গল্প: দূর্গা

দূর্গা
পদ্মনাভ অধিকারী
আচমকা ঘুম ভাঙে বাবরের। কে যেন ডাকছে। না- ও ভুল শুনেছে। আবার বালিশে মাথা রাখে। হ্যারিকেনের জোরটা বাড়িয়ে দেয়। বালিশের নিচু থেকে হাত ঘড়িটা বের করে এনে, হ্যারিকেনের আলোয় দ্যাখে- কটা বাজলো। রাত দুটো বাজে। ঘড়িটা আবার বালিশের নীচে রাখে। হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে দেয়। বালিশে মাথা রাখে। চোখ বন্ধ করে। ধীরে ধীরে ঘুমাতে চেষ্টা করে। ঘুমটা বেশ গাঢ় হয়ে আসছে। হঠাৎ তার পোষা কুকুরটা চিৎকার করে ওঠে। বাবরের ঘুম ভাঙে। ওভাবে এতো রাতে কুকুর ডাকছে। কুকুরের ডাকের ফাঁকে কে যেন ডাকছে বাবর, এই বাবর। কুকুরের ডাক শুনে ও বুঝতে পারে, কুকুরটা একবার এগিয়ে যাচ্ছে আবার পেছচ্ছে। মাঝে মাঝে ডাক আসছে, বাবর, এই বাবর।
বাবরের কানে ডাকটা কেমন যেন বহুদিনের চেনা চেনা বোধ হয়। বাবর বিছানায় ওঠে বসে। হ্যারিকেনের আলোর জোরটা বাড়িয়ে দিয়ে, বালিশের তলা থেকে হাত ঘড়িটা বের করে দ্যাখে, রাত দুটো বেজে পঁচিশ মিনিট। এর ভেতর কুকুরটা কুকু করতে থাকে। বাবরের বুঝতে ভুল হয় না যে, কুকুরটা পরিচিত মানুষের ঘ্রাণ পেয়ে থেমে গ্যাছে। সে টর্চ লাইটটা হাতে নেয়। জানালার কপাট খুলে, এক মিনিট নীরবে দাঁড়ায়। টর্চটা জানালার শিকের গা ঘেঁষে হঠাৎ আলো জ্বেলে এপাশ ওপাশ ঘুরাতে থাকে। বাবরের কানে ফিসফিসানি শব্দ আসে। আলোর ভেতর বাইরে থেকে কারা যেন আসছে আর যাচ্ছে বাঁকাভাবে। সে ছায়া দেখে বুঝতে পারে। কে যেন ভারি গলায় বলে,বাবর উঠেছিস? যদি বাবর না হও তো টর্চ মেরো না পেদানি খেয়ে মরবে কিন্তু। কথা শেষ না হতেই কে যেন খিল খিল করে হেসে ওঠে। বাবর এবার বুঝতে পারে তার বদমাশ বন্ধুরা গাজীর গান শুনে, নিজ নিজ বাড়ীতে না ফিরে ওকে জ্বালাতে এসেছে। আবার কে যেন ডাকে বাবর, এই বাবর, ঘরে থেকে ন্যাকামো হচ্ছে তাই না?
বাবর বুঝতে পারে এটা নারায়ণের কণ্ঠস্বর। ও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
ভেতর থেকে জিজ্ঞাসা করে, কেরে নারা না কি কিরে?
