গল্প: মেঘের ওপারে

গল্প: মেঘের ওপারে

মেঘের ওপারে
অজিত কুমার রায়

দরজায় করাঘাত শুনে কোনো রকমে অলকা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দরজা খুলতেই দেখে মি. রণেশ দাঁড়িয়ে। অলকাকে দেখে মুচকি হাসলেন তিনি। বললেন, কি, ঠিক মতো ঘুম হয়েছে তো? তৈরি হয়ে নাও, রেজিস্ট্রি অফিসে যেতে হবে।
অলকা বলল, কিন্তু…
কোনো কিন্তু নয়, মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রণেশবাবু বললেন বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে।

রণেশবাবু একজন পুলিশ অফিসার। কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলে তাঁর ডিউটি। গত পরশু এসেছিলেন তিনি সোনাগাছিতে সিক্রেট ইনফরমেশনের ভিত্তিতে। মিস অলকা সেন নামে একজন যৌনকর্মীর কমপ্লেন ছিল এ রকমই যে, তাকে জবরদস্তি যৌনকর্মে নিয়োজিত করা হয়েছে। এই কাজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে আসেনি। সে মুক্তি চায়। কিন্তু , তাকে ওই এলাকা থেকে বের হতে দেওয়া হচ্ছে না। সন্ধে নাগাদ ওই এলাকা রেড করে বের করা হয় অলকা সেনকে। বয়স ১৮। গত তিন বছর যাবৎ তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে দুটি পতিতালয়ে। এখানে কলকাতার সোনাগাছিতে সে এসেছে দিন পনেরো হলো। খদ্দেরের দুঃসহ চাপে তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

মি. রণেশ দাশ অত্যন্ত চৌকশ পুলিশ অফিসার। এখনো অকৃতদার। তার নিজের বলতে সংসারে কেউ নেই। কোনো পিছুটান তার নেই। কলকাতার কাঁকুড়গাছিতে নিজের ফ্ল্যাট। একাই থাকেন। অলকাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন থানায়। সেখানেই তাকে রাখা হয়েছে উপযুক্ত পরিচর্যা দিয়ে। মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট করানোও হয়েছে। অলকা অসুস্থ নয় তবে তার বিশ্রামের প্রয়োজন এ কথা সে বলেছে পরশুদিন রণেশবাবুর সাথে।

আগেই বলেছি রণেশবাবু একজন চৌকশ পুলিশ কর্মকর্তা। নিজের বিষয়টা তিনি নিজেই সমাধানের পক্ষপাতী। অন্যের মতামতকেও গুরুত্ব দেন। ভেবে দেখেন। কিন্তু, সিদ্ধান্তটা তার নিজের হতে হবে। এটা হলো তার নীতি। অলকাকে উদ্ধার করার পর থেকে তার ভেতরে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। এতদিন কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছিলেন। বয়স তার তিরিশ ছুঁই ছুঁই। বিয়ে করার কথা এর আগে তেমনটি ভেবে দেখা হয়নি। তবে কলিগদের ভেতর থেকে দুএকটা অফার এসেছে। তাঁকে পাত্রীদের ছবিও দেখানো হয়েছে। কিন্তু, কেন জানি না তাঁর মনে একজনও রেখাপাত করতে পারেনি।

