গল্প:ঈশ্বর দৃষ্টি

গল্প:ঈশ্বর দৃষ্টি

ঈশ্বর দৃষ্টি
সুভাষ সর্ব্ববিদ্যা

বৃত্তাকার গুমোট জঙ্গল। তাকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে একটি বট গাছ। এলাকার বয়োবৃদ্ধরা বলেন,পুরানো এই গাছটির বয়স দুইশ বছর ছাড়িয়েছে। তার একপাশ ধরে সাপের মতো আঁকা-বাঁকা হয়ে মুখ বাড়িয়েছে দু’দুটো পথ। একটি পথ পূর্ব-পশ্চিমে। অন্যটি উত্তর-দক্ষিণে। রাস্তাটির বাঁক পেরোতেই দেওয়াল ঘেরা একটি মাঠ। তার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে একটি স্কুলঘর। নাম-কমলা সুন্দরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়।

সেই সময় মনিপুর গ্রামে বাস করতেন শ্যাম প্রসাদ চক্রবর্তী নামের একজন প্রথিতযশা কবিরাজ। তাঁর বাপ-দাদা ছিলেন এই অঞ্চলের জমিদার। বহুকাল আগে তাঁরা গত হয়েছেন। বেশ কিছু জায়গা এবং ধানী জমি হাত ছাড়া হয়ে গেলেও অবশিষ্ট যে সকল সম্পদ রয়েছে,তার সবটুকুর একমাত্র উত্তরাধিকারী শ্যাম বাবু। তিনি অঢেল সম্পদের মালিক হলেও ভোগ করার মতো তাঁদের ঘরে কোনো সন্তান-সন্ততি ছিলো না। বিয়ের চৌদ্দ বছরের শেষ দিকে এই দম্পতির ঘর আলোকিত করে একটি কন্যা শিশু। শিশুটির গায়ের রঙ ছিলো উজ্জ্বল শ্যামলা। চেহারা ছিলো তার বাবার মতো,গোলগাল। তিনি এই শিশুর নাম রাখলেন কমলা। মা-বাবার অপত্য স্নেহে কমলা দিন দিন বেড়ে উঠছিলো। একই সাথে শ্যাম বাবুর আয় উন্নতির ডালপালাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দূরে প্রসারিত হচ্ছিলো। কোনো একসময় তাঁর ভাবনায় এলো-”আমরাতো বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। নশ্বর পৃথিবীতেই-বা আর কয়দিন টিকে থাকবো? কমলা মেয়ে মানুষ। অতো সম্পদ আগলে রাখার মতো ক্ষমতা তার কখনও হবেনা। দীঘির পাড়ে যে জমিটি অনাবাদি পড়ে আছে,এতে যদি একটি স্কুলঘর প্রতিষ্ঠা করি,সুবিধা বঞ্চিত শিশুরা অন্ততঃ আলোর মুখ দেখবে।”
যেই ভাবা,সেই কাজ। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে শ্যাম বাবু পিছপা হলেন না। এলাকার কতিপয় শিক্ষিত তরুণকে সাথে নিয়ে একটি স্কুলঘর প্রতিষ্টায় উদ্যমী হলেন। কিছু জমি বিক্রি করলেন। এবং কিছু জমি শিক্ষা প্রতিষ্টানের কাজে উপযোগী করলেন। এই স্কুলটির নামকরণ হলো ’কমলা সুন্দরী অবৈতনিক বিদ্যা নিকেতন’। শিক্ষকদের বেতন ভাতার জন্য একটি ট্রাস্টিও গঠন করলেন। এইসব করে তাঁর দায়িত্ব শেষ হয়নি। তরুণদের চাপের মুখে তাঁকে স্কুল প্রধানের দায়িত্ব নিতে হলো। কালের পরিক্রমায় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে অনেক দূর এগিয়ে গেলো। এমপিও ভুক্ত হয়ে মাধ্যমিকে উর্ত্তীণ হলো।
এবার শ্যাম বাবু ভাবলেন-যা চেয়েছি,তা-ই পেয়েছি। আর কি চাই? অবশিষ্ট জীবন ডাক্তারি করে কাটিয়ে দিবো। অবশেষে এই সিদ্ধান্তে তিনি স্থিত হলেন। স্বেচ্ছায় দায়িত্ব ছেড়ে পুনরায় তিনি কবিরাজি পেশায় আত্মনিয়োগ করলেন।

এর কিছুদিন পর শ্যাম বাবুর স্ত্রী অর্থাৎ কমলার মা অকাল প্রয়াত হন। কমলা সবে মাত্র পনেরো বছরে পা রাখলো। সে ছিলো দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। স্ত্রীর অকাল প্রয়াণে শ্যাম বাবুর মনোবল হারিয়ে যায়। মেয়ের সেবা-শুশ্রূষায় সময়ের বেড়া ডিঙিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও চেম্বারে তিনি ফিরে গেলেন না। মানসিক অবসাদ কাটাতে দীঘির পাড়ে হেঁটে-বসে তিনি সময় পার করতেন।
