গল্প: এক বৃষ্টির দিনে

এক বৃষ্টির দিনে
সাইফউদ্দিন আহমেদ বাবর
এক বৃষ্টির দিনে মানুষটা মরে গেলো।
ভোর বেলা।সারা দেশ,সারা অঞ্চল বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে যখন শুয়ে আছে,চারিদিকের দৃষ্টির সীমান্তে যখন থৈ থৈ করছে জল,থেকে থেকে বইছে ঝড়ো হাওয়া,মাটির দিকে নেমে আসছে কান ফাটানো মেঘের গর্জন;ঠিক তখন মানুষটা ইহলোক ত্যাগ করলো।
মানুষটা একদম নিঃশব্দে মরে গেলো।
অনেক্ষণ যাবৎ কেউ টেরই পেলো না।পাশে শোয়ে থাকা স্ত্রী মলিনা বেগমও না।
মরে যাবার মতো কোনো রোগও ছিলো না। সাত চল্লিশ বছর বয়সের শক্ত পোক্ত শরীর।ভালো স্বাস্থ্য।ভীষণ পরিশ্রম করা মানুষ।গ্রামের বিত্তবানদের বাড়িতে কামলা খাটা মানুষ।বছরের বেশির ভাগ সময়,ক্ষেত খোলায়-চাষাবাদের কাজ করে।স্ত্রী আর তিনটি সন্তান নিয়ে তার সংসার।দিনের পর দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে,তাদের আহারের সংস্থান করার চেষ্টা করে।বর্ষাকালে ক্ষেতের কাজ থাকে না।জমি-জমা সব পানিতে ডুবে যায়।তখন জাল দিয়ে সারাদিন মাছ ধরে। সেই মাছ বিক্রি করে চাল ডাল কিনে আনে।
গতকালও সারাদিন মাছ ধরেছে।
সারাদিনই থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছিলো।বাঁশের তৈরী ছাতা একটা মাথায় বেঁধে,সারাদিন পানিতে কাটালো মাছ ধরার জাল নিয়ে।কিছু মাছ ধরা পড়লে— সে গুলো তিন চার বাড়ি ঘুরে বিক্রি করে,ঘরে ফিরলো সন্ধ্যার পর।
মলিনা বেগম তখন আটার রুটি বেলছিলো।আজ ক’দিন ধরে তারা এক বেলা আটার রুটি খাচ্ছে।
মানুষটা শুকনো লুঙ্গি,গেন্জি পরে,গায়ে একটা ছেঁড়া,তালি দেয়া চাদর জড়িয়ে,চুলার ধারে,স্ত্রীর পাশে গিয়ে বসলো।দু হাত মেলে ধরে আগুন পোহাতে পোহাতে মিটি মিটি হাসতে লাগলো।
মানুষটার হাসি রোগ আছে।সময় অসময়ে,বিনা কারনে মিট মিট করে হাসে।মলিনা বেগম জিজ্ঞেস করলো-
-চা দিয়াম এক কাপ?
অবাক হয়ে বলে
-চা পাতা আছেনি?
-আছে এট্টু।চাচি আম্মায় দিছে।
মানুষটা উৎফুল্ল হয়ে উঠে।
-দেও দেও এক কাপ।এরহম দিনে চায়ের উফরে আর কিছু আছে নাহি।
মলিনা বেগম চা বানানোর আয়োজন করে।
মানুষটা এবার একটা পা চুলার কাছে তুলে ধরে।কিছুক্ষণ পর অন্যটা।দিনের পর দিন পানিতে,কাদায়,পড়ে থাকার ফলে পা দু টাই হেজে গেছে।দেখে মলিনা বেগম একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে।বলে,
-আহারে,পাও দুইডার কী অবস্থা।
মলিনা বেগমের কথা শোনে ওর হাসি আরো বিস্তৃত হয়।বলে,
-প্যাকে,পানিতে এরম হয়ই,রিফুজি পাতার রস দিলে ভালা হইয়া যাইবোওনে।
-পাতার রস লাগতো না।বাম আছেনা ঘরে।ঐডা লাগালে কইম্যা যাইবো।ঘুমানের আগে লাগাইয়া দিমুওনে।
-আইচ্ছা দিও।
চা জ্বাল হয়ে গেছে।চারটা ভাঙা কাপে চা ঢাললো মলিনা বেগম।এক কাপে বেশি করে চা দিয়ে মানুষটাকে দিলো।তারপর বাচ্চাদের ডাকলো।চায়ের সংবাদে বাচ্চা গুলো হুড়মুড়িয়ে ছুটে এলো।আনন্দে কল কলিয়ে তারা চুক চুক শব্দে চা পান করতে লাগলো।