বাইরে থেকে বেশ ক’টি কণ্ঠ একত্রে জবাব দেয়,
নারা হতে যাবে ক্যানো, তোমার নাসিমা এসেছে, শালা গরু কোথাকার।
বাবর সাহস করে দরজা খোলে। কিন্তু হাতের টর্চের আলো বন্ধ রাখে। ওভাবে যতই বন্ধু বান্ধব হোক না কেন, ওরা ভীষণ বদমাশ। এমন কোন কাজ নেই যা ওরা করতে পারে না। হঠাৎ টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকে। বাবরের গা-টা ছমছম করে ওঠে। বাবর যেমন শান্ত, তেমনি শিকারী নেকড়ের মত হিংস্র। দরজার একপাশে সরে যায়। ওরা দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। বিড়ির ধোঁয়ার বিকট গন্ধে বাবরের যেন দম বন্ধ হয়ে আসে। ও পরনের লুঙ্গি টেনে নাক বন্ধ করে। ওরা ম্যাচের কাঠি জ্বেলে বাবরের খাটের নীচুতে দেখতে থাকে। বাবর কৌশলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাহির দিক থেকে দ্রুত দরজা টেনে শেকল আটকে দেয়। খোলা জানালার পাশ থেকে দেখতে থাকে ওরা পাঁচজন খাটের নীচু থেকে মাথা বের করে এনে, উঠে দাঁড়িয়ে চাপা হাসি হাসে আর বলে, শালা ভড়কে গেছে। কেউ বলে, হায়রে বাবর! বন্ধুদের বিপদে রক্ষা না করে চেপে গেলি। যা শালা ভয় কাতুরে, থাক তুই বাইরে থাক, আমরা আরামে ঘুমাবো।
ওরা বাবরের বিছানায় শুয়ে পড়ে। হালকা হালকা বদ গন্ধ বাবরের নাকে ঢোকে। ওদিকে ভীষণ বেগে বৃষ্টি নামে। বাইরে ভীষণ অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার পোষা কুকুরটা তার কোল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আদরে কুচকুচ শব্দ করছে। বাবর খুব সহজেই বুঝতে পারে তার বদমাশ বন্ধুরা নিশ্চয়ই কোন অঘটন ঘটিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর বাবর জানালার ভেতর থেকে টর্চের আলো ওদের চোখে মুখে বুলাতে থাকে। নাঃ কেউ জেগে নেই। ওভাবে আসলে ঘটনা কি, টর্চের আলোয় বারান্দার আশপাশ ভালোভাবে দেখতে থাকে। দ্যাখে আর ভাবে ওর বদমাশ বন্ধুগুলো কেউ গরীব ঘরের ছেলে নয়। কম বেশী শিক্ষিত। হয়তো তার বাড়িতে আসার খবর পেয়ে দেখতে এসেছে। না তা হবে কেন, তাহলে তো ওরা পাল পাড়ায় গাজীর গান শুনতে যাওয়ার আগেই তার কাছে আসতো। হঠাৎ টর্চের আলোয় দেখতে পায়, বারান্দার এক পাশে রক্তমাখা ছুরি, আর জড়ানো জামাকাপড় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাবরের বুকের ভেতর একটা ধাক্কা লাগে। নিজের মনেই বলে, সে কি! ওরা কি তবে খুন করে এসেছে! না,তাহলে তো হাতে করে এসব এনে এখানে ফেলতো না। তাহলে কি ওকে ফাঁসানোর চেষ্টা! না, ওরা যদি ফাঁসাতে চাইবে, তাহলে তো ওকে সঙ্গে নিয়েই কাজটা করত।
হঠাৎ দূর থেকে আযানের শব্দ কানে আসে। বাবর বুঝতে পারে ভোর হয়ে আসলেও প্রবল বৃষ্টি আর আকাশে মেঘ থাকার কারণে ফর্সা হতে বিলম্ব হবে। বাবর সরে পড়ে। সাথে করে আলমত নিয়ে লুকিয়ে রাখে।
প্রচন্ড শব্দে মেঘ ডাকতে থাকে। মনে হয় টিনের চালা ছিঁড়ে যাবে। বদমাশগুলো জেগে ওঠে। দরজা বন্ধ। ওরা পালাবে কি করে। বদমাশদের উপস্থিত বুদ্ধির জোর বেশী। ওরা চাঁচের বেড়া খুলে বেরিয়ে পড়ে। কিছু দূরে গোয়ালঘর থেকে বাবর দেখতে পায় তার বন্ধুরা বৃষ্টির ভেতর ভিজতে ভিজতে পালাচ্ছে। চিৎকার করতে থাকে বাবরের কুকুরটা। বাবর ধমক দেয়।