এর একবছর ঘুরতে না ঘুরতেই তাঁর পরিবারে নেমে এলো এক দূর্বিষহ রাত। কে বা কারা যেন তাঁর কিশোরী কন্যা কমলাকে ক্লোরোফর্ম স্প্রে ছিটিয়ে তুলে নিয়ে যায়। শ্যাম বাবুর যখন জ্ঞান ফিরে অবোধ শিশুর মতো তিনি এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলছিলেন। তাঁর চারপাশে তখন পড়শি-স্বজনের ভিড়। ইতোমধ্যে একটি উড়ো সংবাদ পৌঁছে নিকটবর্তী থানায়। পুলিশের দল নেভী রঙের একটি জীপ গাড়ি নিয়ে তদন্তে নামে। তাঁদের বাড়ি থেকে খানিক দূরত্বে ছিলো কমলের দীঘি খ্যাত একটি দীঘি। সংবাদ নিশ্চিত হয়ে পুলিশের দল সেদিকে এগিয়ে যায়। তখনও আমগাছের ডালে ঝুলানো ছিলো কমলার বিবস্ত্র নিথর দেহ। এসপি সাহেব তার দুই সিপাইকে নির্দেশ দেন গাছ থেকে লাশটি দ্রুত নামিয়ে আনতে। ওই দুই সিপাই স্যারের নির্দেশ পেয়ে গাছ থেকে লাশটি নিচে নামিয়ে আনলো। একটি পুরানো কাপড় দিয়ে সেটি মুড়িয়ে গাড়িতে তুলে নিলো। এরপর তারা পোষ্টমর্টেমের উদ্দেশ্যে ছুটে চললো।
পর পর দুইটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা শ্যাম বাবুর মনকে কোনোভাবেই স্বস্তি দিচ্ছিলো না। অবশেষে নিজের গলায় নিজেই দড়ি পড়ালেন।
সময় কারও অপেক্ষায় থেমে থাকলো না। শ্যাম পরিবারের ভিটেই এখন অচেনা লোকের বাস।

অন্যদিকে কমলা সুন্দরী অবৈতনিক বিদ্যানিকেতনটি এক জায়গায় থেমে নেয়। শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে স্থিত হয়েছে মহাবিদ্যালয়ে ।
রনধীর কর্মকার ওই কমলা সুন্দরী অবৈতনিক বিদ্যানিকেতনের। ঐ আঁকা বাঁকা পথ ধরে রনধীর বাবুর নিত্য আসা যাওয়া হয়। শুষ্ক মৌসুমে সাইকেল নিয়ে আসা যাওয়া হলেও বর্ষা মৌসুমে তাঁকে পায়ে হেঁটে চলতে হয়। তিনি কমলা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক। হিসাব বিজ্ঞান পড়ান। হিসাব বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও তাঁর জীবনের হিসাব ছিলো কন্টকাকীর্ণ। কৈশোরে স্কুলের আঙ্গিনা ছেড়ে যেদিন কলেজের বারান্দায় পা রেখেছিলেন,সেদিন তাঁর পিতা সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। তিনিও ছিলেন স্কুল শিক্ষক। ইংরেজি পড়াতেন। পিতার অসময়ে চলে যাওয়াতেই কিশোর রনধীর নিজের এবং তার ছোট দুই বোনের লেখাপড়া নিয়ে খানিক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বন্ধুদের সহায়তা চাইলেন। তারা এগিয়ে এলো। আর এইভাবে এগিয়ে চললো রনধীরের পালছেঁড়া তরী। এক বছরের মাথায় তাঁর মা ও পাড়ি জমালেন জীবনের শেষ সীমান্তে। এতো কিছুর পরও রনধীর তাঁর বোনদের নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। অনার্স মাষ্টার্স শেষ হলে বেশিদিন তাঁকে থিতু হয়ে বসে থাকতে হয়নি। কমলা সুন্দরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে খন্ডকালীণ শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। দীর্ঘ সময় ধরে এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর অবশেষে তাঁর আসনটি স্থায়ী হয়। ওদিকে কষ্টসৃষ্টে বোন দু’টোকেও পাত্রস্থ করলেন। দেনাদারের যেটুকু চাপ ছিলো শুধু পৈতৃক ভিটাখানি রেখে বাকি অংশ বিক্রি করে ভারমুক্ত হলেন। এরপর নিজেই সংসারী হলেন।