আকাশে তখন গুড় গুড় ডাক আরো বাড়লো।বিজলীর চমক আরো ঘন হলো।বাতাসের দূরন্তপণা আরো প্রবল হলো।বৃষ্টির ফোঁটা ঝর্ণা ধারার মতো মোটা হলো।
রাতের বেলা ঘুমুবার আগে মলিনা বেগম দু পা ভালো করে মুছে,আলতো করে বাম লাগিয়ে দিলো।আরামে মানুষটা গলে গেলো।মলিনা বেগম কপালেও একটু বাম লাগিয়ে,মাথা টিপে,চুলে বিলি কেটে দিলো।মানুষটা সুখের হাওয়ার উড়তে লাগলো।মলিনা বেগমকে বুকে টেনে নিলো।আরো কাছে টেনে নিলো।
তারপর প্রচন্ড সুখের আবেশ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
পরদিন মলিনা বেগমের ঘুম ভাঙ্গলো বেশ বেলা করেই।বর্ষার বৃষ্টি ভেজা রাতে ঘুম হয় গভীর।লম্বা।সাধারণত মানুষটা জেগে যায় সকলের আগে।তারপর বাচ্চাদের ডেকে তুলে।মলিনাকে ডাকে।একটু পান্তা,না হয় অন্য যা কিছু থাকে-মলিনা বেগম ঘুম ঘুম চোখে এনে দেয়।খেয়ে,তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বিড়ি টেনে টেনে জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
আজ এখনো ঘুমিয়ে আছে।মলিনা বেগম দেখলো-মানুষটা বেশ আরামে ঘুমিয়ে আছে।আহা,ঘুমাক,একটা দিন আরাম করে ঘুমাক।
মলিনা বেগম সন্তর্পনে উঠে গিয়ে প্রাতঃকালীন কাজ কর্ম সেরে এসে মানুষটার কপালে হাত দিয়েই চমকে উঠলো।এতো ঠান্ডা কেনো?সে মাথায়,বুকে,পেটে উদভ্রান্তের মতো হাত দিলো।মানুষটার সাড়া শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে।মলিনা বেগমের পৃথিবীর দোলে উঠলো।সে প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার করে জ্ঞান হারালো।
জ্ঞান ফিরলে মলিনা বেগম দেখলো,সারা বাড়ির লোক এসে তাদের ঘরে জড়ো হয়েছে।এই ঘোর বর্ষণে-আশ পাশ বাড়ির কিছু লোকও এসে জড়ো হয়েছে।মলিনা বেগম প্রবল শোকের মাঝেও অভিভূত হলো-সবার সহানুভূতি দেখে।
মানুষটা নেত্রকোণা থেকে সিলেট এসেছিলো-একটু সচ্ছল জীবন যাপনের জন্য।তাদের এলাকার অনেকেই এ অঞ্চলে বসবাস করছে।রুজি,রুজগার করছে।এখানে রুজগার করে নেত্রকোণার গাঁয়ে জমি জমাও কিনছে।
মানুষটাও সেভাবে এগুচ্ছিলো।তারা যাদের বাড়িতে থাকে তাদের ঘরের কাজ করে মলিনা বেগম।আর মানুষটা গৃহস্থদের ক্ষেতের কাজ করে,মাছ বিক্রি করে টাকা জমাচ্ছিলো-নেত্রকোণায় সম্পত্তি করবে বলে।
তার অনেক স্বপ্ন ছিলো।
বলতো সিলেটের লোকজন ভালো।এখানে আয় রুজগারও ভালো।টাকা জমাতে বেশিদিন লাগবে না।
এখানকার লোক যে ভালো,তার বড়ো প্রমাণ আজ পেলো মলিনা বেগম।তবে টাকা জমানোর জন্য তার নিজের মানুষটাই রইলো না।
মলিনা বেগমের আহাজারীতে আকাশ আরো উদার হয়ে-পৃথিবী আঁধার করে বৃষ্টি ছাড়লো।এ বৃষ্টি আর থামবে বলে মনে হচ্ছে না।তা না থামুক,মলিনা বেগমের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না।তার আপন,একান্ত মানুষটাই যখন এ পৃথিবীতে রইলো না তখন এ পৃথিবী দিয়েই সে কি করবে?
মলিনা বেগম শোনলো প্রবীণ কেউ একজন বলছেন,
-পুরা অঞ্চলটাই এবার পানিতে ডুবে যাবে।
মলিনা বেগম কান্নার মাঝে চিৎকার করে বললো— যাউক,যাউক,পুরা অঞ্চল ক্যান?পুরা দুনিয়াটা ডুইব্যা যাউক।