি-নাতনি গো আব্দার মিডান করণ লাগে। তার ওপর তার বড় মাইয়া বিধবা…।বাসা ভাড়া দেওন লাগে। কেমনে তুই দুইটা বাদাইয়া আমারে বাসাইয়া দিলি। দিলিই যুদি, দিতি আমি যহন একলা আছিলাম!
আবার কখনো দেলুর কণ্ঠে অন্য সুর। থাউক, খুঁজ নিলে নে। না নিলে না নে! আমিই কি না খাইয়া আছি! আল্লাহ আমারে খাওয়াইতেছে না। এই তো মায় পিত্তিদিন আনারসের ছাবাগুলান বাসাবাড়ির তন নিয়াসে সেগুন খাইয়াই সন্ধ্যারাইতে প্যাট ভইরা যায়। মাঝরাইতে উইঠা রাইতের খাওন খাওয়া লাগে! প্রায় দিনমা’য় বড় মাছের বড় বড় টুকরার তরকারি নিয়াহে। বাসি অইলেইকি! তুই তো গুড়া মাছই পিত্তিদিন খাওয়াইতে পারতি না। আল্লাহযা কপালে রাখছিলো মাইন্যা নিছিলাম…।
এক ঈদের পরদিন দেলু খুব ঝলমলে মুখে সেতারা বেগমের বাড়িতে ঢুকলো। ঢুকেই সেই তার নিজের সাথে কথা। ঈদটা গেলো এট্টু খুঁজ নিলি না। মাইয়া দুইডার লাইগ্যাও একগাছা সুতাও পাডাইলি না। না পাডাইলি। আমার মায় দিছে আমার মাইয়াগোরে। এই যে মায় তিন বাসার থেইকা জাকাতের তিনখান শাড়ি পাইছে, দুইহান আমারে দিয়া নিজের লাইগ্যা একখান রাখছে। তুই দেস্ নাই, কিন্তক আল্লায় আমারে অন্যখান থেকে পাওয়াইয়া দিছে!
একটানা অনেকদিন পর্যন্ত কয়েক ঘন্টা করে দেলুর প্যাঁচাল সেতারা বেগমের মনের অন্ধিসন্ধিতে যেনো জট লাগতো আর খুলতো। অথবা দেলু তার জীবনের গল্প বলে যেতো আর সেতারা বেগমের মনে সেলুলয়েডের ফিতার মতো দৃশ্যগুলো চিত্রায়িত হতো! অভিমানের যে একটা সুখ আছে। ক্রোধের যে একটি তেজ আছে, দেলুর ভেতর তার বিন্দুমাত্র না দেখে সেতারা বেগম তার সেই বয়সে খুব হতাশ হয়েছিলো। স্বামীর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো ওর ভেতরে দ্রোহের এতোটুকু আগুন না দেখে তিনি মনে মনে ভাবতেন, সব মানুষের প্রবণতা যদি দেলুর মতো হতো, তাহলে পৃথিবীটা স্বর্গ নয়, একেবারে গোয়াল ঘর হয়ে থাকতো।
শেষমেষ একদিন দেলু সাজগোজ করা অবস্থায় এসে হেসে বললো, আমার মাইয়া গো বাপে আমাগো নিতে আইছে আপা।আমি যাইতেছি। আইজকারতন খুঁজলে কাইল পর্যন্ত মানুষ আপনি ঠিকঐ পাইবেন। কিন্তু আপনি তো আইজ বিপদে পড়বেন। তাই যাওনের আগে লুকাইয়া আইছি খালি থালাবাসনগুলা অন্তত ধুইয়া দিয়া যাই। আর খুচরা যে কয়দিনকাজ করছি, টাকা কয়টা আমার মারে দিয়া দিয়েন!
সেতারা বেগম দেলুকে আর থালাবাসন পর্যন্ত যেতে দিলেন না। দু’হাতে থাবা দিয়ে তাকে প্রতিহত করলেন। আর পুরো মাসের টাকাটা তাকে তখনি ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোকে তো বাড়তি কিছু কখনো দিইনি। আজ পুরো মাসের টাকাটাই তোকে দিলাম।এ খুব বেশি না!
দেলু বলেছিলো, অহনো মাসের অর্ধেক অয়নাই।
সেতারা বেগম বলেছিলেন, তুই আমাকে কিছু দিয়ে গেলি। আমরাযে জীবন যাপন করি, তার সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই কোনো ধারণা নেই। আর এর নির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠিও হয় না, মেপে চলার। কিন্তু তুই বোধ হয় সেই একখান অদৃশ্য মাপকাঠি আমার হাতে তুলে দিয়ে গেলি!
দেলু বললো, আমি জানি না আপনে কী কন। আমি কী দিলাম। তয় দোয়া কইরেন। য্যান আমার বুইড়া মায়ের ওপর আর বোজা অওন না লাগে! এইটুক ছাড়া আমি দোজখে থাকতেও রাজি আছি!
বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। দক্ষিণখান থেকে ধানমণ্ডি। রাস্তা কম নয়। জ্যামও লাগাতর থাকেই। বিকেলে হোসনেয়ারা বেগম সেতারা বেগমকে ফোন করে বললেন, তুমি বাসায় পৌঁছে একটা ফোন দেবে না? কেমন বন্ধু তুমি, এ্যা? তুমি চলে যাওয়ার পর বাড়িটা ফাঁকা লাগছে। অথচ থাকলে তো মাত্র একটা রাত!
সেতারা বললেন, ফোন দেবো কি! তোমার বাসা থেকে বের হওয়ার পর পয়ত্রিশ বছর আগের তখনকার আমার প্রায় কাছাকাছি বয়সের এক তেইশ/চব্বিশ বছর বয়সী মেয়ে আমার মনটাকে তার নাটকের মঞ্চ বানিয়ে রেখেছে। সেই যে সে কাজ করতে করতে তার যে রোজনামচা আওড়াতো, তাই মহাজীবন্ত হয়ে উঠেছে!
: তুমি আমার সাথে এতো এতো গল্প করে গেলে, চাঁদ দেখতে এসে তাও দেখতে পারলে না, সে সবের কোনো রেশ তোমার মন-মাথা স্পর্শ করতে পারেনি। সেই তোমার জোয়ান কালের কাজের মেয়ে এসে এরি ভেতর তোমাকে কব্জা করে বসে আছে?
: মনের ওপর কারো জোর চলে বলো? তাহলে তো তুমিও পারতে আলগোছে আমিন সাহেবের অসতর্ক কাঁটাখানা সরিয়ে রেখে নিজেকে নিপাট সুখি করে রাখতে!
: তোমার কাজের মেয়ের গল্পটা আমাকে শোনাও তো! নিশ্চয় আমার ওই কাঁটার সাথে তোমার কাজের মেয়ের কোনো বিষয়ের মিল আছে!
: না রে! বরং সম্পূর্ণ বিপরীত। তবে সত্যি কথা সেই বৈপরীত্যের জন্যই তাকে মনে পড়েছে! কতো ছোট্ট একটা বিষয় প্রশ্রয় পেয়ে তোমার মনের সবটুকু জায়গা দখল করে আছে। আর ওই মেয়ের মনে কোনো বেদনা-অভিমান, ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে ঘনীভূত করে তোলার একটু জায়গা অবশিষ্ট নেই…’ বলে, সেতারা বেগম দেলুর কথাগুলো হোসনেয়ারা বেগমকে বলে যেতে লাগলেন।