মেঘে মেঘে অনেক বেলা অতীত হলো। পিতার নীতিবাক্য অনুসরণ করে এগিয়ে চললেও ভাগ্য কখনও তাঁর অনুকূলে ছিলো না। স্ত্রীও তিন কন্যাকে নিয়ে তাঁর জগৎ সংসার। সম্প্রতি তার তিন কন্যার প্রথম জন একটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ কমপ্লিট করলো। দ্বিতীয় জন এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অভিপ্রায় নিয়ে অবিরাম ছুটে চলছে। তৃতীয় জন ছিলো নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। সে পড়তো নিকটস্থ স্কুলে। প্রাইভেট টিউশন আর তাঁর স্কুলের বেতন এর ওপর নির্ভরশীল এই পরিবার।
সেদিন স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন রনধীর বাবু। তাঁর স্ত্রী দীপিকা বাটা হতে পানের খিলি মুখে পুরতে পুরতে বললেন,মেয়েটার বয়স হচ্ছে। কতো ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছে। তোমার কোনো মাথা ব্যথা দেখছি না। মেয়েগুলোকে কি আইবুড়ো করে রাখবে নাকি-এ্যাঁ? আমার ভাইজি নন্দিনী তার তিন বছরের ছোট। সে এখন দুই সন্তানের জননী। আর তোমার মেয়ে? আহারে! উনার লেখাপড়া-ই শেষ হচ্ছে না।
রনধীর বাবু নীরব নিস্তব্দ থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। এগিয়ে গেলেন উঠানের কদম গাছটির দিকে ।
দীপিকা উঠান পর্যন্ত তাঁর পিছু নিয়ে এবার বললেন-কি বলেছি,কানে শোনোনি মনে হয়?
রনধীর বাবু গাছটির সাথে বাঁধা সাইকেলটির শিকল খুলতে খুলতে দীপিকার দিকে আড়চোখে তাকালেন। কথার পিঠে কথা চড়িয়ে বললেন-আমি বধির নই। যা বলেছো সবটাই শুনেছি। শোনো-জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে এইসব ভগবানের ইচ্ছাতেই হয়। আমরা শত মাথা কুটলেও তা হবার নয়।
দীপিকা একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন এবং বললেন-ভগবানের ইচ্ছার ওপর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকো। যখন উনার ইচ্ছা হবে,তখন তোমার মেয়ের জন্য বেছে বেছে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার পাঠাবেন। রনধীর বাবু এবার বললেন-
দীপিকা,তুমি যা-ই বলোনা কেন-বাস্তবতা কখনও অস্বীকার করা যায় না। এই বলে তিনি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই ঐ গুমোট জঙ্গলের দিকে তাঁর দৃষ্টি যায়। একটি কুকুর বটগাছটির পাশ থেকে থেমে থেমে ঘেউ ঘেউ করছিলো। আবার জঙ্গলের ভিতর মুখ বাড়িয়ে কি যেন টেনে আনতে চায়ছিলো।
রনধীর বাবু সাইকেলটি একপাশে দাঁড় করিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। উঁকি দিতেই তাঁর চোখ কপালে উঠলো। এক হৃষ্টপুষ্ট যুবক জঙ্গলে পড়ে আছে। তার অর্ধেক অংশ ভিতরে,বাকি অংশ বাইরে। পরনে দামী শার্ট-পেন্ট ও জুতা। পিঠের দিকটা রক্তাক্ত। একটি ডাল ভেঙে কুকুরটিকে তাড়িয়ে তিনি আরেকটু ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন। তরুণের জুতা জোড়া খুলে পায়ের গোড়ালি টিপে বিড়বিড় করে বললেন-নিঃশ্বাস এখনও শেষ হয়নি। ভগবান সহায় হলে একে বাঁচানো সম্ভব।
ওই পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলো দুইজন পথচারী। তিনি অনুনয় করে তাদের ডাকলেন। রনধীর বাবুকে তারা চিনতে পেরে এগিয়ে এলো এবং বললো-কি খুঁজছেন,স্যার?
-খুঁজছি না ভাই। কে বা কারা যেন এই ছেলেটাকে মেরে এইখানে ফেলে গেছে।
-কি বলেন,স্যার?