ওদের যাবার পরপরই বৃষ্টি থেমে যায়। বাবর জায়গা ছাড়ে না। যদি ওরা ফিরে আসে। না ওরা আর ফিরবে না। বাবর নিজের ঘরের শিকলি খুলে ঘরে ঢুকে দ্রুত ঘরটা ঝাড়– দিয়ে সাফাই করে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
এ ঘটনাটি ঘটেছিল গত তিন বছর আগে। সেদিন দুপুরবেলা বাবর জানতে পারে যে, ওরা খেয়াঘাটের মাঝি রতনের সাথে নেশা করতে বসে, কথা কাটাকাটিতে রতনকে খুন করে নদীতে ফেলে পালিয়ে আসে। রতনের কেউ ছিল না ফলে তার হত্যার ঘটনা নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায়নি। তিন বছর পর বাবর গাঁয়ে ফিরে এসে শুনতে পায়, খেয়াঘাটের মাঝি রতনের খুনের মামলা হয়েছে, বাদি সরকার। বাবর ভাবে, খুনিদের কোন সাজা হবে না। কারণ আলমত তারই হেফাজতে। বন্ধুদের সে হারাতে পারবে না। যদি খোদা তাদের ফাঁসিয়ে দেন তাহলে তার কোন আপত্তি নেই।
বাবর না জানলেও তার বদমাশ বন্ধুদের মধ্যে খুনি আলতাফ জানতো পালপাড়ার বোবা মেয়ে দূর্গা রতনের কাছে যেতো। রতন তাকে মা বলে ডাকতো আদর করত। যে রাতে রতন খুন হয়। যখন খুন হচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে দূর্গা রতনের জন্যে ভাতের গামলা এনে, ওদের দেখতে পেয়ে গোপনে ওঁৎ পেতে থেকে সব কান্ড দ্যাখে, ওরা চলে গেলে দূর্গা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি গিয়ে আকারে ইঙ্গিতে তার মা-বাবা কাকাকে জানিয়ে দেয়। ঘটনার দিন নেশার ঘোরে খুনি আলতাফের দূর্গার কথাটা স্মরণে ছিল না। ভুলে গিয়েছিল দূর্গা শহরে প্রতিবন্ধী স্কুলে পড়াশোনা করে।
সেই ঘটনার পরদিন সকালে দূর্গার বাবা কাকা কিছুই করিনি। সপ্তাহ খানেক পর যখন রতনের লাশ নদীর ওপারে গোলপাতার ঝোপের কাছে ভেসে ওঠে, তখন কথাটা পুলিশের কানে গেলে, পুলিশ থানা থেকে এসে লাশ নিয়ে যায়। আর সেদিনই খেয়া পার হয়ে পুলিশ রতনের চালাঘরে এলে দূর্গা পুলিশের কাছে গিয়ে আকারে ইঙ্গিতে কি য্যান বলে। বৃদ্ধ ঝানু পুলিশ অফিসার দূর্গাকে নিয়ে গিয়ে বোবা স্কুলের শিক্ষক ডেকে দূর্গার সব কথা বুঝে নিয়ে নিজেই বাদী হয়ে কেস ফাইল করে। তারপর দূর্গা জজ কোর্টে গিয়ে স্বাক্ষী দিয়ে আসে। খুনিদের জজ সাহেবের সামনে সনাক্ত করে দেয়। বোবা স্কুলের শিক্ষকের মাধ্যমে সে সব কাজ সমাধা হয়। তারপর ওদের অর্থাৎ খুনিদের মধ্যে ক’জনার যাবৎজীবন জেল হয়ে যায়। আলতাফের ফাঁসির আদেশ হয়। বাবর তা জানে না। কারণ সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। গ্রামে এলো তিন বছর পর। পূজার ছুটিতে গ্রাম্য মেলা দেখবে এবার। গ্রামে এলে অনেক কথা সে শুনেছে। ক’দিন পর আলতাপের ফাঁসি হবে। বাবর ভাবে আলমত না হলেও খোদা দোষীকে ঠিকই শাস্তির ব্যবস্থা করে। হঠাৎ তার মা এসে পিঠে হাত দিয়ে বলে, খোকা।
-জ্বি মা।
-রতনের মাকে দেখেছিস?
-না মা। রতন তো এতিম ছিল মা।
-রতনের মায়ের নাম কি, জানিস?
-না, মা তার তো কেউ ছিল না।
-কিসের মেলায় যাবি তুই?
-দূর্গা পূজার
-ঐ নামটা রতনের মায়েরই নাম। আয় দেখেযা দূর্গা আমাদের বরান্দায়।
বাবর দূর্গাকে দেখে ভাবে, দূর্গা তাহলে দূর্গতিনাশিনী-একথা সত্য। দূর্গা বাবরকে দেখে হাসে। বাবর অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। দূর্গা পূর্ণ যৌবনা। অপরূপা সুন্দরী। তার চোখ দু’টো টানা টানা মায়ময়ী। এই সেই দূর্গা, রতনের কিশোরী জননী! ঢাকের শব্দ কানে আসে, বাবর বারান্দা থেকে উঠানে পারাখে।