অলকা সেন একজন পতিতা। কিন্তু অলকার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বেশ চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েন মুহূর্তেই। একটা মায়াময় চাউনি ওর চোখে। আর দৃষ্টি ছিল ঋজু। এ সবই ওর ভালো লাগার বিষয়। কোনো রকম কপটতা তার অপছন্দ। অতি আধুনিকতা, বিলাসপ্রিয়তা, রং-ঢং, শান-শওকত এসব কখনো তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। অলকার সারল্যপূর্ণ চাউনি, তার দীঘল বাঙালি চুল, ঋজুতা, ছিপছিপে গড়ন সত্যিই আকর্ষণীয়। গায়ের রং ওর একেবারে দুধে আলতায়।
মনে মনে ভাবেন, শেষে কি একজন পতিতাকে বিয়ে করবেন তিনি! একজন স্মার্ট পুলিশ অফিসার, যার উত্তর কলকাতায় লোভনীয় পোস্টিং তিনি কি না একজন পতিতাকে করবেন জীবনসঙ্গিনী! সারা জীবন মানুষ তাঁর দিকে ঘৃণাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবে, তাকে সমালোচনা করবে বা তাকে নিয়ে কৌতুক করবে। তিনি আরো ভাবেন, না তেমন কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তার ভালো লেগেছে অলকাকে ব্যস, এতটুকুই। এর বেশি কিছু তো নয়। পতিতা হলেও সে একজন সাবালিকা মেয়ে। তারও নিজেস্ব মতামত অবশ্যই আছে। অলকা তাকে বিয়ে করতে রাজি নাও হতে পারে। নানা ভাবনা তার মাথায় ভিড় জমায়। কিন্তু , একটা বিষয় তার কাছে খুবই স্পষ্ট। আর তা হলো, এ রকম একটি মেয়ের জন্য তার অপেক্ষা ছিল এত দিনের। কোলকাতা শহরে কত মেয়ে তিনি দেখছেন তো প্রতিদিন। কিন্তু, তারা তাঁর পছন্দের হয় ওপরে নয়তো নিচে, তার পছন্দের উপযোগী নয়। এই কারণে এত কাল বিয়ে সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারেননি। অলকাকে দেখার পর থেকে তার পছন্দের সবগুলো দিক তিনি খতিয়ে দেখেছেন। প্রায় শত ভাগ মিলে গেছে তার পছন্দের সাথে। একজন পতিতাকে এত ভালো লাগা! নিজেকে প্রশ্ন করেন তিনি, মোহ নয়তো এটি? পরক্ষণেই ভেবেছেন, না, তা কে? তিনি এখন যথেষ্ট সংসারাভিজ্ঞ। সে চোখেই বিষয়টি তিনি বিশ্লেষণ করে দেখেছেন। হয়তো অলকাই তার অভীষ্ট পাত্রী। ভাগ্য তাঁর জন্য এ জীবনে হয়তো এই মেয়েটিকে নির্ধারিত করে রেখেছে।

পরশু প্রায় সারাটা রাত তাঁর এভাবেই ভাবতে ভাবতে কেটে গিয়েছিল। গতকাল অফিসে গিয়ে অলকাকে হাজির করালো তাঁর সামনে। বসল অলকা তার সামনের চেয়ারে। এত রূপ লুকিয়ে ছিল এই অষ্টাদশীর শরীরে। গত রাতে হয়তো সে ঘুমিয়েছে গভীরভাব।, পেট পুরে খেয়েছে ভাত। চান করে পরিচ্ছন্ন শাদা শাড়ি পরেছে। ফ্যানের হাওয়ায় উড়ছে তার রেশমি চুলগুলো। শ্যাম্পুর স্নিগ্ধ গন্ধে ভরে যাচ্ছে কক্ষটি। রণেশবাবু তার দিকে তাকিয়ে অনেকটা অগোছালো হয়ে যাচ্ছিলেন ভেতরে ভেতরে। কী বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। তবু অনেক কষ্টে নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করলেন তিনি।
অলকা, কেমন আছো? জিজ্ঞেস করলেন রণেশবাবু।
ভালো, অলকা জবাব দেয়।
তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলাম। এখন কী করতে চাও? বাড়ি ফিরে যাও। একবার বলে দেখলেন।
অলকা মুখ ভার করে বলল, বাড়ি আর কোথায় পাব স্যার? গত বছর খবর পেয়েছিলাম, মা বেঁচে নেই। আমি তার একমাত্র সম্বল ছিলাম। আমি হারিয়ে যাওয়ার পর মা অসুস্থ হতে হতে মারা গিয়েছেন। আমি বড় অভাগী, স্যার।