-হ্যাঁ ভাই। ছেলেটি এখনও জীবিত আছে। তোমাদের সহায়তা পেলে সে হয়তো বেঁচে যেতে পারে।
পথচারীদ্বয় কোনো ভনিতা না করে রনধীর বাবুর সঙ্গি হলো।
আচমকা তাদের একজন বললো-স্যার,তাকে বাঁচাবেন কিভাবে? এখানে কি কোনো ডাক্তার-কবিরাজ আছে নাকি?
-ভগবান সহায় হলে আমরা ঠিকই পারবো। তোমরা দ্রুত একটা ভ্যান দেখো। ক্যাম্প পর্যন্ত আমরা পৌঁছাতেই পারলেই হবে।
পথচারীদ্বয় দ্রুত একটি ভ্যান গাড়ি নিয়ে এলো। অর্ধমৃত যুবকটিকে ভ্যানে তুলে তারা ক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছালো। এরপর একটি মাক্রো নিয়ে শহরের হাসপাতালের দিকে ছুটে চললো। সরকারি হাসপাতালে পৌঁছালো ঠিকই কিন্তু নাম,গ্রাম,পরিচয়হীণ এই যুবককে তারা ভর্তি করাতে রাজি হলো না। রনধীর বাবু দিশেহারা হলেন ঠিকই কিন্তু মনোবল হারালেন না। মুহুর্তে দিহানের কথা তাঁর মনে এলো। দিহান তাঁর প্রিয় ছাত্রীদের একজন। তার স্বামী এই শহরের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। তাকে ফোন দিয়ে স্বামীর ফোন নাম্বার চাইলেন। চিকিৎসক সাহেব ফোন পেয়ে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আন্তরিকতা দেখালেন। ক্লিনিকে প্রায় দশদিন চিকিৎসা নেয়ার পর যুবকের জ্ঞান ফিরলো। রনধীর বাবু পুলিশে খবর দিলেন। পুলিশের জবানবন্দীতে উঠে এলো এক বীভৎস কাহিনী।
যুবকের নাম অনিমেষ সরকার। সে এমবিবিএস ডিগ্রিধারী। ঢাকা শহরের এক প্রাইভেট ক্লিনিকে মেডিক্যাল প্রেকটিশনার এবং অবিবাহিত। মা-বাবার সাথে ঢাকায় থাকেন। তবে,সন্তান সম্ভবা মেয়েকে দেখতে বর্তমানে তাঁরা সুইজারল্যান্ডে। পুলিশ কর্মকর্তা এবার বললেন-ধরে নিলাম,আপনার সব কথা সত্য।
-স্যার,শুধু সত্য নয়। হান্ডেড পার্সেন্ট সত্য।
-এখানে কেন এলেন? কেনোই বা ওরা আপনাকে টার্গেট করলো?
-স্যার,সত্য কথা বলতে কি-প্রায় দুইবছর আগে ফেসবুকে এক তরুণীর সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্বের রেশ ধরে তার প্রতি আমি কিছুটা দূর্বলও ছিলাম। সে বললো,বড় বোনের বিয়ে। বিয়েতে আমন্ত্রণ জানালো। এবং একই সাথে তার বাবার অক্ষমতার কথা প্রকাশ করে কিছু টাকাও ধার চাইলো।
-কতো টাকা?
-টু লাকস্।
-দূর্বল কেন ছিলেন?
-চ্যাট বক্সে তার সাথে প্রায় কথা হতো। যতটুকু জানলাম,এই শহরে একটি অসহায়গ্রস্ত পরিবার।
-এর আগেও কি কোনো টাকা পয়সা চেয়েছিলো?
-হ্যাঁ,স্যার। প্রায় চার-পাঁচ বার।
-কত দিয়েছিলেন?
-হাজার পঞ্চাশের এদিক-সেদিক হবে।
-কখনও কি সে আপনাকে প্রপোজাল দিয়েছিলো কিংবা আপনি?
-না। সেই সুযোগ কখনও দেইনি। তবে,এক ছোট বোনের মর্যাদা তাকে দিয়েছিলাম।
-সেল ফোনে কি কখনও কথা হয়েছিলো।
-না। তবে,এখানে আসার আগের দিন তাকে আমার ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। যেদিন আসছিলাম,সেদিন দুইটা নাম্বার থেকে ফোন এসেছিলো। তরুণীর পরিচয় দিয়ে বললো-তারা তার খালাতো ভাই।
-ফোন করে কি বলেছিলো?