অলকা কাঁদতে লাগল। তার খুব মায়া হচ্ছিল অলকার উপরে। মনে হচ্ছিল যেন এক্ষুনি নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে ওর চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে বলেন,
দুঃখ কোরো না অলকা, আমি তো রয়েছি। আমি তোমার যাবতীয় যন্ত্রণা দূর করে দেব। কিন্তু , চুপচাপ বসে রইলেন তিনি ওর দিকে তাকিয়ে।
জিজ্ঞেস করলেন, তুমি হারিয়ে গেলে কেমন করে?
অলকা বলল, স্যার, আমাদের বাড়ি বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায়। মায়ের চাকরির জন্যে ঢাকায় থাকতাম। একদিন বিকেলবেলা চন্দ্রিমা উদ্যানে ঘুরতে গিয়েছিলাম মায়ের সাথে। মা বসে ছিলেন। আমি একটু এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। হঠাৎ কে একজন এসে আমার নাকে একটা ন্যাকড়া চেপে ধরল। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই মুহূর্তে। তারপর জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি একটি পতিতালয়ে। বের হওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু, আমাকে অত্যাচার করা হলো। অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য ওদের কথায় দেহ ব্যবসায় যোগ দিলাম। এই জীবন আমি ঘৃণা করতাম। কিন্তু, কিছু করার ছিল না। কাস্টমারদের থেকে জানতে পারি ঢাকায় আছি। কারণ, বাইরে বেরুনোর অনুমতি ছিল না। বছর দুই ঢাকায় থাকার পর আমাকে বেনাপোলের পথে ভারতে এনেছে একটি চক্র। তাদের কাছে আমাকে ঢাকার মালিক বিক্রি করে দিয়েছিল।
কাঁদতে শুরু করল অলকা।
বলল, স্যার, আমি বড়ই পোড়াকপালী। বাবা আগে মারা গেলেন। আমার শোকে মাও মরলেন। হায় ঈশ্বর! এখন কোথায় যাব এই কোলকাতা শহরে? এখানে আমার কোনো আত্মীয় নেই স্যার। আমায় একটা কাজ জুটিয়ে দিন না, স্যার।

রণেশবাবু ওকে শান্তনার সুরে বললেন, এতটা ভেঙে পোড়ো না। দেখছি কী করতে পারি তোমার জন্য। আমার ওপর ভরসা করতে পারো তুমি।
ও কেঁদেই চলেছিল। তিনি বড়ই কষ্ট পাচ্ছিলেন অলকার জন্য।
তুমি পড়াশোনা করেছো কতটা? জানতে চাইলেন তিনি।
মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম সেবার। স্যার, আমি ছাত্রী হিসেবে খুবই মেধাবী ছিলাম। আমার বাবা-মা আমায় ডাক্তারি পড়ানোর স্বপ্ন দেখতেন।
এবার আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল সে। এবার আর ওকে বাধা দিলেন না তিনি। ভাবলেন, একটু কাঁদুক ও। কেঁদে কেঁদে মনের জমানো দুঃখের মেঘটা গলিয়ে দিক। ওর মনটা আবার নির্মল আকাশের মতো হয়ে উঠুক।
তোমাকে আমি যদি পড়ার সুযোগ করে দিই তুমি পড়বে আবার? জানতে চাইলেন তিনি।
নিশ্চয়ই স্যার। জানেন আমার পড়ার ভীষণ ইচ্ছে। স্যার, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব। আমার পড়াশোনার একটা ব্যবস্থা করে দিন না স্যার।
সে হঠাৎ উদ্দীপ্ত হয়ে আবার প্রদীপের মতো নিভে গেল যেন।
বলল, স্যার, কিন্তু কোথায় টাকা পাব আমি? আমি কোথায় থাকব? অসহায়ের মতো প্রশ্ন করতে লাগল অলকা।

রণেশবাবু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এত উদ্বিগ্ন হচ্ছ কেন? তুমি তো সরকারের হেফাজতে আছ। সরকারি উপায়ে না হলে ব্যক্তিগতভাবে তোমায় সাহায্য করার চেষ্টা করব।
সে বলল, ব্যক্তিগতভাবে মানে?
হ্যাঁ, ব্যক্তিগতভাবেও তো তোমার উপকারে আসতে পারি আমি। তিনি বললেন, মানুষ কি বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ায় না?

তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অলকা বলল, কিন্তু, আমি তো একজন পতিতা।
একটা ধমক দিয়ে রণেশবাবু বললেন, ভুলে যাও তোমার অতীত। ওই শব্দটা আর একবারও উচ্চারণ করো না। পতিতা কি তোমার গায়ে লেখা আছে? তুমি কি স্বেচ্ছায় এসেছো এই পথে? আমি তো জানি তুমি একটি ভালো পরিবারের একজন মেধাবী ও সুন্দরী মেয়ে। দেখো, একদিন তুমি অনেক বড় হবে। তোমার বাপ-মায়ের স্বপ্নপূরণও সম্ভব তোমার দ্বারা। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রণেশবাবু দেখলেন, কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর মুখ সদ্য মেঘমুক্ত আকাশের মতো। ওর চোখ দুটো চিকচিক করছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন রণেশবাবু। কী যেন ভাবলেন মনে মনে। তারপর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তাকালেন অলকার চোখে। বললেন, কি, আমায় ভরসা করতে পারবে ত? আমি তোমার পাশে দাঁড়াতে চাইছি। ভরসা করতে পারবে আমায়?