-বাস স্টেশনে নামলে তারা আমাকে রিসিভ করে নিয়ে যাবে।
-হুম। বুঝেছি।
তদন্তকারী দল আবার আসার কথা বলে অন্য একটি তদন্তে বেরিয়ে পড়লেন।
ওদিকে ছেলের এই দুঃসংবাদ শোনে বিদেশ থেকে ছুটে এলেন অনিমেষের মা ও বাবা। রনধীর বাবু ছেলেটিকে তার মা-বাবার হাতে তুলে দিতে পেরে নিশ্চিন্তে মনে বাড়ি ফিরে গেলেন।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। রনধীর বাবু ফোনে খোঁজ খবর নিতেন। আজ তাঁর স্কুল ছুটি। ঘুম থেকে একটু দেরী করে উঠলেন। দীপিকা চায়ের ট্রে হাতে তাঁর সামনে। এমন সময় একটি ফোন এলো। অচেনা নাম্বার। হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে বললেন-দাদা,নমস্কার। আমি নিরঞ্জন সরকার। অনিমেষের বাবা।
-হ্যাঁ দাদা। নমস্কার। অনিমেষ এখন কেমন আছে?
-দাদা,এখন বেশ আছে।
-ঠিক আছে। ঢাকা যাচ্ছেন কবে?
-ভাবছি,আরও দুই চারদিন এখানে থাকবো। যে কারণে আপনাকে ফোন দিলাম।
-হ্যাঁ দাদা,বলুন।
-অনিমেষ এবং তার মা আপনাদের গ্রামে যেতে চায়। যদি আপনাদের কোনো …
-ছিঃ! দাদা। কি যে বলেন? আপত্তি থাকবে কেন? এতো আমাদের পরম সৌভাগ্য।
-ঠিক আছে দাদা। আমরা আসছি। আপনাদের ঠিকানাটা দিন। ওহ! আরেকটি কথা।
-হ্যাঁ,বলুন।
-কোনো ফর্মালিটি নয়। দুটো ডাল-ভাত খেয়ে আসবো।
-কোনো সমস্যা নেই,দাদা। নিঃসংকোচে আসুন।
রনধীর বাবু ফোনটি রেখে দ্রুত চা পান সেরে নিলেন। ওদের কৃতজ্ঞতার কথা জেনে দীপিকা খুব খুশি হলেন। সদাই আনার জন্য বাজারের থলেটি রনধীর বাবুর হাতে তুলে দিলেন। বললেন-তাড়াতাড়ি যাও। রান্না করতে সময় লাগবেতো। রনধীর বাবু দীপিকার কথা শোনে বাজারের থলেটি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন।
বেলা গড়াতেই অনিমেষরা এলো। চারপাশের গাছ-গাছালি এবং রনধীর বাবুর বাড়ি দেখে তারা মনোমুগ্ধ। অতিথি আপ্যায়নে তাঁরা কোনো কার্পণ্য দেখালেন না।
এই সময়ের মধ্যে দুই পরিবারের নানা কথা উঠে এলো। নিরঞ্জন বাবুর খুব পছন্দ হলো,রনধীর বাবুর বড় কন্যা কমলিকাকে। অনিমেষও আড়চোখে তাকে দেখে নিলো। ভালো লাগার কথা তার মাকে জানালো।
নিরঞ্জন বাবুর মুখে এই কথা শোনে রনধীর বাবু ও তাঁর স্ত্রী সংশয়ের ঘোর কাটলেন। দীপিকা বললেন,তবে কি তারা করুণা দেখাচ্ছে!
ডাইনিং টেবিলে বসে নিরঞ্জন বাবু এবার বললেন-দাদা,এটা এমন নয় যে আমরা আপনাদের প্রতি কোনো দয়া দেখাচ্ছি। এটাই প্রকৃত সত্য যে,মামনিকে আমাদের খুব ভালো লেগেছে।
-তাতো বুঝছি দাদা। মেয়েরও কোনো জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। তার সাথে আলাপ করে আপনাদের জানাবো।
-ঠিক আছে। মামনিকে আপনারা জিজ্ঞাস করুন। প্রয়োজনে আমরা আরও পনেরো দিন এই শহরে থাকবো। এই সময়ের মধ্যে আপনারাও আমাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিন।
কমলিকা দ্বিমত করেনি। দীর্ঘদিন ধরে এমন এক সুপুরুষকে সে মনে মনে খুঁজছিলো। স্বপ্নের সেই পুরুষ আজ বাস্তবে ধরা দিলো।
অতঃপর কমলিকার সম্মতি পেয়ে নিরঞ্জন বাবু তার অনামিকায় আংটি পড়ালেন। এরপর বিয়ের দিনক্ষণ খুঁজতে রনধীর বাবু ও নিরঞ্জন বাবু একটি পঞ্জিকা নিয়ে বসলেন।